মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
এতবড় মাতৃশক্তিকে এতদিন ধরে কষ্ট দেওয়ার যে চক্রান্ত, তার মূলচক্রীকে গত ২৮ জানুয়ারি দিল্লি পুলিস বিহারের জহানাবাদ থেকে গ্রেপ্তার করেছে। জেএনইউ-এর এই গবেষক ছাত্রের নাম শরজিল ইমাম। শরজিল ইমাম শাহিনবাগের আগেও ধর্মীয় মেরুকরণের অনেক গবেষণা করেছেন বলে দিল্লি পুলিসের অভিযোগ। অসম, মণিপুরসহ উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে আজাদির নামে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করার জন্য যে গবেষক দল দিল্লিতে বসে নিরন্তর কাজ করে চলেছেন, শরজিল তাঁদের মধ্যে একজন। এঁরা দেশকে টুকরো টুকরো করতে চান। তাই দাদি কিংবা পোতি কাউকেই এঁরা সত্য কথাটা বলেননি।
সত্যি কথা হল, একটি সার্বভৌম দেশে যেভাবে কোনও আইন প্রণয়ন হওয়ার কথা, তার সবকটি ধাপ ঠিকঠাকভাবে মেনেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) তৈরি হয়েছে। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে তৈরি করা বিলটি প্রথমে লোকসভা এবং পরে রাজ্যসভাতে অনুমোদিত হয়েছে। দ্বিতীয় সত্য হল, এই আইনে মুসলমান সম্প্রদায়ের কোনও মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হবে না। কেবলমাত্র কিছু হতভাগ্য মানুষকে বিশেষভাবে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে। যাঁরা এতদিন ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে ভারতে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন, তাঁদের সম্মানজনক নাগরিকত্ব দেওয়া হবে সিএএ-র মাধ্যমে।
দিল্লিতে আজ যাঁরা সত্যি সত্যি ‘দাদিমা’, মানে যাঁদের বয়স আটের কোঠায়, তাঁরা জানেন কেন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল প্রয়োজন। দাদিরা তাঁদের শৈশবে ওই উদ্বাস্তু মানুষদের কষ্ট দেখেছেন। স্বাধীনতার ঠিক পরে-পরেই দিল্লি ভরে গিয়েছিল ছিন্নমূল, স্বজন হারানো মানুষে। কেউ রাওয়ালপিণ্ডি থেকে নিজের ষোলো বছরের মেয়েকে ছেড়ে এসেছেন, তো কারও শরীরে লাহোরের নৃশংস নারী নির্যাতনের দগদগে ঘা। সেই ভাগ্যহত মানুষগুলি আশ্রয় নিয়েছিলেন সেকালের কিংসওয়ে থেকে তেগবাহাদুর নগর সর্বত্র। তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু ওই উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে খাবার সরবরাহ করার আদেশ দিয়েছিলেন ওই অঞ্চলের কয়েকটি রেস্তরাঁ আর ধাবাকে। এত শত মানুষের খাবার, তার হিসাব রাখা—এ এক আপাত অসাধ্য কাজ ছিল। পণ্ডিতজি কলকাতার স্ট্যাটিসটিক্যাল ইনস্টিটিউটের কর্ণধার অধ্যাপক প্রশান্ত মহলানবিশকে অনুরোধ করেছিলেন সাহায্য করতে। সেদিন কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন দুই তরুণ গবেষক জেএম সেনগুপ্ত আর ডিবি লাহিড়ি। তাঁরা গড়প্রতি লবণ গ্রহণের হিসাব করে আশ্চর্যভাবে সমস্যার সমাধান করেছিলেন। সেই বিষয় নিয়েই একটা গোটা প্রবন্ধ লেখা যায়।
কিন্তু সেদিনের দিল্লির শিশুরাও দেখেছে ছিন্নমূল মানুষের দুঃখ। তাঁরা কেউ অর্থনৈতিক কারণে পাঞ্জাব থেকে দিল্লি আসেননি, এসেছিলেন ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে। অত্যাচারের সবচেয়ে সহজ শিকার হয় মেয়েরা। মেয়েদের দুঃখের কথা, মেয়েদের থেকে বেশি কে বুঝবেন? তাই দিল্লির দাদিরা পারেন তাঁদের শৈশবের অভিজ্ঞতার কথা বলে এই মেরুকরণের অসাধু চক্রান্তকে রুখে দিতে।
দিল্লির দাদিমায়েরা তাঁদের পাঞ্জাব থেকে আসা উদ্বাস্তু প্রতিবেশিনীদের কথা জানেন। হয়তো উদ্বাস্তু শিখ বা হিন্দু গৃহবধূর সকালে এক বাটি ডাল ধার নিয়ে পরের দিন বা সেদিনই সন্ধ্যায় ফেরত দেওয়ার কথা বলে হাসিঠাট্টাও করেন। কিন্তু একজন মহিলা হিসাবে ওই হিন্দু বা শিখ উদ্বাস্তু মহিলার দুঃখও তাঁরা হৃদয় দিয়ে বুঝতেন। তাই দাদি যদি জানতেন যে এমনই হতভাগিনী হিন্দু উদ্বাস্তুরা যাতে দেশের নাগরিকত্ব না পায় তার জন্যই ওই শরজিল আর তার সহযোগীরা ষড়যন্ত্র করছে, তবে নির্ঘাত ওদের জুতোপেটা করতেন!
