মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
শতাধিক বছর আগের কথাটি মনে পড়ে যাচ্ছে দিল্লি রাজ্য বিধানসভা ভোটের প্রসঙ্গে। ঠাকুরের কথাটিকে প্রাসঙ্গিক করে তুলেছেন আম আদমি পার্টির (আপ) মুখ অরবিন্দ কেজরিওয়াল। তিনি তৃতীয়বারের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সি নিশ্চিত করলেন। কেজরিওয়াল শুধু সরকার গড়ার ছাত্রপত্র জোগাড় করলেন না—ভারতকে এক অভিনব রাজনীতি উপহার দেওয়ার কৃতিত্ব দাবি করার উচ্চতায় নিয়ে গেলেন নিজেকে। দিল্লির সঙ্গে অন্য রাজ্যগুলির মূলগত তফাত হল—এখানে মুখ্যমন্ত্রীর হাতে রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দপ্তর বলে কিছু নেই। সেটি কেন্দ্রের কুক্ষিগত। অর্থাৎ নিজস্ব পুলিসকে ব্যবহার করার কোনও সুবিধা কেজরিওয়াল পান না। রাজ্য বিধানসভার ভোট অনুষ্ঠানের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব ক্ষমতা অধিকার সরকারিভাবে জাতীয় নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত। তবু, রাজ্যের সাধারণ প্রশাসন ও পুলিসের উপর বিশেষভাবে নির্ভর করার বিকল্প কমিশনের সামনে নেই। ভোটের সময় অল্প কিছুদিনের জন্য রাজ্যের প্রশাসন ও পুলিস কমিশনের অধীন হয়ে যায় বটে, কিন্তু ভোট মিটতেই তাদের পুরনো মালিকের অধীন হতেই হয়। তাই বেশিরভাগ সময়ই রাজ্য প্রশাসন ও পুলিসের নিরপেক্ষতা নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন ওঠে। ভারতের মাটিতে এই ট্রাডিশন ভাঙতে আগ্রহী রাজনৈতিক দলের দেখা এখনও অবধি মেলেনি।
অন্যদিকে, ইভিএমে গৃহীত দিল্লির এই ভোটের স্বচ্ছতা নিয়ে কারও মনে বিন্দুমাত্র সংশয় সন্দেহ নেই। আমরা দেখলাম, মোট আসনের ৯০ শতাংশই দখল করেছে দিল্লি রাজ্যের শাসক দল আপ। কিন্তু, কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি দিল্লি রাজ্যের ক্ষমতা দখলের জন্য এবার মরিয়া ছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ-সহ তাদের জাতীয় স্তরের সমস্ত হেভিওয়েট নেতাকে নামিয়েছিল। তার পরেও বিজেপি ‘পুওর সেকেন্ড’! ৭০-এর মধ্যে মাত্র ৮! তাদের একমাত্র সান্ত্বনা—ভোটের হার এবং আসন সংখ্যা ২০১৫ সালের বিধানসভা ভোটের নিরিখে কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু, তাদের এবারের লড়াইটা মোটেই দু’নম্বর হওয়ার লক্ষ্যে ছিল না। বরং, জয় ছাড়া আর কিছুই ভাবেনি মোদি-শাহদের দল। পরাজয়ের স্রোতে বাঁধ দেওয়ার জন্য এটা ভীষণ জরুরি ছিল। গত দু’বছরে ১১টি রাজ্যে বিধানসভার ভোট নেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে হরিয়ানা ও অরুণাচলের মতো দুটি ছোট রাজ্য মুখরক্ষা করলেও, বাদবাকি ৯টিতে সরকার গড়তে ব্যর্থ হয়েছে ‘মোদি ম্যাজিক’! দিল্লিটা হাতে পেলে মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ডের ক্ষতে সামান্য প্রলেপ দিতে পারতেন মোদিজিরা। কিন্তু, সেই সুযোগ কেড়ে নিলেন কেজরিওয়াল।
বিজেপিকে আশার আলো দেখিয়েছিল ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের রেজাল্ট—দিল্লিতে সাতে সাত! ওই রেজাল্টের অন্তরে আরও লেখা ছিল—৭০টি বিধানসভার মধ্যে ৬৫টিতে এগিয়ে! অতএব, পায় কে? কেজরিওয়ালকে রামধাক্কা দেওয়াটা কেবল সময়ের অপেক্ষা।
কিন্তু, মানুষ ভাবে এক আর হয় আর-এক। কারণ, ভাবনার ভিতরেও যে ভাবনা থাকে—লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটের সময় একই ভোটার যে বিপরীত আচরণ করে থাকেন! গত দুটি লোকসভা এবং দুটি বিধানসভার ভোটের রেজাল্ট অন্তত তাই বলছে। যে-মানুষ লোকসভায় আন্তরিকভাবে মোদিকে চেয়েছেন, সেই মানুষটাই বিধানসভায় চেয়েছেন কেজরিওয়ালকে! বিজেপি নেতৃত্ব মানুষের এই চাহিদা বুঝতে এবং তাদেরকে প্রভাবিত করতে যার পর নাই ব্যর্থ হয়েছে।
