উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
আমরা চাই অর্থনীতির দ্রুত পুনরুজ্জীবন এবং মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) হবে অন্তত ১৪০.০৩ লক্ষ কোটি টাকা, যেটা ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের এস্টিমেট ছিল অথবা ১৪৫.৬৯ লক্ষ কোটি টাকা, যেটা ২০১৯-২০ অর্থবর্ষের এস্টিমেট ছিল। যদিও ওই দু’বছর বৃদ্ধির হার দ্রুত নেমে গিয়েছিল। তবুও ওই দু’বছরে বৃদ্ধির পজিটিভ হার রক্ষা করা সম্ভব হয়েছিল। বৃদ্ধি ঘটেছিল যথাক্রমে ৬.১ শতাংশ এবং ৪.০ শতাংশ। পরের বছর, অর্থাৎ ২০২০-২১-এ মহামারীর আঘাত নেমে আসে। অযোগ্য ‘ইকনমিক ম্যানেজমেন্ট’-এর সৌজন্যে পুরনো ক্ষত আরও দগদগে হয়ে ওঠে। যার জন্য দেশ ৪০ বছরের ভিতরে সবচেয়ে ভয়ানক আর্থিক মন্দার কবলে পড়ে যায়। এনএসও-র মতে, ১৩৪.০৯ লক্ষ কোটি টাকার জিডিপি (ধ্রুবক মূল্যে) সহ মার্চ ২০২১-এ এই অর্থবর্ষ শেষ হতে চলেছে। অর্থাৎ পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় বৃদ্ধির হার দাঁড়াবে -৮.০ শতাংশ। এটা আরও খারাপও হতে পারে।
পরিপূরক সমেত পুনরুদ্ধার
কতকগুলি উদ্বেগজনক ছাড়ের সঙ্গে এসেছে তৃতীয় ত্রৈমাসিকে ০.৪ শতাংশ বৃদ্ধির সাময়িক স্বস্তিটা, যার ভিত্তি ২০২০-২১ পুরো অর্থবর্ষের অনুমান (এস্টিমেটস):
১. যে বৃদ্ধির কথা বলা হচ্ছে তার পুরো কৃতিত্ব দিতে হবে কৃষি, বন ও মৎস্য উৎপাদন ক্ষেত্রের ৩.৯ শতাংশ এবং নির্মাণ ক্ষেত্রের ৬.২ শতাংশ বৃদ্ধিকে। খনি, ম্যানুফ্যাকচারিং এবং ট্রেড, হোটেল ও পরিবহণ ক্ষেত্রের মন্দা অব্যাহত রয়েছে।
২. গ্রস ফিক্সড ক্যাপিটাল ফর্মেশন (জিএফসিএফ) দাঁড়িয়েছে ৪১ লক্ষ ৪৪ হাজার ৯৫৭ কোটি টাকা—এই অঙ্কটা ২০১৮-১৯ এবং ২০১৯-২০ সালের থেকে কম। অঙ্কটাকে জিডিপির অংশ হিসেবে ধরলে দাঁড়ায় ৩০.৯ শতাংশ।
৩. রপ্তানির পরিমাণ ২৫ লক্ষ ৯৮ হাজার ১৬২ কোটি টাকা এবং আমদানির পরিণমাণ ২৭ লক্ষ ৩৩ হাজার ১৪৪ কোটি টাকা। এই দু’টি সংখ্যাই পূর্ববর্তী দু’টি বছরের থেকে কম। জিডিপির অংশ হিসেবে ধরলে এই দু’টি যথাক্রমে ১৯.৪ শতাংশ ও ২০.৪ শতাংশ।
৪. মাথাপিছ জিডিপির পরিমাণ ৯৮ হাজার ৯২৮ টাকায় নেমে এসেছে। চূড়ান্তভাবে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, যখন প্রতিটি মানুষ (২০২০ সালে যে বিলিয়নেয়ারদের সংখ্যা ৪০ বেড়ে গিয়েছে, তারাই কেবল ব্যতিক্রম) আগের চেয়ে গরিব হয়ে গিয়েছে, তখন কয়েক কোটি মানুষকে দারিদ্র্যসীমার নীচে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে মানুষগুলি আগেভাগেই দারিদ্র্যসীমার নীচে ছিল তারা এ-যাত্রায় দৈন্যদশায় পতিত হয়েছে। আরও আশঙ্কা হয় যে তারা আরও দেনার দায়ে ডুবে গিয়েছে।
৫. মন্দা এবং মহামারীর প্রভাব অর্থনীতির পরিধি অতিক্রম করে গিয়েছে: তারা মিলিতভাবে জনগণের শিক্ষা, পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যের ভয়ানক ক্ষতি করেছে। এর প্রভাব গরিব মানুষ এবং তাদের সন্তানদের জীবনে অবশ্যই আরও ভয়াবহ হয়েছে।
রিজার্ভ ব্যাঙ্ক আরও সতর্ক
‘অর্থনীতির পরিস্থিতি’ (স্টেট অব দ্য ইকনমি) মূল্যায়নে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া (আরবিআই) আরও অকপট। বাজেট এবং সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপের ব্যাপারে অযৌক্তিক কিছু অনুমোদন নেওয়া হয়েছে। তার পরেও, ২০২১-এর ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত বুলেটিনে এই বিষয়ক নিবন্ধটি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে: ‘সন্দেহ নেই যে আজ উপভোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতির পুনরুজ্জীবনের চেষ্টা চলছে। বিষয়টি যাঁরা বিচার করছেন তাঁদের ঝোঁক সেই ধরনের পুনরুজ্জীবনের দিকে যা পরিমাণে অল্প এবং স্বল্পকাল স্থায়ী। মোদ্দা ব্যাপার হল, বিনিয়োগের প্রতি আগ্রহ এবং মানুষের খিদে-তৃষ্ণা বাড়িয়ে দেওয়া। যাবতীয় চাহিদার সমস্ত শক্তি সক্রিয় হতে শুরু করেছে, শুধু বেসরকারি বিনিয়োগের উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে না। ঘুরে দাঁড়াবার জন্য বেসরকারি বিনিয়োগেরই উপযুক্ত সময় এটা ... ভারতীয় শিল্প এবং বাণিজ্য উদ্যোগগুলি কি এই আহ্বানে সাড়া দেবে?’
