গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
একটা সময় আরামবাগের নাম উচ্চারিত হলেই চোখের সামনে ভেসে উঠত বোমা-গুলির লড়াইয়ের ভয়াবহ ছবি। বোমাবাজির শব্দে গ্রামের মানুষ দু’চোখের পাতা এক করতে পারত না। সকাল হতে না হতেই বোমার ব্যাগ, বন্দুক, লাঠি নিয়ে ছুটত ছেলে ছোকরার দল। উদ্দেশ্য, গ্রাম দখল। এইটা করতে পারলেই দেদার লুটপাট। গ্রামে ঢোকার মুখে থাকত চেকপোস্ট। বাঁশ দিয়ে আটকানো রাস্তা। বাঁশের এক প্রান্তে মাটির বস্তা, অন্য প্রান্তটা দড়ি দিয়ে বাঁধা। সেই দড়ির নিয়ন্ত্রণ থাকত গ্রামের ডাকাবুকোদের হাতে। অচেনা কেউ এলেই জেরা। উত্তর সন্তোষজনক হলে মিলত গ্রামে ঢোকার অনুমতি। এসব এখন গল্পকথা মনে হলেও, এটাই ছিল বাস্তব।
বাম আমলে আরামবাগ, খানাকুল, গোঘাটের বুকে একের পর এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে নৃশংসতায় সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছিল যুধিষ্ঠির দোলুইয়ের খুন। সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আজও খানাকুলের মানুষ ভুলতে পারেনি। কী অপরাধ করেছিলেন যুধিষ্ঠির? গরিব হয়েও সিপিএমের বদলে করতেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পার্টি। তারই জন্য তাঁকে সবক শেখাতে মিছিল করে যুধিষ্ঠিরের বাড়ি ঘিরেছিল সিপিএম। বাঁচার জন্য ঘরে ঢুকে খিল এঁটে দিয়েছিলেন যুধিষ্ঠির। দরজা ভাঙতে না পেরে পেট্রল ঢেলে জীবন্ত পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল ওরা। ঘর যখন জ্বলছে, বাঁচার জন্য টালি খুলে বেরিয়ে এসেছিলেন যুধিষ্ঠির। কিন্তু বাঁচতে পারেননি। মা ও স্ত্রীর চোখের সামনে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করেছিল সিপিএমের হার্মাদরা।
অবসান ঘটেছে রাজনৈতিক খুনোখুনির। শান্তি ফিরেছে আরামবাগে। শুধু শান্তিই নয়, ফিরেছে গণতন্ত্রও। বাম আমলে এই আরামবাগে ভোটের ফলাফল কী হবে, তা নিয়ে দ্বিমত থাকত না। মনোনয়ন জমা দেওয়া মাত্রই নিশ্চিত হয়ে যেত সিপিএমের জয়। হিসেব-নিকেশ যা কিছু, সবটাই হতো ব্যবধান নিয়ে। আর সেটা লাখে। এক লক্ষ, দু’লক্ষ, তিন লক্ষ, এই করতে করতে ২০০৪ সালে তা পৌঁছে গিয়েছিল ৫লক্ষ ৯২ হাজার ৫০২তে। প্রায় ছ’লক্ষ! সিপিএমের সৌজন্যে অনিল বসুর এই রেকর্ড বাংলায় অমর-অক্ষয় হয়ে থাকবে। যারা সেদিন অনিল বসুর জয়ের আনন্দে আরামবাগের রাস্তা আবিরে লাল করে দিয়েছিল, এখন তারাই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভোট লুটের কথা বলে বড়গলা করে।
গণতন্ত্র ফিরেছে বলেই আরামবাগে কে জিতবে, তা নিয়ে এত চর্চা। গণতন্ত্র আছে বলেই পুরশুড়ার শ্রীরামপুর পঞ্চায়েতের তোতন মহন্ত বুক ফুলিয়ে বলতে পারেন, ‘আমি ভরপুর বিজেপি।’ তবে, লোকসভা নির্বাচনের পর কি মানুষ এভাবেই তাদের মতামত জানাতে পারবে? নাকি আরামবাগে ফিরবে বাম আমলের সেই আতঙ্ক? নির্বাচন এগিয়ে আসতেই এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সাধারণ মানুষের মনে।
