উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
এবার আলোচনার মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। ২০২১-এর এপ্রিল-মে মাসে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে। অলীক কুনাট্য-রঙ্গে মজে আছে রাজ্যবাসীর একাংশ। এই অবকাশে সুন্দরবনের বর্তমান অবস্থা ও পরিণতি নিয়ে কোনও আলোচনাই তেমন করে শোনা যাচ্ছে না। নির্বাচনে শুধু গলা কাঁপিয়ে বক্তৃতা দিলেই তো হবে না। সুন্দরবনের এবং সুন্দরবনবাসীর মূল সমস্যাগুলো রাজনৈতিক দলের কাছে ইস্যু হিসাবেও উঠে আসতে হবে। গত তিরিশ বছর আমি সুন্দরবনেই বাড়ি করে বসবাস করছি। আমার অভিজ্ঞতা বলে, দীর্ঘ সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার নদীবাঁধকে উপযুক্তভাবে গড়ে তোলাই সুন্দরবনবাসীর কাছে সবচেয়ে জরুরি কাজ। কয়েকদিন আগে রাজ্য মন্ত্রিসভার মিটিং-এ সারা রাজ্যের নদী ও ড্যাম অঞ্চলে বাঁধ দেওয়ার ব্যাপারে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্কের সঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত হয়েছে। কিন্তু সেখানে সুন্দরবনের নদীবাঁধ নিয়ে একটি কথাও নেই।
বর্তমানে যে অতিভঙ্গুর নদীবাঁধ আছে তা গড়ে উঠেছিল ইংরেজ আমলে, মূলত লাটদার জমিদারদের প্রয়োজনে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ঘি-ননী-মাখন খাওয়ার উদ্দেশ্যে লাটদাররা সাঁওতাল পরগনা থেকে আদিবাসী জনমজুরদের এখানে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই পরিশ্রমী জনজাতির মানুষরা একদিকে যেমন গাছ কেটে জঙ্গল হাসিল করেছিল, কৃষি জমি বা আবাদি জমি তৈরি করার উদ্দেশ্যে তেমনি নদীতে মাটি ফেলে বাঁধও বেঁধেছিল। কারণ ভরা কোটালে তাদের বাসস্থান জলের তলায় চলে যেত। সমাজের নিম্নবর্গীয় প্রান্তিক মানুষদের এরকমই নিয়তি! চর্যাগীতিকায় যেমন বর্ণিত হয়েছে, ‘নগর বাহিরে ডোমনি তোহারই কুড়িয়া’, তেমনি এই শোষিত প্রান্তিক মানুষগুলোকেও জনপদের সীমান্তে সমুদ্র-সন্নিহিত এলাকায় বসবাস করতে হতো আর বাধ্যত নিয়ম করে মাটি দিয়ে বছর বছর নদীবাঁধ বাঁধতে হতো। মূলত আলগা মাটির এই বাঁধ রক্ষার দায়িত্ব ছিল প্রান্তিক গরিব মানুষদের উপর এবং ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত এই ব্যবস্থাই বহাল ছিল। ১৯৬০ সালে ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় সরকার এই নদীবাঁধ রক্ষায় দায়িত্ব গ্রহণ করে।
