মৃত্যু না হলে বিশ্বাস নেই। মৃত্যু পর্যন্ত ঠিক থাকতে পারলে তবেই বাঁচোয়া। মানুষ মনে করে, ‘আমি ঠিক থাকব, পবিত্র থাকব’ কিন্তু মহামায়ার এমনি মায়া যে, হয়তো সব গুলিয়ে দিলে। কখন যে বদ-মায়া চেলে দিয়েছে জানতেই পারেনি। তাঁর দয়া ছাড়া এ মায়ার হাত হতে নিস্তার নেই। তিনি যাকে বাঁচিয়ে রাখেন—পবিত্র রাখেন, সেই থাকতে পারে। যার সংসারে কেউ নেই, কিছু নেই, সে তো ভগবানকে ডাকবেই। তা ছাড়া আর কি করবে? কিন্তু যার সবই আছে—ধন, জন, সুখ-ঐশ্বর্যের অভাব নেই, সে যদি ভগবানের জন্য ব্যস্ত হয় তো তার বাহাদুরি বলতে হবে। ঠাকুর বলতেন, ‘যার কেউ নেই সে একটা বেড়াল পুষবে, আর তাকে নিয়েই দিন-রাত ব্যস্ত।’ দেখ একবার মায়ার খেলা! ইচ্ছা করলেই তো ভগবানকে ডাকতে পারে, কিন্তু তার সে ইচ্ছাই হয় না। এমনি মায়ার প্রভাব! তাঁর কৃপা না হলে, এ মায়ার হাত হতে নিস্তার পাবার উপায় নেই। তাঁর মায়া—তিনি ইচ্ছা করলেই সরিয়ে দিতে পারেন। এর হাত হতে নিস্তার পাবার জন্য তাঁর কাছে প্রার্থনা করতে হয়, তা ছাড়া আর উপায় নেই। শ্রীকৃষ্ণ বিদুরের বাড়ীতে গেলেন। বিদুর খুব স্তব-স্তুতি করতে লাগলো। শ্রীকৃষ্ণ বললেন—‘স্তবস্তুতি করো, কিন্তু এখন উপস্থিত কিছু খাওয়াও।’ তিনি দুর্যোধনের রাজভোগ ত্যাগ করে বিদুরের ‘খুদ’ সেবা করলেন। —তাঁর অপার দয়া। বিদুর ভিক্ষে করে এনে তাই তাঁকে নিবেদন করে খেত। কথায় বলে—বিদুরের খুদ-গুঁড়ো। শ্রীকৃষ্ণ বিদুরের সংশয় দূর করে বলেছিলেন—‘আমি ভগবান।’ তিনি জীবের শিক্ষার জন্য রাজ-অন্ন না খেয়ে ভিক্ষার অন্ন খেলেন। দেখিয়ে দিলেন—ভক্তি করে যে যা দেয় ভগবান তা গ্রহণ করেন। বিদুরের মত ভক্ত পাওয়া কঠিন। ঠিক ঠিক ডাকলে ভগবান নিশ্চয়ই বুঝিয়ে দেন। তিনি বুঝাতে বাধ্য। তিনি যদি জীবকে না দেন তো জীবের সাধ্য কি যে তাঁকে বুঝে। তিনি মান বুদ্ধির অগম্য। তাঁকে ডাকলে তিনি দয়া করে নিজেকে প্রকাশিত করেন। সে তাঁর দয়া বই তো নয়। ভগবান ভক্তের প্রার্থনা শুনেন। সরলভাবে ডাকলেই তিনি শুনেন, মনে গোল থাকলে শুনেন না। মানুষের কাছে কপটতা করে পার পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু তিনি হচ্ছেন অন্তর্যামী। তাঁর কাছে ও সব গোপন করা যায় না। কপট-ভাব ত্যাগ করে সরলভাবে তাঁর শরণ নিলে তিনি দয়া করেন।
কি ধর্মের ঢেউই উঠেছিল! এখানে মুক্তি-ফৌজের দল লেকচার দিচ্ছে, ওখানে ব্রাহ্মসমাজের দল বক্তৃতা করছে, সেখানে চৈতন্যের দল কীর্তন লাগিয়েছে, আর এদিকে পরমহংসদেবের দল জমে উঠেছে। আজ কেশব সেনের বক্তৃতা—লোকে লোকারণ্য; কাল বিডন গার্ডেনে কালী খ্রীষ্টানের লেকচার, পরশু কৃষ্ণানন্দ পরিব্রাজকের বক্তৃতা—লোক আর ধরে না। আবার শশধর তর্ক-চূড়ামণির শাস্ত্র-ব্যাখ্যা; বুথ সাহেব, অলকট সাহেব—এ রকম কত যে সে সময় এসেছিলেন, কত যে সভা, বক্তৃতা হতো তার ইতি নেই। ছেলে, বুড়ো, যুবা সকলের মধ্যেই ধর্ম নিয়ে কথাবার্তা, তর্ক-ঝগড়া—বাড়ীতে, আফিসে, রাস্তায় সে এক ব্যাপার চলেছিল। সে ধর্মের বন্যায় সব দিক ভাসিয়ে দিলে। সে যে কি ব্যাপার তা তোমাদের কি করে বুঝাব? কিন্তু, দেখ, ভগবানের চক্র। সে সব দলটল কোথায় সব মিলিয়ে যাচ্ছে; আর তাদের তেমন জোর দেখা যাচ্ছে না। আর পরমহংসদেবের দল—যাদের তখন কেউ জানতই না, এখন একেবারে পৃথিবী ছেয়ে ফেলছে।
স্বামী সিদ্ধানন্দ-সংগৃহীত ‘সৎকথা’থেকে