মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
লোকসভা আর বিধানসভা নির্বাচন মোটেই এক নয়। দুই ভোটের প্রেক্ষিত আলাদা। সেটাও আর একবার প্রমাণ করল দিল্লির নির্বাচন। মাত্র সাত মাস আগে লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে ‘সাতে সাত’ রেজাল্ট করে চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ। বিধানসভার নিরিখে রাজধানীতে ৭০টির মধ্যে ৬৫টি আসনেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। বাকি পাঁচটিতে এগিয়েছিল কংগ্রেস। সবাই ভেবেছিল, ২০১২ সালে ভারতীয় রাজনীতিতে ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব হওয়া অরবিন্দ কেজরিওয়ালের রাজনীতির বুঝি এখানেই শেষ। বিধাতা তখন নিশ্চয় আড়াল থেকে মুচকি হেসেছিলেন। কারণ ইতিহাসই সাক্ষী, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু হয় না। আর কেজরিওয়াল কোনও অবস্থাতেই দেশের প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার ছিলেন না। তাই মোদিকে দু’হাত তুলে লোকসভায় আশীর্বাদ করা দিল্লির জনগণই বিধানসভায় দান উল্টে দিলেন। গোটা ঘটনাটা ঘটল লোকসভা ভোটের মাত্র সাত মাসের মধ্যে। গত সপ্তাহের বিধানসভার ভোটে পুরো হিসেবটাই উল্টে দিয়েছেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। জয়ের হ্যাটট্রিক করে আবার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হচ্ছেন তিনি। তাঁর জন্য রামলীলা ময়দানের শপথমঞ্চও আজ প্রস্তুত।
২০১৫-র ঐতিহাসিক জয়ের পর আবার তিনি ৭০টি আসনের মধ্যে সিংহভাগের দখল নিয়ে দিল্লির রাজ্যপাট সামলানোর ছাড়পত্র আদায় করে নিয়েছেন। আগের বার তাঁর আপ পেয়েছিল ৬৭টি আসন। আর এবার তাঁদের দখলে আগের বারের চেয়ে ৫টি আসন কম—৬২টি। পাঁচ বছরের ব্যবধানে খোদ দেশের রাজধানীতে যাবতীয় প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে আপ-এর এই সাফল্য নিঃসন্দেহে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে মোদি-অমিত শাহের সর্বগ্রাসী রাজনীতিতে বিরোধীরা যখন দিশাহারা, তখন একক ক্ষমতায় কেজরিওয়ালের এই সাফল্য নিঃসন্দেহে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। একইসঙ্গে এই ফল আসন্ন বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন সম্পর্কেও নিঃসন্দেহে একটা গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত দিচ্ছে। সেই দিক দিয়ে ওই দুই রাজ্যের আসন্ন নির্বাচন নরেন্দ্র মোদি নামক এক মিথের অগ্নিপরীক্ষা।
প্রথমেই আসি বিহারের কথায়। এবার বিহারের রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা অভিনব। পশুখাদ্য কেলেঙ্কারি মামলায় লালুপ্রসাদ যাদব জেলে। তাঁর দুই পুত্র দুই মেরুর বাসিন্দা। ফলে লালু-রাবড়ির পরিবার কার্যত ছন্নছাড়া অবস্থায়। বিহারে কংগ্রেসের অবস্থাও তথৈবচ। এই পরিস্থিতিতে নীতীশ কুমারের জেডিইউ এবং বিজেপিই বিহারের প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। বিহারের