গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
তিনি এমন একজন শক্তিশালী নেতা যে, তাঁর একার তাঁবে রয়েছেন লোকসভার ৩০৩ জন সদস্য এবং বারোটি রাজ্যে এক ডজন মুখ্যমন্ত্রী। ওই মুখ্যমন্ত্রীরা নিজ নিজ রাজ্যে নির্বাচনী প্রচারে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিজেপির একার পক্ষে ৩৭০ এবং এনডিএ’র পক্ষে মোট ৪০০-র বেশি আসন জয়ের জন্য তাঁর লড়াইটা তো একতরফা বা ভীষণ সহজ হওয়া উচিত ছিল। যাই হোক, যেহেতু বিজেপি নেতারাই ব্যক্তিগতভাবে মানছেন যে, ৩৭০ বা ৪০০+ আসন জেতা তাদের পক্ষে আর সম্ভব নয়, অতএব বিজেপি মোটামুটি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেই তাঁরা এখন খুশি।
কেন এই গিয়ার বদল?
নরেন্দ্র মোদি আত্মবিশ্বাস এবং দৃঢ়তার সঙ্গেই তাঁর প্রচার শুরু করেছিলেন। এর মধ্যে কংগ্রেসের নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশিত হল ৫ এপ্রিল। মোদিজি তখন সেটি উপেক্ষা করেন অত্যন্ত তাচ্ছিল্য ভরে। বিজেপির ইস্তাহারটি প্রকাশ করা হল ১৪ এপ্রিল। কেন্দ্রীয় শাসক দলের ইস্তাহার দেরিতে প্রকাশিত হলেও, ‘সেলিব্রেশন’ দূর তার বক্তব্য নিয়েও জনগণের মধ্যে প্রচারের কোনও প্রচেষ্টা দেখা গেল না। ইস্তাহারটির শিরোনাম অবশ্য ‘মোদি কি গ্যারান্টি’। বিষয়বস্তু এড়িয়ে মোদিজি কোনও সমাবেশে তাঁদের ইস্তাহার সম্পর্কে শুধু বললেন, ‘এটা মোদির গ্যারান্টি’। মোদি এ পর্যন্ত ঠিক কত যে ‘গ্যারান্টি’ দিয়েছেন তা গুনেগেঁথে রাখা আমার সাধ্যে কুলোয়নি। যাইহোক, আপাতত এটাই দাঁড়াচ্ছে যে মাননীয় মোদি—(১) বেকারদের জন্য কর্মসংস্থান বা নতুন চাকরির ব্যবস্থা এবং (২) জিনিসপত্রের দাম ক্রমাগত বেড়ে চলা বা বেলাগাম মুদ্রাস্ফীতি রোখার ব্যাপারে কোনও ‘গ্যারান্টি’ দেননি। এই দুটি সমস্যাই সাধারণ মানুষের সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়। নরেন্দ্র মোদি ইচ্ছাকৃতভাবে আরও কিছু কথা বলেননি, যেগুলি একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচনের সময় তাঁর বলা উচিত ছিল। যেমন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, উন্নয়ন, কৃষির সঙ্কট, শিল্পক্ষেত্রের রুগ্নতা, বহুমাত্রিক দারিদ্র্য, আর্থিক স্থিতিশীলতা, জাতীয় ঋণ, পারিবারিক ঋণ, শিক্ষার মান, স্বাস্থ্য পরিষেবা, ভারতীয় ভূখণ্ডের অভ্যন্তরে চীনের দখলদারি। ওইসঙ্গে রয়েছে আরও শ’খানেক গুরুতর উদ্বেগের বিষয়।
