সমৃদ্ধ দত্ত, নয়াদিল্লি: সবই করলেন প্রধানমন্ত্রী। রাহুল গান্ধীকে শিশু আখ্যা দিলেন। কংগ্রেসকে বললেন নরখাদক পশু। মহাজোট ‘ইন্ডিয়া’য় ফাটল ধরাতে মরিয়া চেষ্টা চালালেন। বললেন, ‘কংগ্রেস পরজীবী, আপনাদের ভোটব্যাঙ্ক হরণ করে বেঁচে আছে।’ হুঁশিয়ারি দিলেন রাহুলকে, ‘কেউ যেন না ভুলে যান যে, তাঁর বিরুদ্ধে একঝাঁক মামলা চলছে। জামিনে আছেন।’ বিরোধীদের তাবৎ অভিযোগকে মিথ্যা বলে উড়িয়েও দিলেন। কিন্তু তারপরও অষ্টাদশ লোকসভায় নরেন্দ্র মোদির দু’ঘণ্টার প্রথম ভাষণের প্রতিপাদ্য কী?—১০ বছর পর সংসদে মোদির কাছে সরকার আছে, আধিপত্য নেই। উধাও অথরিটিও। গরিষ্ঠতাহীন বিজেপি বনাম শক্তিশালী বিরোধী—এই নাটকীয় রাজনৈতিক প্লটে চরম সংঘাতের সম্ভাবনা ছিলই। সেটাই সত্যি হল। ১০ বছরে যা ছিল বেনজির, সেটাই ঘটল লোকসভায়। মোদিকে গলা চড়িয়ে, ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে এবং কোণঠাসা হয়েই ভাষণ দিতে হল। কারণ দু’ঘণ্টা ধরে স্লোগান, বিক্ষোভ, বিদ্রুপ এবং সর্বোপরি ওয়েলে এসে তাঁর মুখের সামনে লাগাতার শোরগোল করে বক্তৃতায় বাধা দিয়ে গেল ‘ইন্ডিয়া’। মোদি যখনই বিরোধীদের ভোটপ্রচারকে আক্রমণ করেছেন, বিরোধীরা চিৎকার করেছে। স্লোগান উঠেছে, ‘ঝুট বোলে কাউয়া কাটে’। মোদি যখনই রাজ্যে রাজ্যে এবার তাঁর দলের আসন প্রাপ্তির ফিরিস্তি দিয়েছেন, বিরোধীরা তাঁর কণ্ঠস্বর ছাপিয়ে বলেছে, ‘মণিপুর....মণিপুর...।’ মোদি টেনে এনেছেন জরুরি অবস্থা। বিরোধী বেঞ্চে স্লোগান উঠেছে, ‘জয় সংবিধান...।’
মঙ্গলবার লোকসভায় রাষ্ট্রপতির অভিভাষণের উপর আলোচনায় সরকারের জবাবি ভাষণ। আর শুরু থেকেই সতর্ক মোদি। মুখ ফসকে যেন ‘আমিত্ব’ না প্রকাশ পায়। অতএব বলে চললেন, ‘আমরা দুর্নীতির অবসান ঘটিয়েছি। আমরা পাকিস্তানে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক করেছি। আমাদের সরকার ৩৭০ ধারার অবসান ঘটিয়েছে। ২৫ কোটি গরিবকে দারিদ্র থেকে মুক্তি দিয়েছে এনডিএ সরকার। আমরাই প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা এনেছি।’ সোজা কথায়, ‘হাম, আমরা, আমাদের’। নরেন্দ্র মোদির ভাষণে মোদিই নেই! নেই শ্রীরামচন্দ্র! মোদির চোখের সামনে বিরোধী বেঞ্চে বসেছিলেন অযোধ্যা থেকে জিতে আসা ‘ইন্ডিয়া’র এমপি অবধেশ প্রসাদ। রামচন্দ্রের আশীর্বাদে আর প্রবেশ করলেন না মোদি। বললেন মহাপ্রভু জগন্নাথের কথা। বিকেল সাড়ে ৪টা থেকে সাড়ে ৬টা পর্যন্ত তাঁর প্রতিটি বাক্যকে যেভাবে ব্যঙ্গ করে স্লোগান তোলা হয়েছে, সেটা যে ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ নামক ইংরেজি প্রবাদের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। আর এটা সবথেকে ভালো বুঝেছেন স্পিকার ওম বিড়লা। মাঝেমধ্যেই রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছেন বটে, আদপে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কারণ, সপ্তদশ নয়, এটা অষ্টাদশ লোকসভা। তিনশো পার নয়, সংখ্যালঘু বিজেপি। ওম বিড়লা বললেন, ‘এভাবে আগামী পাঁচ বছর চলতে পারে না!’
এই অভূতপূর্ব বিরোধিতা দেখে মোদি বললেন, ‘যুক্তি-তর্ক না থাকলেই এভাবে চিৎকার চেঁচামেচি করে।’ তাঁর কটাক্ষ, ‘কংগ্রেস তো ফেল হওয়ার ওয়ার্ল্ড রেকর্ড গড়ে ফেলল। ১৩ রাজ্যে শূন্য আসন পেয়েছে।’ মরিয়া আক্রমণে বোঝালেন তাঁর আধিপত্যহীনতা। রাহুল গান্ধীর আক্রমণাত্মক ভাষণকে শিশুর সঙ্গে তুলনা করলেন মোদি। বললেন, ‘সহানুভূতির জন্য নতুন ড্রামা। কংগ্রেস নরখাদক পশুর মতো। কংগ্রেসের মুখে মিথ্যার রক্ত লেগে গিয়েছে।’
শক্তিশালী হয়ে ক্ষমতায় ফিরলে সংবিধান বদলে দেবেন—এই প্রচারের জেরে ভোটে দলিত ও অনগ্রসরদের কাছে জোর ধাক্কা খেয়েছেন মোদি। আর তাই দলিত ইস্যুতে ড্যামেজ কন্ট্রোলে কংগ্রেসকে দলিত বিরোধী প্রমাণে ব্যস্ত রইলেন মোদি। ঘুরেফিরে জওহরলাল নেহরুর ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে বললেন, ‘নেহরুই বাবাসাহেব আম্বেদকরের রাজনৈতিক কেরিয়ার ধ্বংস করার চক্রান্ত করেছেন।’ অর্থাৎ, দিনের শেষে মোদির আক্রমণের অভিমুখ থাকল কংগ্রেসের দিকেই। ‘ইন্ডিয়া’ নয়। বিরোধী জোটে ফাটল ধরানোর চেষ্টায় অন্য সদস্যদের নামোচ্চারণ করলেন না তিনি। শুধু ভাষণের শেষে পৌঁছে আমিত্বকে আর আড়াল করতে পারলেন না। বুক ঠুকে বললেন, ‘মোদি কাউকে ভয় করে না।’ কাকে বললেন? বিরোধীদের? নাকি আশ্বস্ত করলেন আগ্রাসী বিরোধিতার সামনে ম্রিয়মাণ হয়ে ট্রেজারি বেঞ্চে বসে থাকা নিজের দলকেই?