মদনুগ্রহায় পরমং গুহ্যমধ্যাত্মসংজ্ঞিতম্‌।
যৎ ত্বয়োক্তং বচস্তেন মোহোহয়ং বিগতো মম।।

তখন পার্থ ভগবানকে বলিলেন—“হে কৃপানিধি, আপনি আমার জন্যই যাহা অবর্ণনীয় তাহাও প্রকট করিয়া বলিয়াছেন। যখন (পঞ্চ) মহাভূত ব্রহ্মে লীন হয়, আর জীব ও মহাদাদিও লয়প্রাপ্ত হয়, তখন দেব (পরব্রহ্ম) যে স্বরূপে অবস্থান করেন, তাহাই তাঁহার অন্তিম বিশ্রামস্থল। যে স্বরূপ আপনি কৃপণের ন্যায় হৃদয়ের অভ্যন্তরে লুকাইয়া রাখিয়াছেন, যাহা আপনি বেদের কাছেও গোপন করিয়াছেন—হে প্রভু, তাহা আপনি আমার সম্মুখে হৃদয় উদ্‌ঘাটন করিয়া দেখাইয়াছেন—যে অধ্যাত্ম বস্তুর জন্য শঙ্কর সমস্ত ঐশ্বর্য্য (আরতি করিয়া) পরিত্যাগ করিয়াছেন; সেই বস্তু (জ্ঞান), হে স্বামিন্‌, আপনি আমাকে একেবারে দান করিয়াছেন—এ কথা বলিলে আমি আপনার স্বরূপ দেখিব কিরূপে? পরন্তু, সত্যই মোহের মহাবন্যায় আমাকে মস্তক পর্যন্ত ডুবিতে দেখিয়া, হে শ্রীহরি, আপনি নিজে ঝাঁপাইয়া পড়িয়া আমাকে উদ্ধার করিয়াছেন। এক আপনি ভিন্ন এই বিশ্বে দ্বিতীয় কোনও বস্তু নাই—পরন্তু, আমার কর্ম্ম দেখুন,—যে ‘আমি আছি’ এই প্রকার কথা বলিতেছি। আমি জগতে এক ‘অর্জ্জুন’ এই দেহাভিমান পোষণ করিয়া কৌরবগণকে আমার স্বজন মনে করিতেছিলাম। শুধু ইহাই নহে,—ইহাদের বধ করিয়া আমি কি পাপে লিপ্ত হইব, এই দুস্বপ্ন দেখিতেছিলাম,—আপনি আমাকে জাগ্রত করিয়াছেন। হে দেব, হে লক্ষ্মীপতি, নিজের বসতিত্যাগ করিয়া আমি গন্ধর্ব্বনগরীতে গিয়াছিলাম, জলপান করিবার ইচ্ছায় আমি মৃগজল পান করিতেছিলাম। বস্ত্রনির্ম্মিত সর্পের দংশনে সত্যই বিষের যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্‌ করিতেছিলাম—এই বৃথা মরণ হইতে আমাকে বাঁচাইয়া আপনি শ্রেয় প্রাপ্তি করাইয়াছেন। আপন প্রতিবিম্ব না বুঝিয়া সিংহ কূপের মধ্যে লাফাইয়া পড়িতে গেলে যেমন কেহ তাহাকে ধরিয়া ফেলে, তেমনি, হে অনন্ত, আপনি আমাকে রক্ষা করিয়াছেন। নতুবা, শুনুন, আমার এতটা নিশ্চয়তা হইয়াছিল যে সপ্তসমুদ্রও যদি একত্রে মিলিয়া যায়; যুগক্ষয়ে প্রলয় হইয়া সমস্ত জগতের অন্ত হয়, অথবা আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়ে, তথাপি আমার গোত্রজগণের সহিত যুদ্ধ করিব না; এইরূপ অহঙ্কারের আধিক্যে আমি আগ্রহরূপ জলে ডুবিতেছিলাম,—ভাগ্যে আপনি নিকটে ছিলেন, নতুবা কে আমাকে উঠাইত? আমি মিথ্যাই নিজের অস্তিত্ব মানিয়া লইয়াছিলাম, আর যাহার অস্তিত্ব নাই তাহার নামগোত্র আখ্যা দিয়াছিলাম—এইভাবে ঘোর ভ্রমে পতিত হইয়াছিলাম—পরন্তু আপনিই রক্ষা করিয়াছেন। পূর্ব্বে জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ড (লাক্ষানির্ম্মিত জতুগৃহ) হইতে বাঁচাইয়াছেন, তাহাতে শুধু দেহেরই ভয় ছিল,—এখন এই ভ্রমরূপ দ্বিতীয় অগ্নিকুণ্ডে চৈতন্যের সঙ্কট হইয়াছিল। দুরাগ্রহরূপ হিরণ্যাক্ষ আমার বুদ্ধিকে কুক্ষিতলে লইয়া মোহরূপ সমুদ্রের (গবাক্ষে) তলদেশে প্রবেশ করিয়াছিল; সেখানে আপনারই সামর্থ্যে পুনরায় আমার বুদ্ধি স্বস্থানে ফিরিয়া আসিল,—আপনাকে দ্বিতীয় বরাহ (অবতার) হইতে হইল। আপনার কৃতিত্ব এমনই অপার যে একমুখে আমি তাহার কি বর্ণনা করিব? পরন্তু, আপনি আমার জন্য আপনার পঞ্চপ্রাণই সমর্পণ করিয়াছেন। ইহার কিছুই বৃথা যাইবে না, হে দেবরাজ, আপনি আমার মায়ার আদ্যন্ত (সমূল) নিরসন করিয়াছেন, ইহাতে আপনার উত্তম যশঃপ্রাপ্তি হইল। হে প্রভু, আনন্দসরোবরে কমলের ন্যায় আপনার নেত্র যাহার জন্য আপনার প্রসাদের মন্দির নির্ম্মাণ করিয়া দেয় (যাহার উপর কৃপাদৃষ্টি নিক্ষেপ করে); তাহার কি আর মোহের সহিত সাক্ষাৎ হয়? ইহা কত তুচ্ছ (হীন) কল্পনা। মৃগজলের বৃষ্টি বড়বানলের কি করিবে? আর আমার কথা ধরিলে, হে কৃপানিধি, আমি আপনার কৃপার গর্ভগৃহে প্রবেশ করিয়া ব্রহ্মরসের আস্বাদন করিতেছি; তাহাদ্বারা যে আমার মোহ চলিয়া যাইবে ইহাতে আর বিস্ময়ের কি আছে? আপনার চরণস্পর্শে আমার উদ্ধার হইয়া গেল।

ভবাপ্যয়ৌ হি ভূতানাং শ্রুতৌ বিস্তরশো ময়া।
ত্বত্তঃ কমলপত্রাক্ষ মাহাত্ম্যমপি চাব্যয়ম্‌।।

    হে কমলনেত্র, হে কোটিসূর্য্যপ্রভ মহেশ, আজ আপনার নিকট হইতে (ইহাই) শুনিলাম; এই ভূতগ্রাম যেখান হইতে উৎপন্ন হয়, এবং লয়প্রাপ্ত হইয়া যেখানে যায়, হে দেব, সেই প্রকৃতির বর্ণনা আমার কাছে করিয়াছেন; আর, প্রকৃতির রহস্য উদ্‌ঘাটন করিতে গিয়া সেই পরমপুরুষের মূলস্থান দেখাইয়াছেন,—যাঁহার মহিমারূপ আচ্ছাদনে বেদ সর্বস্ত্র হইয়াছে; শব্দরাশি (বেদ) বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া জীবিত আছে, অথবা ধর্ম্মরূপ রত্ন প্রসব করিতেছে—ইহা তাঁহারই প্রভাব চরণ সেবা করিতেছে বলিয়া (তেজের প্রভাবে) সম্ভব হইতেছে। এইভাবে, যিনি সকল সাধনমার্গের একমাত্র ধ্যেয়, যাঁহার স্বরূপ শুধু আত্মানুভব দ্বারাই আস্বাদন করা যায়, সেই পরব্রহ্মের অগাধ মাহাত্ম্য আপনি আমাকে স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়াছেন। আকাশ মেঘনির্মুক্ত হইলে যেমন দৃষ্টি সূর্য্যমণ্ডলে প্রবেশ করে, কিম্বা হস্তদ্বারা শৈবাল সরাইয়া ফেলিলে যেমন জল দেখা যায়; অথবা সর্পের বেষ্টনী ছাড়াইলে যেমন চন্দনবৃক্ষকে আলিঙ্গন দেওয়া যায়, অথবা (রাক্ষসী) পিশাচ পলায়ন করিলে যেমন ধনভাণ্ডার হস্তগত হয়; তেমনি প্রকৃতির প্রতিবন্ধকতা দূরে সরাইয়া, হে দেব, আপনি আমার বুদ্ধিকে পরতত্ত্বের শয্যায় শয়ন করাইয়াছেন (ব্রহ্মজ্ঞান প্রদান করিয়াছেন)। এইজন্য, হে দেব, আমার অন্তঃকরণে এ বিষয়ে সম্পূর্ণ প্রত্যয় (দৃঢ় বিশ্বাস) হইয়াছে, পরন্তু, হে দেব, আর একটি (ইচ্ছা) উৎপন্ন হইয়াছে। সঙ্কোচ করিয়া যদি বলি ‘থাক’ (জিজ্ঞাসা না করি), তবে আর কাহার কাছে জিজ্ঞাসা করিতে যাইব? আপনি ভিন্ন কি আর অন্য কোনও আশ্রয় আছে? জলচর যদি জলে আশ্রয় লইতে সঙ্কোচ করে, বালক যদি স্তনপান করিতে না চায়, তবে, হে শ্রীহরি, তাহার বাঁচিবার আর কি উপায় আছে? সুতরাং সঙ্কোচ করিব না, যাহা ইচ্ছা হয় আপনাকে প্রশ্ন করিব।” তখন ভগবান বলিলেন—“থাক, তোমার যাহা ইচ্ছা হয় বল।”