উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
ঠিক যেমন মৌপাল-গড়মান-পীড়াকাঁটা-শালবনীর কুন্তি মাহাতোরা আজ বলেন, যাঁরা বেঁচে আছেন, বেঁচে থাকবেন বিবেকে-শরীরে, তাঁরা শুনে নিন, এইসব মহিলাকে তাঁদের সহ্যের সীমার দিকে হেঁটে যেতে হয়েছিল। সেই সীমা পার করেও তাঁরা বেঁচে আছেন, কেউ কথা বলতে পারেন, কেউ এখনও বলতে পারেন না। যেমন শেফালি মাহাতো মাওবাদীদের হাতে তাঁর স্বামীর খতম হওয়া দিনের কথা এখনও বলতে পারেন না...।
আর যাঁরা বলতে পারেন, কুন্তি মাহাতোর মতো, তাঁদের টানা কথার শেষে আপনি এসে মুখোমুখি দাঁড়াবেন এমন এক-একটা লাশের সামনে। যেমন ভাদুতলা কিংবা ধান্যশোলের কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে বলে যাবেন, ছ’ফুটের উপর লম্বা ছিল রণজিৎদা, বয়স বড়জোর উনচল্লিশ চল্লিশ হবে। আমরা যখন খুঁজে পাই তখন গাছের গায়ে বাঁধা। শরীরের তলার দিকের পুরোটাই পোড়ানো...।
জঙ্গল এখানে চোখ টানে...লাল মাটি ছুঁয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর জুড়োয়। আর মন পড়ে থাকে, সেই ২০০৮-এর মে মাসে। জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে সেই নাশকতা... অসহায় মানুষের হত্যাকাণ্ড, আর্তনাদ এখনও যেন সর্ডিহা আর খেমাশুলি স্টেশনের মাঝের এই রেললাইনের পাশে দাঁড়ালে শোনা যায়। শহর মেদিনীপুর থেকে আপনি যদি দক্ষিণ-পশ্চিমে টানা চলে যান নয়াগ্রামের দিকে, অথবা উত্তর-পশ্চিমে ঝাড়গ্রাম, শিলদা, বেলপাহাড়ির দিকে, অথবা উত্তরে এগিয়ে গিয়ে আবার পশ্চিম ঘেঁষে শালবনী-গোয়ালতোড়... অগণন গাঁয়ের এক-একটা বাঁক চিহ্নিত হয় এক-একজন গরিব মানুষের পড়ে থাকা লাশের স্মৃতি দিয়ে। এক-একটি ছোট গাঁ এক-একজন নিখোঁজ হওয়া মানুষের নাম দিয়ে। এক একটি জঙ্গল এক একটি গাঁয়ের যৌথ আতঙ্কের বৃত্তান্ত দিয়ে। মৃত্যুই এখানে যেন মাইলফলক। পীড়াকাঁটা থেকে কলসিভাঙা সাড়ে চার-পাঁচ কিলোমিটার লালমাটির পথ শালবনের অন্দর দিয়ে। কলসিভাঙা ছিল মাওবাদীদের শক্তপোক্ত ঘাঁটি। এখানে নিজের কথা, নিজের গাঁ-ছাড়া হওয়ার কথা, মাওবাদীদের কব্জা থেকে পালিয়ে যাওয়ার কথা, সাতবার জিজ্ঞাসা করলেও মুখ দিয়ে রা বেরয় না কারও। তাঁরা আতঙ্ক ভুলতে চান রোজই।
