অধ্যাত্ম সাধনায় প্রথম অবলম্বন মন্ত্র। মন্ত্র কি? ‘‘মনঃ ত্রায়তে যেন’’—যদ্দ্বারা মন তাহার চঞ্চলতা হইতে ত্রাণ পায়। আচার্য শিষ্যকে এই মন্ত্র দান করেন, নিরবয়ব মন একটা অবলম্বনশূন্যবস্থায় থাকিতে পারে না। এই মন্ত্রকে অবলম্বন করিয়া মন স্থিতি নিতে নিতে ক্রমশঃই তাঁহার চঞ্চলতা বিনষ্ট হইয়া চিত্তজাল বিস্তৃতি নিরুদ্ধ হয়। বৈদিক ও বৈদান্তিক যুগে বর্তমানে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী অধ্যাত্ম সাধনার জন্য আচার্য্য কর্ত্তৃক কোন বিশিষ্ট মন্ত্রদানের প্রচলন ছিল না। শিষ্যকে দত্ত ব্রহ্মোপদেশই ছিল তখনকার মন্ত্র। আচার্য্য শিষ্যকে উপদেশ করিলেন—ব্রহ্ম সত্য ও আনন্দময়। এই উপদেশ দান করিয়া তিনি শিষ্যকে ধ্যান করিতে পাঠাইয়া দিলেন। নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্যপুষ্ট জীবনবাহী, শক্তিশালী, ধীমান্ শিষ্যও আচার্য্যের নিকট হইতে ব্রহ্মোপদেশ শ্রবণ করিয়া শুদ্ধ মনের শক্তির সাহায্যে নিধিধ্যাসনে বা ধ্যানযোগে উহা অনুভব করিলে পর পুনরায় আচার্য্য সমীপে আসিয়া তাহার অনুভূতির বিস্তৃত বিবরণ আচার্য সমীপে বর্ণনা করিত। ইহাতে আচার্য্য শিষ্যের অনুভূতির পূর্ণত্ব বিষয়ে নিঃসন্দেহ হইলে পুনরায় দ্বিতীয় উপদেশ দান করিতেন—‘‘ব্রহ্মা জ্ঞানময়’’ এবং পুনরায় ইহা ধ্যানে উপলব্ধির জন্য পাঠাইয়া দিতেন। এইরূপে আচার্য্য কর্ত্তৃক ক্রমে ক্রমে ব্রহ্মোপদেশ দান ও শিষ্য কর্তৃক বৎসরের পর বৎসর কঠোর ধ্যানযোগে উহার উপলব্ধির মাধ্যমে হইত ব্রহ্মবিদ্যা লাভ। এইভাবে জীবের স্বরূপ বা ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করিতে জীবনের বহু সময় অতিবাহিত হইত। সেকালে মানুষ ছিল দীর্ঘায়ুঃ। তাই সেই দীর্ঘপরিসর জীবনে কঠোরতম তপস্যায় কেবল মাত্র ধ্যানযোগে আত্মজ্ঞান লাভ ছিল সম্ভব। ইহা ছিল দীর্ঘ সময়, কঠোর একনিষ্ঠ ব্রহ্মচর্য্যপুষ্ট ত্যাগময় ব্রাত্য জীবন ও অসাধারণ মনঃশক্তিসাপেক্ষ সাধনা।
কিন্তু কালপ্রভাবে মানুষের জীবন ক্রমশঃ ভুক্তিবাদে আচ্ছন্ন হইতে লাগিল। ফলে মানুষের জীবনে দেখা দিল ব্রহ্মচর্য্য, প্রজ্ঞা, স্মৃতি, ধী ও মনঃশক্তির দুর্ব্বলতা এবং আয়ুষ্কালও হইল স্বল্পপরিসর। বৈদিক ও বৈদান্তিক যুগের ধ্যানযোগের ধারায় স্বল্পপরিসর জীবনে পরমকে পূর্ণভাবে জানিবার বিকলতা দৃষ্ট হইলে যুগে যুগে ত্রিকালজ্ঞ ঋষিগণ চিত্তবৈকল্য বিনষ্ট করিতে মনাবলম্বনের বহু বিকল্প বিধান রচনা করিয়াছেন। বেদান্ত পরবর্ত্তী যুগে ‘প্রাণকর্ম্ম’ বা ‘প্রাণায়ামাদি কর্ম্ম’ বিহিত যোগধারায় তনুর মাধ্যমে অতনুর সাধনায় মনোলয়ের যে বিধান রচনা হইল সেখান হইতেই জন্ম নিল তন্ত্র। সেখানেই জন্ম নিল দীক্ষা-বিজ্ঞান। ক্ষেত্রজ্ঞ আচার্য্য সমীপে দেহানুযায়ী বিশিষ্ট মন্ত্রযোগে দীক্ষা গ্রহণের প্রণালীর হইল উদ্ভব। ভূত, বায়ু ও ধ্বনি বিচারের বিজ্ঞান হইল রচিত। সেই বিজ্ঞানধারায় মনাবলম্বনে মানুষের অধ্যাত্ম কর্ম্মের চলিল অনুশীলন। সেখানে প্রথমেই জন্ম নিল রাজযোগ পন্থা, যে বিষয়ে গীতা বলিয়াছেন। এই রাজযোগে সহজে (easily) এবং সোজাভাবে (directly) পৌঁছিবার পন্থায় ও যখন বিকলতা ও বিফলতা দেখা দিল তখন সেখানে পৌঁছিবার জন্যও কতকগুলি বিকল্প পন্থার উদ্ভব হইল, যথা—হঠযোগ, লয়যোগ, মন্ত্রযোগ ইত্যাদি।
মহর্ষি প্রেমানন্দের ‘গীতায় ভগবান’ থেকে