মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
রাজস্ব-শৃঙ্খলার প্রথম শর্ত হল, গোল্ডেন রুল। অর্থাৎ রাজস্ব ঘাটতি (রেভিনিউ ডেফিসিট) শূন্য বা উদ্বৃত্ত সৃষ্টিই হল গোল্ডেন রুলের মূল কথা। মোদ্দা কথা হল, রাজস্ব খাতে কোনও ঘাটতি চলবে না। এই বাজেটে এটা কতটুকু আনা গেল এবার সেটাই দেখা যাক।
এই বাজেট থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের প্রকৃত রাজস্ব ও মূলধনী খাতের সমস্ত হিসেব পাওয়া গিয়েছে। এ থেকে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষের সংশোধিত বাজেটে রাজস্ব ঘাটতি ধরা হয়েছিল ৭,৫২৪ কোটি টাকা, যা ওই বছরের পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপির (গ্রস স্টেট ডোমেস্টিক প্রোডাক্ট) ০.৬ শতাংশ (রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী)। বাস্তবে এটা দাঁড়িয়েছে ১০,৩৯৮ কোটি টাকা, যা ওই বছরের জিএসডিপির ০.৯ শতাংশ। ফলে, আগের তুলনায় রাজস্ব-শৃঙ্খলার অগ্রগতি ঘটেছে বলা যায়। ওই বছর রাজকোষ ঘাটতি (ফিসকাল ডেফিসিট) ধরা হয়েছিল ৩২,৪৯৭ কোটি টাকা। বাজেট তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, এটাও ২ হাজার কোটি টাকা বাড়ছে। ওই বছর মূলধনী ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৪,৪১২ কোটি টাকা। প্রকৃত মূলধনী ব্যয় দাঁড়িয়েছে ২৩,৭১৩ কোটি টাকা। ফলে, ২০১৮-১৯ অর্থবর্ষে যথেষ্ট রাজস্ব-শৃঙ্খলা অর্জন করা গিয়েছে, এটা সংশয়াতীত ভাবেই বলা যায়। এছাড়াও, রাজস্ব আদায় করা গিয়েছে লক্ষ্যমাত্রার প্রায় সমান। বাজেটে ধরা হয়েছিল প্রায় ১.৪৭ লক্ষ কোটি টাকা। প্রকৃত পক্ষে আদায় প্রায় ১.৪৬ লক্ষ কোটি টাকা। সুতরাং রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও অনুরূপ সাফল্য সরকার দাবি করতে পারে।
এবার চলতি বছরের (২০১৯-২০) প্রেক্ষাপটে আসা যাক। চলতি বছরেও পশ্চিমবঙ্গ সরকার রাজস্ব-শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রশংসার দাবি করতে পারে। প্রথমে রাজস্ব আয়ের প্রসঙ্গে আসা যাক। বাজেটে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছিল ১,৬৪,৩২৭ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটি ধরা হয়েছে ১,৬৩,২৫৯ কোটি টাকা। মোদ্দা কথা, রাজস্ব আদায় অপরিবর্তিত থাকছে। রাজস্ব ঘাটতি যদিও শূন্য ধরা হয়েছিল, সংশোধিত বাজেটে এটা দাঁড়াচ্ছে ৬,১৭১ কোটি টাকা। এটা চলতি বছরের জিডিপির ০.৫ শতাংশ। গত বছরের থেকে এটা কম। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বাম আমলের শেষ বছরে (২০১০-১১) রাজস্ব ঘাটতি ছিল ওই বছরের জিএসডিপির ৩.৬ শতাংশ। ফলে, এক্ষেত্রেও যে যথেষ্ট অগ্রগতি ঘটেছে, এটাও সরকার অবশ্যই দাবি করতে পারে। রাজকোষ ঘাটতি হ্রাসের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বাজেটে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ ধরা হয়েছিল ২৭,২৫৪ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে এটা প্রায় ৬ হাজার কোটি টাকা। জিডিপির হিসাবে রাজকোষ ঘাটতি ধরা হয়েছিল ২ শতাংশ। সংশোধিত বাজেটে সংখ্যাটি দাঁড়াচ্ছে ২.৪ শতাংশ। মূলধনী ব্যয় মোটামুটি অপরিবর্তিত রাখা গিয়েছে। ধরা হয়েছিল ২৬,৬৬৯ কোটি টাকা। সংশোধিত বাজেটে সংখ্যাটি হয়েছে ২৬,৮৭০ কোটি টাকা। তাই সার্বিকভাবে চলতি বছরে যে রাজস্ব-শৃঙ্খলার কিছুটা অগ্রগতি ঘটেছে একথা বলাই যায়।
