উচ্চবিদ্যার ক্ষেত্রে বাধার মধ্য দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ যোগ। ব্যবসায় যুক্ত হলে ... বিশদ
তারা থেকে থেকে গুজরাতের কথা তোলে। গুজরাত যদি আদর্শ হয়, তাহলে বাংলার যা গর্ব অর্থাৎ শিল্প ও সংস্কৃতি তা সত্যি গোল্লাতেই যাবে। কারণ রাজ্যের মোট জিডিপি বা রেভিনিউ-এর ৪ বা ৫ শতাংশ যেখানে শিক্ষার পিছনে ব্যয় করা উচিত, সেখানে তারা শিক্ষাখাতে মোটে ২ শতাংশ ব্যয় করে থাকে। এর ফলে গুজরাতের ৪৫ শতাংশ শ্রমিক এবং নিম্নবর্গের মানুষ ফিফথ স্ট্যান্ডার্ড পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পারে না, সমীক্ষা তাই বলছে। ফলে দেখা যাবে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে যেখানে বাঙালি বা তামিল বেশি, সেখানে গুজরাত থেকে কিছু নামীদামি ব্যবসায়ী হয়তো বেরিয়েছেন, কিন্তু কোনও বিজ্ঞান সংক্রান্ত গবেষণা সংস্থায় বা তথ্যপ্রযুক্তি দপ্তরের শীর্ষপদে সেই রাজ্যের কেউ নেই।
গুজরাতের স্কুল-সিলেবাসে বিজেপির তাত্ত্বিক নেতা দীননাথ বাটরার লেখা (গুজরাত ও হরিয়ানার স্কুলে বাটরা-র মোট ৯টি বই পড়ানো হয়) ‘তেজোময় ভারত’ বলে একটি সহায়ক-পুস্তক পড়ানো হয়, যাতে লেখা আছে ভারতে টেলিভিশনের প্রচলন ছিল মহাভারতের সময় থেকে, বৈদিক যুগ থেকেই নাকি ভারতে মোটরগাড়ি চলত, স্টেম সেল রিসার্চের শুরু প্রাচীন ভারতে! গান্ধারী ও ধৃতরাষ্ট্রের দুর্যোধনসমেত যে শতপুত্রের কলসি থেকে জন্ম, তার উৎস নাকি ওই ‘স্টেম সেল’। এছাড়াও ত্রিপুরার বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব বলেছেন, কয়েক হাজার বছর আগে ভারতেই প্রথম ইন্টারনেট আবিষ্কৃত হয়। তাছাড়া ২০১৯ সালের বিজ্ঞান কংগ্রেসে দাবি করা হয়েছে ভারতে ডাইনোসরের আবিষ্কারক স্বয়ং পিতামহ ব্রহ্মা এবং সেই ডাইনোসরের নাম হল রাজাসোরাস। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের গোরুর দুধে সোনা খুঁজে পাওয়ার কথা নিয়ে বিরাট হাসাহাসি ও চর্চা হল। সেই আশ্চর্য আবিষ্কারের পেটেন্ট কিন্তু শ্রী ঘোষের নয়। সেই ২০১৬ সালে গুজরাতের জুনাগড়ে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা গো-এষণা করে এই অবৈজ্ঞানিক তথ্য দিয়ে বলেন গোরুর প্রতি লিটার মূত্র থেকে ৩-১০ মিলিগ্রাম সোনা পাওয়া যায়। আর ভোরবেলা বাছুরের মূত্রে নাকি সোনার পরিমাণ আরও বেশি। দেশের স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন আইনস্টাইনের বিখ্যাত আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্ব বা E= mc2 পাওয়া যাবে বেদে এবং শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন ডারউইনের বিবর্তনবাদ ভ্রান্ত, কারণ প্রাচীন শাস্ত্রে কোথাও কেউ লিখে যাননি বাঁদর থেকে মানুষের উৎপত্তি হয়েছে। এছাড়াও গুজরাতে দশম শ্রেণির পড়ুয়াদের সিলেবাসে জার্মানির নাৎসি-নেতা হিটলারের ব্যাপক গুণগান করে লেখা হয়েছে, তিনি দেশে নয়া অর্থনৈতিক নীতি নেন, জার্মানিতে এক সম্পন্নতা এনেছিলেন, দেশে বেকারত্ব নির্মূল করার চেষ্টা করেন ইত্যাদি ইত্যাদি।
‘বিদ্যাভারতী চিন্তন কি দিশা’ বলে আরেকটি স্কুলপাঠ্য বইতে লেখা হয়েছে, কমপিউটারের পক্ষে সবচেয়ে কার্যকরী ভাষা হল সংস্কৃত (যা হয়তো পরে হিন্দিতে রূপান্তরিত হবে)। প্রাচীন যোগবিদ্যা বলছে মানুষের দেহে রক্তবাহক নালী আছে ৭২ হাজার, তাছাড়া পিপুল ও তুলসী গাছ একমাত্র উদ্ভিদ যারা রাত্রে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত করে না বরং অক্সিজেন তৈরি করে। প্রাচীন ভারতে সমস্ত নদীতে প্রবাহিত হতো পবিত্র দুধ ইত্যাদি ইত্যাদি। অজস্র উদাহরণ। ফলে আজকে যাঁরা রবীন্দ্রনাথের জন্ম বোলপুরে বা বিভূতিভূষণের নামের আগে ‘উপনিবেশিক’ শুনে আঁতকে উঠছেন, তাঁরা জেনে রাখুন বিজেপি যদি সত্যিই এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসে, তাহলে হয়তো আর ‘ব্রাহ্ম’ রবীন্দ্রনাথ-এর ‘সহজ পাঠ’ থাকবে না বা ইংরেজি অর্থাৎ বিদেশি ভাষায় শিক্ষিত বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ স্কুল সিলেবাস থেকে নিষিদ্ধ হবে।
‘তেজোময় বাংলা’ বলে হয়তো নতুন কোনও বই ঢুকবে বাংলার স্কুলে, যেখানে ‘বঙ্গোপসাগর’ নামটি ‘বঙ্গ’ থাকার অপরাধে মুছে দেওয়া হবে (গুজরাতে একটি স্কুলপাঠ্য বইতে বঙ্গোপসাগর নামকে বদলে ‘গঙ্গাসাগর’ রাখার কথা বলা হয়েছে), শিক্ষকদিবস পালিত হবে কোনও সাধুর জন্মদিনে, শিশুদিবস পালিত হবে লব বা কুশের কোনও কাল্পনিক জন্মদিনে। চিকিৎসাশাস্ত্র নিষিদ্ধ হয়ে তার বদলে আসবে কোনও বিরিঞ্চিবাবার আয়ুর্বেদ বটিকা। রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়তো গাওয়া নিষিদ্ধ হবে, নিষিদ্ধ হবে থিয়েটার থেকে কবিতা থেকে সাহিত্য সবকিছু। এমন এক সেনসরশিপ শুরু হবে, যা অ-দৃষ্টপূর্ব। সাধু সাবধান। বিজেপি কিন্তু একান্তভাবেই বাংলা ও বাঙালি বিরোধী।
লেখক রাজ্যের মন্ত্রী, মতামত ব্যক্তিগত