মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
সার্জিকাল স্ট্রাইক। কথা রেখেছিল ভারতীয় সেনাবাহিনী। ভারতের সীমান্ত-পাহারায় রাতের পর রাত জাগা প্রত্যেকটি ইউনিটের কাছে। দেশের কাছে। কিন্তু দেশ কি কথা রাখল? এখানে দেশ বা রাষ্ট্র মানে শুধু ১৩০ কোটি মানুষ নয়। বরং দেশ চালানেওয়ালারা। একটা সার্জিকাল স্ট্রাইক বা একটা বালাকোটের মতো অপারেশন নিয়ে রাজনীতির কারবারিরা গত কয়েক বছর ধরে যে হারে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন, তা কানে বিঁধে থাকার মতো। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কড়া কড়া কথাবার্তা পাবলিক ‘খায়’। আর এই তত্ত্ব বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি সরকার বিলক্ষণ জানে। তাই ভোটের মুখে ভাষণে যত কথা কর্মসংস্থান নিয়ে শোনা যায়, তার থেকে অনেক অনেক বেশি শব্দ খরচ হয় দেশাত্মবোধ বা ‘পাকিস্তানকে ঘরে ঢুকে মেরে আসব’ জাতীয় প্রতিশ্রুতিতে। দুর্ভাগ্য কোথায়? যে সেনাবাহিনীকে প্রচারে ব্যবহার করে ভোট বৈতরণী পেরনোর কৌশল, তাঁদেরই প্রবল ঠান্ডা ঠেকানোর মতো উপকরণ সরকার দিতে পারছে না। আর এ কোনও বিরোধী দলের প্রচার নয়। বলছে ক্যাগের সাম্প্রতিক রিপোর্টই। উল্লেখ রয়েছে সেখানে সিয়াচেন ও লাদাখের। যে জওয়ানরা পাকিস্তান ও চীনের ওই সীমান্ত রক্ষার খাতিরে প্রাণেরও তোয়াক্কা করেন না, তাঁদের অতি প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের অভাবের। ২০১৫-১৬ এবং ২০১৭-১৮—এই দু’বছরের রিপোর্ট পেশ হয়েছে সংসদে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ইস্টার্ন কমান্ডে ৯ হাজার ফুট এবং নর্দার্ন কমান্ডে ৬ হাজার ফুট উচ্চতায় যে যে উপকরণ প্রয়োজন, অর্থাৎ খাবার, জুতো, কোট, ফেস মাস্ক, স্নো গগলস, স্লিপিং ব্যাগ... পর্যাপ্ত নেই কিছুই। নতুনের তো দেখাই নেই, বরং বহু ক্ষেত্রে পুরনো বা মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া উপকরণ জওয়ানদের ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। মজুত খাবারের অবস্থা এমন যে, হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় ৮২ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ক্যালরির চাহিদা মেটে না। গত মার্চে এ ব্যাপারে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সাফাই কী ছিল? বাজেটে ঘাটতির জন্য কিছু কিছু বিষয়ে কাটছাঁট করতে হচ্ছে।
মোক্ষম যুক্তি। দেশের অর্থনীতির হাল সুবিধের নয়। উৎপাদন শিল্প ধুঁকছে, চাকরি-বাকরির হাল খারাপ। এয়ার ইন্ডিয়ার মতো রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা নিলামে চড়িয়েও খদ্দের মিলছে না। রাজস্বের হাল খারাপ... কাজেই কোষাগারে টান পড়াটা স্বাভাবিক। তাই একটু ‘কমপ্রোমাইজ’ করতে হবে সেনাবাহিনীকেও। তবে এরপরও প্রশ্ন হল, সব ক্ষেত্রে একই নিয়ম প্রযোজ্য তো? তাহলে রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ‘বিশেষ বিমানে’র জন্য ৮ হাজার ৪৫৮ কোটি টাকা বরাদ্দ কেন? যে দেশে প্রত্যেক ত্রৈমাসিকে জাতীয় গড় উৎপাদন এবং মূল্যবৃদ্ধির হার রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে, সেখানে এমন বোয়িং ৭৭৭-৩০০ইআর বিলাসিতা নয় কি? কৌতূহল হতেই পারে, কী এমন আছে এতে? কেন এত দাম? এতে রয়েছে সাংবাদিক সম্মেলনের জন্য আলাদা ঘর, মিসাইল ওয়ার্নিং সিস্টেম, সেল্ফ প্রোটেকশন স্যুইট এবং আরও অনেক কিছু। মানে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এবং রাষ্ট্রপতিও এখন এয়ারফোর্স ওয়ানের মতো বিমানে চড়বেন। নিরাপত্তার খাতিরে প্রয়োজন হতেই পারে। সে নিয়ে সন্দেহ নেই। কিন্তু একটু বিবেচক মন বলছে, এখনই না হলেও চলত।