পুরশুড়ার চিলাডাঙি বাসস্ট্যান্ডে জগন্নাথ দাসের স্টেশনারি দোকান। জমজমাট এলাকা। চেষ্টা চলছে ভোটের হাওয়া কোনদিকে, তা বোঝার। এক একজন এক একটি দলের হয়ে কথা বলছেন। তারই মধ্যে গোবিন্দ জানা নামে একজন বলে উঠলেন, ‘কে আবাস যোজনার টাকা পেয়েছে, কে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার পাচ্ছে, সেটা বড় কথা নয়। আসল কথাটা হল, শান্তি। এখন গ্রামের মানুষ শান্তিতে আছে। মারামারি, বোমাবাজি, চাষ বন্ধ, এই সব আর নেই।’ গোবিন্দবাবুর কথায় ঘাড় নাড়লেন সবাই। বললেন, এখানে আর অশান্তি নেই। যে যাকে ইচ্ছা ভোট দিতে পারে। গোবিন্দবাবু বলেন, ‘চাওয়া পাওয়া নিয়ে ক্ষোভ থাকতেই পারে, কিন্তু মানুষ শান্তিতে আছে। এখানে শান্তিই শেষ কথা।’
শান্তি যে আরামবাগের ভোটে একটা ইস্যু, সেটা টের পাওয়া গেল খানাকুলে তৃণমূলের পথসভাতেও। ভাষণ দিচ্ছিলেন রাধাবল্লভপুর হাইস্কুলের শিক্ষক সৌরভ ভট্টাচার্য। তাঁর কথায়, ‘বহু রক্তের বিনিময়ে খানাকুল, আরামবাগ, গোঘাটে শান্তি ফিরেছে। সিপিএম নির্বিচারে মানুষ খুন করেছে। রাজ্যজুড়ে গণহত্যা চালিয়েছে। এখন তারাই জার্সি বদলে বিজেপি হয়েছে। আরামবাগে বিজেপি জিতলে ফের ফিরবে সেই অশান্তির দিন।’
বিজেপি জিতলে খানাকুল যে বাম আমলের অবস্থায় ফিরবে, তা টের পেয়েছেন তৃণমূল কংগ্রেসের প্রার্থী মিতালি বাগ। বিজেপি শাসিত খানাকুল-২ ব্লকের মোস্তাফাপুরে প্রচারে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর গাড়ি ভাঙচুর করে ‘প্রাক্তন কমরেড’রা বুঝিয়ে দিয়েছে, জার্সি বদলালেও বদলায়নি তাদের স্বরূপ। শুধু পলাশপাই অঞ্চলেই নয়, খানাকুলের চিংড়া, ধান্যগোড়ি সহ বেশ কিছু পঞ্চায়েত এলাকাকে মুক্তাঞ্চল বানানোর চেষ্টা করছে বিজেপি। উদ্দেশ্য, ভোটের দিন তৃণমূলের এজেন্ট বসতে না দেওয়া। একটা সময় সিপিএম যে কায়দায় ভোট করত, এবার সেভাবেই ভোট করাতে চাইছে বিজেপি।
আরামবাগকে রেলওয়ে মানচিত্রে যুক্ত করার কৃতিত্ব কার? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। আরামবাগের মতো মহকুমা শহরকে মেডিক্যাল কলেজ দিয়েছেন কে? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তা সত্ত্বেও আরামবাগ মহকুমার চারটি আসনেই হেরেছে তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। তার মধ্যে খানাকুল ও পুরশুড়ায় রীতিমতো মুখ থুবড়ে পড়েছে। এজন্য দায়ী ঠিকাদারিরাজ। পুরশুড়া এবং খানাকুলের কিছু ‘ঠিকাদার’ নেতা ফুলেফেঁপে ওঠায় শুধু সাধারণ মানুষই নয়, তৃণমূল কর্মীরাও ক্ষুব্ধ। তারই প্রভাব পড়েছে পঞ্চায়েত ভোটে। খানাকুল-২ পঞ্চায়েত সমিতির এখন বিজেপির দখলে।
