উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
এবার দেখা যাক, যে ডবল ইঞ্জিনের স্বপ্ন বাংলার মানুষকে বিজেপি দেখাচ্ছে, তার পরিণতিটা কী? মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, রাজস্থান, ঝাড়খণ্ড সহ বিভিন্ন রাজ্যে বিজেপি দীর্ঘদিন সরকার চালিয়েছে। দিল্লিতে যখন কংগ্রেস তখন থেকেই ওই সমস্ত রাজ্যে বিজেপির সরকার। একবার নয়, দু’বার নয়, কোনও কোনও রাজ্যে বিজেপি তিনবার সরকার গড়েছে।
২০১৪ সালে মোদিজি প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় বিজেপি শাসিত রাজ্যের মানুষ অনেক স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, কেন্দ্রে ও রাজ্যে একই দলের সরকার হওয়ায় উন্নয়নের জোয়ার বইবে। কারণ বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীরা তাঁদের ব্যর্থতা ঢাকতে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের বঞ্চনাকে ‘ঢাল’ করতেন। কেন্দ্রে বিজেপি বসায় সেই বৈষম্য ঘুচবে। কেন্দ্র ঢালাও অর্থ দেবে। কিন্তু, ঘটল ঠিক তার উল্টো। কেন্দ্রীয় সরকারের তালে তাল ঠুকতে গিয়ে বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীরা রাজ্যের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিলেন। বেশি টাকা আদায় তো দূরের কথা, কেন্দ্রের যাবতীয় জনবিরোধী নীতির দায় তাঁদের ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। প্রতিবাদ করতেও পারলেন না। কারণ টুঁ শব্দ করলেই গর্দান(মুখ্যমন্ত্রিত্ব) যাওয়ার ভয়। তাই তাঁরা চুপচাপ কেন্দ্রের সমস্ত সিদ্ধান্ত মেনে নিলেন। মুখ্যমন্ত্রিত্ব খোয়ানোর ভয়ে নেতারা চুপ থাকতে পারেন, কিন্তু রাজ্যের মানুষ সহ্য করবেন কেন? তাঁরা প্রতিবাদ জানালেন। কিন্তু, দিল্লি বহু দূর। নাগালের মধ্যে রয়েছে রাজ্য সরকার। সেটাকেই উল্টে দিলেন।
তার ফলে ছত্তিশগড়ের তিনবারের বিজেপি সরকারের পতন হল। শুধু পতন হল না, মুখ থুবড়ে পড়ল। ৯০টি আসনের মধ্যে বিজেপি মাত্র ১৫টি, আর কংগ্রেস দখল করল ৬৮টি আসন। বিজেপির ‘ডবল ইঞ্জিনে’-র সরকার লাইনচ্যুত হল।
মধ্যপ্রদেশের শিবরাজ সিং চৌহানেরও একই হাল। কেন্দ্রে যখন কংগ্রেস সরকার ছিল তখন বিজেপি একের পর এক নির্বাচন জিতে রাজ্যে সরকার গড়েছে। কিন্তু, রাজ্যের সঙ্গে কেন্দ্রের ইঞ্জিন জুড়তেই ‘শিবাজি এক্সপ্রেস’ উল্টে গেল। তারপর জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে ভাঙিয়ে কোনওরকমে গদি বাঁচালেন।
ঝাড়খণ্ডেও বিজেপির ‘ডবল ইঞ্জিনে’র সরকারও হল কুপোকাৎ। তাও আবার রাজনীতিতে নবাগত হেমন্ত সোরেনের কাছে। হরিয়ানাতেও একই অবস্থা। সেখানেও বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল না। শেষপর্যন্ত ‘বিজেপির চাণক্যে’র হস্তক্ষেপে তৈরি হল বিজেপির মিলিজুলি সরকার।