দিল্লির দাদিমায়েরা হয়তো পূর্ববঙ্গ থেকে আসা হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান উদ্বাস্তুদের কষ্ট ঠিকঠাক জানেন না। তাঁর একটা কারণ অবশ্যই তথাকথিত লেফট লিবারাল সংবাদ মাধ্যমের বদান্যতা। তাঁরা গাজাভূখণ্ডে ইজরায়েলের অত্যাচারের সচিত্র বর্ণনা প্রথম পাতায় প্রকাশ করেছেন, তাতে সংবাদপত্রের নৈতিকতায় বাধেনি, কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানে বা পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদেরই ভাইয়েদের হত্যা করলে বা বোনেদের সঙ্গে পাশবিক আচরণ করলেও তার প্রতিবাদ হয়নি। এই উপমহাদেশে নারীজাতির উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার হয়েছে বিগত সাত দশকে, সেই মানবাধিকার লঙ্ঘনের করুণকাহিনী গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসাবে ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমে প্রায় কখনওই উঠে আসেনি। সংবাদ মাধ্যমের একাংশের এই অদ্ভুত অথচ নিষ্ঠুর আচরণের জন্যই আজ কিছু শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরও নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে।
দিল্লির সেসব ঘটনার কথা দাদিরা জানেন, মানেন ছিন্নমূল শিখ আর হিন্দুদের যন্ত্রণা, তা সবই ১৯৫০ সালের আগের ঘটনা। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বুঝতে হলে এর পরে পূর্ব পাকিস্তানে বা পাকিস্তানে কী নির্মম ঘটনা ঘটেছে তা বোঝা প্রয়োজন।
১৯৫১ সালে পাকিস্তানের আদমশুমারি হিসাবে ১৪.২০ শতাংশ অমুসলমান জনসংখ্যা ছিল। তার মধ্যে ৩.৪৪ শতাংশ ছিল আজকের পাকিস্তানে আর ২৩.২ শতাংশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে মানে আজকের বাংলাদেশে। আজ পাকিস্তানে হিন্দুর সংখ্যা প্রায় অবলুপ্তির পথে। সরকারি হিসাবে ২০১১ সালে বাংলাদেশে হিন্দুর সংখ্যা ৮.৫ শতাংশ। এই অস্বাভাবিক জনসংখ্যা হ্রাসের মূলে আছে অমুসলমান মহিলাদের উপর অমানবিক অত্যাচার। সেই অসহনীয় অত্যাচার সহ্য করতে না পেরেই ওই মহিলারা, তাঁদের বাবারা, ভাইয়েরা, সন্তান-সন্ততি ভারতে আশ্রয় নিতে এসেছেন। ভারত স্থান না দিলে তাঁদের মৃত্যু ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই। কারণ পাকিস্তান বা বাংলাদেশে তাঁরা মানুষের জীবনযাপন করতে পারবেন না। সেই মানবিক সাহায্যটুকু দেওয়ার জন্যই সিএএ-এর ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় ৩ লক্ষ হিন্দু মহিলা ধর্ষিতা হয়েছিলেন। জামাত-ই-ইসলামি, মুসলিম লিগ, নিজাম-ই-ইসলাম একত্রিতভাবে পাকিস্তানের খান সেনাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অত্যাচার করেছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। রাজাকাররা হিন্দু মহিলাদের ‘জনগণের সম্পত্তি’ হিসাবে ঘোষণা করে। গত কয়েক বছর আগে অলস্টন মার্গারেটের বই ‘ওম্যান অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ ইন বাংলাদেশ’ প্রকাশিত হয়েছে। লেখিকা দেখিয়েছেন বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলায় কী ভীষণ অত্যাচারিত হয়েছিলেন মূলত হিন্দু সম্প্রদায়ের মহিলারা। ‘ব্লাড টেলিগ্রাফ’ মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক ভয়ঙ্কর দলিল। আর্চার কে ব্লাড ছিলেন এক মার্কিন কূটনীতিক। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ওই ভয়ানক দিনগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ ব্লাড টেলিগ্রামে লিখেছিলেন ‘পাক সেনাদের সাহায্যে অবাঙালি মুসলমানেরা পরিকল্পিতভাবে দরিদ্র বাঙালি এবং হিন্দুদের আক্রমণ করেছে আর হত্যা করেছে।’ তাই অত্যাচারিত হিন্দু এদেশে আশ্রয় নিয়েছে, সেই হতভাগ্যদের বঞ্চিত করতে চাইছেন শরজিল ইমামরা।
