চলতি সপ্তাহেই সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে পেঁয়াজ। কালোবাজারি রুখতে সরকারের এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ রয়েছে। নজরদারির জন্য রয়েছে টাস্ক ফোর্স। কিন্তু, সেসবকে কলা দেখিয়ে খুচরো বাজারে চলছে ‘পেঁয়াজের দাদাগিরি’। পরিস্থিতি এমনই যে, আপেলের মতো দামি ফলকে হারিয়ে মহার্ঘ তকমা ছিনিয়ে নিয়েছে সে। ব্যবসায়ীদের দাবি, অতিবৃষ্টি, অকাল বর্ষায় মহারাষ্ট্রে পেঁয়াজ পচে যাওয়ায় ফল ভোগ করছে এরাজ্য। এবছরের মে মাস থেকেই পেঁয়াজের দামে ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা গিয়েছে। ঠিকই, দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ চাষ হয় মহারাষ্ট্রে। দেশের ৭০ শতাংশ পেঁয়াজ উৎপন্ন হয় সে-রাজ্যে। মহারাষ্ট্রে নাসিক জেলার লাসালগাঁও দেশের সর্ববৃহৎ পেঁয়াজ বাজার। লাসালগাঁওয়ের পাইকারি বাজারে জানুয়ারি মাসের শুরুতে যেখানে ছিল কুইন্টাল প্রতি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, সেখানে মে মাসের পর সে দাম বেড়ে যায় ১০০০ টাকার উপরে। লাসালগাঁওতে পেঁয়াজের দাম বাড়লে সারা দেশে পেঁয়াজের দাম বাড়ে, সেখানে দাম কমলে সারা দেশে পেঁয়াজের দাম কমে। অথচ, শুনলে অবাক হবেন, গত দু’মাস ধরে পেঁয়াজের ঝাঁঝে যখন নাস্তানাবুদ গোটা দেশ, তখন মহারাষ্ট্রের চাষিরা দাম পাচ্ছেন কেজি প্রতি মাত্র ৮ টাকা। এমন ভিডিও ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। চাষির কাছ থেকে বিক্রি হওয়ার পর ওই পেঁয়াজ কয়েক হাত ঘুরে পাইকারি বাজারে আসে। সেই বাজারে পেঁয়াজ বিকোচ্ছে কেজি প্রতি কোথাও ৬০, কোথাও-বা ৬৫ টাকা। অর্থাৎ চাষি এবং পাইকার দু’জনের মধ্যে যেসব হাত ঘুরছে পেঁয়াজ, সেখানেই প্রায় ৫০-৫৫ টাকার ফারাক তৈরি হয়ে যাচ্ছে। আর সেই পেঁয়াজ যখন খুচরো বাজার থেকে ক্রেতা কিনছেন, তাঁকে দিতে হচ্ছে কেজি প্রতি ১০০ থেকে ১২০ টাকা! কেন? তার কোনও উত্তর নেই।
অন্যান্য নিরামিষ পদ রান্নাও মহার্ঘ হয়ে উঠেছে। আলুও তো চড়া দামের দিকে এগোচ্ছে। নতুন আলুর দাম কেজি প্রতি ২৬ টাকা হয়ে গিয়েছে। চন্দ্রমুখীর দাম তার আশপাশেই। জ্যোতি আলু ২২ টাকা। এই সময় আলুর দাম এত হওয়া উচিত নয় বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীদের একাংশ। আলু ১০ থেকে ১২ টাকা, পেঁয়াজও ২০ থেকে ২৫ টাকা হলে মধ্যবিত্তের নাগালেই থাকত। কিন্তু পেঁয়াজের জোগান এবং একাংশের অসাধু ব্যবসায়ীদের জন্যে পাইকারি মার্কেট থেকে খুচরো মার্কেটে আলু-পেঁয়াজের দামের হেরফের হচ্ছে। ঘণ্টার ফারাকেই বেড়ে যাচ্ছে সেই দাম। কেউ দোষ দিচ্ছেন বৃষ্টিকে। কারও অভিযোগ, আমদানি কম। একাংশের নালিশ, মাঝখানে থাকা ব্যবসায়ীরা বেশি লাভ করে যাচ্ছেন। কোনও কোনও হোটেলে পোস্টার সাঁটানো হয়েছে, ‘পেঁয়াজ চেয়ে লজ্জা দেবেন না।’ ফাস্টফুড দোকানগুলোয় কাঁচা পেঁয়াজ দেওয়া হলেও অনেক কমে গিয়েছে পরিমাণ। কেউ কেউ পেঁয়াজের সঙ্গে মিশিয়ে দিচ্ছেন মুলো। কেউ আবার একমুঠো পেঁয়াজের বদলে দুই আঙুলে মেপে গ্রাহকের প্লেটে তুলে দিচ্ছেন ‘বহুমূল্য’ পেঁয়াজ। সেই ঝাঁঝে দিশেহারা রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ।
দাম নিয়ে চাপানউতোর চলছেই। প্রশ্ন উঠছে বাজারে নজরদারি নিয়ে। পাইকার ও খুচরো বিক্রেতাও একে অপরের দিকে আঙুল তুলছেন। মাঝে পড়ে পেঁয়াজের এই ঝাঁঝে চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে চাষি ও খুচরো ক্রেতার। এক দল দাম পাচ্ছেন না। অন্য দল, কয়েক গুণ দাম দিয়ে বাজার থেকে তা কিনছেন। মানুষও এটা বুঝে গিয়েছেন যে, পেঁয়াজ ‘হোর্ড’ করা হচ্ছে, অর্থাৎ স্টকে জমা করা হচ্ছে, যাতে দাম আরও বাড়লে বাজারে একটু একটু করে ছাড়া যায়। কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করা হচ্ছে। অনেকটা শেয়ার বাজারের মতো আর কী! এখন যা পরিস্থিতি, তাতে তো ব্যবসায়ীরা চাইলেই নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী দাম ঠিক করে নিতে পারেন। এই দামের ওঠাপড়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না সরকার? সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণে স্পেশাল টাস্ক ফোর্স এবং এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চকে নজরদারি জোরদার করতে বলেছেন। এরপর কলকাতার এবং জেলার গুরুত্বপূর্ণ পাইকারি ও খুচরো বাজারে দাম নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমে পড়েছেন অফিসাররা। নজরদারির ফলে দাম কমেওছে কিছুটা। কিন্তু, নজরদারি সরলেই ফের যে কে সেই! বাধ্য হয়ে রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সংস্থা নাফেড-এর কাছে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহে ২০০ মেট্রিক টন করে মোট ৮০০ মেট্রিক টন পেঁয়াজ চেয়েছে। এই পেঁয়াজ পাওয়া গেলে সমস্যা খানিকটা মিটবে বলে আশাবাদী সরকার। সেইসঙ্গে জানুয়ারির মাঝামাঝি বাজারে আসতে শুরু করবে রবি চাষের পেঁয়াজ। ফলে, তারপর থেকে পেঁয়াজের জোগান অনেকটা স্বাভাবিক হবে। আশার আলো বলতে ওইটুকুই!