বিজেপিকে ধাক্কা দিতে পারেন একমাত্র নীতীশ কুমারই। বলা বাহুল্য, দিল্লির অভাবনীয় ফলাফলের পর বিহারে বিজেপির সঙ্গে দর কষাকষির ক্ষমতাও কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে নীতীশের। একের পর এক রাজ্য হাতছাড়া হওয়ার প্রেক্ষিতে বিজেপির পক্ষে এখন কোনও অবস্থাতেই যে নীতীশকে ঝেড়ে ফেলা সম্ভব নয়, তা জেডিইউ নেতৃত্ব বিলক্ষণ জেনে গিয়েছে। তাই নীতীশের যে কোনও শর্তই অমিত শাহরা আপাতত মেনে নিতে বাধ্য। অন্যথায় বিহারও গেরুয়া শিবিরের হাতছাড়া হয়ে যাবে। তাই সব ফেলে বিরোধীদের কৌশল হবে যে কোনও মূল্যে বিজেপির সঙ্গে নীতীশের দূরত্ব তৈরি করা। আগামী কয়েকমাস তাই বিহারের রাজনীতির এই টানাপোড়েন জাতীয় রাজনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠতে চলেছে।
কিন্তু, এই মুহূর্তে সব ছাপিয়ে বিজেপি নেতৃত্বের কাছে বৃহত্তম চ্যালেঞ্জ পশ্চিমবঙ্গে মা-মাটি-মানুষের নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে তুল্যমূল্য লড়াই গড়ে তোলা। তার জন্য টাকাপয়সা, পেশিশক্তির ব্যবহার ইতিমধ্যেই বাড়াতে শুরু করেছে বিজেপি নেতৃত্ব। ত্রিপুরায় বামপন্থীদের রাজ্যপাট খতম করতে বিগত নির্বাচনে অর্থ ও পেশি শক্তির মরিয়া ব্যবহার দেখেছে দেশ। গত লোকসভা ভোটে পশ্চিমবঙ্গেও তার অন্যথা হয়নি। গ্রামেগঞ্জে আছড়ে পড়েছে মোদির প্রচার। উড়েছে টাকা। সেই সুবাদেই রাজ্যের ১৮টি লোকসভা আসনে জিতে তৃণমূলকে সে যাত্রায় বড় ধাক্কা দিয়েছিল নরেন্দ্র মোদির দল। লোকসভা ভোটের ফলের নিরিখে ১২৬টি বিধানসভা আসনে গেরুয়া দলের লিড রয়েছে। কিন্তু, তারপরই অহঙ্কার আর গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ হয়ে জেলায় জেলায় অনেকটাই মাটি হারিয়েছে বিজেপি। তার উপর দোসর হয়েছে এনআরসি। গত দু’মাসে এনআরসির চাপে মানুষ গেরুয়া দলের থেকে অনেকটাই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়েছে। নিজদেশে পরবাসী হওয়ার তীব্র আতঙ্ক এখনও সীমান্ত লাগোয়া জেলার মানুষজনের মনে চেপে বসে আছে। দিল্লির মতোই এই বঙ্গেও গত সাত মাসে গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। যে উত্তরবঙ্গে বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে বড় সাফল্য পেয়েছিল সেখানেই এনআরসি, এনপিআর ও সিএএ-র সাঁড়াশি আক্রমণে মানুষ দিশাহারা। ফলে আস্থা-বিশ্বাস নিমেষে বদলে গিয়েছে আক্রোশে। সদ্য সমাপ্ত উপনির্বাচনে বিজেপিকে হারিয়ে সেই প্রতিশোধ ইতিমধ্যেই কড়ায়গণ্ডায় তুলে নেওয়া শুরু করেছে উত্তরবঙ্গের মানুষ। উত্তরবঙ্গ এবং রাজ্যের সীমান্তবর্তী জেলাগুলিতে এনআরসি আচমকাই বড় ইস্যু হয়ে বিজেপির জনভিত্তিকেই ধ্বংস করতে উদ্যত। নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহের পক্ষে উচিত হবে এনআরসি ও সিএএ প্রত্যাহারের কথা অবিলম্বে ঘোষণা করা। তা না হলে গেরুয়া শিবিরের এই বিদ্বেষ ও বিভাজনের রাজনীতি জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ফুৎকারে উড়ে যেতে বাধ্য।
