গুরুজনের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তা ও মানসিক উদ্বেগ। কাজকর্মে বড় কোনও পরিবর্তন নেই। বয়স্কদের স্বাস্থ্য সমস্যা ... বিশদ
২০২৪ সালের মে মাসে এই কিছুদিন আগে চম্বলের বানমোড় থেকে মুরেনা যাওয়ার পথে বাসের সহযাত্রী লোকেন্দ্র টোমার জানতে চাইলেন, কলকাতা তো শ্মশান হয়ে গিয়েছে! এখনও ওখানে শিক্ষিত বাঙালি থাকে? নাকি সব পালাচ্ছে? লোকেন্দ্র টোমার থাকে অম্বার মঈ গ্রামে। গোয়ালিয়র থেকে ফিরছে। জমি সংক্রান্ত মামলার শুনানি ছিল। প্রশ্ন করেছিলাম কেন? সবাই পালাবে কেন? লোকেন্দ্র বললেন, এই যা মোবাইলে, আর নিউজে দেখি। তাছাড়া গোয়ালিয়রে তো প্রচারেও বিজেপি বলছিল বাঙ্গালে মেয়েদের কোনও সম্মান নেই। ওখানে নাকি অনুপ্রবেশকারীদের রাজত্ব চলে। তিন চারটে জেলা বাংলাদেশ হয়ে গিয়েছে। ওখানে ভারতের টাকাও চলে না। বাংলাদেশের টাকা। আর পরীক্ষা টরীক্ষা সব বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এখন আর বাংলায় কোনও আগের মতো টিচার, ডাক্তার, উকিল পাওয়া যায় না। সব ঘোটালা করে পাশ করে। সবাই দু নম্বরী। ভোটও তো নাকি হয় না। সব ভোট ছিনতাই করে নেয় টিএমসি। মানুষ ভোটই দিতে পারে না। বাংলার এই অবস্থা ভাবা যায়? এরকম একটা রাজ্য ধ্বংস হয়ে গেল? কিছুই বিকাশ হল না।
এসব ক্ষেত্রে প্রতিবাদ করে লাভ হয় না। কারণ, বাংলার অবস্থা অতীতের চম্বলের মতো হয়ে গিয়েছে, এরকম যদি এখানে মানুষজন বিশ্বাস করে, তাহলে সেই ভাবনার বদল ঘটানো যাবে না। আর তখনই স্পষ্ট হল, যে অপপ্রচার এবং অসত্য প্রোপাগান্ডার শক্তি ঠিক কতটা শিকড়ে প্রোথিত হয়ে যায়। সন্দেশখালি অথবা অন্য যে কোনও ঘটনার সত্যাসত্য বিচার না করে আগেভাগেই দেশজুড়ে প্রবলভাবে প্রচারমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে সুপরিকল্পিতভাবে। চম্বলের রাস্তায় যেতে যেতে বোঝা যাচ্ছিল, যে বাংলার বদনাম করাই আসল উদ্দেশ্য এই ঘটনাগুলির প্রেক্ষিতে গোটা রাজ্য এবং গোটা বাঙালি জাতি সম্পর্কে অপবাদ দেওয়ার একটি পরিকল্পনা কার্যকর করা হচ্ছে।
প্রশ্ন জাগছে, এই যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক আক্রমণ করতে গিয়ে বিজেপির সর্বভারতীয় নেতৃত্ব সামগ্রিকভাবে বাংলা একটি অবাসযোগ্য স্থান, এখানে শিক্ষিত মানুষ থাকে না, এখানে নারীদের সামান্যতম সুরক্ষা নেই, এখানে আইনের শাসন নেই, এখানে একটি ধ্বংসের রাজত্ব চলছে, এটাই প্রতিষ্ঠা করার প্রাণপণ চেষ্টা করছে, তার আসল লক্ষ্য কী? আর বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন ইস্যুকে ধরে যেভাবে বাংলাকে কলঙ্কিত করা হয়েছে, সেই ধ্বংস হওয়া ইমেজের ক্ষতিপূরণ দুঃসাধ্য।
সন্দেশখালিতে এখন যে মহিলারা বলছেন, সবটাই মিথ্যা, তাদের জোর করে সাদা কাগজে স্বাক্ষর করানো হয়েছিল, টাকা দেওয়া হয়েছিল, এটা বহু মানুষ বিশ্বাস করছে না। কিন্তু এই একই মহিলারা যখন ওই অভিযোগুলি করেছিলেন, তখন কিন্তু আজকের অবিশ্বাসীরা বিশ্বাস করেছে। তখন মনে হয়েছিল এই নারীরা ঠিক বলছেন। কিন্তু সেই একই মানুষ যখন বিপরীত কথা বলছেন, তখন তাঁকে অবিশ্বাস করা হচ্ছে! কারণ কী?
ভোটের আগে বলা হয় মানুষ ভোট দিতে পারে না, রিগিং হয়। বাংলার একটা বড় অংশের মানুষ ভিখারি। সরকারি অনুদান পেয়ে ভোট দেয়। আবার এই মানুষ যেখানে যেখানে শাসক দলকে হারিয়ে দেয়, তখন বলা হয়, এই তো, মানুষ শিক্ষা দিল! তাহলে আগে যে বলা হয়েছিল যে, মানুষ ভিখারি এবং নিজের ভোট নিজে দিতে পারে না? কোনটা ঠিক?
সন্দেশখালির ঘটনা, এসএসসির ঘটনা অথবা অন্য যে কোনও অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্যি হতেই পারে। আবার সম্পূর্ণ মিথ্যাও হতে পারে। রাজনৈতিক এবং আইনি পন্থা রয়েছে। সেই প্রক্রিয়া চলছেও। সর্বোচ্চ আদালত সবটাই অবলোকন করছে এবং সেইমতো নির্দেশিকা দিচ্ছে। কিন্তু আমার পছন্দের রায় অথবা নির্দেশিকা হলে, সুপ্রিম কোর্ট খুব ভালো। আর অপছন্দের নির্দেশিকা হলে সুপ্রিম কোর্ট খারাপ, এই মনোভাবেব মতো চরম নির্বুদ্ধিতা আর আছে নাকি? আমরা সাধারণ মানুষ কেন অলক্ষ্যে কোনও না কোনও পক্ষ হয়ে যাচ্ছি?
এসবের বাইরে সবথেকে বড় ক্ষতিকর যা হচ্ছে,সেটি হল বাংলার বদনাম। বাঙালি জাতির চরম অপবাদ। সন্দেশখালিতে যেটা হয়েছে বলে অভিযোগ, সেটাই নাকি বাংলার কালচার। অর্থাৎ বাংলাজুড়ে সারা বছর ধরে নাকি এরকমই হয়। এটাই সর্বভারতীয় স্তরে লাগাতার প্রচার হচ্ছে। বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ চিরন্তন সত্য। বহুকাল ধরে হয়ে আসছে। কিন্তু বাংলায় কোনও বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ হলে সেটাকে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়। চলে আসে জঙ্গি যোগের সন্ধান করতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। বলা হয়, বাংলা একটি অগ্নিস্তূপের উপর বসে আছে। জেলায় জেলায় শহরে শহরে নাকি বারুদের কারখানা। বিস্ফোরকের রমরমা। জঙ্গিরাজ্য।
আমাদের প্রশ্ন হল, তৃণমূল শাসক দল। তার বিরুদ্ধে আক্রমণ, অভিযোগ, তাকে সরকার থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা, এসব বিরোধী দল করবেই। করুক না। রাজনৈতিক ভাবমূর্তি নির্মাণ ও বিনির্মাণে যে দল জয়ী হবে, যার প্রচার বেশি গ্রহণযোগ্য হবে, যার জনপ্রিয়তা বেশি, সে ভোটে জয়ী হবে। অন্যপক্ষ বহু চেষ্টা করেও পরাস্ত হবে। সব রাজ্যে এসব চলে। কিন্তু তার সঙ্গে বাংলার বিরুদ্ধে চরম অপপ্রচারের কারণ কী? বাংলাকে বদনাম করার এই প্রয়াস কি নিছক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং ক্ষমতা দখলের জন্য? নাকি জাতি এবং রাজ্য হিসেবে বাঙালি ও বাংলাকে ক্রমেই কোণঠাসা করে দেশবাসীর চোখে হেয় প্রতিপন্ন করার একটি সূক্ষ্ম প্ল্যান কাজ করছে?