এবার রাজস্থান। ২০১৩ সালে রাজস্থানের ক্ষমতা দখল করেছিলেন বিজেপির বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া। ২০১৪ সালে কেন্দ্রে বসলেন মোদিজি। চলতে লাগল ‘ডবল ইঞ্জিন’ সরকার। তাতে রাজ্যবাসী খুশি হওয়ার বদলে খেপে গেল। ২০১৮ সালে উল্টে গেল বিজেপির ‘রাজমাতা এক্সপ্রেস’! সরকার গড়ল কংগ্রেস। তবে, কংগ্রেসকে ভাঙার জন্য বিজেপি লড়ে যাচ্ছে। কারণ নীতি নয়, ক্ষমতাই বিজেপির লক্ষ্য।
এই হল বিজেপির ডবল ইঞ্জিনের ‘সাফল্যে’র ইতিহাস। একের পর এক রাজ্যে ‘ডবল ইঞ্জিন’ গোঁত্তা খাওয়া সত্ত্বেও বিজেপির নেতারা সেটাই মোক্ষলাভের রাস্তা বলে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। কারণ ‘স্বপ্ন’ ছাড়া ভাঁড়ারে কিছু নেই। এখন বঙ্গের মানুষ সেই ‘স্বপ্নের ফানুসে’ চড়বেন কি না, একুশের নির্বাচন তারই পরীক্ষা।
এবার দেখা যাক, সিঙ্গল ইঞ্জিনের সরকার কাজ করতে পারে কি না? ১৯৭৭ সালে এরাজ্যে বামফ্রন্ট যখন ক্ষমতায় এল তখন দিল্লিতে কংগ্রেস সরকার। উভয়ের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। যে কোনও মুহূর্তে সরকার ভেঙে দেওয়ার আশঙ্কা বুকে নিয়ে বামফ্রন্টের পথ চলা শুরু। বামফ্রন্ট নেতৃত্ব বুঝেছিল, সরকার টিকিয়ে রাখতে গেলে কাজ করতে হবে। তাই তারা প্রথম থেকেই ‘জনগণের সরকার’ হওয়ার চেষ্টা করেছিল। সেই লক্ষ্যেই ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করিয়েছিল। হয়েছিল ভূমি সংস্কার। জোতদারের জমি কেড়ে দিয়েছিল গরিবকে। এসবই ছিল ‘সিঙ্গল ইঞ্জিন’ সরকারের সাফল্য।
প্রতিযোগিতায় দক্ষতা বাড়ে। গণতন্ত্রের প্রতিযোগিতায় উন্মুক্ত হয় জনহিতকর প্রকল্পের দরজা। সরকারে টিকে থাকার জন্য জারি থাকে মানুষকে পাশে পাওয়ার প্রয়াস। সেটাই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন। কন্যাশ্রী, রূপশ্রী, সবজুসাথী, বিনা পয়সায় রেশন, বিনা পয়সায় হাসপাতালে চিকিৎসা, মা, সমব্যথী, স্বাস্থ্যসাথীর মতো প্রকল্প চালু করে প্রমাণ করেছেন, ইঞ্জিনের শক্তি নয়, অভিমুখটাই আসল। মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছাটাই বড়। ইচ্ছা থাকলে উপায় বের হয়। বিজেপি নেতারা কথায় কথায় গুজরাতের উন্নয়নের উদাহরণ দেন। ধরেই নিলাম, মোদিজির নেতৃত্বে গুজরাতে উন্নয়ন হয়েছে। তাহলে সেটাও হয়েছিল ‘সিঙ্গল ইঞ্জিনে’র সরকারের আমলেই। কারণ তিনি যখন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী, তখন কেন্দ্রে ছিল কংগ্রেস সরকার। বরং গুজরাতে ‘গোধরা কাণ্ড’ ঘটেছিল ‘ডবল ইঞ্জিনে’র আমলেই। অটলবিহারী বাজপেয়ি তখন প্রধানমন্ত্রী, আর মুখ্যমন্ত্রীর নাম নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদি। লর্ড অক্টন বলেছিলেন,‘অ্যাবসল্যুট পাওয়ার কোরাপ্টস অ্যাবসল্যুটলি’। ‘ডবল ইঞ্জিনের’ কথা যাঁরা বলছেন, লর্ড অক্টনের সেই কথাটা তাঁদের আরও একবার স্মরণ করানো দরকার।
