গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
আবার অন্য একটি শ্রেণি আছে যারা ভোট উদাসীন। রাজনীতিতে নির্লিপ্ত। সংখ্যায় এই অংশ কম। তবে আছে। এই অংশের ভোট কখন কে পাবে এবং আদৌ তারা ভোট দেবে কিনা সেটাও সর্বদা নিশ্চিত নয়। তারা বলে থাকে, আমি রাজনীতি বুঝি না। অথবা আমাকে তো বাবা সেই খেটেই খেতে হবে, কে জিতল কে হারল আমার কী যায় আসে। কিংবা এমনও বলা হয় যে, এই দল হারলে, ওই দল জিতলে কী এমন সমাজ পাল্টাবে? সব দলই সমান। দেখলাম তো এতকাল ধরে। যে যায় লঙ্কায়, সেই হয় চোর।
পাশাপাশি আরও ক্ষুদ্র একটি অংশ থাকে, যাদের নিশ্চিত আনুগত্য নেই কোনও বিশেষ দলের প্রতি। তারা নিজেদের মতামত পাল্টে ফেলে। লোকসভায় কাউকে ভোট দিল। বিধানসভায় হয়তো অন্য কাউকে। ২০২১ সালে যাকে ভোট দিয়েছে, ২০২৪ সালে হয়তো অন্য পক্ষকে দিচ্ছে। এই অংশটিকে ভোট রাজনীতির পরিভাষায় বলা হয় ফেন্স সিটার। অর্থাৎ তারা যে কোনওদিকে হেলে যেতে পারে। অনেক সময় এই অংশের কারণে ভোটের ফলাফলে সামান্য হেরফের হয়ে যায় কিছু শতাংশের ভোটপ্রদানের রকমফেরে।
এই যে ভোটারদের নানারকম মনস্তত্ত্ব এদের মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল, যারা নিজেদের ভালোমন্দ বিচার বিবেচনা এবং বিশ্লেষণ করে ভোট দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা লক্ষ্য করে তাদের জীবন কীভাবে চলছে। এই জীবনে তাদের মধ্যে স্বস্তি আছে কিনা। আরও অন্যরকম কিছু হতে পারে কি? হলে সেটা কেমন? কোন দল কী কী কথা বলছে। কাদের কথার ধরণ কেমন। যে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়ে থাকে বিভিন্ন দলের পক্ষ থেকে, সেগুলির মধ্যে কোনগুলো কাজে আসবে। এবং সর্বোপরি কোনগুলি বিশ্বাসযোগ্য। আমাদের ভোট যারা চাইছে, তাদের ভোট দিলে আমার লাভ কী হবে? এইরকম চিন্তাভাবনা করে যারা ভোট দেয়, তাদের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলির বিশেষ পক্ষপাত থাকে। তাদের মন জয় করার জন্য প্রতিযোগিতা চলে। কারণ, একটাই। এই ভোটাররা কমিটেড নয়। এদের ভোটের সিদ্ধান্ত পাল্টে যেতেই পারে। সুতরাং কীভাবে এদের প্রলোভিত করা যায় কিংবা অন্য পক্ষের কাছে এতদিন ধরে থাকা এই ভোটারদের কী উপায়ে নিজেদের দিকে টেনে আনা যায়, সেই পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে অবিরত। কারণ কী? কারণ এই ভোটাররাই হয় ফলাফলের নির্ণায়ক।