এবার আগামী বছরের (২০২০-২১) বাজেট প্রসঙ্গ। এই বাজেটে মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ২,৫৫,৬৭৭ কোটি টাকা। চলতি অর্থবর্ষে বাজেটে অনুমিত ব্যয়ের থেকে প্রায় ৩৯ হাজার কোটি টাকা বেশি। চলতি বছরের তুলনায় আগামী বছরের মোট ব্যয় বৃদ্ধির অনুপাত ১৮ শতাংশ। রাজস্ব খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১,৭৯,৩৯৮ টাকা। চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বৃদ্ধির অনুপাত প্রায় ৬ শতাংশ। রাজস্ব আদায় চলতি বছরের সংশোধিত বাজেটের তুলনায় প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা বেশি ধরা হয়েছে। সংশোধিত বাজেটে আদায় ধরা হয়েছে ১.৬৩ লক্ষ কোটি টাকা। আগামী বছরে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ১.৭৯ লক্ষ কোটি টাকা। এই বৃদ্ধির হারটিও প্রায় ৬ শতাংশ। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, এই লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন করা সম্ভব।
নিজস্ব কর আদায়ের ক্ষেত্রে গত কয়েকটি বছরে যথেষ্ট সাফল্য আমরা দেখেছি। তথ্য থেকে স্পষ্ট, নিজস্ব কর রাজস্বের প্রায় ৬০ শতাংশ আসে জিএসটি থেকে এবং বাকিটা আসে রাজ্যের অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল, আবগারি কর সংগ্রহ বৃদ্ধি। ২০১৫-১৬ সালে যেখানে ৪ হাজার কোটি টাকার মতো আদায় হয়েছিল, চলতি বছরে সেখানে আদায় করা গিয়েছে ১২ হাজার কোটি টাকার মতো। এটা নিজস্ব কর রাজস্বের প্রায় ১৮ শতাংশ। জিএসটি চালু হওয়ার পর বিক্রয় কর আদায় যথেষ্ট কমলেও, জিএসটি বাদে রাজ্যের বিক্রয় কর আদায় হয়েছে নিজস্ব কর রাজস্ব আদায়ের প্রায় ১১ শতাংশ। এরপর স্ট্যাম্প ডিউটি এবং রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ আদায়ের পরিমাণ নিজস্ব কর রাজস্ব আদায়ের প্রায় ৯ শতাংশ। মোটামুটি বাজেটের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, রাজস্ব আদায় মোটামুটি অপরিবর্তিত রয়েছে। এটা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
ঋণ নিঃসন্দেহে এক বড় সমস্যা। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-র ৩১ মার্চ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে মোট ঋণের পরিমাণ ৪.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা। এটা পশ্চিমবঙ্গের জিএসডিপির ৩২.৬ শতাংশ। মোট ঋণ উত্তরপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রে আরও বেশি। উত্তরপ্রদেশে মোট ঋণ ৬.০২ লক্ষ কোটি টাকা, যা ওই রাজ্যের জিএসডিপির ৩৮.১ শতাংশ। পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে ঋণ ৩৯.৯ শতাংশ। ঋণ মূলধনী খাতে ব্যয়িত হলে এটা তেমন ক্ষতিকর নয়। কারণ, এই ঋণ সম্পদ সৃষ্টিতে ব্যয় হয়, যা পরবর্তী বছরগুলিতে আরও সম্পদ সৃষ্টি করে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, রাজস্ব ঘাটতি উল্লেখযোগ্য হারে কমছে। এটা পুরো শূন্যে নামিয়ে আনাই সরকারের মূল লক্ষ্য। দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে ঋণ নিচ্ছে তার সিংহভাগটাই ব্যয় হচ্ছে মূলধনী খাতে। ২০১৭-১৮, ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে দেখা যাচ্ছে, মোট ঋণের ৭০-৭৫ শতাংশ অর্থ মূলধনী খাতে ব্যয় হচ্ছে। তবে, এটা সত্য যে অতীতের ঋণের বোঝা ক্রমশ বাড়ছে। এবারে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রকে ঋণ বাবদ পরিশোধ করতে হবে। রাজ্যের ঘাড়ে এই বিশাল ঋণের বোঝা লাঘব করার বিষয়ে কেন্দ্রকেও আন্তরিকভাবে ভাবতে হবে।