বঙ্গোপসাগরে অতি গভীর নিম্নচাপ তৈরি হলে তা মূলত আমাদের সুন্দরবন, ওড়িশার পারাদ্বীপ অথবা বাংলাদেশের কক্সবাজারে ভয়ঙ্কর সাইক্লোন হিসাবে ধেয়ে আসে। একটি ঘূর্ণিঝড়ে একবার শুধুমাত্র সাগরদ্বীপেই, সম্ভবত ১৭৩৭ সালে, ষাট হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। সুন্দরবন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনায় এবং জাপানের কিয়োটো শহরে বিশ্ব আবহাওয়া পরিবর্তন ও উষ্ণায়ন বিষয়ক আন্তর্জাতিক মঞ্চে দু’বার প্রতিনিধিত্ব করার সুবাদে সুন্দরবনের সমস্যার মূলগত বিষয়ে কিছু চিন্তাভাবনার বিকাশ ঘটানোর সুযোগ পেয়েছিলাম। কিয়োটো প্রোটোকল সিদ্ধান্ত ঘোষণার পূর্বেই পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বার বার বিশ্ব উষ্ণায়নের সতর্কতা বিষয়ে যেমন আলোচনা করতেন তেমনি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সন্নিহিত সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ ভয়াবহ পরিণতির কথাও উল্লেখ করতেন। তাঁদের আশঙ্কা সত্য প্রমাণ করে গত দশ-বারো বছরে কয়েকটি ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড়ে সুন্দরবন বিপদগ্রস্ত হল। তবু বাদাবন ও ম্যানগ্রোভ অরণ্যের সুবাদে প্রকৃতির ধ্বংসলীলা হয়তো কিছুটা কম হয়েছিল। ১৯৬০ সাল থেকে বাংলাদেশে যেমন বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলন শুরু হয়, অনুরূপভাবে পশ্চিমবাংলার নিম্নগাঙ্গেয় উপত্যকায় সুন্দরবন নদীবাঁধ রক্ষায় আন্দোলনও গড়ে ওঠে, যার পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন তুষার কাঞ্জিলাল। তুষারবাবু বারবার সুন্দরবনের নদীবাঁধ উপযুক্তভাবে সংরক্ষণের কথা বলতেন। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, স্কুল-কলেজ, যাইহোক না কেন, নদীবাঁধ সুরক্ষার বিষয়টি সুন্দরবনের অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত।
সাম্প্রতিক সময়ে সুন্দরবনের বুকে আছড়ে পড়া তিনটি ঝড়—আয়লা, বুলবুল, উম-পুন। তিনটি ঝড়ের চরিত্র ও মারণ ক্ষমতা তিন রকম। আয়লা যখন হয়, অর্থাৎ ২০০৯-এর ২৫-২৬ মে, ঝড়ের গতি ১৭০ থেকে ১৮০ কিমি প্রতি ঘণ্টা, তখন ছিল অমাবস্যার ভরা কোটাল এবং একই সঙ্গে একটানা ঝমঝম করে তুমুল বৃষ্টি হয়েছিল বেশ কয়েকদিন ধরে। এছাড়াও যে কোনও ঘূর্ণিঝড়ে লেজের ঝাপটাটাই হচ্ছে মারাত্মক। আয়লায় তাই প্রায় এক হাজার কিমি নদীবাঁধ ভেঙেছিল এবং কৃষিজমি ও পানীয় জলের উৎসের তীব্র বিপর্যয় ঘটেছিল। নদীর স্রোতে ভেসে যাচ্ছে গবাদি পশু, নারী-শিশু—সে এক হাড়হিম করা মর্মান্তিক দৃশ্য। বাড়ি ঘর একেবারে ধূলিস্যাৎ। পরবর্তী সময় নদীবাঁধ বাঁচাও আন্দোলন ও তৎকালীন রাজ্য সরকারের তৎপরতায় দিল্লির সরকার যোজনা কমিশনের চেয়ারম্যান মন্টেক সিং আলুওয়ালিয়া সহ নদীবাঁধ বিশেষজ্ঞ দলকে প্রেরণ করেন সুন্দরবনে। প্রণব মুখার্জিও এক্ষেত্রে আলাদা করে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রেরিত সমীক্ষক দল মোট তিন হাজার পাঁচশো কিমি নদী বাঁধের মধ্যে ভেঙে যাওয়া এক হাজার কিমি নদী বাঁধের মধ্যে সাতশো তিয়াত্তর কিমি অঞ্চলকে চিহ্নিত করেন কংক্রিটের নদীবাঁধ তৈরি করার জন্য। কেন্দ্রীয় সরকার