আর যারা ফলাফলের নির্ণায়ক হয়, লক্ষ্য করা যায়, তারাই সবথেকে কম কথা বলে। তারা সারাদিন ধরে রাজনীতি নিয়ে কথা বলছে, তর্ক করছে, আলোচনা করছে, মরিয়া হয়ে নিজের মতপ্রকাশ করছে, এরকম হয় না। তারা চুপচাপ থাকে। যাকে সাইলেন্ট ভোটার হিসেবে তকমা দেওয়া হয়। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত যে নাগরিক শ্রেণি, তারা সর্বদাই উচ্চকিত মতামত ব্যক্ত করে। তারা নিজেদের ওপিনিয়ন মেকার মনে করে। কিন্তু ভোট রাজনীতির ক্ষেত্রে তাদের তেমন মূল্য নেই। কারণ, তারা ঘোষিত ভোটার। তাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট হয়ে যায় দ্রুত যে, তারা কাকে ভোট দেবে। সুতরাং রহস্য থাকে না তাদের নিয়ে। তাদের মতামতগুলিও তেমন উচ্চবিশ্লেষণাত্মক হয় না। কারণ সেগুলি হবে পক্ষপাতদুষ্ট। নিজেদের প্রিয় দলের পক্ষে, প্রতিপক্ষ দলের বিপক্ষে। অতএব তাদের মন জানতে রাজনৈতিক দলকে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। তার অর্থ এই নয় যে, তাদের যুক্তি অথবা মতামতে শাণিত বুদ্ধি কিংবা সঠিক যুক্তি নেই। অবশ্যই আছে। তবে সেগুলির অভিমুখ জানা হয়ে যায়। অর্থাৎ যাই বলুক, পছন্দের দলের পক্ষেই থাকে। বিপক্ষের বিরোধিতা করা হবে।
ঠিক এখানেই সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে ওঠে ওই নীরব অথবা শক্তিশালী ভোটারদের ভূমিকা। অতীতেও হয়েছে। এবার এই লোকসভা ভোটেও হতে চলেছে সেই প্রবণতারই পুনরাবৃত্তি। কী সেটা? এবারের ভোটেও বাংলার ৪২ আসনের ফলাফলে নির্ণায়ক শক্তি হবে তিনটি শ্রেণি। মহিলা, মুসলিম, গরিব। মুসলিম সম্প্রদায় ধর্মীয় আইডেন্টিটির বিচারে। এবং মহিলা ও গরিব জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে। কেন? কারণ, এই তিনটি শ্রেণির ভোটারদের সিংহভাগই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে নিজেদের ব্যক্তিগত ভালোমন্দ বিচার করে। অর্থাৎ তাদের কীসে ভালো হবে, তারা কী কী চায় এবং তাদের উচ্চাশা অথবা আশা আকাঙ্ক্ষা কী সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কোন দল কী কী বলছে, কাদের কথার মধ্যে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা আছে, কারা জয়ী হলে জীবন আরও একটু উন্নত হবে অথবা জীবনের স্থিতাবস্থা, স্বস্তিপূর্ণ পরিস্থিতি ধাক্কা খেতে পারে, তখন আবার জীবনটা টলোমলো হয়ে যেতে পারে, এরকম হাজারো সাতপাঁচ ভাবেন এই ভোটারশ্রেণি।
তৃণমূল ছাড়াও সিপিএম অথবা আইএসএফ মুসলিম ভোটের প্রত্যাশী। সিপিএম আশাবাদী যে, এবার এই সংখ্যালঘু ভোটের কিয়দংশ তাদের কাছে ফিরবে। যদিও প্রশ্ন হল, কেন সিপিএম এরকম বিশ্বাস করছে? যেহেতু হঠাৎ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উন্নয়ন অথবা জনস্বার্থমূলক কাজের ইস্যুকে ছেড়ে বেশি বেশি ধর্মীয় বিভাজনের প্রসঙ্গ প্রকটভাবে প্রচার করতে শুরু করেছেন, সেই কারণে, মুসলিমদের মধ্যে কিছুদিন আগে পর্যন্ত কোনও দ্বিধা থাকলেও এখন তা আর সম্ভবত নেই। তারা চাইবে বিজেপিকে রুখতে যে দল শক্তিশালী তাকেই ভোট দিতে। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর এই হাইভোল্টেজ প্রচার মুসলিমদের বেশ কিছুটা একজোট করে দিচ্ছে। যা কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, তৃণমূল, ডিএমকে ইত্যাদি দলের কাছে সুবিধাজনক। অর্থাৎ যেখানে বিজেপির বিরুদ্ধে যারা প্রধান প্রতিপক্ষ, তাদেরই মুসলিম সমাজের সিংহভাগ ভোট দেবে।
