রাজনীতির ময়দানে একের পর এক ধাক্কা সামাল দেওয়ার ফুরসত নেই, তারই মধ্যে নরেন্দ্র মোদির কাছে আরও বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে এল দেশের অর্থনীতি। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন ‘সমস্যা কিছু রয়েছে ঠিকই, তবে আর্থিক মন্দা নয়। আমরা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াচ্ছি’ জাতীয় দাবি করলেও তা যে আদপে ফাঁপা আওয়াজ, তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে দেশবাসী। ভারতের জাতীয় গড় উৎপাদনের হার ৫ শতাংশে নেমে যাওয়ার পরও কেন্দ্রীয় সরকার দাবি করে এসেছে, ওটা ৬.৭ শতাংশ হয়ে যাবে। উন্নতির লক্ষণ তো দূরঅস্ত, আর্থিক বৃদ্ধি নেমে এসেছে সাড়ে ৪ শতাংশে। অর্থমন্ত্রকের সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কোর সেক্টর আউটপুট মাইনাস ৫.৮-এ নেমে গিয়েছে। অর্থাৎ ধাক্কা খেয়েছে উৎপাদন, নির্মাণশিল্প ও বিদ্যুৎক্ষেত্র। নির্মাণশিল্পকে বাঁচানোর চেষ্টা বেশ কয়েকমাস যাবৎ চালিয়ে যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদি সরকার। বিভিন্ন ছাড়ের পাশাপাশি প্যাকেজ পর্যন্ত ঘোষণা করা হয়েছে। তাতে অবশ্য এখনও খুব একটা আশার আলো দেখা যায়নি। মানুষের হাতে টাকা নেই, তাই খুব স্বাভাবিকভাবেই বাড়ি বানানো বা ফ্ল্যাট কেনার মতো দুঃসাহস সাধারণ মধ্যবিত্ত দেখিয়ে উঠতে পারছে না। দেশের যে অংশের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে বাজারে সরাসরি প্রভাব পড়ে, তারা মধ্যবিত্ত। তারা যদি কোনও পণ্য না কেনে, তাহলে বাজারে চাহিদা তৈরি হবে না। এবং চাহিদা তৈরি না হলে খুব স্বাভাবিকভাবেই পণ্য সরবরাহ কমবে। অর্থাৎ, সংস্থাগুলি পণ্য উৎপাদন কমিয়ে দেবে বা বন্ধ করে দেবে। মার খাবে উৎপাদন শিল্প। এবার উৎপাদন শিল্প যদি ধুঁকতে শুরু করে, তাহলে তার প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎক্ষেত্রে। যা গত অক্টোবর মাসে হয়েছে। বিদ্যুতে বৃদ্ধির হার কমে হয়েছে ৩.৬ শতাংশ। উৎপাদন শিল্প ধাক্কা খাওয়ার যদি এটা পরোক্ষ ফল হয়, তাহলে সরাসরি এই আগুনের আঁচ পড়বে সাধারণ মানুষের উপর। ইতিমধ্যেই বহু মানুষ কাজ হারিয়েছেন। দেশের আর্থিক সঙ্কট এভাবে বাড়তে থাকলে আরও মানুষ কাজ হারাবেন। নতুন করে কর্মসংস্থান তো তৈরিই হয় না।
কথায় বলে, শূন্য কলসি বাজে বেশি। মোদি সরকার আপাতত এই নীতিতেই বিশ্বাসী। ‘আচ্ছে দিনে’র যে স্বপ্ন নরেন্দ্র মোদি পাঁচ বছর আগে দেখাতে শুরু করেছিলেন, সেই স্বপ্ন দেখানো আজও চলছে। যদিও তার বিন্দুমাত্র বাস্তবায়িত হয়নি। নোট বাতিল এবং জিএসটির নড়বড়ে প্রয়োগের পর দেশের শিল্প-বাণিজ্যে যে ধাক্কাটা লেগেছিল, সেই পরিস্থিতি থেকে আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি বেশিরভাগ মানুষ। ছোটখাটো ব্যবসা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কেউ কেউ বিপুল পরিমাণ ছাঁটাই এবং কর্মীদের বেতন কাটছাঁট করে টিমটিম করে চালাচ্ছে। শুধুমাত্র কোটিপতি ব্যবসায়ীদের দিকে তাকিয়ে থাকলে আসল চিত্রটা সামনে আসবে না। নোট বাতিলের পর থেকে বেকারত্ব বেড়েছে তা তো কেন্দ্রীয় সরকারই স্বীকার করেছে।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু প্রথম থেকে মোদি সরকার এবং সেই ‘ফাঁকা কলসি’ সম্পর্কে সতর্ক করে গিয়েছিলেন। তাঁর সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। হয়তো মোদি সরকার চেষ্টা করছে। কিন্তু তা মোটেও যথেষ্ট হচ্ছে না। সাধারণ মানুষের রান্নাঘরে আজ আগুন। ১০০ টাকা কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। সব্জির দাম আকাশছোঁয়া। বাড়ছে ডিম, মুরগির দামও। গ্যাসের ভর্তুকি কমছে। অগ্নিমূল্য হচ্ছে পেট্রল, ডিজেল। এই সবই কিন্তু একে অপরের সঙ্গে জড়িত। আর্থিক হাল যত খারাপ হবে, ধীরে ধীরে তা গ্রাস করবে দেশকে। মানুষকে। মনমোহন সিং কিন্তু বলেই দিয়েছেন, আর্থিক হাল নিয়ে যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, সেই প্রবণতা চলতে থাকলে পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতি স্বপ্নই থেকে যাবে।
রাজনীতির লড়াই চলবে। নরেন্দ্র মোদির সামনে কিন্তু এখন
একটাই চ্যালেঞ্জ হওয়া উচিত। অর্থনীতি। কারণ, তার সঙ্গে মানুষ জড়িয়ে। দেশ জড়িয়ে।