মণিলালের সঙ্গে ঠাকুরের কথা হচ্ছে। ‘আহ্নিক করবার সময় তাঁকে কোনখানে ধ্যান করব’, মণিলালের এই প্রশ্নের উত্তরে ঠাকুর বললেন, ‘হৃদয় তো বেশ ডঙ্কামারা জায়গা। সেইখানে ধ্যান করবে’। জপধ্যান আরম্ভ করতে গিয়ে অনেকের মনে প্রায়শঃ এই প্রশ্ন ওঠে। নানান রকমের বিধান আছে—সহস্রারে, ভ্রূ-মধ্যে, কণ্ঠে, হৃদয়ে, বিভিন্ন চক্রে ধ্যানের কথা বলা হয়েছে। নীচের চক্রগুলি থেকে মনকে ক্রমশঃ ঊর্ধ্বচক্রে বা ভূমিতে নিয়ে যেতে হয়। ঠাকুর হৃদয়কে ডঙ্কামারা জায়গা বললেন। ডঙ্কামারা মানে বিখ্যাত জায়গা। এ জায়গাটি ধ্যানের পক্ষে সকলের জন্য প্রশস্ত। হৃদয়ে তিনি অবস্থান করেন, সেখানে তাঁকে ভাবতে হয়! যেমন গানে আছে, ‘যতনে হৃদয়ে রেখো আদরিণী শ্যামা মাকে।’ সাধারণ সাধকের পক্ষে হৃদয়ের সঙ্গে ধ্যানের সম্বন্ধ খুব বেশী। তবে অসাধারণ সাধকের পক্ষে আরও উঁচুতে ভ্রূ-মধ্যে, সহস্রারে ধ্যানের কথা আছে। সাধারণ সাধকের জন্য বলা আছে যে, গুরুকে সহস্রারে এবং ইষ্টকে হৃদয়ে ধ্যান করতে হয়। মনে রাখতে হবে কোনো নিয়মই সকলের পক্ষে অনুকূল হবে এমন কোন কথা নেই। তবে যা বেশীর ভাগ লোকের পক্ষে উপযোগী, তাই প্রশস্ত বলে ঠাকুর বলছেন, হৃদয় ডঙ্কামারা জায়গা। ভ্রূ-মধ্যে ধ্যান খুব কঠিন। অনেক সময় ভ্রূ-মধ্যে দৃষ্টি স্থির করতে গিয়ে চোখের অসুখ হয়। নিরাকার উপাসকদের পক্ষে ভ্রূ-মধ্যে ধ্যান প্রশস্ত বলা হয়। কিন্তু এখানে ঠাকুর নিরাকার ধ্যানেরও স্থান নির্দেশ করেছেন হৃদয়। মণিলাল নিরাকারবাসী, ঠাকুর তাঁকে বলছেন হৃদয়ে ধ্যান করবে। সাকার ধ্যান বলতে আমরা সাধারণভাবে বুঝি মূর্তির ধ্যান বা সেই মূর্তির সঙ্গে যে সব গুণ ওতপ্রোতভাবে জড়িত সেইসব গুণের ধ্যান। ধ্যান মানে চিন্তা। সে চিন্তা রূপেরও চিন্তা হতে পারে, গুণেরও। যেমন ভগবানের কোন রূপের চিন্তা যখন করি তখনও তিনি পবিত্র, করুণাময়, সর্বশক্তিমান, সবেশ্বর এগুলি সব সঙ্গে সঙ্গেই আসে। সুতরাং এই গুণগুলিও চিন্তার বিষয়ীভূত হল। কাজেই আমরা বুঝতে পারি মূর্তির চিন্তা হৃদয়ে করব। নিরাকারের চিন্তা কি করে করব? এ সম্বন্ধে শাস্ত্র বলেছেন, হৃদয়ের মধ্যে যে আকাশ রয়েছে সেই অন্তরাকাশের চিন্তা করতে হবে। তবে কেবল নিরাকার বস্তুর চিন্তা করা কঠিন বলে বলছেন, তার সঙ্গে আর একটু যোগ কর। কখনও জ্যোতি, কখনও নীহারিকা, কখনও নক্ষত্র পুঞ্জ, কখনও উজ্জ্বল ব্রহ্মজ্যোতি বা ব্রহ্মসত্ত্বা পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে এইরকম চিন্তা করবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এই নিরাকার স্বরূপগুলি একেবারে নিরাকার নয়। কারণ বিশিষ্ট একটা আকৃতি না থাকলেও জ্যোতিও একটা আকার, ধোঁয়া বা কুয়াশাও একটা আকার। আকার মানেই যে, হাত পা প্রভৃতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ থাকতেই হবে তা নয়, আকার মানে যার দ্বারা এক বস্তু থেকে অন্য বস্তুকে পৃথক করা যায়।