উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
ভোট এলেই শিলান্যাসের হিড়িক পড়ে যেত জ্যোতি বসুর জমানায়। নদী পেরনোর পর যাত্রীর কাছে নৌকা ও মাঝির কদর যতখানি, রাইটার্স দখলের পর বেশিরভাগ শিলাখণ্ডের গুরুত্ব ততটাই তুচ্ছ দেখেছি আমরা। বাংলায় বাম রাজত্বের বয়স যত বেড়েছে এই ট্র্যাডিশন তত বেশি করে পেয়ে বসে যেন। অসীম দাশগুপ্ত, বিশেষ খ্যাতিমান এই অর্থমন্ত্রীকে পাশে বসিয়েই অবলীলায় প্রতিশ্রুতির বন্যা বইয়ে দিতেন জ্যোতিবাবু। যত দূর মনে পড়ে, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধীও এই ব্র্যাকেটের রাজনীতিক। কংগ্রেস আর মার্কসবাদী—কে যে কাকে কপি করত, বলা দুষ্কর।
মনমোহন সিংকে হারিয়ে নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০১৪ সালে। একজন মুখ্যমন্ত্রী থেকে রূপকথার চরিত্রের মতো তাঁর উত্থানের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিলেন তিনি নিজেই। মনমোহনকে জব্দ করতে মোদি হাতিয়ার করেছিলেন চাকরির টোপ। ২০১৩-র শেষাশেষি এক জনসভায় মোদি প্রথম উসকে দিলেন যুবসমাজের আবেগ। বললেন, ‘দেশের মোট জনসংখ্যার ৬৫ শতাংশের বয়স ৩৫ বছরের নীচে। এই বিশাল যুব শ্রেণি বেকারত্বের বিরুদ্ধে লড়ছে। অথচ এদেরকেই উন্নয়নের মূল শক্তি করে তোলা সম্ভব।’ আরও বললেন, ‘বিজেপি ক্ষমতাসীন হলে বছরে এক কোটি বেকারকে চাকরি দেব।’ ‘ইউপিএ কথা রাখেনি’—মোদি সেদিন দুষেছিলেন। ভোট যত এগিয়ে আসে, চাকরির প্রতিশ্রুতি গল্পের গোরু হয়ে ওঠে। সেবার ভোট শুরুর দু’সপ্তাহ আগে বিজেপি তাদেরই প্রতিশ্রুতিতে আরও রং লেপেছিল, পরবর্তী দশ বছরে ২৫ কোটি চাকরির ব্যবস্থা করবে! প্রথম মোদি সরকার গড়ার আগে বিজেপির ইস্তাহারে চাকরির বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। দাপুটে সরকার গড়েও মোদি তাঁর প্রথম টার্মে বেকারদের ভীষণ হতাশ করেন। প্রতিশ্রুতিভঙ্গের অভিযোগ ক্রমশ জোরদার হয়েছে। ২০১৮-র মার্চে এক টিভি সাক্ষাৎকারেও মোদি এই সংক্রান্ত প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে জবাব দেন, ‘পকোড়া ভেজেও দিনান্তে দু’শো টাকা রোজগার হয়। এটাকেও কর্মসংস্থান হিসেবে দেখতে হবে।’ ২০১৯-এর ভোটে বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে মোদিই ফিরে এসেছেন। কিন্তু এতদিনে দেশে ক’জন বেকার কেন্দ্রের চাকরি পেয়েছেন? সবাই সবাইকেই জিজ্ঞাসা করছেন, কিন্তু কারও কাছে কোনও উত্তর নেই। মোদি সরকারও স্পিকটি নট।