এছাড়াও ইকবাল আহমেদ একটা ফ্যাক্টর। তিনি যতদিন ছিলেন, খানাকুল ও পুরশুড়া এলাকাকে তিনিই নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রয়াণের পর তাঁরই হাতে তৈরি লোকজন এলাকায় ছড়ি ঘোরাতে শুরু করেন। সেই সব নেতার খবরদারির জন্যই প্রশস্ত হয় বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতির রাস্তা। বাস্তব পরিস্থিতি উপলব্ধি করে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্ব সংশোধনের রাস্তায় হাঁটা শুরু করেছে। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে শাসক দলের প্রতি আস্থা ফিরছে। সঙ্গে জুড়েছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের সুফল। কিন্তু সাইড লাইনে পাঠিয়ে দেওয়া নেতারা এখন দলকেই ‘শিক্ষা’ দিতে উঠে পড়ে লেগেছেন।
খানাকুলের এক প্রবীণ তৃণমূল নেতার কথায়, ‘দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে এমন কয়েকজন ভাবছে, দল খারাপ ফল করলে নেতৃত্ব তাদের ফের গুরুত্ব দেবে। সেই অঙ্কে তারা কালিদাস হয়ে যে ডালে বসে আছে, সেই ডালটাই কাটতে চাইছে। কিন্তু তারা একবারও ভাবছে না, তৃণমূল হারলে তাদেরই পিঠের চামড়া আগে উঠবে। কারণ তৃণমূলকে ভাঙিয়ে সম্পত্তি করায় মানুষ তাদের উপরেই সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ। তাদের উপর ঝাল মেটানোর আশায় ১২ বছর ঘাপটি মেরে বসে থাকা কমরেডরা এখন জার্সি বদলে হয়েছে বিজেপি।’
আরামবাগ লোকসভা আসনের সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে একটি পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণা। বাকি ছ’টি হুগলি জেলার। গেরুয়া শিবিরকে আরামবাগ আসনটি পাওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি স্বপ্ন দেখাচ্ছে খানাকুল ও পুরশুড়া। সেই কারণেই আরামবাগের পর ফের পুরশুড়াতে নির্বাচনী সভা করেছেন প্রধানমন্ত্রী। এই দু’টি আসন থেকেই জয়ের মূলধন ঘরে তুলতে চাইছে বিজেপি। কারণ, আরামবাগ ও গোঘাট বিধানসভা কেন্দ্রে লড়াই হাড্ডাহাড্ডি। চন্দ্রকোণা ও তারকেশ্বরে এখনও লিড নেওয়ার জায়গায় নেই গেরুয়া শিবির। আর বাকি রইল হরিপাল। এই হরিপালই বদলে দিতে পারে আরামবাগ লোকসভার ভাগ্য। তাই জেতার জন্য হরিপালকেই পাখির চোখ করেছে তৃণমূল।
৪৮ ঘণ্টা পর পঞ্চম দফার লোকসভা নির্বাচন। হুগলি, হাওড়া, উত্তর ২৪ পরগনার সাতটি আসনের ভোট নেওয়া হবে। ঠাকুরবাড়ির প্রতি মতুয়া আবেগ অটুট আছে কি না, বনগাঁয় হবে তারই অ্যাসিড টেস্ট। দল বড় নাকি ব্যক্তি, বারাকপুরে তার পরীক্ষা। আর আরামবাগে? শান্তি থাকবে, নাকি ফিরবে সেই আতঙ্কের দিন, পরীক্ষা সামনেই। তবে, তৃণমূল আত্মঘাতী গোল না করলে মোদির আরামবাগ দখলের স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যাবে।