বিজেপি জয়ের জন্য হাতিয়ার করেছিল তাদের পুরনো অস্ত্রগুলিই—পাকিস্তান জুজু, দেশপ্রেম, রামমন্দির, ধর্মীয় বিভাজন এবং বাহুপ্রদর্শন ও বিরোধীদের নামে কুৎসা। ব্যক্তি কেজরিওয়ালকে নিয়েও আলতু-ফালতু অভিযোগ করেছিল বিজেপি। অন্যদিকে, কেজরিওয়াল এবার হেঁটেছেন একেবারে নতুন এক পথে। তিনি নিখাদ এক উন্নয়নের তরি ভাসিয়েছিলেন। যে-উন্নয়নের মূল কথা হল কোয়ালিটি লাইফ। সুস্থ-সবল-সুন্দর ভাবে বাঁচা। যে-বেঁচে থাকার মধ্যে শুধু আনন্দ খুঁজে নেওয়া যায়—দিনগত পাপক্ষয়ের চেনা যন্ত্রণার ধারণা থেকে সরে আসা। তাই তাঁর ‘২৮ পয়েন্ট গ্যারান্টি কার্ড’-এর ১ নম্বরে জায়গা করে নিয়েছিল দিল্লির ভয়াবহ দূষণ থেকে মানুষকে ধীরে ধীরে মুক্তি দেওয়ার আশ্বাস। ‘দূষণ’ নামক সত্যটা যে-দেশে শুধুমাত্র পরিবেশকর্মী নামক কিছু মানুষের (যাঁরা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়িয়ে আনন্দ পান বলে ভাবা হয়) সাবজেক্ট হয়ে রয়েছে, সেই দেশে কেজরিওয়াল দূষণকে ভোট কেনার মুদ্রা করে তুলেছেন! নিঃসন্দেহে এ এক অমিত সাহসী পদক্ষেপ। পরিস্রুত পানীয় জল, চিকিৎসা, বিদ্যুৎ, রেশন, পরিবহণ, কর্মরত অবস্থায় মৃত সাফাইকর্মীর পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, প্রবীণ নাগরিকদের তীর্থযাত্রা এবং শিক্ষার প্রসার বিষয়ে কেজরিওয়ালের ভাবনাগুলি অভূতপূর্ব! বিশেষ করে স্কুলশিক্ষার উন্নতির বিষয়ে তাঁর সরকারের পদক্ষেপ অনেক নামী বেসরকারি স্কুলের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছে। যে-কাজগুলি কয়েক দশক আগে বামেদের করে দেখানোর কথা ছিল, সেটাই করে চলেছেন আপ কাণ্ডারী। বামেদের যা চিন্তাতেও আসেনি—সেসবও তিনি ভাবছেন করছেন।
পাশাপাশি দেখা যাচ্ছে, সস্তা রাজনীতির সমস্ত চেনা পথ কেজরিওয়াল সযত্নে পরিহার করেছেন। নরেন্দ্র মোদির তীব্র বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও ইমরান খানের বাজে কথার জবাব দিতে গিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সমর্থন করতে কুণ্ঠিত হননি কেজরিওয়াল। ৩৭০ ধারা বাতিলে সম্মতি জানিয়েও নাগরিকত্ব (সংশোধিত) আইনের বিরোধিতা করেছেন বলিষ্ঠভাবে। এই রাজনীতিক আবার জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া এবং শাহিনবাগ আন্দোলনের গড্ডলিকাতেও ভাসেননি। কুৎসা করা দূরে থাক, ভোটের প্রচারে একবারও বিজেপি নেতাদের নামে গরমাগরম কিছু বলেননি। বরং দেশপ্রেমে আস্থা রেখে একইসঙ্গে ‘ভারত মাতা কি জয়’ ও ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলে চলেছেন দরাজ গলায়। মোদ্দা কথা, উন্নয়নের ইস্যু চাপা পড়ে যায় এমন একটাও লুজ বল তিনি খেলেননি। বাজে না বকে এবং ‘ভোট করানো’র অসৎ পথ পরিহার করেও যে বিপুল জয় হাসিল করা সম্ভব—ভারতের মাটিতে কেজরিওয়ালের আগে হাতেকলমে কেউ দেখাতে পেরেছেন বলে শুনিনি। এমনকী বিপুল জয়েও মাথা ঘুরে যায়নি তাঁর। জয় যেন তাঁকে আরও সংযত করেছে। জয়ের প্রকাশেও দলীয় কর্মীদের মনে করিয়ে দিয়েছেন নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিরক্ষার কথা। তাঁর নির্দেশ—বিজয় উৎসবে একটিও বাজি ফাটবে না!
ভারতের রাজনীতির পরতে পরতে মিথ্যাচার আর দুর্নীতি। এসব ঢাকতে রাজনীতির ভাষা আত্মস্থ করে নিয়েছে কুবাক্যসমূহ—ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কথিত দুধের মধ্যে মিশে থাকা জলের মতোই। এবারের ভোটে অরবিন্দ কেজরিওয়াল দেখিয়ে দিয়েছেন—জলটুকু সরিয়ে খাঁটি দুধটুকুই গ্রহণের সহজ কৌশলটি। তাঁকে ঠাকুরের দেখানো পথের পথিক ভাবতে একটুও কষ্ট হচ্ছে না। এই পন্থায় ক্ষমতার কুর্সিকে কোনোভাবে মলিন বলে মনে হচ্ছে না—মনে হচ্ছে শিবজ্ঞানে জীবসেবার একটি শ্রেষ্ঠ উপায়। দিল্লিতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত অভিনব ভোট-সংস্কৃতি বিহার, বাংলা, কেরল, তামিলনাড়ু, অসম ও পুদুচেরি বিধানসভা ভোটের আগে শুধু বিজেপিকেই চাপে ফেলল না—চাপে পড়ে গেল সারা দেশের রাজনীতি। ভারতীয় রাজনীতির কাছে মানুষের চাহিদাটাই বদলে যেতে পারে এবার।