মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
বিজেপি, প্রধানমন্ত্রী এবং অর্থমন্ত্রীর উচিত নিজেদের দোষারোপ করা। যে প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা তাঁর অর্থনৈতিক সমীক্ষায় কিছু নির্ভরযোগ্য পরামর্শ দিয়েছিলেন, বিজেপি নেতৃত্ব তাঁকে দুষতে পারেন না। প্রাক-বাজেট আলোচনায় কিছু অর্থনীতিবিদ ও বণিক শ্রেণীর নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্ব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এঁদেরকেও দায়ী করতে পারেন না বিজেপি নেতৃত্ব। হাতের সামনে অনেক আইডিয়া বা বুদ্ধি ছিল। বাজেট নিয়ে বাজারে গুঞ্জনের ভিত্তিতে আমার ২৬ জানুয়ারির সাপ্তাহিক কলমে (‘বর্তমান’ কাগজ) দশটি সম্ভাবনার একটি তালিকা দিয়ে আন্দাজ দিয়েছিলাম যে বাজেটে অর্থমন্ত্রী কী কী করতে পারতেন।
অর্থমন্ত্রী যদি প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদগণ এবং বণিকমহলের চাহিদার কথাগুলিতে কর্ণপাত না-করে থাকেন, তবে কী কী কারণে, নীচে সেগুলি তুলে ধরলাম:
১. সরকার অস্বীকার করায় অভ্যস্ত: এই সরকার মেনেই নিল না যে নোট বাতিল এবং ত্রুটিপূর্ণ জিএসটি তড়িঘড়ি চালু করাটা একটা ভয়ঙ্কর ভুল পদক্ষেপ ছিল। আর এই কারণেই যে ছোট ও মাঝারি শিল্প-ব্যবসা (এমএসএমই) এবং চাকরির সম্ভাবনাগুলি ধ্বংস হয়ে গিয়েছে—সরকার সেটাও মানল না। সরকার আরও স্বীকার করল না যে আর্থিক মন্দার কারণগুলি হল—রপ্তানি বাণিজ্যের নিম্নগতি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রগুলিতে অস্থিরতা, ঋণের জোগানে ঘাটতি, গৃহস্থের সঞ্চয় হ্রাস, ভোগ্যপণ্যের চাহিদা হ্রাস, খনি ও নির্মাণ শিল্পের ধসে পড়ার মতো অবস্থা এবং সর্বত্র অনিশ্চয়তা ও ভয়ের পরিবেশ। পরিতাপের বিষয় এই যে, অর্থনীতির এই নেতিবাচক দিকগুলি নিয়ে অর্থমন্ত্রীর বাজেট ভাষণে কোনও উচ্চবাচ্য পাওয়া গেল না।
২. অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকারের মূল্যায়ন দুর্ভাগ্যজনক ভাবে ভুল: সরকার বিশ্বাস করে যে অর্থনীতির নিম্নগতিটা সময়ের আবর্তনশীলতার কারণে (সাইক্লিকাল ফ্যাক্টরস)। তারা যদি ওই কাজগুলিই আরও বেশি পরিমাণে করতে থাকে তবে অর্থনীতির ঊর্ধ্বগতি ফিরে আসবে। যেমন অর্থ সংগ্রহের কৌশল অবলম্বন, চালু কর্মসূচিগুলিতে আরও বেশি টাকা খরচ এবং নতুন নতুন কর্মসূচির ঘোষণা। অনেক অর্থনীতিবিদ মনে করছেন, অর্থনীতির নিম্নগতির মূল কারণটা হল—কাঠামোগত ত্রুটি, সাইক্লিকাল ফ্যাক্টরস নয়। আর এটাই যদি বাস্তব হয় তবে তো অর্থনীতিকে টেনে তোলার রাস্তাগুলি সরকারই কার্যত রুদ্ধ করে দিল।