অন্য রাজ্যেও অনেক ঘটনা হয়। কিন্তু সেইসব রাজ্য সম্পর্কে লাগাতার নেতিবাচক প্রচার, সেই সব রাজ্য ধ্বংসপ্রাপ্ত, সেইসব রাজ্যের শিক্ষা সংস্কৃতি সব ভুলুণ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, ওইসব রাজ্যে ভুলেও যেন কেউ পা না বাড়ায়, এরকম পরিকল্পিত প্রচার আমরা কি দেখতে পাই? পাই না। গোটা দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলার অবস্থা সবথেকে খারাপ, বাঙালি এখন বিচ্ছিন্ন এক অন্ধকার দ্বীপে বাস করছে, এরকম একটি ভাবমূর্তি নির্মাণ করা হচ্ছে। একটি রাজ্যে কিছুই ভালো নয়, সব খারাপ, এরকম হতে পারে? তৃণমূলকে খারাপ বলুন। তাদের হারানোর চেষ্টা করুন। না পারলে স্বীকার করবেন যে পারিনি। কিন্তু বঙ্গবাসীকে অন্য রাজ্যে গিয়ে, বিদেশে গিয়ে চরম লজ্জায় যাতে পড়তে হয়, সেই লক্ষ্যপূরণে অপবাদ দেওয়ার প্রজেক্ট নেওয়া হচ্ছে কেন?
আমরা যাকে ইচ্ছে ভোট দিতেই পারি। যাকে মনে করব আমাদের নিজেদের জন্য এবং রাজ্যের জন্য ভালো হবে, তাকেই গদিতে বসানো যেতেই পারে। এটাই গণতন্ত্র। কিন্তু লাগাতার রাজ্যের বদনাম সর্বভারতীয় স্তরে হলে আমাদের ভালো লাগছে? প্রচারের সময় আমাদের চোখ কান খোলা রাখতে হবে না? আমরা কি দেখবো না, প্রথমত কারা বাংলা এবং বাঙালির বিরুদ্ধে সামগ্রিক একটা নেগেটিভ ক্যাম্পেন চালাচ্ছে কয়েকটি ঘটনাকে সামনে নিয়ে। যেগুলো আবার পরে দেখা যায় মিথ্যা। আর দ্বিতীয়ত, কারা বাংলার এই বদনামে খুব খুশি হচ্ছে? দক্ষিণ ভারত কিংবা ওড়িশা। বিহার অথবা গুজরাত। মারাঠা কিংবা অসমিয়া। এমন কোনও রাজ্য অথবা জাতি আছে, যারা নিজেদের ভূমি এবং জাতিসত্ত্বার এই চরম ধারাবাহিক অপপ্রচার ও অসম্মান মেনে নেবে? এদের কারও সম্পর্কে কিন্তু এই স্তরের বদনাম করাও হয় না। কারণ বিপুল প্রত্যাঘ্যাত ও প্রতিবাদ হবে। হয়ও। অথচ আমাদের রাজ্যে এসে এসে এবং অন্য রাজ্যেও গিয়ে গিয়ে বাংলার বদনাম চলছে। আমাদের মাটি কি নরম? আমরা কেন নীরবে এই জাতি ও রাজ্যের অপপ্রচার সহ্য করে চলেছি? অবশ্যই রাজ্যে অনেক উদ্বেগজনক, লজ্জাজনক, বিপজ্জনক ঘটনা ঘটছে। যার প্রতিবাদ সঙ্গত। হচ্ছেও। কিন্তু গোটা বাংলা এবং বাঙালিই খারাপ হয়ে গিয়েছে? এই প্রচারও মেনে নিতে হবে? বাংলার ভাবমূর্তি যতটা খারাপ করে দেওয়া হয়েছে, সেই ক্ষতিপূরণ হবে কীভাবে?