পাঁচ হাজার বত্রিশ কোটি টাকা এই প্রকল্পে অনুমোদন করে। এখন কংক্রিটের নদীবাঁধ তৈরি করতে গেলে রিং-বাঁধ তৈরি করতে হবে এবং সেই জন্য জনপদের দিকের কিছু কৃষিজমিও সরকারকে অধিগ্রহণ করতে হয়। জমি সংক্রান্ত জটের কারণে সাতশো তিয়াত্তর কিমি নদীবাঁধের মধ্যে মাত্র সত্তর কিমি কংক্রিট নদীবাঁধ দেওয়া সম্ভব হল। বাকি আশি শতাংশ টাকা ফেরত চলে গেল। কেননা ২০১১ সালে সরকার পরিবর্তন হয়েছে। পরবর্তী সময়ে ঘটে যাওয়া উম-পুন ঘূর্ণিঝড়ের বেগ ২৫০ কিমি প্রতিঘণ্টা ছিল, এটা যেমন ঠিক, তেমনি সেই সময় অমাবস্যার মরা কোটাল বা নদীতে ভাটা ছিল ও সেই সময়ে একটানা বৃষ্টিপাত হয়নি। আসলে সেদিন দুপুর দেড়টা থেকে পৌনে দুটোর সময় উম-পুনের ঝড় শুরু হয়েছিল। গতিবেগ ২৪০ থেকে ২৫০ কিমি প্রতি ঘণ্টা। কিন্তু সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস তেমন ঘটল না, কারণ নদীতে তখন মরা কোটাল বা ভাটা চলছে। রাত প্রায় আটটার সময় যখন নদীতে ভরা কোটাল হবার সময় আসন্ন, ঠিক তখনই প্রকৃতির অকৃত্রিম আশীর্বাদে পুব-দক্ষিণের হাওয়ার দাপট স্তিমিত হয়ে এল এবং হাওয়ার গতি পশ্চিম দিকে ঘুরে গেল। সুন্দরবনে ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষেত্রে এই পুব-দক্ষিণের হাওয়াটাই মারাত্মক। সাংঘাতিক বিপর্যয়ের হাত থেকে বেঁচে গেল সুন্দরবনের নদীবাঁধ। ভরা কোটালের সময় যদি পুব-দক্ষিণের হাওয়ার গতি স্তিমিত না হতো তাহলে ভরা কোটালের সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে প্রায় চল্লিশ ফুট পর্যন্ত ঢেউয়ে সমুদ্রের জলে প্লাবিত হতো গোটা সুন্দরবন, এমনকী বারুইপুর সংলগ্ন এলাকাও। সঙ্গে ঘূর্ণিঝড়ের লেজের ঝাপটে তছনছ হয়ে যেত গোটা তল্লাট। মণি নদীর তটে আমার স্কুলবাড়িতে সেদিন চারশো বিপদগ্রস্ত মানুষকে নিয়ে তীব্র আতঙ্কে সময় কাটিয়েছি। উম-পুন ঝড়ের দাপট তাই আয়লা ঝড়ের থেকে অনেকটা বেশি হলেও নদীবাঁধ ভেঙে ছিল কম। নদীবাঁধ দেশের সর্বত্রই ভাঙে, প্লাবিত হয় কৃষিজমি; জমির উর্বরতাশক্তি বৃদ্ধি পায়। কিন্তু সুন্দরবনের নদীবাঁধ ভাঙলে লবণাক্ত জলে কৃষিজমি প্লাবিত হলে প্রায় তিন-চার বছর মাটির নোনাভাব না কাটা পর্যন্ত চাষ-আবাদ হয় না। সুন্দরবনের নদীবাঁধ সংরক্ষণ করার ক্ষেত্রে তাই সর্বাত্মক উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। অন্য একটি বিষয়ও এই প্রেক্ষিতে আলোচনা করব। গ্রামীণ বিভিন্ন আবাস- যোজনা, যেমন প্রধানমন্ত্রী- গীতাঞ্জলি-ইন্দিরা আবাস স্কিমে গরিব মানুষ অ্যাসবেসটস ছাওয়া পাকা বাড়ির জন্য আর্থিক সাহায্য পান। যদিও প্রত্যেক বছরই ঝড়ে এই টিন, অ্যাসবেসটসের শেড ধ্বংস হয়ে যায়। সরকারকেও বছর বছর ত্রিপল, বাড়ি ভাঙার ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি ব্যবস্থা করতে হয়। এক্ষেত্রে আমার প্রস্তাব—এই সমস্ত গ্রামীণ আবাস যোজনায় যাঁরা সমুদ্র উপকূলবর্তী অংশে ঘর পাবেন, তাঁদের যেন অতিরিক্ত কিছু টাকা প্রদান করা হয় কংক্রিটের ছাদ তৈরির জন্য। তাহলে সরকারকে বছর বছর ত্রিপল ও বাড়ি ভাঙার ক্ষতিপূরণের অর্থের ব্যবস্থা করার দরকার পড়বে না।