৩. ঘুরে দাঁড়ানোর অন্তরায় সরকারের মতার্শগত প্রবণতা: সরকারের আস্থা সংরক্ষণবাদ, আমদানির বিকল্প এবং ‘শক্তিশালী রুপি’র মতো কিছু সেকেলে দর্শনে। এই সরকার বহির্বাণিজ্যের বহুবিধ লাভালাভে বিশ্বাস করে না এবং রপ্তানি বাণিজ্যে জোয়ার আনার জন্য যে ধরনের উদ্যোগ দরকার সেটাও এরা ছেড়েছুড়ে দিয়েছে। এরা আঁকড়ে ধরেছে আমদানি শুল্ক বাড়িয়ে চলার মতো বিপরীত বুদ্ধি। রুপি বা ভারতীয় মুদ্রা যে একটা যুক্তিগ্রাহ্য ‘লেভেল’ খুঁজে নেবে, সেটাও এরা চায় না। ভুল মতাদর্শের কারণে সুরাহার সূত্র খুঁজে পেতে সরকার পিছিয়ে পড়ছে।
৪. সরকার ও বাণিজ্যের মধ্যে গড়ে ওঠা ভয়ানক অবিশ্বাসের বাতাবরণ ছেড়ে বেরতে নারাজ সরকার: অনেকগুলি অর্থনৈতিক আইনকে সরকার ফৌজদারি অপরাধে রূপান্তরিত করে দিয়েছে। কর আদায় বিভাগ এবং তদন্তকারী সংস্থাগুলির ছোটখাটো অফিসারদেরও হাতে বিশেষ ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছে। কর সংগ্রহের কাজটিকে বস্তুত কর-সন্ত্রাসে (ট্যাক্স টেররিজম) রূপান্তরিত করে ফেলা হয়েছে। এই প্রসঙ্গে বিখ্যাত ভারতীয় ব্যবসায়ী ভি জি সিদ্ধার্থের দুর্ভাগ্যের কথাটি স্মরণ করা যেতে পারে। সরকারের দাবি অনু্যায়ী কর প্রদানের যে পদ্ধতি চালু করা হয়েছে সেটা চূড়ান্ত হয়রানি ছাড়া কিছু নয়। অর্থমন্ত্রী তাঁর বাজেট ভাষণে করদাতাদের অধিকার বিষয়ে যে ‘চার্টার’-এর কথা ঘোষণা করেছেন, সেটি থেকে মানুষের মনে সংশয়-সন্দেহ দানা বেঁধেছে। কিছু সরকারি কর্তৃপক্ষ ও এজেন্সিকে যে অন্যায় খবরদারি করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, আমরা জানি। তাই করদাতাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, তাহলে সোজাসুজি এটাই প্রত্যাহার করা হল না কেন?
৫. সরকার নিজেকে একটি অযোগ্য ‘ম্যানেজার’ বলে প্রতিপন্ন করেছে: বিমুদ্রাকরণ থেকে জিএসটি, স্বচ্ছ ভারত মিশন থেকে বাড়ি বাড়ি বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার প্রকল্প রূপায়ণ, উজ্জ্বলা যোজনা (সবার বাড়িতে রান্নার গ্যাসের সংযোগ) থেকে উদয় (উজ্জ্বল ডিসকম অ্যাসুরেন্স যোজনা) প্রভৃতি প্রতিটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচিতে মারাত্মক সব গলদ রয়েছে। দুর্ভাগ্য এই যে, সরকার একটি ‘ইকো চেম্বার’-এ বাস করে এবং মন ভোলানো মেকি কথাবার্তাগুলোই শোনে। তাই এই সমস্ত কর্মসূচিতে বিপুল টাকা খরচ করেও সন্তোষজনক ফল মেলে না। প্রকল্পগুলি আরও ভালোভাবে রূপায়ণের কিংবা ফলাফল সম্পর্কে নির্ভেজাল রিপোর্ট দেওয়ার ক্ষমতা প্রশাসন-যন্ত্রের নেই।
