ধর্ম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা আমাদের অনেকেরই নেই। আমরা ভাবি যে সামাজিক কর্তব্যের মতো কিছু আচার অনুষ্ঠান, উপবাস, মন্দিরে যাওয়া এগুলিই বোধ হয় ধর্ম। এছাড়া নানারকমের কুসংস্কার ও লৌকিক আচার আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রবেশ করে, ঐগুলিও ধর্মের অঙ্গ হয়ে গেছে। ‘ভাববার কথা’ প্রবন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ লিখছেন, “সনাতন হিন্দু ধর্মের গগনস্পর্শ মন্দির—সে মন্দিরে নিয়ে যাবার রাস্তাই বা কত! আর সেথা নাই বা কি? বেদান্তীর নির্গুণব্রহ্ম হ’তে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, শক্তি, সূয্যিমামা, ইঁদুরচড়া গণেশ, আর কুচো দেবতা ষষ্ঠী, মাকাল প্রভৃতি—নাই কি?......আর লোকেরই বা ভিড় কি, তেত্রিশ কোটী লোক সে দিকে দৌড়েছে। আমারও কৌতুহল হ’ল, আমিও ছুটলুম। কিন্তু গিয়ে দেখি, এ কি কাণ্ড! মন্দিরের মধ্যে কেউ যাচ্ছে না, দোরের পাশে একটা পঞ্চাশ মুণ্ডু, একশত হাত, দু’শ পেট, পাঁচশ ঠ্যাঙওয়ালা মূর্তি খাড়া! সেইটার পায়ের তলায় সকলেই গড়াগড়ি দিচ্ছে। একজনকে কারণ জিজ্ঞাসা করার উত্তর পেলুম যে, ওই ভেতরে যে সকল ঠাকুর দেবতা, ওদের দূর থেকে একটা গড় বা দুটি ফুল ছুড়ে ফেললেই যথেষ্ট পূজা হয়। আসল পূজা কিন্তু এঁর করা চাই—যিনি দ্বারদেশে;……তখন আবার জিজ্ঞাসা করলুম—তবে এ দেবদেবের নাম কি? উত্তর এলো-এঁর নাম ‘লোকাচার’।” স্বামী বিবেকানন্দ আমাদের বলছেন যে এগুলি ধর্ম নয়। ধর্ম হচ্ছে প্রত্যক্ষানুভূতি। আচার্য শঙ্করও বলেছেন, “গঙ্গাসাগরে স্নান, ব্রতপালন অথবা দান শত শত জন্ম করলেও জ্ঞান বিনা মুক্তি হবে না।” ছোটবেলা থেকেই স্বামীজী ধর্মের এই প্রত্যক্ষ উপলব্ধি চেয়েছিলেন। তিনি সে যুগের বিখ্যাত ধার্মিক ব্যক্তিদের জিজ্ঞাসাও করেছিলেন যে তাঁরা ভগবানকে প্রত্যক্ষ করেছেন কি না। এ-প্রশ্নের উত্তরে শ্রীরামকৃষ্ণ ছাড়া কেউই ‘হ্যাঁ’ বলতে পারেন নি। তিনি বলেন, “হ্যাঁ, আমি ভগবানকে দেখেছি। তার সাথে আমি কথাও বলে থাকি যেমন এখন তোর সাথে বলছি।” আধুনিক বিজ্ঞান কোন জিনিস বিশ্বাস করতে গেলে প্রত্যক্ষ প্রমাণ চায়। কিছু বৈজ্ঞানিক, ভগবানের অস্তিত্বের প্রমাণ নেই বলে ভগবান মানেন না অর্থাৎ ভগবানে বিশ্বাস করেন না। ভগবানকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করে শ্রীরামকৃষ্ণ ভগবানের অস্তিত্বের প্রমাণ দিলেন। তাতে বৈজ্ঞানিক জগৎও তাদের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেল। ‘রাজযোগ’ বইটিতে স্বামীজী ধর্মের সংজ্ঞা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “আত্মা মাত্রেই অব্যক্ত ব্রহ্ম। বাহ্য ও অন্তঃপ্রকৃতি বশীভূত করিয়া আত্মার এই ব্রহ্মভাব ব্যক্ত করাই জীবনের চরম লক্ষ্য। কর্ম, উপাসনা, মনঃসংযম অথবা জ্ঞান—ইহাদের মধ্যে এক, একাধিক বা সকল উপায়ের দ্বারা নিজের ব্রহ্মভাব ব্যক্ত কর ও মুক্ত হও। ইহাই ধর্মের পূর্ণাঙ্গ। মতবাদ, অনুষ্ঠান-পদ্ধতি, শাস্ত্র, মন্দির বা অন্য বাহ্য ক্রিয়াকলাপ উহার গৌণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মাত্র।” এগুলি মুখ্য নয়,—আধ্যাত্মিক ভাবের বিকাশসাধন ও মুক্তিলাভেই মুখ্য প্রয়োজন। কিসের থেকে মুক্ত হতে হবে? বন্ধন থেকে মুক্ত হতে হবে। বন্ধন কি? অজ্ঞানই বন্ধন যা’ সত্য বস্তুকে ঢেকে রেখেছে। ‘অজ্ঞানেনাবৃতম্‌ জ্ঞানম্‌ তেন মুহ্যন্তি জন্তবঃ’—অজ্ঞানের আবরণ দিয়ে জ্ঞান ঢাকা থাকায় জীব মোহগ্রস্ত হয়। সুতরাং মোহ বা ভ্রান্তির কারণ হচ্ছে অজ্ঞান। এই অজ্ঞানের ফলে আমরা ভুলেই গেছি যে আমরা স্বরূপে চিরমুক্ত চৈতন্য মাত্র। জ্ঞানের উদয়ে অজ্ঞান চলে গেলে আমরা মুক্ত হয়ে যাব। আমাদের মনে রাখতে হবে যে সব ধর্মই সত্য। নিজের উপলব্ধির ফলে শ্রীরামকৃষ্ণ এই সত্য স্থাপন করেন যে সব ধর্মেরই লক্ষ্যবস্তু এক।