মহিলাশক্তি এবং গরিব সম্প্রদায়ের ভোট সকলেই চায়। তাই লক্ষণীয় যে, এই দুই শ্রেণিকে তুষ্ট করার জন্য প্রতিযোগিতার অন্ত নেই। বাংলার মহিলা এবং গরিব ভোটব্যাঙ্ককে কাছে টানতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম থেকেই বিশেষ সচেষ্ট। অসংখ্য সরকারি প্রকল্পকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, কার্যত এই দুই শ্রেণি প্রধান টার্গেট অডিয়েন্স তাঁর। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার অথবা কন্যাশ্রী। ২০১৬ অথবা ২০২১, এই দুই অংশ তাঁকেই ভোট দিয়ে বিপুলভাবে জয়ী করেছে। ঠিক এই ভোটারদের হাইজ্যাক করতে নরেন্দ্র মোদি বিগত ৬ মাস ধরে নারীশক্তির জয়গান গাইছেন। উজ্জ্বলা গ্যাসের ভর্তুকি বাড়াচ্ছেন। বিনামূল্যে রেশনকে তাঁর সরকারের এক বিপ্লবাত্মক পদক্ষেপ হিসেবে প্রচার করছেন। কৃষকদের ৬ হাজার টাকা দিচ্ছেন। আয়ুষ্মান কার্ড দিতে বলছেন। বাংলায় এই প্রচারের প্রতিবন্ধকতা হল, রাজ্যের স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ইতিমধ্যেই পরীক্ষিত এবং জনপ্রিয়। সুতরাং মহিলা এবং গরিব ভোটারকুল এবার কোনদিকে যাবে? এই দুই শ্রেণি যদি মনে করে যে, সরকারের সহায়তা এবং সামাজিক স্থিতাবস্থায় তারা বাংলায় স্বস্তিতে আছে, তাহলে তারা এবারও আনুগত্য বদল করবে না। আবার যদি তাদের কাছে মনে হয়, পরিবর্তন করা হলে তাদের নিজেদের আরও একটু লাভ হবে, তাহলে বিজেপির লাভ। কিন্তু এই দুই শ্রেণি সাধারণত কোনও এক্সপেরিমেন্ট করতে চায় না। কারণ তাদের কাছে যেহেতু ভোট দেওয়া না দেওয়া নিছক বিলাসিতা নয়। গণতান্ত্রিক অধিকার অথবা দেশগঠনের দায়িত্ব, এরকমও উচ্চমার্গীয় দার্শনিক কিছু নয়। ভোট তাদের জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। নিজেদের ক্ষুণ্ণিবৃত্তি, শান্তিপূর্ণ যাপন, সামাজিক ও পারিবারিক ভারসাম্য বজায় রাখা খুব জরুরি। এই দুই অংশের মানুষের মধ্যে মিল কোথায়? এরা শান্তি চায়। ঝঞ্ঝাট চায় না। বেসামাল সময়কাল চায় না। কারণ সেরকম হলে সবথেকে বেশি আঘাত আসে তাদেরই উপরে! তাই তাদের সিদ্ধান্ত নিতে হয় ভেবেচিন্তে। অতএব মহিলা মুসলিম গরিব ফ্যাক্টর, এবার বাংলায় সবথেকে তাৎপর্যপূর্ণ নির্ণায়ক শক্তি হতে চলেছে। আর সেই ফ্যাক্টরে প্রবল টানাপোড়েন চললেও টেনিসের পরিভাষায়, এখনও পর্যন্ত এবারও অ্যাডভান্টেজ-মমতা! মোদি কি পারবেন এই মিথ ভাঙতে?