তাই অবাক হচ্ছি না যে, অর্থমন্ত্রী একটি নিষ্প্রভ বাজেট, জিডিপির নিম্ন বৃদ্ধি (নমিনাল) এবং কর-রাজস্ব সম্পর্কে আশাবাদ-বিচ্যুতিই মেনে নিয়েছেন। যখন নমিনাল জিডিপির বৃদ্ধির হার ১০ শতাংশ ধরা হচ্ছে, ঠিক তখনই মোট কর-রাজস্ব বৃদ্ধির হার ১২ শতাংশ ধরাটা অস্বাভাবিক। এছাড়া, অনুমিত রাজস্ব ভালো-মন্দ মিলিয়ে অনেকগুলি কর্মসূচির মধ্যে বরাদ্দ করে দেওয়া হয়ে গিয়েছে। তার ফলে সমস্যা যেটা হয়েছে, গরিবের হাতে নিশ্চিতরূপে পয়সার জোগান দ্রুত বাড়ানোর মতো কর্মসূচিগুলিতে বাড়তি অর্থ বরাদ্দ করার সুযোগ আর বিশেষ থাকলই না। ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প (এমজিএনআরইজিএ), মিড-ডে মিল, খাদ্যে ভর্তুকি, পিএম কিষান সম্মান প্রভৃতি কর্মসূচিতে চলতি বছরে অব্যবহৃত অর্থ কিংবা আগামী বছরে বরাদ্দ কাটছাঁট দেখার পর গ্রামীণ সমাজে আয় বা গৃহস্থের ভোগব্যয় বৃদ্ধির আশা করতে পারছি না।
একেবারে নীচের ভাগের আয়করদাতাদের জন্য তথাকথিত করছাড় ঘোষণা—কর কাঠামটিকে বিশৃঙ্খল করে দিয়েছে এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছে। ৪০ হাজার কোটি টাকার অনুমিত সুরাহা (বেনিফিট) কিন্তু নিশ্চিত নয়। তার উপর আয়কর দাতাদের মন জয় করার পক্ষেও অঙ্কটা যৎসামান্য।
বেসরকারি লগ্নিতে জোয়ার আনার মতো কোনও ‘ইনসেনটিভ’ এই বাজেটে ঘোষণা করা হয়নি। ডিভিডেন্ড ডিস্ট্রিবিউশন ট্যাক্স (ডিডিটি) তুলে দিলেও কোম্পানির ঘাড়ে-চেপে-থাকা করের বোঝা শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে বিশেষ কিছু বণ্টিত হয়নি। পাশাপাশি, এটাও বলব যে—যখন ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে মোট ক্ষমতার ৭০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে, তাপবিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রের ব্যবহার হচ্ছে মাত্র ৫৫ শতাংশ—তখন নতুন লগ্নি আসার আশা বড়ই ক্ষীণ।
সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে যে, ক্ষীণ-চাহিদা ও বিনিয়োগ-আকাল অর্থনীতির প্রয়োজনের দিকগুলি নিয়ে অর্থমন্ত্রী কিছুই বলেননি। রপ্তানি বৃদ্ধিতে মদত দিতে পারলে কিন্তু অনেক সুফল মেলে। এটাকেও তিনি তারিফ করেননি। তিনি বাধ্য হয়েছেন সরকারি ব্যয় নামক একমাত্র ‘ইঞ্জিন’-এর উপর আস্থা রাখতে। কিন্তু এই ইঞ্জিনটাও যে জ্বালানি সঙ্কটে ভুগছে এবং নড়বড়ে রাজকোষের (ফিসকাল ইনস্টেবিলিটি) ভূতের ছায়াটিও পড়ছে সরকারের উপর! তীব্র বেকারত্ব এবং ব্যাপক হারে ছোট ও মাঝারি শিল্প-ব্যবসা চৌপাট হয়ে যাওয়ার মতো দুটি ভয়ঙ্কর ইস্যুও অস্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী।
সাম্প্রতিককালে ভারতের অর্থনীতিকে সবচেয়ে কঠিন যে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে সেটা হল—স্বঘোষিত শক্তিমান এবং নির্ণায়ক (ডিসিসিভ) সরকার—যে সরকার নিজেকে দিশেহারা এবং ভীত বলেই প্রতিপন্ন করেছে।