কেজরিওয়াল দেখিয়ে দিয়েছেন, তথাকথিত রাজনীতির বাইরে গিয়েও জনগণের মন কীভাবে জিততে হয়। মহল্লা ক্লিনিক, মহিলাদের জন্য বিনা পয়সায় বাসে চলাচলের সুবিধা, বস্তির ভিতরেও বিশ্বমানের স্কুল স্থাপন, গরিবদের জন্য বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ ও পানীয় জল প্রভৃতি আম আদমির প্রয়োজনীয় পরিষেবা পৌঁছে দিয়ে তিনি গোটা দিল্লির মন জয় করেছেন। কেজরিওয়ালের এই সদর্থক ভূমিকার জন্যই বিজেপির তথাকথিত ‘ওস্তাদের মার’ও এ যাত্রায় মাঠেই মারা গেল! শেষ মুহূর্তে কলোনিগুলির নিঃশর্ত মালিকানা প্রদান করেও বিশেষ লাভ হল না মোদির। আজীবন লড়াই করে আসা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জনগণের মন বোঝার দৌড়ে কেজরিওয়ালের চেয়েও যে অনেক এগিয়ে, তা বলা মোটেই অতিশয়োক্তি হবে না। বাংলার অগ্নিকন্যার লড়াই ও সংগ্রামের ইতিহাসও আরও বিস্তৃত। সিপিএম নামক এক ভয়ঙ্কর সাংগঠনিক শক্তির দলকে তিনি খড়কুটোর মতো উড়িয়ে দিতে পেরেছেন শুধুমাত্র প্রবল সাহস আর ইচ্ছাশক্তির জোরে। প্রায় একদশক আগের পরিবর্তনের সেই কাণ্ডারী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ই আজ এরাজ্যের সফল প্রশাসক, সবার আস্থা ও ভরসার জায়গা। গত প্রায় ন’বছরে তৃণমূল নেত্রী রাজ্যের সর্বস্তরের গরিব খেটেখাওয়া সাধারণ মানুষের জন্যে একের পর এক কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন—কখনও কন্যাশ্রী, কখনও যুবশ্রী, রূপশ্রী, সবুজসাথী, খাদ্যসাথী, স্বাস্থ্যসাথী প্রভৃতি। স্কুলের ছেলেমেয়েদের দেওয়া হয়েছে সাইকেল, বইখাতা, স্কলারশিপ-সহ অনেক কিছু। বিভাজন নয়, বিদ্বেষ নয়, তাঁর এই জনমুখী রাজনীতিই আজ এরাজ্যের প্রধান চালিকাশক্তি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল, সর্বদা তিনি মানুষকে সঙ্গে নিয়ে মানুষের জন্য রাজনীতিটা করেন। আর এই তাড়না থেকেই অবহেলিত উত্তরবঙ্গে তিনি যেমন বার বার ছুটে গিয়েছেন, তেমনি জঙ্গলমহলেও গরিব পরিবারগুলিকে ২ টাকা কেজি দরে চাল দেওয়ার যুগান্তকারী পদক্ষেপ করেছেন। গ্রাম ও গরিবের দিকে তাকানোর পরিণামে শহর-নগরও কোনওভাবে অবহেলিত হয়নি তাঁর সরকারের আমলে। তার বড় প্রমাণ কলকাতা। কলকাতা তাঁর আমলে যেভাবে সেজে উঠেছে তা অভূতপূর্ব। সবচেয়ে বড় কথা, বাঙালির আবেগ, বাঙালির মনন ও সংস্কৃতির সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের যোগ যতটা নিবিড়, বিরোধীপক্ষের আর একজনও নেতানেত্রীরই তা নেই। রাজ্যে পুরভোট আসন্ন। তার এক বছরের মধ্যেই বিধানসভা ভোটের ঢাকে কাঠি পড়বে। কার্যত পুর ও বিধানসভার ভোটকে কেন্দ্র করে বাংলা এক বিরাট লড়াইয়ের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বলতে দ্বিধা নেই, এখনও পর্যন্ত এই যুদ্ধে অনেক এগিয়ে মা মাটি মানুষের নেত্রী। ২০১১, ২০১৬ এবং ২০২১ পরপর তিনবার। বাংলার অগ্নিকন্যার সেই অনবদ্য হ্যাটট্রিক দেখার জন্যই প্রহর গুনছে রাজ্যের মানুষ।