মাঝরাতেই শিবির বদল শারদ পাওয়ারের ভাইপোর। রাতের অন্ধকারে মহারাষ্ট্রের রাজনীতিতে নাটকীয় পরিবর্তনের অন্যতম প্রধান চরিত্র হয়ে উঠলেন এনসিপি নেতা অজিত পাওয়ার। কোন অজিত পাওয়ার? ফড়নবিশ যাঁকে দুর্নীতির দায়ে জেলে পাঠিয়েছিলেন। অতঃপর সেই অজিতের হাত ধরেই মহারাষ্ট্রে ফের সরকারে বিজেপি। শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস, এই তিন দলের সরকার গঠনের স্ক্রিপ্ট যখন চূড়ান্ত, তখনই সবার অগোচরে অন্য ইতিহাস লিখলেন দেবেন্দ্র-অজিত জুটি। প্রতিপক্ষের যখন ঘুম ভাঙল, ততক্ষণে হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে মহারাষ্ট্রের মসনদ। পাওয়ারের ঘর ভাঙিয়ে মহারাষ্ট্রে রাতারাতি সরকার গড়ে ফেলল বিজেপি। আরব সাগরে সূর্যোদয়ের আগেই মুম্বই পেল দ্বিতীয়বারের মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশকে। তারপর থেকেই যে কথাটা ঘুরে বেড়াচ্ছে তা হল, কেন অজিত পাওয়ার এমন একটা কাজ করলেন? কেন অজিত পাওয়ার কাকা শারদকে এতটা ধাক্কা দিলেন? এর উত্তরে ১৫ বছর আগের স্মৃতি ফিরিয়ে আনছেন অনেকেই। ২০০৪ সাল। দ্বিতীয় বারের জন্য কংগ্রেস-এনসিপি সরকার গঠিত হয়েছে। এনসিপির আসন সে-বার কংগ্রেসের থেকে বেশি। স্বাভাবিকভাবেই মনে করা হয়েছিল শারদ পাওয়ারের ভাইপো অজিত পাওয়ার মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিতে বসবেন। কিন্তু, প্রখর রাজনৈতিক বুদ্ধিধারী শারদ পাওয়ার, নিজেদের মুখ্যমন্ত্রিত্বের দাবি ছেড়ে দিয়ে আরও দুটো ক্যাবিনেট মন্ত্রক চেয়ে বসলেন। সেই থেকেই শুরু অজিত পাওয়ারের ক্ষোভ। মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়ায়, কাকার উপর রাগ ছিল তখন থেকেই। সেই সুযোগটাই এবার তিনি নিলেন। এর বাইরে ইডি ও এসিবি (দুর্নীতি দমন শাখা) তো রয়েইছে। অজিত পাওয়ারের নামে সেচ-দুর্নীতির গুচ্ছ অভিযোগ রয়েছে। একথাও শোনা গিয়েছিল, তিনি যে-কোনও সময় গ্রেপ্তার হয়ে যেতে পারেন। এবং, এই সম্ভাব্য গ্রেপ্তারি থেকে তাঁর বাঁচার রাস্তা প্রয়োজন। ফলে, বিজেপির হাত ধরা ছাড়া তাঁর কাছে আর কোনও উপায় ছিল না। ভোটের প্রচারে খোদ প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, এনসিপি মানে ন্যাচরালি করাপ্ট পার্টি। ওদের প্রতীক ঘড়িতে দশটা বেজে থাকে। তার মানে দশ বছরে দশগুণ দুর্নীতি। সেই প্রধানমন্ত্রী সরকার গঠনের পর ফড়নবিশের পাশাপাশি অজিত পাওয়ারকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। কোনও সংবাদপত্রে এই নয়া পর্বের ইঙ্গিত পর্যন্ত ছিল না। আসলে ভারতের রাজনীতিতে সব সম্ভব!
আর শারদ পাওয়ার? কখনও মনে করা হয়েছিল, তিনি হিরো। কখনও আবার মনে করা হচ্ছে তিনিই ভিলেন। বিজেপির মহারাষ্ট্রে সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে যিনি একাহাতে শেষ পর্যন্ত বানচাল করে দিতে পারেন। ‘মারাঠা স্ট্রংম্যান’কে যাঁরা কাছ থেকে চেনেন, তাঁরা জানেন শরদ পাওয়ার মানেই গোলকধাঁধা। যাঁর ডান হাতও জানে না বাঁ হাত কী করবে! কয়েকদিন আগে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে ৪৫ মিনিটের একান্ত বৈঠক হয়েছিল পাওয়ারের। সেই বৈঠকে মহারাষ্ট্রের এই চিত্রনাট্যেরই নকশা তৈরি হয়েছিল কি না, ঘরে-বাইরে তা নিয়ে শুরু হয়েছে তুমুল চর্চা। কংগ্রেসের নেতারাও বলতে শুরু করেছেন, ‘‘পাওয়ার বলেন এক, ভাবেন এক, করেন আর এক।’’ ১৯৭৮ সালে অজিতের মতোই বসন্তদাদা পাতিলের দলে ভাঙন ধরিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন শারদ নিজেও। সেদিন তিনি যেভাবে ক্ষমতার টানে দল ছেড়েছিলেন, ৪১ বছর পর যেন সেই ঘটনারই পুনরাবৃত্তি ঘটল তাঁর পরিবারেও। ‘অবাধ্য’ ভাইপো অজিত পাওয়ার দলের বিরুদ্ধে হেঁটে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে শপথ নিয়েছেন উপমুখ্যমন্ত্রী পদে। অজিত কি সত্যিই শারদের অবাধ্য হলেন? নাকি মারাঠা স্ট্রংম্যানের তৈরি করা নেপথ্য নকশা অনুযায়ীই সব ঘটে গিয়েছে? এ প্রশ্নও মহারাষ্ট্রে ওঠা শুরু করেছে। সবকিছুর পরেও মহারাষ্ট্র ভুলবে কী করে দেবেন্দ্রর সেই বক্তৃতা! অজিতের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগের প্রসঙ্গ তুলে একের পর এক জনসভায় ‘শোলে’র সংলাপ উদ্ধৃত করে দেবেন্দ্র বলতেন, ‘‘বিজেপি ফের ক্ষমতায় আসবে। তারপর অজিত চাক্কি পিসিং অ্যান্ড পিসিং অ্যান্ড পিসিং ...।’’
রাজনীতি সম্ভাবনার অনন্ত এলগোরিদম! এখানে কোন সময় কোন ইকুয়েশন ক্লিক করে যায় তা বোঝা মুশকিল। বিজেপির ‘গেমপ্ল্যান’, অজিত পাওয়ারের শক্তি, শারদ পাওয়ারের ভূমিকা—সংশয় অনেক কিছু নিয়েই। অতএব, মহারাষ্ট্র আপাতত জল্পনার স্বর্গরাজ্য।