ইঞ্জিনটা ডবল নাকি সিঙ্গল, সেটা বড় নয়। আসল কথা হল, ইঞ্জিনের অভিমুখ কোন দিকে। উন্নয়নে নাকি বেসরকারিকরণে? কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ বলে দিচ্ছে, বিলগ্নিকরণের পক্ষে বিজেপি। তাই রেল থেকে বিমান, সর্বত্র ঢালাও বেসরকারিকরণ শুরু করে দিয়েছে। বছরে ২কোটি বেকারের চাকরি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সরকারে এসে রেলে, ব্যাঙ্কে, ডাক বিভাগে ও টেলিকমে লক্ষ লক্ষ পদ পূরণ করছে না। চক্রান্ত অনেক গভীরে। কর্মী কমলে ব্যাহত হবে পরিষেবা। মানুষজন বিরক্ত হয়ে ঝুঁকবে অন্যদিকে। তখন সরকারি সংস্থাকে রুগ্ণ দেখিয়ে ‘বেওসায়ি’দের বেচে দেবে। আর কেনার লোক তো হাতে গোনা।
মজার কথা হল, বিজেপির ওই সব নেতাই বঙ্গের বেকার সমস্যার সমাধানের কথা বলছেন। যাঁরা কেন্দ্রীয় সরকারের অসীম ক্ষমতা সত্ত্বেও চাকরি দিতে পারছেন না, তাঁরা রাজ্যের বেকারদের চাকরি দেবেন কী করে? জাদু নাকি? বলি, সব কিছুর যদি সীমা থাকে, ধাপ্পাবাজির থাকবে না কেন! দেশে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচন। এই অবস্থাতেও কেন্দ্রের সরকার পেট্রল, ডিজেলের দাম বাড়িয়ে চলেছে। আর গ্যাসের অবস্থা আরও খারাপ। রাতে শুতে যাওয়া আর ঘুম ভাঙার মধ্যেই সিলিন্ডারের দাম বেড়ে যাচ্ছে ২৫ থেকে ৫০টাকা। আচমকা বাড়িয়ে দিল লোকাল ট্রেনের ভাড়াও। তিন মাস চাষিরা রাস্তায় পড়ে রয়েছেন। কিন্তু সরকার তোয়াক্কা করছে না। সবেতেই যেন ‘ডোন্ট কেয়ার’ ভাব।
ডবল ইঞ্জিনের ‘রোল মডেল’ নাকি উত্তরপ্রদেশ! সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ মালদহে নির্বাচনী প্রচারে এসে বলেছেন, বাংলাকে উত্তরপ্রদেশ বানাবেন। ‘সুশাসন’ প্রতিষ্ঠা করবেন। যখন তিনি একথা বলছেন, ঠিক তার ২৪ ঘণ্টা আগে তাঁরই রাজ্যের হাতরাসে ঘটে গিয়েছে এক ভয়াবহ কাণ্ড। শ্লীলতাহানিতে অভিযুক্ত গুলি করে মেরেছে নির্যাতিতার বাবাকে। এটা ‘সুশাসন’? দোহাই যোগীজি, দয়া করে বাংলাকে উত্তরপ্রদেশ বানাবেন না। ফ্যাসিস্ট শক্তির কাছে ‘প্রতিবাদ’ বরাবরই অসহ্য। আর ‘প্রতিবাদ’ মানেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বেসরকারিকরণের প্রতিবাদ, কৃষি আইনের প্রতিবাদ, পেট্রল-ডিজেল-গ্যাসের দামবৃদ্ধির প্রতিবাদ, এনআরসির প্রতিবাদ। তাই উপড়ে ফেলতে হবে ‘প্রতিবাদের কাঁটা’। বিজেপির নজর এখন সেদিকেই।
বঙ্গে নির্বাচন। তাই ঝাঁকে ঝাঁকে আসছেন বিজেপির মুখ্যমন্ত্রীরা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা। এমনকী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছেও পশ্চিমবঙ্গ হয়ে উঠেছে ‘জলভাত’। লক্ষ্য একটাই, বঙ্গজয়। কারণ তাঁরা খুব ভালো করেই জানেন, লক্ষ্যভ্রষ্ট হলে বাংলা থেকেই হবে বিজেপির শেষের শুরু। তাই বঙ্গের নির্বাচন বিজেপির কাছে হয়ে উঠেছে ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচ।