গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
রাজ্য, আর তারপর দেশ। কেউ যদি মনে করে, এই রাজত্বে নরেন্দ্র মোদির কোনও অংশীদার নেই, তাহলে সে এখনও মূর্খের স্বর্গে বাস করছে। মোদিজি চিরকালই এই পাওয়ার সেন্টারের মুখ হয়ে থেকেছেন। আর প্লেব্যাক সিঙ্গারের মতো নেপথ্য কণ্ঠ দিয়ে গিয়েছেন শাহ। মুখ্যমন্ত্রী হয়েই শাহকে মন্ত্রিসভায় নিয়ে এসেছিলেন নরেন্দ্র মোদি। কী কী দপ্তর দেওয়া হয়েছিল তাঁকে? স্বরাষ্ট্র, আইন, কারা, সীমান্ত সুরক্ষা, সিভিল ডিফেন্স, শুল্ক, পরিবহণ, হোম গার্ড, গ্রাম রক্ষক দল, পরিষদীয় দপ্তর। ইঙ্গিতটা পরিষ্কার ছিল, পাওয়ার সেন্টার দু’জনে মিলেই চালাবেন। শুধু অমিত শাহ প্রচারের মুখ হবেন না। ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা বছর দশেক আগে বলেছিলেন গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শঙ্করসিং বাঘেলা—‘শাহ একমাত্র ব্যক্তি, যাঁর উপর মোদি ভরসা করেছিলেন। আর তাঁরা দু’জনই একসঙ্গে ধারণ করেছেন ক্ষমতার পাত্র। কিন্তু দল হিসেবে নয়, ব্যক্তিতন্ত্রে। কারণ, গুজরাতে বিজেপিকে সাংগঠনিক ও আদর্শগত দিক থেকে ধ্বংস করে দিয়েছেন তাঁরা।’
প্রথমে গুজরাত। আর এখন দেশ। মঞ্চ বদলেছে, বদলায়নি পদ্ধতি, পাওয়ার সেন্টার। এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদির বয়স ৭৩ বছর, আর অমিত শাহের ৫৯। মোদি জনতা পার্টির এই দুই কাণ্ডারী কোনওকালেই দলের নিয়ম-কানুনকে খুব একটা গুরুত্ব দেন না। লোকসমক্ষে দেখান, তাঁরা সবটাই মেনে চলছেন। কিন্তু দিনের শেষে দেখা যায়, সবটাই তাঁদের প্রয়োজন মতো আকার নিয়ে ফেলেছে। এবার খানিক মুশকিল হয়েছে। কারণ, সামনে এসে গিয়েছে বিজেপির সংবিধান। ৭৫ বছর বয়স হয়ে গেলে আর কোনও দায়িত্বের পদে থাকা যাবে না। নরেন্দ্র মোদি আগামী ১৭ সেপ্টেম্বর ৭৪ পূর্ণ করবেন। অর্থাৎ ৭৫’এ পা। আর ৭৫ পূর্ণ হওয়ার জন্য অপেক্ষা করলেও আগামী বছরের সেপ্টেম্বর। তারপর কী? এই প্রশ্নটা বাজারে কয়েক মাস যাবৎ আকাশে ঘোরাফেরা করলেও ভোটের ময়দানে এনে ফেলেছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। পরের দিন হনুমান মন্দিরে প্রণাম করেছেন। আর বেরিয়ে দেখেছেন, গোটা দিল্লি স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। কারণ, ওই স্পট থেকেই শুরু হচ্ছে কেজরিওয়ালের রোড শো। গলায় উত্তরীয় ঝোলানো ‘আয়োজিত’ ভিড় নয়, মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এসেছে তাঁর প্রচারে যোগ দিতে। আর সেই প্রচারমঞ্চ থেকে কেজরিওয়াল তোপ দাগছেন, ‘আপনারা আসলে নরেন্দ্র মোদিকে ভোট দিচ্ছেন না। আপনাদের সমর্থন যাচ্ছে অমিত শাহের দিকে। এক বছর নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। বাকি চার বছর শাহ। এবার ভেবে নিন, কাকে ভোট দেবেন।’
মানুষের মনে নাড়া দেওয়ার মতো সমীকরণ বটে। কেজরিওয়াল শিক্ষিত, বুদ্ধিমান রাজনীতিক। কোমরের নীচে ঠিক কোথায় মারলে ব্যথাটা মোক্ষম হবে, সেটা ভীষণভাবে জানেন। আর সেটাই করেছেন। তিনি জানেন, মোদি হাওয়া যতটুকু আছে, সেটাই বিজেপির সম্বল। গোটা দেশে মোদির গ্যারান্টির ভ্যারেন্ডা ভেজে ভোটভিক্ষা চলছে। উন্নয়নের দিশা না পেয়ে ধর্মের সেফ হাউসে ঢুকে পড়েছেন গেরুয়া কর্তারা। তাই ‘মোদিকে দেখে ভোট’—এই মিথটা ভাঙতে পারলে সত্যিই বিজেপি ২০০’র নীচে নেমে আসবে। সেটাই করেছেন তিনি। আর ঢিলটা যে সঠিক চাকে লেগেছে, তার প্রমাণ বিজেপির ত্রাহি রব। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে স্বয়ং অমিত শাহকে আসরে নামতে হয়েছে। তিনি সাফাই দিয়েছেন, এসব ভুল কথা। মোদিজিই আমাদের নেতা। তাহলে কি জিতে এলে পাঁচ বছর তিনিই প্রধানমন্ত্রী থাকছেন? এই গ্যারান্টি কেউ দিচ্ছে না। আর এখানেই মুচকি হাসছেন কেজরিওয়াল। ভোটপর্বের মাঝে তাঁকে ঘাড় ধরে জেলে ঢোকানোর পাল্টা দিতে ময়দানে নেমেছেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে যেমন প্রমাণ না হওয়া দুর্নীতির অভিযোগ আছে, ঠিক তেমনই আছে পরিষেবা। মানুষের জন্য করেছেন, এমন পাঁচটা কাজ তিনি অবলীলায় বলতে পারবেন। বিদ্যুৎ বিলে ছাড়, পানীয় জল, দূষণ নিয়ন্ত্রণে জোড়-বিজোড় নীতি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনুকরণে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার... আরও অনেক কিছু। কেজরিওয়াল বলেই থাকেন, বাকি বহু দপ্তর আমার হাতে নেই। কেন্দ্রের অধীনে। থাকলে ওখানেও করে দেখাতাম। মানে চ্যালেঞ্জটা পরিষ্কার—লড়তে এসো পরিষেবায়। ভোট ওই অঙ্কেই হোক। দেখি কীভাবে সামাল দিতে পারো।
সামলানো যে কঠিন, সেটা বিজেপিও জানে। কিন্তু তা বলে ভোটের মাঝে দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার? শুধু তো তিনি নন, হেমন্ত সোরেনও। বিরোধীদের ঝেঁটিয়ে খাঁচায় পোরার ট্রেন্ডটা যেভাবে শুরু হয়েছিল, তা কেজরিওয়ালে এসে থামতে পারে... এটা সম্ভবত ভয়ানক ভক্তও ভাবেননি। কিন্তু এখানে আরও যে গুরুতর প্রশ্নটা সামনে আসছে তা হল, বুদ্ধিটা কার? অমিত শাহ কি জানতেন না, বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের জেলবন্দি করার সিদ্ধান্ত ব্যুমেরাং হতে পারে? এটা তো হতে পারে না। দেড় বছর ধরে কেজরিওয়ালের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। তাহলে এতদিন পরে গ্রেপ্তার কেন? তাও ভোট চলাকালীন! বিরোধীদের কণ্ঠরোধ করাটা নিশ্চিতভাবে বিজেপির ড্যামেজ করেছে। আর অমিত শাহকে এতটা অবিবেচক মনে হয় না, যে তিনি ভোটের মাঝে এতটুকুও ঝুঁকি নেবেন। তাহলে নেপথ্যে কে? স্বয়ং মোদি? নাকি ড্যামেজ করার মনোবাসনা নিয়ে পাওয়ার সেন্টারের মধ্যেই কেউ বসে আছেন!