মোদি বিদেশ থেকে কালো টাকা উদ্ধার করে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আর স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, প্রতিটি নাগরিকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেবেন। সেই স্মৃতি ফিকে হয়নি এখনও। তবু হালফিল ভোটের বাংলায় এসে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি ছোটাতে একটুও লজ্জা বোধ করছেন না বিজেপির তাবড় নেতারা। মোদি, অমিত শাহ, জে পি নাড্ডা ঘন ঘন আসছেন। বাংলার গরিব জনগণ ও ছাত্রছাত্রীদের ‘দুর্দশা’ আর ‘ভেঙেপড়া আইনশৃঙ্খলা’ নিয়ে ৭ মার্চ ব্রিগেডে মোদি প্রায় কেঁদে ফেললেন। যা বলে গেলেন তার সরলার্থ একটাই, বাংলার সমস্ত অভাব অভিযোগ দুর্দশা তিনি এবার দূর করে তবেই থামবেন। বাঙালিদের বোঝার সুবিধের জন্য কথার ভাঁজে ভাঁজে বাংলাও পাঞ্চ করলেন বর্তমান ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ ‘সেলসম্যান’—‘বাংলা চায় শান্তি, বাংলা চায় উন্নতি, বাংলা চায় সোনার বাংলা’। আর কথা দিলেন, তাঁর নেতৃত্বে বাংলায় এই দফায় এমন
উন্নতি হবে যে তার প্রভাব থাকবে ২৫ বছর।
কংগ্রেস, কমিউনিস্ট এবং তৃণমূলের শাসনে বাংলা থেকে যা-সব লুট হয়েছে তিনিই ফিরিয়ে দেবেন। স্বাধীনতা-উত্তর সাড়ে সাত দশকে যা হারিয়েছে, সবই ফেরত পাবে বাংলা।
একের পর এক জনসভায় এসব যখন বলছেন, তখন যোগীরাজ্যের কথাটি মুখে পর্যন্ত নিচ্ছেন না। (অথচ বিজেপি-শাসিত এই রাজ্যটিই খুন, ধর্ষণ, নারী, শিশু ও সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারে সর্বকালীন রেকর্ড গড়েছে। কোনও বিরোধী নেতার কুৎসা নয়, এ তথ্য এনসিআরবি-র।) অমিত শাহ থেকে মোদির কারবার দেখে মনে হয়, যোগী তাঁদের ভাসুর ঠাকুর!
আসলে তাঁরা রাজনীতি নামক গঙ্গাজলের সুবিধে নিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মিথ্যাভাষণের কিছু অসুবিধে থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু রাজনীতিক হিসেবে সেই সমস্যা নেই বলেই হয়তো তাঁরা মনে করেন। সাম, দান, দণ্ড ও ভেদ—ভারতের প্রাচীন শাস্ত্র বর্ণিত রাজধর্মের এই চারটি দিকের অপপ্রয়োগেই সিদ্ধহস্ত আধুনিক ভারত। ‘রাজধর্মে ভ্রাতৃধর্ম বন্ধু নাই’—দুর্যোধনের এই দর্শনকে সামনে রেখে অবাধে দলবদল করা যায়, আয়ারাম গয়ারাম হওয়া চলে। গণতন্ত্র বাঁচানোর দোহাই পেড়ে, ‘ধর্মনরিপেক্ষতা’ রক্ষার প্রশ্নে সিলেকটিভ হওয়া যায়। যেমনটা সিপিএমসহ বামপন্থীদের একটা অংশ এবার করেছে। অতীতেও করেছে একাধিকবার। বাংলায় কংগ্রেস এবং সিপিএমের হাত ধরাধরি নিয়ে মোদির কটাক্ষও যথার্থ—‘কংগ্রেসের কালো হাত সাদা হয়ে গেল কী করে—বামেরা তো একসময় এই হাতই ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার সংকল্প করেছিলেন!’ পিকচার আভি বাকি হ্যায়! ভোট যত এগিয়ে আসবে আরও অনেক পিকচার আমাদের সামনে আসবে। তার অনেকগুলিই আমাদের বহু চেনা। যেমন কিছু ঘরে নগদ টাকা, চাল, বিরিয়ানি, এমনকী বিলিতি মদের বোতলও পৌঁছে যাবে। কিছু ক্লাব এবং মস্তানকে হাত করার জন্যও পৌঁছে যাবে উপঢৌকন। এসব চলবে জনসেবার নামে। নির্বাচন কমিশনের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও চলে। সরকারি দেওয়াল, সরকারি খরচায় গাড়ি, প্রচারের সুযোগও নেয় অনেক শাসক দল। কমিশনের পর্যবেক্ষকদের একাংশের নামে অতীতে অন্যায় সরকারি আতিথ্য গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে, বারবার। ভোটে কারচুপির সব অভিযোগের নিরপেক্ষ নিষ্পত্তি হয়েছে, এমনটাও জোর দিয়ে বলতে পারবেন না কোনও কমিশন কর্তা? বরং সুবিধাপ্রাপ্ত কোনও কোনও রাজনৈতিক দল পার পেয়ে যায় কমিশন নামক গঙ্গাজলে আধগলা পর্যন্ত ডুবে নেয়ে এসে।
১৯৪৭-এর ১৪ আগস্ট কিরণশঙ্কর ঢাকা বিধানসভার বিরোধী দলনেতা নির্বাচিত হন। ১৯৪৮-এর ২৩ জানুয়ারি বিধানচন্দ্র রায় মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কিরণশঙ্করকে এই বাংলার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার আহ্বান জানান। মালদহের এক মুসলিম বিধায়ক ঢাকায় চলে যান। সেই শূন্যস্থানে কিরণশঙ্করকে মনোনীত করা হয়। কিন্তু মন্ত্রিপদ বাঁচাতে কিরণশঙ্করের ভোটে জিতে আসা জরুরি ছিল। উপনির্বাচনে দাঁড়ালেন। মালদহের তৎকালীন কালেক্টর (ডিএম) অশোক মিত্রের সঙ্গে দেখা করে বললেন, ‘আমাকে কোনওভাবে ফেভার করবেন না।’ সেকালে প্রার্থীদের গাড়ির তেল কালেক্টর মারফত নিতে হতো। চাহিদামতো তেল এবং অন্যান্য সুবিধে না-পেয়ে কিরণশঙ্করের ছেলে বেজায় খেপে যান। তিনি দেখা করে কালেক্টরকে হুমকি দেন। কড়া কালেক্টরও তাঁকে পাল্টা শুনিয়ে দেন, ‘পারলে যথাসাধ্য ক্ষতি করবেন আমার। কিন্তু আইনের নড়চড় হবে না।’ তেল না-পেয়ে এমন অবস্থা হয় যে কিরণশঙ্করের ডানহাত সৌরীন্দ্রমোহন মিশ্র গোরুর গাড়ি চেপে ভোটের কাজ করতে বাধ্য হন। তবু কংগ্রেস প্রার্থী কিরণশঙ্কর রায় জয়ী হন। এমএলএ হওয়ার পর কিরণশঙ্কর মালদহবাসীকে ধন্যবাদ জানাতে গিয়ে ডিএমের সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর প্রতি স্নেহ, সৌজন্যের বিন্দুমাত্র ঘাটতি না দেখে ডিএম অবাক হন। তিনি যেচে ডিএমের সঙ্গে খাওয়াদাওয়াও করেন। পুত্রের অভব্য আচরণের কথা পরে শুনে তিনি ব্যথিতই হয়েছেন বলে জানান। ছেলেকে কিরণশঙ্কর উপদেশ দেন, ‘তুমি কোন বংশের ছেলে ভুলে যেও না।’
ভাবতে অবাক লাগে, আজকের দিনে কোন প্রধানমন্ত্রী তাঁর দলের রাজ্য সরকারের কাজের নিন্দে করতে পারতেন! স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ছেলেকে কড়কে দেওয়ার হিম্মত আছে কোন ডিএমের! কোন মন্ত্রী একজন কড়া আমলার সরকারি দায়িত্বকর্তব্য পালনের সহায় হতে পারেন, যে-কর্তব্যপালনের ফল সরাসরি তাঁরই বিরুদ্ধে যাচ্ছে!