আমরা একটা পরিবৃত্তিকালের মধ্য দিয়ে চলেছি। মানব সভ্যতা ও প্রগতি একটা অধ্যায় শেষ করে নতুন এক অধ্যায়ে পদার্পণ করতে চলেছে। বিগত দুই শতাব্দী বিজ্ঞানের সঙ্গে তার প্রধান শত্রু ধর্মের মারাত্মক সংঘাতের সাক্ষী হয়ে আছে। এই দ্বন্দ্ব শুরু হওয়ার পূর্বকালে সর্বধর্ম সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষতার জ্ঞানকে অবজ্ঞা করে এসেছে এবং ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে নির্ণীত মানকে অস্বীকার করে এসেছে। আজ এই দ্বন্দ্বের ফল হয়েছে সুদুর প্রসারী। গত দুই শতাব্দী যাবৎ বিজ্ঞান-ভিত্তিক মন সত্যের প্রতি একটা অনিচ্ছুক ভালবাসার দ্বারা চালিত হয়েছে এবং সেখানে তার ফলের ওপর কোন মর্যাদা দেওয়া হয় নি। ফলে ধর্মের ওপর বিজ্ঞানের একটা সার্বিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। যুক্তি মানুষের মনের প্রধান স্থান দখল করে এবং শাস্ত্র বলেছে বলেই যেকোন বিষয় সে সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। যে সমস্ত বিষয়ের অস্তিত্ব যুক্তি অথবা ইন্দ্রিয়ানুভূতির সাহায্যে প্রমাণ করা যায় না সেগুলোকে কুসংস্কার বলে বর্জন করা হল। অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে সমস্ত জিনিসের সত্যতা নির্ণীত হয়। যদিও জ্ঞানের এই বিচার বিজ্ঞান জগতে একটা বিপ্লব ঘটাতে যথেষ্ট ছিল তবুও আত্ম জগতে এগুলো যথেষ্ট ছিল না। আত্ম জগতে প্রবেশ করা যায় কেবল আত্ম সংযম, আত্মোৎসর্গ এবং আত্মবিলোপের সাহায্যে। বিজ্ঞানবাদীমন তার বর্হিমুখী প্রবণতার জন্য এতখানি প্রশান্তি লাভ করে না—যার মধ্যে কেবল সত্য, আত্মজ্ঞান প্রতিফলিত হতে পারে। এর ফলে বিজ্ঞান নির্ভর পাশ্চাত্য জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি হয়েছে জড়বাদী এবং তার সমাজ গড়ে উঠেছে নতুন ভিত্তি—ভোগের ওপর। এইদিকে সে তার অদম্য শক্তির সাহায্যে এমন সাফল্যে উপনীত হয়েছে যা অতীতে সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ এর ফলে পাশ্চাত্য সভ্যতা হয়েছে স্বার্থপর ও অহংকারী এবং সে ভাবছে যে তার এই ভাবগুণের বলে সে এমন এক সভ্যতার পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে যা আজ পর্যন্ত কেউ লাভ করতে পারেনি। যদিও তার নিজস্ব আদর্শের সাহায্যে সে নিজেই সভ্যতার মাপকাঠি ঠিক করেছে। এই মানসিকতার ফলে সে বিজ্ঞান প্রভাবিত সভ্যতার বাইরের জাতিকে অবজ্ঞা করেছে অসভ্য বলে। যদিও বিজ্ঞান ধর্মকে-যার প্রয়োজন সমাজের কাছে আস্তে আস্তে কমে যাচ্ছে, কুসংস্কার বলে বর্জন করেছে এবং অতীতে বিশেষ করে মানব সভ্যতার গোড়ার দিকে এই কুসংস্কারই ছিল সভ্যতার মূল্যবান উপাদান। তবুও আধুনিক জগতের সমস্যার কাছে আজও বিজ্ঞান মূক। সমস্ত ধর্মীয় বিশ্বাসের ওপর বিজ্ঞান আঘাত হেনেছে এই কারণে যে সেগুলো যুক্তিভিত্তিক নয়। কিন্তু এর পরিবর্তে তার দেওয়ার কিছু নেই যা ভবিষ্যৎ মানব সভ্যতার উন্নতির উদ্দেশ্যমুখী শক্তি হবে। শিল্পকলা, ব্যবসা বাণিজ্য, পণ্যদ্রব্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং আরও বহু বাস্তব সুযোগ সুবিধা এনে দিয়েছে বিজ্ঞান। কিন্তু মানব সভ্যতার বৃহৎ অংশে সুখ ও শান্তি আনয়নে ব্যর্থ হয়েছে। ইহা কেবল মানুষের চাহিদার ব্যাপ্তি ও তীব্রতা বাড়িয়েছে এবং তার সঙ্গে এসেছে দৈহিক ও নৈতিক অধঃপতন।
স্বামী বীরেশ্বরানন্দজীর ‘এ যুগে ধর্ম কেন’ থেকে