একটি ‘অল্প এবং স্বল্পকাল স্থায়ী’ পুনরুজ্জীবন এবং ‘বেসরকারি বিনিয়োগের অনুপস্থিতি’র মাঝখানে যে-কোনও ধরনের ‘সেলিব্রেশন’ অত্যন্ত আগাম হয়ে যায়। চতুর্থ ত্রৈমাসিক ও সারা বছরের এস্টিমেটস এবং স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সূচকের জন্য আমরা অবশ্যই অপেক্ষা করব।
স্বাধীনতা কমছে
আর্থিক পরিস্থিতি নিয়ে আমরা যখন আশায় রয়েছি, তখন অন্যদিকে রয়েছে দুঃসংবাদ। স্বাধীনতার সূচকে ভারতের র্যাঙ্ক নীচে নেমে গিয়েছে। ১৮০টি দেশের ওয়ার্ল্ড প্রেস ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারতের র্যাঙ্ক ১৪২। অন্যদিকে, ১৬২টি দেশের হিউম্যান ফ্রিডম ইনডেক্সে ভারতের স্থান ১১১তম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘ফ্রিডম হাউস’-এর বিচারে ভারতের নানান ক্ষেত্রে স্বাধীনতা কমে গিয়েছে। ভারতের স্কোর ৭১/১০০ থেকে ৬৭/১০০-তে নেমে গিয়েছে। তার ফলে ‘ফ্রি’ ক্যাটিগরি থেকে ‘পার্টলি ফ্রি’ ক্যাটিগরিতে নেমে গিয়েছে ভারত।
নির্দিষ্ট র্যাঙ্ক বা সংখ্যা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হল পারসেপশনের দিক থেকে বা মানুষের চোখে নেমে যাওয়া এবং অসংখ্য মানুষের জীবনে যে প্রভাবটা পড়ছে। এটা কি অস্বীকার করা যাবে যে মিডিয়া বা সংবাদ মাধ্যম শাসক দল ও সরকারের বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছে এবং মিডিয়ার একটা বড় অংশ ভিনটেজ এইচএমভি রেকর্ড প্লেয়ারের মতোই হয়ে গিয়েছে? মহিলা, মুসলিম, খ্রিস্টান, দলিত এবং তফসিলি জনজাতির (এসটি) বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনা বেড়ে গিয়েছে (ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বা এনসিআরবি-র তথ্য অনুসারে) এবং রেহাই মিলবে ধরে নিয়েই অপরাধগুলি সংঘটিত হচ্ছে—এটা কি অস্বীকার করা যাবে? সন্ত্রাসবাদ থেকে করোনা ভাইরাসের বিস্তার পর্যন্ত প্রতিটা খারাপ ব্যাপারের জন্য মুসলিমদেরই ‘নন্দ ঘোষ’ ঠাওরানো হচ্ছে—এটাও কি অস্বীকার করা যাবে? এটা কি অস্বীকার করা যাবে যে কেন্দ্রীয় সরকার আরও স্বৈরাচারী, ফৌজদারি আইন আরও দমনমূলক, কর আইন ও কর প্রশাসন আরও অনধিকারমূলক, পুলিস ও তদন্তকারী সংস্থাগুলি আরও নির্মম, এবং আর্থিক নীতিসমূহ আরও বেশি করে ধনী ও একচেটিয়া কারবারিদের প্রতি পক্ষপাতমূলক হয়ে গিয়েছে? গুরুত্বপূর্ণ সেন্টিমেন্টটা হল মানুষের মনকে ভয় গ্রাস করে ফেলেছে, তা কি অস্বীকার করা যায়? যারা সরকারের বিরুদ্ধে লিখেছে এবং ‘ফেক নিউজ’ ছড়িয়েছে বলে সরকার মনে করছে, তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করার জন্য দিল্লিতে একটা গোষ্ঠীর মাধ্যমে যে চক্রান্ত করা হয়েছে সেটাই সর্বশেষ বিস্ময়।
একটি ক্ষয়িষ্ণু অর্থনীতি এবং হ্রাসমান স্বাধীনতা মিলিতভাবে একটি বিস্ফোরক জুটি গড়ে তোলে। পতন রোধ অবশ্যই হবে। পাঞ্জাব, হরিয়ানা এবং উত্তরপ্রদেশের কৃষকরা একটাই পথ বেছে নিয়েছেন, সেটা হল প্রতিরোধ। অসম, পশ্চিমবঙ্গ, কেরল, পুদুচেরি এবং তামিলনাড়ুর ভোটারদের সামনে আর একটি পথ এসে গিয়েছে।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত