মাঝেমধ্যে মানসিক উদ্বেগের জন্য শিক্ষায় অমনোযোগী হয়ে পড়বে। গবেষণায় আগ্রহ বাড়বে। কর্মপ্রার্থীদের নানা সুযোগ আসবে। ... বিশদ
গাঢ় নীল রঙের একটা সোয়েটার। গলায় জড়ানো মাফলার। সেই চিরপরিচিত পোশাক। মুখ্যমন্ত্রী হয়েও কেজরিওয়াল নিজেকে বদলাননি। একবারের জন্যও ‘স্যুটেড-বুটেড’ মুখ্যমন্ত্রীকে দিল্লিবাসী দেখেনি। বিপুল জয় পেয়ে ক্ষমতায় ফিরে ভগবান হনুমানকে স্মরণ করলেন তৃতীয় বার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রীর আসনে বসতে চলা ‘মাফলার ম্যান’ অরবিন্দ কেজরিওয়াল। জনতাকে ধন্যবাদ দিতে চটজলদি তৈরি মঞ্চে এসে দাঁড়িয়ে প্রথমেই যে স্লোগান তুললেন, তা এত দিন বিজেপি মনে করত তাদেরই পেটেন্ট নেওয়া। ‘ভারতমাতা কী জয়’। এরপর বামেদের সুরে বললেন ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ এবং শেষে কংগ্রেসের প্রায় নিজস্ব করে নেওয়া ‘বন্দে মাতরম’। আম জনতা তাঁর সঙ্গে গলা মেলালেন। দিল্লিবাসী জানিয়ে দিল, সবাইকে নিয়েই তিনি এবং তাঁর দল। বিজেপি ভোটপ্রচারকে যেভাবে ধর্মীয় মেরুকরণের নামাবলিতে মুড়ে দিতে চেয়েছিল, কেজরিওয়ালের এই স্লোগানগুলো সম্ভবত তারই উত্তর। একইসঙ্গে নতুন ধারার এক রাজনীতির জন্ম দিলেন তিনি। যেটা উন্নয়নের রাজনীতি। কেজরিওয়াল মনে করেন, ‘এই ধরনের রাজনীতিই ভারতকে একবিংশ শতাব্দীতে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এই জয় শুধু দিল্লির নয়, ভারতমাতারও।’ ধন্যবাদ জানাতে হাজির হয়েছিলেন স্ত্রী, কন্যা ও পুত্রকে নিয়ে। আমজনতাকে জানাতে দ্বিধা করেননি, ১১ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার তাঁর স্ত্রীর জন্মদিন। বলেছেন, মঙ্গলবার ‘ভগবান হনুমানজিরও দিন’। তিনিও তাঁকে আশীর্বাদ করেছেন। এই সহজ সরল আটপৌরে পারিবারিক রাজনীতিই কেজরিওয়ালের হাতিয়ার। নিজের যাপিত জীবনকেও তিনি সাধারণের পর্যায়েই রেখে দিয়েছেন। ঠিক ‘দিদি’-র মতোই।
প্রশাসনিক স্তরে দুর্নীতির অবসান ঘটাতে মোটা মাইনের সরকারি চাকরি ছেড়ে রাস্তায় নেমে দাঁড়িয়েছিলেন। দুর্নীতি দমনে লোকপাল আইনের দাবিতে আন্না হাজারের ধর্না–বিক্ষোভে। খোলা আকাশের নীচে। রাস্তায় বসে প্রতিবাদে। সেই শুরু। ২০১২ সালে ‘আম আদমি পার্টি’ প্রতিষ্ঠা। ২০১৩ সালে দিল্লিতে ক্ষমতায়। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন কেজরিওয়াল। তবে ৪৯ দিন পরে, ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি ইস্তফা দেন। ২০১৫ সালে সেই ১৪ ফেব্রুয়ারি তারিখেই দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী পদে দ্বিতীয়বার শপথ নেন তিনি। ফের ২০২০ সালের বিধানসভা নির্বাচনে আপ-ঝড়ে তৃতীয়বার দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পথে কেজরিওয়াল। গোপন তথ্য জানার দাবি নিয়ে ‘তথ্য জানার অধিকার’ আইন আনার লড়াই শুরু করেছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়ালই। সেই আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকার জন্য ২০০৬ সালে ‘র্যা মন ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কারে সম্মানিত হন। শিক্ষাদীক্ষায় তাঁর সমকক্ষ ভারতের রাজনীতিতে খুব কমই আছেন। আইআইটি–র স্নাতক। তারপর ইন্ডিয়ান রেভিনিউ সার্ভিস। সব ছেড়েছুড়ে নাগরিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পথে নেমেছেন। পদস্থ আমলা থেকে প্রতিবাদী ‘আম আদমি’। মুখ্যমন্ত্রীর তখতে বসেও কখন যেন হয়ে উঠেছেন ‘পাশের বাড়ির লোক’। যিনি অন্তত রুটি–রুজির সমস্যাটা বোঝেন।
লক্ষ্য করুন, হ্যাটট্রিক নিশ্চিত করে সন্ধ্যায় কনট প্লেসের প্রাচীন হনুমানজির মন্দিরে গিয়েছেন প্রণাম করতে। ওই মন্দিরেই মাথা ঠেকিয়ে তিনি নির্বাচনী মনোনয়নপত্র দাখিল করতে গিয়েছিলেন। আসলে তা করেছিলেন নিজে কতটা ধার্মিক, তা বোঝাতে নয়। করেছিলেন হিন্দুত্ববাদী বিজেপিকে বোঝাতে, তিনিও প্রকৃত হিন্দু। আরও বোঝাতে চেয়েছিলেন, প্রকৃত হিন্দু কখনও হিন্দুস্তানের শত্রু হতে পারে না। এভাবে নরম হিন্দুত্বের নামাবলি তাঁকে জড়াতে বাধ্য করেছিল কিন্তু বিজেপিই। এবারের মতো এত তিক্ত, এত কদর্য, এত বিদ্বেষপূর্ণ প্রচার দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে আগে দেখা যায়নি। গত একমাসে বিজেপি–র প্রচারের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন শাহ। নামিয়েছিলেন ২৪০ সাংসদ–সহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের। প্রধানমন্ত্রী নিজে সভা করেছেন। ভোট প্রচারে খোদ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুরের মিছিল থেকে স্লোগান উঠেছে, ‘দেশ কি গাদ্দারকো, গোলি মারো শালোকো।’ শাহিনবাগ নিয়ে কেজরিওয়ালকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ তকমা জুড়ে দেওয়া হয়েছে। দলে বাড়তি জোশ আমদানি করতে অমিত শাহ প্রচারের অভিমুখ বদলে দেওয়ার পর কেজরিওয়াল হয়ে গিয়েছিলেন টুকরে টুকরে গ্যাংয়ের প্রশ্রয়দাতা। প্রকারান্তরে পাকিস্তানের ‘দালাল’। শাহিনবাগের বিরুদ্ধে কেন তিনি রা কাড়ছেন না, অবরোধ সরাতে কেন পুলিসকে বলছেন না, এমন ধরনের কথা তাঁকে শুনতে হয়েছিল। শুনতে হয়েছিল, তিনি ‘টেররিস্ট’। কেন টেররিস্ট, তার ব্যাখ্যা শুনিয়ে বিজেপির এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেছিলেন, সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মের অনেক প্রমাণ নাকি তাঁদের কাছে রয়েছে। কেজরিওয়াল সব শুনেছেন। কিন্তু সেই অর্থে জবাব দেননি। বরং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে জনতার কাছে পাল্টা জানতে চেয়েছেন, ‘আপনারাই বলুন, আমি সন্ত্রাসবাদী কি না। যদি মনে হয় তা-ই, তাহলে আমাকে ভোট দিতে হবে না।’ ঠিক এই সময়ই আম আদমি পার্টি পাল্টা স্লোগান তোলা শুরু করে: ‘লাগে রহো কেজরিওয়াল’। আপ-এর এই থিম সংটি তৈরি করেছিলেন বলিউডের বিখ্যাত সুরকার বিশাল দাদলানি। তার প্রতিটি শব্দে গত পাঁচ বছরে সরকারি কাজের খতিয়ান। কেজরিওয়াল নিজে ভোটারের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন ‘আপকা বেটা’ হিসেবে। ফলে বিভাজনের রাজনীতি শুধু ব্যর্থ হয়নি, দিল্লিতে একেবারে বেআব্রু হয়ে গিয়েছে বিজেপি।
এই সময়ই একের পর এক ঘটে গিয়েছে জেএনইউ ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের হামলা, জামিয়ার মিছিলে ‘ইয়ে লো আজাদি’ বলে গুলি চালানো, জামিয়ার মিছিলে পুলিসের বেলাগাম লাঠিচার্জের মতো ঘটনা। প্রতিটি ক্ষেত্রে কাঠগড়ায় বিজেপি, এবিভিবি বা অমিত শাহের দিল্লি পুলিস। এ সব যত ঘটেছে, তত উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলে গিয়েছেন বিজেপি নেতারা। যোগী আদিত্যনাথও ঘাড় নেড়ে জোরগলায় বলেছিলেন, এটাই সেরা উপায়। ভোটের ফলাফলে দেখা গেল, শাহিনবাগের সেই ‘কারেন্ট’-এ ঘায়েল হয়েছে বিজেপিই। দিল্লির বাঙালি মহল্লায়ও ফোটেনি পদ্ম। কালকাজি থেকে গ্রেটার কৈলাস সর্বত্রই আপ ঝড়। রাজধানী দখলের লড়াইয়ে দিল্লিনিবাসী বাঙালিরা বুঝিয়ে দিয়েছেন ধর্মীয় ভেদাভেদ তাঁরা মানবেন না। বরং যারা এই ভেদাভেদ করতে আসবে তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন তাঁরা।
কেজরিওয়াল পাশে পেয়েছিলেন ভোটকৌশলী প্রশান্ত কিশোরকে। সেই প্রশান্ত কিশোর, যাঁর সংস্থা অর্থের বিনিময়ে গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়দের ভোটের স্ট্র্যাটেজি তৈরিতে সাহায্য করেছেন ও করছেন। আম আদমি সুপ্রিমোকে নাকি প্রশান্ত কিশোর বলেছিলেন, উন্নয়নের মুখ হয়ে উঠতে হবে। অর্থাৎ বিরোধীদের ভুলত্রুটি না খুঁজে-বিজেপির সমালোচনা না করে রাজ্যের উন্নয়নকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব, সেদিকেই মন দিতে হবে। বিজেপি গোটা প্রচারকে হিন্দুস্তান-পাকিস্তানে টেনে আনলেও সেই ফাঁদে পা না দিয়ে কেজরিওয়াল উন্নয়ন ও নাগরিক পরিষেবার গণ্ডিতে আবদ্ধ থেকেছেন। পিকে জানতেন, লড়াইটা নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহের মতো হেভিওয়েট মগজাস্ত্রের বিরুদ্ধে। তাই বিজেপি যখন ভোট পেতে ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা করল, তখন আপের জয় নিশ্চিত করতে কেজরির রোজনামচায় হনুমান চালিশা জুড়ে দিলেন প্রশান্ত কিশোর। বিজেপি নেতা কেজরিকে ‘জঙ্গি’ আখ্যা দিতেই প্রতিবাদ মিছিল করাও স্ট্র্যাটেজিরই অংশ। শুধু তাই নয়, অযোধ্যায় রাম মন্দির তৈরির জন্য যেদিন কেন্দ্র ট্রাস্ট গঠনের ঘোষণা করে, সেদিনও পিকের ঝুলিতে গচ্ছিত ছিল দাওয়াই। পরিকল্পনা করেই সমস্ত সংবাদপত্রের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল আপ সুপ্রিমোর ইন্টারভিউ। যাতে শিরোনামে তিনিও সমান গুরুত্ব পান। প্রশান্ত কিশোরের এই সব ছোটখাটো গুগলিতেই দিল্লিতে বাজিমাত হয়েছে। বিজেপির ফাঁদে পা দেননি কেজরিওয়াল। উল্টে মোদির কাছ থেকে ধার করে তিনি প্রচারে জনতার কাছে জানতে চেয়েছেন, ‘কাকে ভোট দেবেন? নামকে (নরেন্দ্র মোদি), নাকি কাজকে?’ প্রতিশ্রুতি হয়তো আরও অনেক কিছুই ছিল। সব পূরণ করতে পারেননি। কিন্তু দিল্লির মানুষ দেখেছে, কেজরিওয়াল সরকারের অন্তত সদিচ্ছা আছে। সত্যিই কিছু করতে চায়। সাধারণ মানুষকে সুরাহা দিতে চায়। মানুষ তাই তাদের বিমুখ করেনি। রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে ২১ বছরের অজানা-অচেনা বিজেপির উপর ভরসা না রেখে ঘরের মানুষ চেনা কেজরিওয়ালকেই তাঁরা কাছে টেনে নিয়েছেন। একইসঙ্গে দিল্লির নির্বাচনী রাজনীতির দৃশ্যপট থেকে শূন্যে নামিয়ে এনেছেন কংগ্রেসকেও।
২০১২ সালের নভেম্বরে যখন জনসমক্ষে এসেছিল আম আদমি পার্টি, তখনও কি কেউ ভেবেছিল নতুন এই দলটা আগামী আট বছরে ইতিহাস গড়বে? শুধু কি ইতিহাস গড়া, উল্টে দেবে সব হিসেব নিকেশ? কোনও রাজনৈতিক পরিচিতি ছাড়াই একটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করাই শুধু নয়, কংগ্রেস-বিজেপির মতো বর্ধিষ্ণু দলকে পিছনে ফেলে পর পর তিন বার তাঁর দল আসবে দিল্লির ক্ষমতায়?
এমন দিনেই নিশ্চিন্তে ‘মাফলার ম্যান’ মুচকি হেসে বলতে পারেন, ‘নাথিং সাকসিডস লাইক সাকসেস।’