ক্যাগ রিপোর্ট প্রকাশ পাওয়ার পর যে বিবেচনাটা আরও প্রকট হয়ে দেখা দিচ্ছে। আজ সিয়াচেনে প্রচণ্ড ঠান্ডায় জমতে বসা যদি কোনও জওয়ান এই প্রশ্ন করেন, তার উত্তর রাষ্ট্রনেতারা দিতে পারবেন তো? ওই জওয়ানকে যদি নেহাতই একজন কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মী হিসেবে দেখেন, তাহলে আলাদা কথা। ভাবলেন, ওরা তো চাকরি করে। মাইনে পায়... আবার কী? তবে তেমনটা মনে করলে কিন্তু ভোটের অস্ত্র হিসেবে সেনাবাহিনীকে ব্যবহারের আগে এক মুহূর্ত হলেও ভাবতে হবে। যদিও তা হবে না। বরং মুখ বন্ধ করে দেওয়া হবে তেজবাহাদুর যাদবদের। বিএসএফ জওয়ান... সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে অভিযোগ করেছিলেন খাবার নিয়ে। অভিযোগ ছিল, অত্যন্ত নিম্নমানের খাবার দেওয়া হয় তাঁদের। কখনও কখনও খালি পেটেই দিন কাটে। তদন্তে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। বলা হয়, মিথ্যা অভিযোগ এনে বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন তিনি। তাই শাস্তিস্বরূপ তেজবাহাদুরকে সাসপেন্ড করা হয়। হয়তো মিথ্যা অভিযোগই করেছিলেন বিএসএফের ওই জওয়ান। তিনি যা দাবি করেছিলেন, বিষয়টা মোটেও তেমন নয়। দেশের মানুষ বছর তিনেক আগের ওই ঘটনা হয়তো ভুলেও গিয়েছিল। ফের কিন্তু মনে পড়ল। সৌজন্যে অবশ্যই এই ক্যাগ রিপোর্ট। আবার একটা কৌতূহল পোকার মতো নড়েচড়ে উঠছে, অভিযোগ যা হয়, তার কিছু কিছু সত্যি নয় তো?
এই উত্তর দেওয়ার দায় সরকারের। দেশের নিরাপত্তার স্তম্ভ হিসেবে এক একজন জওয়ান, মেজর, কমান্ডার সীমান্ত আগলে রাখেন। বানচাল করেন জঙ্গি অনুপ্রবেশের ছক, বুকে গুলি নিয়ে নিশ্চিত করেন সাধারণ ভারতবাসীর নিরাপত্তা। অথচ, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বা পর্যাপ্ত খাবার ছাড়াই তাঁদের ডিউটি করতে হয়। দিনের পর দিন। আর তারপরও কিন্তু তাঁরা কর্তব্যে অবিচল থাকেন। নীরবে। মেজর ট্যাঙ্গো তাই বলতে পারেন, ‘আমরা যখন অপারেশনে থাকি না, তখন তারই প্রস্তুতি নিই... সেটাই আমাদের কাজ। উদ্দেশ্য।’
সেনাবাহিনী কখনও ভোটের হাতিয়ার হতে পারে না। চাকরি তাঁরা করেন ঠিকই... কিন্তু তাঁদের সমান প্রতিকূলতা কাউকে সহ্য করতে হয় না। আইডেন্টিটি কার্ড হাতে ধরিয়েই তাঁদের ঠেলে দেওয়া হয় গুলি খাওয়ার জন্য।
পুঞ্চ সীমান্তের বাঙ্কারে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একজন যখন এসএলআরে চোখ রেখে বসে থাকেন, তাঁর পরিবার বসে থাকে প্রার্থনায়... মানুষটা শুধু যেন বেঁচে থাকে। কোটি কোটি সাধারণ মানুষের মাঝে অসাধারণ কেউ থাকলে তা ভারতীয় বাহিনীর প্রত্যেক সদস্য। তাঁদের কমপ্রোমাইজ করতে বাধ্য করার আগে একবার-দু’বার নয়, একশোবার ভাবা উচিত। একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াইয়ের সময় তাঁরা জাত, ধর্ম দেখেন না। একটাই শব্দ তাঁদের মনে আসে... ভারত।
যে দেশে ধর্মীয় বিভাজন চলে না। চলতে পারে না।