সেই মাওবাদীদের এলাকাছাড়া করেছে মমতার পুলিস-প্রশাসন। পাল্টে গিয়েছে জঙ্গলমহল। ঝাড়গ্রাম শহর থেকে বেরিয়ে লোধাশুলি-ফেকোঘাট-গোপীবল্লভপুর-রামেশ্বর হয়ে নয়াগ্রাম—বিস্তীর্ণ এই জঙ্গলমহলের ক্যানভাস এখন পাল্টে গিয়েছে। উন্নয়ন স্পষ্টতই চোখে পড়ে এলাকায় পা রাখলে। কোনও সন্দেহ নেই, বামফ্রন্ট আমলে যা হয়নি, গত দশ বছরে সেই কাজ করে দেখিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নির্বাচনের মুখে আদিবাসী এলাকাগুলি বলছে তাই। নিজের চোখে মিলিয়ে আসতে পারেন কাজের খতিয়ান। বিশেষ করে রাস্তা-পানীয় জল-বিদ্যুৎ এবং অবশ্যই নানাবিধ সামাজিক প্রকল্পের সুবিধা। সরকারি সুযোগ-সুবিধার ক্ষেত্রে শাসক এবং বিরোধীদের মধ্যে বাছবিচার করা হয়েছে, এমন অভিযোগও বিশেষ নেই। এখানে ভোট মানে যেন উৎসব! প্রশাসনের সহায়তায় আতঙ্কের দিনকাল ফেলে গ্রামবাসীরা আবার গাঁয়ে ফিরেছে। হৃদপিণ্ডকে লাফ পাড়ার তাগত দিয়েছে মিছিলের ঢোল-চড়াচড়া নানা বাদ্যি বাজনার বোল! ঘূর্ণিতে বাঁধা তেরঙা নিশান নাগরদোলার মতো ঘুরছে বনবন করে। পলাশের বন বাঁধনছেঁড়া উল্লাসে খেপে উঠছে সেই মিছিলে। আর মিছিল জুড়ে অগণন নারী, মাথায় তাঁরাই ঢের বেশি। এই নারীরাই এবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শক্তি। স্বাস্থ্যসাথী থেকে কন্যাশ্রী—সামাজিক এত সব প্রকল্পের চালিকাশক্তি তো বাংলার মায়েরাই। এইসব প্রকল্পের সুফল যত মিলেছে, জঙ্গলমহলও চিনেছে গেরুয়াধারীদের মিথ্যাচার। সেই মিথ্যাচারই এখন আতঙ্ক।
জঙ্গলমহল জানে, গঙ্গাপাড়ের নীলবাড়ি দখল করতে গেরুয়াধারীরা আবার স্বপ্ন ফেরি করছে। ফিরিস্তি শোনাচ্ছে, বাংলায় বিজেপি ক্ষমতায় এলে কী কী করবে। ওরা বলছে, স্বাধীনতা-উত্তর ৭৫ বছরে বাংলা থেকে ছিনিয়ে নেওয়া সবকিছু ফিরিয়ে দেবে। ২০১৯-এ ‘বিকাশ রাজনীতি’-র বুলি আওড়ে জঙ্গলমহলের ভোট নিজেদের ঝুলিতে পুড়েছিল গেরুয়া শিবির। তারপর আদিবাসী, গাঁ-গঞ্জের দিকে ফিরেও তাকায়নি।
ধরুন সেই আদিবাসী খেতমজুরের কথাই। যার আয় বাড়েনি এতটুকু। শুধু তেল-ডাল-চিনির দাম বেড়েছে দোজখের আগুনের মতো লাফ খেয়ে। একসময় দুপুর গড়িয়ে খেতে বসে তাঁর বিবিজান নিজের পাত থেকে পাঁচমুঠ ভাত সরিয়ে জড়ো করে রাখতেন মরদের পাতে। আর দাম বাড়ার আগুনে বাচ্চা দুটোর পাত থেকে হররোজ একমুঠো ভাত কমে উধাও। খেতে বসে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ত ষষ্ঠী মাহাতোর। বাচ্চা দুটোর পাতের দিকে তাকিয়ে বুকের তলায় পাথর জমতো ষষ্ঠীর, চোয়াল শক্ত হতো। সেসব কথা পাড়তেই কেমন যেন ডুকরে ওঠেন ষষ্ঠী। গরিবের বাল-বাচ্চার নাড়ি নিংড়ে নিয়ে ভোটে জেতার খরচ তুলছে গেরুয়া শিবির। গরিবের যন্ত্রণা বুঝবে কী করে? ভাতের পাতে সামান্য ডালও জোটে না। দু-মুঠো করে গ্রাস কমে যায় রোজ। অথচ রাস্তার মোড়ের মাথায় ফ্লেক্স হয় আরও গেরুয়া, রংদার। মাঝে মাঝে তা নতুন হয়, উচ্চতাও বাড়ে। আরও বাড়ে শুভ্র কেশের দাড়ির বহর। সঙ্গে ‘আত্মনির্ভর’-এর ফাঁকা আওয়াজও!