এবারের বাজেটে বেশকিছু জনমুখী কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছে। তফসিলি জাতির প্রবীণ নাগরিকদের জন্য আগামী অর্থবর্ষ থেকেই পেনশন প্রকল্প চালু করা হচ্ছে। এই শ্রেণীর ষাটোর্ধ্ব পুরুষ-মহিলা উভয়েই মাসে মাসে ১০০০ টাকা করে পেনশন পাবেন। এজন্য বরাদ্দ করা হয়েছে ২৫০০ কোটি টাকা। এর ফলে পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের ২১ লক্ষ প্রবীণ মানুষ বিশেষভাবে উপকৃত হবেন। একইভাবে তফসিলি উপজাতি বা আদিবাসীদের জন্য ‘জয় জওহর’ প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। এর মাধ্যমে ৪ লক্ষ গরিব আদিবাসী পরিবার উপকৃত হবে। এজন্য বরাদ্দ হয়েছে ৫০০ কোটি টাকা। সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে দেড় কোটি অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের জন্য বাড়তি সুরাহার কথা ঘোষণা করল সরকার। এই সরকারি পিএফ প্রকল্পে প্রিমিয়াম বাবদ শ্রমিককে প্রতি মাসে ২৫ টাকা দিতে হতো। এরপর সরকারের অংশ হিসেবে যোগ হতো আরও ৩০ টাকা। এবার থেকে এই মোট ৫৫ টাকাই রাজ্য সরকার দেবে। শ্রমিককে এই বাবদ এক পয়সাও দিতে হবে না। অর্থাৎ ওই শ্রমিকরা নিখরচায় এই পিএফ প্রকল্পের পুরো সুবিধা ভোগ করতে পারবেন।
চা শিল্পের জন্য ঘোষণা করা হয়েছে দুটি প্রকল্প। একটির নাম ‘চা সুন্দরী’। গৃহহীন চা বাগান শ্রমিকদের বাসস্থান নির্মাণের প্রকল্প এটা। তিন লক্ষ চা শ্রমিকদের গৃহ নির্মাণের জন্য ৫০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হল চা শিল্পে দু’বছরের জন্য কৃষি আয়কর ছাড় দেওয়া হবে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও অভূতপূর্ব ছাড়ের কথা ঘোষণা করা হয়েছে। যেসব গরিব পরিবার তিন মাসে ৭৫ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ খরচ করে তাদের আর বিদ্যুৎ বিল মেটানোর চিন্তা করতে হবে না। সরকারই এটা বহন করবে। সরকারের হিসাব হল, সারা রাজ্যের ৩৫ লক্ষ পরিবার উপকৃত হবে। এই বাজেটে এই বাবদ ২০০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। সহজ শর্তে ঋণদানের জন্য বেকার যুবক-যুবতীদের জন্য ‘কর্মসাথী’ প্রকল্প ঘোষণা করা হল। প্রতি বছর ১ লক্ষ হিসাবে আগামী তিন বছরে মোট ৩ লক্ষ বেকার যুবক-যুবতীকে ঋণদানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করার লক্ষ্য সরকার স্থির করল। মাঝারি ও ছোট শিল্পের প্রসারের জন্য ১০০টি নতুন এমএসএমই হাব গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করা হল। এজন্য বরাদ্দ করা হল ২০০ কোটি টাকা। ওই একই শিল্পক্ষেত্রের জন্য ‘বাংলাশ্রী’ উৎসাহ প্রকল্প ঘোষণা করল সরকার। এই বাজেটের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল, কর বিবাদ নিষ্পত্তির জন্য বেশকিছু ছাড় প্রদান। এছাড়া জমি বাড়ি প্রভৃতি সম্পত্তির একত্রীকরণ রেজিস্ট্রেশনের জন্য স্ট্যাম্প ডিউটিতে ছাড় ঘোষণা করা হল। দিতে হতো সম্পত্তির মূল্যের ৫-৭ শতাংশ, সেটা কমিয়ে করা হল ০.৫ শতাংশ। তবে, এর ঊর্ধ্বসীমা ৩ লক্ষ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে।
সার্বিকভাবে এই বাজেটকে জনমুখীই বলব। তবে, বাজেট বরাদ্দ ক্ষমতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। অন্যদিকে, রাজস্ব-শৃঙ্খলার শর্ত অনেকটাই পালিত হয়েছে চলতি বাজেটে। মোদ্দা কথা, রাজস্ব-শৃঙ্খলার মধ্যে থেকেই জনমুখী বাজেট পেশ করল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জনদরদি সরকার।