মুক্তিযুদ্ধের শেষে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা হল। ওদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতীয় সেনার বীর জওয়ানদের রক্তও মিশে গেল। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ স্বাক্ষরিত হল ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি। যদিও যে ৩ কোটি মানুষ অত্যাচারিত হয়ে ভারতে এসেছিলেন তার খুব কম অংশই বাংলাদেশে ফিরে গেলেন। কারণ বাংলাদেশ তৈরি হওয়ার পরেও হিন্দুদের উপর অত্যাচার বন্ধ হল না। বাংলাদেশের জন্মলগ্নে সেখানের জনসংখ্যার ১৩.৫ শতাংশ ছিল হিন্দু। আজ সেই সংখ্যা সরকারিভাবে ৮.৫ শতাংশ।
১৯৭০-৭১ সালে যাঁরা পূর্ববাংলা থেকে এসেছেন বা বাংলাদেশ হওয়ার পরে যাঁরা ভারতে অত্যাচারিত হয়ে এসেছেন তাঁদের বেশিরভাগই হিন্দু তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষ। বিগত কয়েক দশকে সবথেকে বেশি শোষিত হয়েছেন বাংলাদশের তফসিলি জাতিভুক্ত মহিলারা। মহিলাদের সম্মান বাঁচাতে প্রান্তিক গরিব মানুষও এদেশে চলে এসেছেন। আবার অনেক সম্পন্ন পরিবারও সব ছেড়ে এক বস্ত্রে ভারতে চলে এসেছেন।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া হামিদা পাইলট হাইস্কুলের ছাত্রী ছিল ১৪ বছরের পূর্ণিমা শীল। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর তাদের বাড়িতে প্রায় ৩০ জনের একটি দল আক্রমণ করে। বাড়ির লোককে মেরে আধমরা করে গণধর্ষণ করা হয়েছিল পূর্ণিমাকে। পূর্ণিমাকে ১১ জন মিলে সেই রাত্রে ধর্ষণ করেছিল বলে পুলিস পরে জানিয়েছিল। পূর্ণিমার অসহায় মা ধর্ষণকারীদের পায়ে ধরে বলেছিলেন, তারা যেন এক এক করে অত্যাচার করে। কারণ তার মেয়েটা বড়ই ছোট। এরকম শত শত পূর্ণিমা শীলের পরিবার যাতে ভারতে সম্মানের সঙ্গে বাঁচতে পারে তার জন্যই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। এই কথাগুলি যদি শাহিনবাগের মায়েদের বলা হতো তা হলেও কি তাঁরা সিএএ-এর বিরোধিতা করতেন? পূর্ণিমা হিন্দু হলেও সেও তো একটা মানুষ, একটি মেয়ে!
এই শাহিনবাগের মহিলাদের সামনে আসল সত্যটা তুলে ধরার দায়িত্ব যাঁদের ছিল তাঁরা উত্তেজনার আগুনে নিজের নিজের স্বার্থের রুটি সেঁকেছেন। দিল্লি রাজ্য সরকার বোঝাতে পারতেন যে এই আইনে একজন দিল্লিবাসী মুসলমানেরও কোনও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই। সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের, পাকিস্তান থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসা হতভাগ্য মানুষদের কেন নাগরিকত্ব দেওয়া উচিত সেই কথা সহজে বোঝাতে পারত। মানবতার বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে একশ্রেণীর প্রচারমাধ্যম আগুনে ঘি ঢালার কাজ করল। শরজিল ইমামের মতো লেখাপড়া জানা মানুষ বাংলাদেশের বা পাকিস্তানের সংখ্যালঘুদের প্রাণান্তকর অবস্থা নিয়ে সমাজকে সচেতন করতে পারতেন। ওই হতভাগিনীদের পরিবার যদি ভারতে স্থান না পায় তবে ওই হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, পার্সি, শিখ পরিবারগুলির কী নিদারুণ অবস্থা হবে তা বোঝাতে পারতেন। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল বাংলা আর পাঞ্জাবের। সেই দুটি প্রদেশের অর্ধেক মানুষ স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও স্বাধীনতাকে উপভোগই করতে পারলেন না। মুক্তির মন্দির সোপানতলে প্রাণ দেওয়া সেই মানুষদের পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশে বা পাকিস্তানে আজ কেমন আছেন? ধর্ষিতা হয়ে, লুণ্ঠিত হয়ে, ভয়ে সন্ত্রাসেই কি তাঁদের জীবন কাটবে? নাকি নিতান্ত মানবিক কারণেই তাঁরা ভারতের পূর্ণ নাগরিকত্ব পাবেন? এই কথা তো বলতেই পারতেন তথাকথিত বিদ্বজ্জনেরা।
পরিচিত এক সাংবাদিক দিদি প্রথম দিন থেকেই শাহিনবাগ কভার করছেন। উপরের কথাগুলো বলে তিনি পুরনো হিন্দ গানের একটি পরিচিত কলি বললেন, ‘চিঙ্গারি কোই ভড়কে/ তো সাওন উসে বুঝায়ে, সাওন জো আগুন লাগায়ে/ উসে কৌন বুঝায়ে?’