এই লেখার আর একটি প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে যে, আয়লা-বুলবুল-উমপুন—এই তিন ঝড়ের প্রকৃতিকে সামুদ্রিক ঝড়ের নির্দিষ্ট চরিত্রের মধ্যে সবসময় সংজ্ঞায়িত করা যাচ্ছে না। এটাই হচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়নের ফলশ্রুতি। ঘূর্ণিঝড় ও তার প্রকৃতির পরিবর্তন হচ্ছে এবং চরিত্র পাল্টাচ্ছে কিন্তু উল্লেখনীয় বিষয় এই যে, কেন্দ্রীয় সরকার প্রেরিত সমীক্ষক দল যে অঞ্চলগুলোকে কংক্রিটের নদীবাঁধের জন্য চিহ্নিত করেছিল, সেখানেই উম-পুনের সময়ও নদীবাঁধগুলো ভেঙেছিল। গোসাবা, বাসন্তী, দেউলবাড়ি, রাঙাবেলিয়া, মাতলা, মৈপীঠ, ঠাকুরান নদী সংলগ্ন মৃদঙ্গভাঙা ইত্যাদি অঞ্চলে। এত কথা বলছি একটাই কারণে, নির্বাচন আসবে যাবে, সরকারের মুখগুলো পাল্টাবে কিন্তু আগামী মে-জুন মাসে আবার হয়তো সুন্দরবনে আছড়ে পড়বে নাম না জানা কোনও বিধ্বংসী ঝড়। এক সময় দাবি উঠেছিল সুন্দরবনের নদীবাঁধকে জাতীয় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করতে হবে। তারপর মাতলা, ঠাকুরান, বিদ্যাধরী, হেড়োভাঙা, সপ্তমুখী, মণি নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গেছে। সুন্দরবনের ছেচল্লিশ লক্ষ মানুষের জীবনের মূল সমস্যা নিয়ে অর্থাৎ নদীবাঁধ রক্ষা নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক আলোচনাকে তাই আজ সামগ্রিকভাবে নির্মাণ করতে হবে। যদি আমরা তা না পারি তাহলে এক মুহূর্তের মধ্যে সুন্দরবন জলের তলায় চলে যেতে পারে। আর কে না জানে, পরিবেশের ভারসাম্যের প্রেক্ষিতে ‘নগর পুড়িলে দেবালয় রক্ষা পায় না।’
তাই আসুন, নদী বাঁধ রক্ষার ক্ষেত্রে স্পর্শকাতর এলাকাগুলিতে তিনটি নিরাপত্তাবেষ্টনী নিয়েই আমরা সচেতন হই। প্রথমটি হচ্ছে নদীর ধার বরাবর বাদাবন, ম্যানগ্রোফ অরণ্যের প্রাচীর। দ্বিতীয় নিরাপত্তাবেষ্টনী হচ্ছে উঁচু কংক্রিটের বাঁধ এবং তৃতীয় ব্যবস্থা হচ্ছে, জনপদের মধ্যে সার দিয়ে তাল, খেঁজুর, নারকোল গাছের ঘন প্রাচীরের মতো নিবিড় ও সুসংহত বনসৃজন, যে গাছগুলো ঝড়ের তীব্রতার মোকাবিলা করতে পারে। এই তিন নিরাপত্তাবেষ্টনী দ্বারা সুন্দরবনের নিরাপত্তা স্থায়ী হতে পারে। রাজনৈতিক দল সমূহের কাছে একজন অতি সাধারণ রাজনৈতিক কর্মী ও সুন্দরবনবাসী হিসাবে বিনম্র অনুরোধ, আপনারা সুন্দরবনের অস্তিত্ব রক্ষার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিন।
লেখক রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী, মতামত ব্যক্তিগত