মোদ্দা কথাটা হল, এজেন্সির অতিসক্রিয়তা, বিরোধীদের কণ্ঠরোধ, আম জনতাকে ভিতরে ভিতরে খেপিয়ে তোলার মধ্যে দিয়ে ড্যামেজটা কোনও দল বা সংগঠনের হচ্ছে না। ধাক্কা খাচ্ছেন একজন—নরেন্দ্র মোদি। বিজেপি যদি চব্বিশের মহারণ উতরে যায়, তাহলে সম্পূর্ণ কৃতিত্ব যেমন তাঁর হবে, ধরাশায়ী হলেও তার দায় অন্য কারও হবে না। অমিত শাহেরও না। বিজেপি ক্ষমতায় আসতে না পারলে হার হবে নরেন্দ্র মোদির। আর জিতলে বছর দেড়েক পর প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারটা অপেক্ষায় থাকবে অমিত শাহের। সমীকরণ পরিষ্কার। নরেন্দ্র মোদি নিজেও সেটা জানেন। তাই আজ তিনি মরিয়া। ৩৭০, মহিলা সংরক্ষণ, জি-২০ সম্মেলন... কোনওটাই আর তাঁর ভাষণে নেই। আছে শুধু ধর্ম, এসসি-এসটি, মেরুকরণ। মহাজোট ক্ষমতায় এলে সবার থেকে সংরক্ষণ কেড়ে নাকি মুসলিমদের দিয়ে দেবে। এটাও কি হতে পারে? দেশে সংবিধান নেই? সুপ্রিম কোর্ট নেই? নাকি সংসদ নেই? তাও মোদি বলছেন। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন হিন্দু ভোটটাকে এক ছাতার তলায় আনার। আর সেই দাবির পক্ষ সমর্থনে প্রকাশ করছেন রিপোর্ট... বলছেন, ১৯৫০ থেকে ২০১৫ সালের সময়সীমা পর্যন্ত হিন্দু জনসংখ্যা নাকি কমে গিয়েছে। বেড়েছে মুসলিমরা। কেন, কোন পরিস্থিতিতে, সেইসব ব্যাখ্যা পিএমও থেকে প্রকাশিত রিপোর্টে নেই। যদি এটাই সত্যি হয়, এখনও পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদি সেন্সাস করাতে দিলেন না কেন? ২০২১ সালে না হয় কোভিডের দাঁত-নখ বেরিয়ে ছিল। তারপরও তো তিন বছর পেরিয়ে গিয়েছে। সেইসব না করে একটি গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশ করলেন। তাও ভোটের মাঝে। এবেলা আদর্শ আচরণবিধি ভাঙল না? আসলে তাঁর সরকার বাস্তবের মাটিতে পা দিয়ে চলা ভুলে গিয়েছে। বা আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, ওই গলিতে পা দিতে চায় না। তাহলেই যে ব্যর্থতার হাড়-কঙ্কাল বেরিয়ে পড়বে! তাই মোদিজি রামমন্দিরের কথা বলেন, আর বর্তমানকে এড়িয়ে ’৪৭ সালের পরিকল্পনা দেন। এর সঙ্গেও বাস্তবের কোনও সম্পর্ক নেই। ২০০৮ সালের একটি অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে। মঞ্চে উপস্থিত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। দর্শকের আসনে রাহুল গান্ধী, প্রকাশ জাভড়েকর, রবিশঙ্কর প্রসাদের মতো রাজনীতিক। আর বক্তা? শাহরুখ খান। রাহুল গান্ধী দর্শকাসন থেকে শাহরুখকে বলেন, ‘রাজনীতিকদের যদি একটা পরামর্শ দিতে হয়, কী বলবেন?’ শাহরুখ হেসে ফেলেন, খানিক ইতস্তত করেন, আর তারপর বলেন, ‘খুব সহজ প্রশ্ন। সোজাসাপ্টা প্রশ্ন।’ একটু থেমে শাহরুখের মন্তব্য, ‘একটা পরামর্শ, যা রাজনীতিকরা মেনে চলবেন... আমাদের দেশ বিশ্বসেরা হবে...। দেখুন কাকে আপনারা প্রশ্নটা করলেন। যার পেশাটাই হল কিছু মিথ্যা, কিছু স্বপ্নকে পর্দায় তুলে ধরা। আমি একজন অভিনেতা। কিন্তু আপনারা নন। আপনারা যাঁরা দেশ পরিচালনা করেন, তাঁদের প্রতি আমার অসীম শ্রদ্ধা রয়েছে। নাগরিক হিসেবে আপনাদের একটাই কথা বলতে পারি... টেবিলের নীচে হাত পেতে টাকা নেবেন না। যতটা সম্ভব সৎ থাকবেন, আর অবশ্যই বাস্তবের মাটিতে পা রাখবেন। তাহলে আমাদের দেশ বিশ্বসেরা হবেই।’
আজ নরেন্দ্র মোদির জমানায় আমরা বড়পর্দার বাইরে অভিনেতা দেখছি। তাঁরা স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবের মাটিতে পা রাখছেন না। আর সেই শাহরুখ খান বড়পর্দায় জনগণের উদ্দেশে বলছেন, ‘একটা পেন কিনতে গেলেও পাঁচবার কাগজে ঘষে দেখেন ঠিকমতো কালি পড়ছে কি না... চাল, ডাল, আটা, তেল কেনার সময় কত প্রশ্ন করেন আপনারা। শুধু নিজের দেশের সরকার নিয়ে একটা প্রশ্নও করেন না। কেন? পাঁচ ঘণ্টা চলে, এমন মশার কয়েল নিয়ে একগাদা প্রশ্ন করেন, কিন্তু পাঁচ বছর যে সরকার ক্ষমতায় বসে থাকে, তাদের নিয়ে? ভোট দেওয়ার আগে প্রশ্ন করুন, কী করেছ দেশের জন্য? কী করেছ আগামী প্রজন্মের জন্য? আমার জন্য? আগে উত্তর দাও। তারপর ভোট।’ এই প্রশ্নগুলো কি ১০ বছর রাজত্ব করা শাসককে করা যায় না? আলবাৎ যায়। এটা আমাদের অধিকার। গত কয়েক দশকে সবচেয়ে বেশি কর্মসংস্থান হয়েছিল বাজপেয়ি জমানায়—৬০ লক্ষ। পরিকাঠামো উন্নয়নও হয়েছিল চোখে পড়ার মতো। রাস্তাঘাট, সামাজিক প্রকল্প...। তারপরও ধসে গিয়েছিল তাঁর সরকার। আগের ভোটের তুলনায় মাত্র ২ শতাংশ ভোট কম পড়েছিল। সেটাই বদলে দিয়েছিল রাজনীতির সমীকরণ। কেন? মধ্যবিত্ত কিছুই পায়নি ওই জমানায়। চাকরি হয়েছে, কিন্তু মূল্যবৃদ্ধি কমেনি, আয়করের স্ল্যাবেও মেলেনি ছাড়। প্রতিদিন ধুঁকতে হয়েছে আম জনতাকে। তার ফল ভোটে পড়েছে। এবার কিন্তু চার দফাতেই প্রায় পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ করে ভোট কম পড়েছে। ইস্যুও ফিরে এসেছে... মূল্যবৃদ্ধি, আয়কর, বঞ্চিত মধ্যবিত্ত। আর সঙ্গে জুড়েছে বেকারত্ব।
মোদি হাওয়া থাকলেও সেটা ভোটযন্ত্র পর্যন্ত পৌঁছচ্ছে তো?