ঠাকুর বলিলেন—“দেখ, সাধন-ভজনের যে কার কতদূর দৌড়, তা আমার জানা আছে। আমি যে সামান্য জপ-ধ্যানটুকু দিয়েছি, তা-ই অনেকে করে না, অথচ মুখে সাধন-ভজনের বড় বড় বুলি। এই ধর না কেন, আমি নিয়ম ক’রে দিয়েছি আশ্রম মঠে প্রত্যেককেই সকাল-সন্ধ্যা স্তোত্র-কীর্ত্তনে যোগদান করতে হবে, কেন না আমি জানি বর্ত্তমান যুগে দুর্বল অধিকারীর পক্ষে প্রার্থনার মত এত বড় সহজ সাধনপন্থা আর কিছুই নেই। অথচ দেখি, অনেক বড় বড় পণ্ডিতও এতে যোগদান করে না, কাজেই তাদের শক্তির স্ফুরণ হবে কেমন ক’রে, ভাবের বিকাশ হবে কেমন ক’রে? গুরুনির্দ্দিষ্ট পন্থায় না চ’লে স্বেচ্ছাচারিতা ক’রে, কেউ কোন দিন সত্যলাভ করেছে? সহজ সরল অনাড়ম্বর সাধন-ভজনে যাদের নিষ্ঠা নেই, তারা বড় বড় সাধন করতে যায় কোন সাহসে? বড় বড় বই প’ড়ে কতকগুলি আধ্যাত্মিক পরিভাষার জ্ঞান হলেই হয় না, তাদের নিজের জীবনে ফুটিয়ে তুলতে হবে। নিজেই যদি নিজের ডাক্তারী কর, তবে আবার পৃথক্ ডাক্তারের প্রয়োজন কি? নিজের অভাব কি? দৈন্য কি, তা গুরুর কাছে জানাতে হয়, তিনি অবস্থা বুঝে তার ব্যবস্থা করেন, নতুবা নিজের ব্যবস্থা নিজে করতে গেলে পদে-পদে প্রতারিত ও বিড়ম্বিত হতে হয়। আমি ত তোমাদের বরাবরই ব’লেছি, সত্যলাভের দু’টী চিরন্তন পন্থা, একটি কঠোর সন্ন্যাসযোগ, অপরটি ব্রহ্মবিদ্ গুরুর সেবা। কঠোর সন্ন্যাসযোগের সাধনা বর্ত্তমান যুগের মানুষের পক্ষে কঠিন ব’লে আমি তোমাদের সেবার পন্থাই নির্বাচন ক’রে দিয়েছি; সন্ন্যাসলক্ষ্য যে ব্রহ্মজ্ঞান, এর দ্বারাই তা তোমাদের লাভ হবে—এর জন্মে আর কৃচ্ছ্র সাধন-ভজনের প্রয়োজন নেই। তবে যদি বল, ঠাকুর তবে এত কৃচ্ছ্র সাধন-ভজন করলেন কেন? তার উত্তরে বলি, ঠাকুর এত সাধন-ভজন করেছেন ব’লেই তোমাদের আর পৃথক্ভাবে সাধন-ভজন কর্তে হবে না, ঠাকুরের সাধন-ভজনে তোমাদেরও সাধন-ভজন হয়ে যাবে। যে যাকে ভালবাসে, ভজনা করে, তার মধ্যে তার গুণরাজি অলক্ষ্যে সংক্রামিত হয় তা জান কি? এ একেবারে বৈজ্ঞানিক সত্য! সেই হিসাবে তোমরা যদি আমাকে ভালবাস, আমার ভজনা কর, আমার প্রীত্যর্থে আমার উদ্দেশ্যে কর্ম্ম ক’রে যাও, তাহলে আমার সমস্ত গুণরাজি, সমস্ত সাধন-ভজনের ফল তোমাদের মধ্যে সংক্রামিত হবে। এইজন্যেই আমি পূর্বাপর তোমাদের বলে আস্ছি, তোমরা আমার এপারের কর্ম্মের ভার নাও, আমি তোমাদের ওপারের ভার নিলাম। এত সাধন-ভজন ক’রে ঠাকুরের যে গতি, বিনা সাধন-ভজনে তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ ক’রে তাঁর আদেশ প্রতিপালন ক’রে তোমাদেরও সে গতি!
“আমার এত আশ্বাস-বাণী সত্ত্বেও যাদের প্রাণে সাধন-ভজনের প্রবল পিপাসা জেগে উঠবে, তারা বেশ যাও না, ঐকান্তিক দৃঢ়তার সঙ্গে সাধন-ভজনে লেগে যাও। কিন্তু আমি জানি অভিমানবশে বা উত্তেজনার আবেগে সাধন-ভজনে প্রবৃত্ত হলে তাতে ফল মোটেই হয় না। গুরুনির্দ্দিষ্ট পন্থা ছেড়ে দিয়ে দম্ভাহঙ্কারযুক্ত চিত্ত নিয়ে কেউ কোনদিন সাধন-ভজনে সুফল লাভ কর্তে পারেনি। গুরুর বিরুদ্ধাচরণ কর্লে সমগ্র বিশ্বপ্রকৃতি তাকে এমনভাবে বাধা দেয় যে, তার অগ্রগতি চিরতরে রুদ্ধ হয়ে যায়। আর দুরন্ত প্রারদ্ধ কাকে কোন্ পথে টেনে নেয় তার ঠিক কি? আজ হয়তো উত্তেজনা এবং অভিমানের বশে সাধন-ভজন ক’রে কিছুদূর ধাঁক ধাঁক করে উঠে গেলে, কিন্তু পরমুহূর্ত্তেই এমন বাধা এমন অন্তরায় এসে উপস্থিত হল যে মুহূর্ত্তের মাঝে কোথায় তলিয়ে গেলে তার স্থিরতা নেই। এইজন্যে সাধনভজনের পথে আত্মাভিমান এবং অহঙ্কার সাধকের প্রবল পরিপন্থী। শুধু অধ্যাত্মজগতেই বলি কেন, সাধারণ জগতেও দেখি, আত্মাভিমানপ্রসূত কার্য্যের ফল বেশীদিন স্থায়ী হয় না। টাইটেনিক জাহাজ নির্ম্মাণ ক’রে ব্রিটিশ জাতি মনে কর্লেন, এমন জাহাজ আর কেউ নির্ম্মাণ কর্তে পারেনি। তাঁরা স্পষ্টভাবে ঘোষণা করলেন, একটা শোলা বরং জলে ডুব্লে ডুব্তেও পারে, কিন্তু এর নিমজ্জন অসম্ভব! কিন্তু ভগবান্ তাঁদের এ অহঙ্কার রাখ্লেন না, প্রথম যাত্রায়ই তাঁদের সমগ্র অভিমানকে বিচূর্ণিত ক’রে সে জাহাজ নিমজ্জিত হল। অভিমানবশে সাধন-ভজনের দশাও ঐরূপ হয়।”
‘শ্রীশ্রীনিগমানন্দ উপদেশামৃত’ থেকে