প্রথম দফায় ১০২টি আসনে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে ১৯ এপ্রিল। সম্ভবত, ২১ এপ্রিল কিছু একটা মালুম হয়েছিল মোদিজির। অতএব, রাজস্থানের জালোর ও বনসওয়ারার জনসভা থেকে সেদিনই কংগ্রেসের উপর চূড়ান্ত রকমের আক্রমণ শুরু করে দিলেন তিনি। নরেন্দ্র মোদি বললেন, ‘কংগ্রেস বামপন্থী এবং শহুরে নকশালদের খপ্পরে পড়ে গিয়েছে। ভোটের ইস্তাহারে কংগ্রেস যা বলেছে তা অত্যন্ত গুরুতর এবং উদ্বেগজনক বিষয়। তারা বলেছে, কংগ্রেস সরকার গঠন করলে প্রত্যেক ব্যক্তির সম্পত্তির জরিপ করা হবে। আমাদের বোনেরা কত সোনাদানার মালিক এবং সরকারি কর্মচারীদের কত টাকা আছে, খতিয়ে দেখা হবে সেসবও। তারা আরও বলেছে যে, আমাদের বোনদের মালিকানাধীন সোনাদানা সমানভাবে বিতরণ করে দেওয়া হবে। আপনার সম্পত্তি সরকারের নিয়ে নেওয়ার অধিকার আছে কি?’ আমরা কেবল অনুমান করতে পারি যে, ১৯ ও ২১ এপ্রিলের মধ্যে মাননীয় মোদি এমন কিছু তথ্য (ইন্টেলিজেন্স বা গোয়েন্দা সূত্রে?) পেয়েছেন, যা তাঁকে গিয়ার পাল্টাতে বাধ্য করেছে।
কেন মিথ্যা এবং আরও মিথ্যা?
উপরের অনুচ্ছেদে যতগুলি অভিযোগের উল্লেখ করা হল, তার প্রতিটিই মিথ্যা। দিন যত গড়াচ্ছে, মিথ্যা আরও বড় এবং আপত্তিকর হয়ে উঠেছে। ‘সম্পত্তি’ থেকে ‘সোনাদানা’ থেকে ‘মঙ্গলসূত্র’ থেকে ‘স্ত্রীধন’ থেকে ‘বাড়িঘর’—নরেন্দ্র মোদি অভিযোগ করেছেন যে কংগ্রেস তাদের এসবই বাজেয়াপ্ত করবে এবং অতঃপর সেগুলি বিতরণ করে দেবে মুসলমান, অনুপ্রবেশকারী ও যাদের বেশি সন্তান রয়েছে তাদের মধ্যে। অন্য একটি সমাবেশে নরেন্দ্র মোদি ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন ধর্মভিত্তিক কোটা এবং উত্তরাধিকার কর নিয়ে। অন্তহীন মিথ্যা বলে গিয়েছেন তিনি। এমনকী ‘মহিষের উপর উত্তরাধিকার কর’ আরোপের মতো একটি অর্থনৈতিক ভাবনাও ছুড়ে দিয়েছেন মাননীয় মোদি। তিনি বলেছেন যে, যদি একজন ব্যক্তির দুটি মহিষ থাকে তবে তার থেকে একটি কেড়ে নেওয়া হবে।
তাৎক্ষণিক উদ্দেশ্যটা ছিল পরিষ্কার। কী সেটি? ভারতীয় মুসলমানদের কালিমালিপ্ত করে ভোটারদের মধ্যে মেরুকরণ ঘটানো এবং হিন্দু ভোটদাতাদের এক জায়গায় নিয়ে আসা।
প্রধানমন্ত্রী কী কী মিথ্যা বলছেন, তা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তবে, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হচ্ছে—প্রধানমন্ত্রী কেন এমন মিথ্যাচার করছেন? উল্লেখ্য, একটিমাত্র মিথ্যা নয়, এটি ছিল ‘স্ট্রিং অব লাইজ’ এবং এই মিথ্যাচার চলছেই! একজন প্রধানমন্ত্রী যিনি ৩৭০ বা ৪০০+ আসন জয়ের ব্যাপারে সত্যিই আত্মবিশ্বাসী, তিনি তাঁর প্রতিপক্ষদের উপর এমন বেপরোয়াভাবে মিথ্যা দায় চাপিয়ে দেবেন না। তিনি তো তাঁর রেকর্ড সাফল্যের ভিত্তিতে বিরোধী দলগুলিকে বিতর্কে জড়াবেন। নরেন্দ্র মোদির সম্বল ও পছন্দ কিছু মিথ্যাচার, তাঁর সাফল্যের খতিয়ান নয়।
কেন আত্ম-সন্দেহ?