সেই মিথ্যাচারের আতঙ্ক পিছনে সরিয়ে এগিয়ে চলার সাতকাহন বুনছেন জঙ্গলমহলের গাঁ-গঞ্জ। কীভাবে? একসময় এই তল্লাটে অভাব-অনটন ছিল গা-সওয়া। আমলাশোলের ঘটনা কে না জানে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় এসেই গরিব মানুষগুলির জন্য ২ টাকার চালের বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। পুরসভাগুলিতে চালু হয়েছে ‘মা প্রকল্প’। ৫ টাকায় ‘মা’-এর ভাত, ডাল, তরকারি, ডিমের ঝোলে খুশি সবাই। অন্তত অনাহারে মৃত্যুর খবর যেন নবান্নে না পৌঁছয়। সেইসঙ্গে ঘরে ঘরে সবুজ সাথী, রূপশ্রী, কন্যাশ্রী। ট্যাব কেনার ১০ হাজার টাকা ইতিমধ্যেই জঙ্গলমহলের পড়ুয়াদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ঢুকে গিয়েছে। সাক্ষী জঙ্গলমহল।
মাওবাদ ছেড়ে সমাজের মূলস্রোতে ফিরেছেন যাঁরা, তাঁদের চাকরির বন্দোবস্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। জঙ্গলমহলের একদা ত্রাস মাওবাদীদের আত্মসমর্পণের ক্ষেত্রে রাজ্য প্রশাসন তাদের কথা রেখেছে। সবাই হয়তো পাননি। তবে ধাপে ধাপে সেই প্রচেষ্টা জারি রয়েছে। মাওবাদীদের হাতে নিহত, নিখোঁজ বা জখমদের পরিবারের যাঁরা, তাঁরাও পাচ্ছেন হোমগার্ডের নিয়োগপত্র। সংখ্যাটা কম নয়। ‘মাওবাদী হানায় শহিদ ও নিখোঁজ পরিবারের যৌথ মঞ্চ’-র পক্ষ থেকে রাজ্য পুলিস-প্রশাসনের কাছে মাওবাদীদের হাতে ক্ষতিগ্রস্ত ৪৫৫টি পরিবারের একজন করে চাকরির দাবি জানিয়ে একটি তালিকা পেশ করা হয়েছিল। তার মধ্যে এখনও পর্যন্ত প্রায় ৩৩৫ জন হোমগার্ডের চাকরি পেয়েছেন।
নয়াগ্রামের নতুন জঙ্গলকন্যা সেতু প্রত্যন্ত এলাকাকে আরও কাছে এনে দিয়েছে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু তৈরি হওয়ায় মেদিনীপুর-খড়্গপুরের সঙ্গে নয়াগ্রাম ব্লকের দূরত্ব অনেকটাই কমেছে। আবার কমেছে কলকাতার সঙ্গে দূরত্বও। নয়াগ্রামে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, নয়াগ্রাম স্টেডিয়াম, কিষান বাজার, প্রকৃতি উদ্যান হয়েছে। যে ঝাড়গ্রাম এক সময়ের মাওবাদী মুক্তাঞ্চল, এখন সেখানে দলে-দলে যাচ্ছেন পর্যটক! আতঙ্কহীন ঝাড়গ্রামে পর্যটনের পালে হাওয়া লেগেছে। ভোল বদলে তৈরি পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন উন্নয়ন নিগম পরিচালিত ঝাড়গ্রাম রাজবাড়ি ট্যুরিস্ট কমপ্লেক্স।
কে দুশমন, কে ঘরের লোক কিচ্ছু বোঝাতে হয় না জঙ্গলমহলের মানুষকে। গাঁয়ের জন্য কী করা গিয়েছে, আর কী করা যায়নি প্রতিমুহূর্তে তার হিসেব কষে নেন গাঁয়ের মানুষই। একটা টিউবওয়েল, এক টুকরো জমি, বিনে পয়সায় দুটো পড়ার বই, দু’বেলা দু’মুঠো খাবার আর পরিশ্রমের নিশ্চয়তা—সামান্য এই প্রাপ্তিতে সুখ, কত শক্তি খুঁজে পান এখানকার মানুষ। ‘কৌশলে কিন্তু ঘাসফুলের বনেও পদ্ম ফোটে’—এ কথা বলে বছর দুই আগেও গেরুয়াধারী নেতারা শোনাতেন ওড়িয়া প্রবাদ: মরিব মরিব, কৌশল করি মরিব! মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারাও আজ উধাও। তাদের সর্বভারতীয় সভাপতির সমাবেশে আজ হাতে গোনা ভিড়। ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়—জানে জঙ্গলমহলের আদিবাসীরাও। সাক্ষী লালগড়, ঝাড়গ্রাম। আর জবাব না-পাওয়া কত প্রশ্নই তো অসত্যের পর্দা ছিঁড়ে দিচ্ছে।
আসলে ঘোলা জল কেটে জঙ্গলমহল পরিষ্কার জলের স্রোতে ফিরছে। জঙ্গলমহলে ভোট মানে এখন উৎসব!