ধরা যাক, মাননীয় মোদি ইভিএমে বন্দি লুকনো রহস্যটা জানেন। তাহলে তাঁর উদ্বিগ্ন হওয়ার যুক্তি থাকতে পারে, কারণ বাস্তব পরিস্থিতিটা ২০১৯ সালের থেকে বেশ আলাদা। প্রথমত, মাননীয় মোদি নির্বাচনের ন্যারেটিভটা স্থির করতে পারছেন না। কোনও বিতর্কের সূচনা করছেন না তিনি, কেবল কংগ্রেসের ইস্তাহার নিয়ে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন, যদিও সেটা নিখাদ কাল্পনিক। দ্বিতীয়ত, কংগ্রেসের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে তাঁর প্রতিশ্রুতি তিনি মেলাতে এবং ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছেন না। তৃতীয়ত, বিজেপির একঘেয়ে স্লোগান দেশবাসীকে ক্ষুব্ধ ও বিরক্ত করে তুলছে। তবু ‘আচ্ছে দিন আনেবালে হ্যায়’ গোছের একটি নতুন আকর্ষণীয় স্লোগান মোদিজি তৈরি করতে পারছেন না। চতুর্থত, ভোট পড়ছে কম হারে। এই ঘটনা তাঁকে নার্ভাস করে থাকতে পারে। কারণ এর মধ্যে এমন একটি ইঙ্গিত তিনি পেতে পারেন যে, তাঁর বহু অনুগত বা ভক্ত ভোটদাতাও ভোট কেন্দ্রে যাননি। সবশেষে, বুথগুলিতে আরএসএস স্বেচ্ছাসেবকদের অনুপস্থিতি এবং সঙ্ঘের শীর্ষ নেতৃত্বের নীরবতায় বিজেপি শিবিরে বিপদের ঘণ্টা বেজে উঠতে পারে।
এর থেকে এটাই অনুমান হচ্ছে যে, কংগ্রেস এবং অন্য বিরোধী দলগুলি এবার উল্লেখযোগ্যভাবে লাভবান হবে। বিরোধীদের এহেন ‘লাভ’ বিজেপির জন্য ‘নিখাদ ক্ষতি’ হয়ে উঠবে কি না, সেটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। সম্ভবত, নরেন্দ্র মোদি আরও কঠিন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েছেন, যার মোদ্দা বিচার এটাই হতে চলেছে যে, চব্বিশের ভোটে কোনও রাজ্যেই বিজয়ী পক্ষ সবটা একা ঘরে তুলে নিয়ে যেতে পারবে না—অর্থনীতির পরিভাষায় যাকে ‘উইনার-টেক-অল’ পরিস্থিতি বলে। একমাত্র ব্যতিক্রম ঘটতে পারে গুজরাতে। মোদিজি হয়তো এমন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে, তাঁর অধরা ‘লাভ’ নয় বরং সম্ভাব্য ‘নিখাদ ক্ষতি’রই খতিয়ান নেওয়া উচিত। এই চিন্তাই হতে পারে তাঁর উদ্বেগের কারণ। আর সেই উদ্বেগই রূপান্তরিত হচ্ছে মিথ্যাচারে।
জনগণ কী বুঝে, কাকে ভোট দেবে—সে সম্পর্কে আমি কোনও ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারছি না। তবে একটি ব্যাপারে আমি নিশ্চিত যে, মাননীয় মোদির মিথ্যাচার জনগণ দেখতে পাচ্ছে এবং জনগণ ভাবছে, একজন ‘শক্তিশালী’ নেতা মিথ্যা বলবেন কেন!