বিহারের সমস্তিপুরের রেলের অনুষ্ঠানে বিস্ফোরণটা হল। সময়টা ১৯৭৫ সালের গোড়ার দিক। ভালোরকম জখম হলেন ললিতনারায়ণ মিশ্র। দানাপুর নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে। সঙ্গে সঙ্গে। অপারেশন করতে হবে। কিন্তু না, বাঁচানো গেল না ললিতনারায়ণকে। অপারেশন টেবিলেই হৃদযন্ত্র থেমে গেল তাঁর। কে এই ললিতনারায়ণ মিশ্র? একটু পিছনে তাকাতে হবে। কংগ্রেসের খাস লোক এবং ইন্দিরা ঘনিষ্ঠ। আগে রাজনৈতিক দলগুলির কাছে ডোনেশন আসত চেকের মাধ্যমে। কোনও বড় সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান দলগুলিকে চেকের মাধ্যমেই চাঁদাটা দিত। রাজনীতির দরবারে দুধের শিশুরাও জানে, পার্টি চালানোটা শুধু কৌটো নেড়ে সম্ভব নয়। আর কোনও নেতা বা নেত্রী নিজেদের পকেট থেকেই দল চালানোর টাকা দেবেন না। তাহলে সেই টাকা আসবে কোথা থেকে? কেন, বড় বড় কোম্পানি দেবে! বিনিময়ে নানাবিধ সুযোগ সরকার বা প্রধান বিরোধীদের থেকে তারা পাবে। এটাই অলিখিত নিয়ম। চেকে টাকা নিলে সমস্যা একটাই—কংগ্রেসকে কোন সংস্থা কত টাকা দিচ্ছে, সেটা বোর্ডে লিখে রাখার মতো পরিষ্কার হয়ে যায়। বাকিদের থেকে যেহেতু তখন কংগ্রেসই বেশি টাকা পেয়ে থাকে, তাই অতিরিক্ত ‘স্বচ্ছতা’ ভাবাল ইন্দিরা গান্ধীকে। তিনি আইন করে চেকের মাধ্যমে ডোনেশন নেওয়া বন্ধ করে দিলেন। তাহলে পার্টি তহবিল ভরল কীভাবে? নগদে। কালো টাকায়। ডোনেশন হয়তো একই সূত্র থেকে এল। কিন্তু তার লেখাপড়া কিছু থাকল না। কংগ্রেসের হয়ে এই কালেকশনের কাজটা হাতেগোনা কিছু নেতা করতেন। তাঁদের মধ্যেই ললিতনারায়ণ একজন। টাকা জোগাড় হতো, আর সেটা বিলিবণ্টনের ফর্মুলা বাতলে দিতেন মিসেস গান্ধী। সম্পূর্ণ অন্তরালে থেকে। ফলে নগদের উপর যাঁরা বসে থাকতেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠতই। ললিতনারায়ণ মিশ্রর বিরুদ্ধেও উঠল। কারণ, এই কালো টাকার তহবিলটা সামলাতেন তিনিই। সংসদের সব দল তাঁকে দুর্নীতিগ্রস্ত বলে দেগে দিয়েছিল। কংগ্রেসের মধ্যেও ললিতনারায়ণকে নিয়ে বিস্তর ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল। জয়প্রকাশ তাঁর বিরুদ্ধে বেসরকারি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। তারপরই বিস্ফোরণের ঘটনা এবং ললিতনারায়ণের মৃত্যু। বলা হয়, তাঁর মৃত্যুর নেপথ্যে শক্তিশালী কারও হাত ছিল। সে অবশ্য আজও প্রমাণ হয়নি। তবে জবাব মিলেছে একটি গুরুতর প্রশ্নের—স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর সবচেয়ে বাধ্য ‘ছাত্রে’র নাম কী?—নরেন্দ্র মোদি। সরকার পরিচালনা, আগ্রাসন, পার্টি ফান্ডের ব্যবস্থা, আম জনতার ইস্যু চাপা দেওয়া... একের পর এক ক্ষেত্রে মিসেস গান্ধীকে অনুসরণ বা অনুকরণ করে গিয়েছেন মোদিজি। সেই ধারা আজও চলছে। তিনি কালো টাকার বিরুদ্ধে সরব হচ্ছেন, কিন্তু আইন কাজে লাগিয়ে কার্যকর করছেন নির্বাচনী বন্ড। সবাই জানে, বড় বড় কোম্পানি, কিংবা বেআইনি সংস্থাগুলি নিজেদের পিঠ বাঁচানোর জন্য ঢেলে বন্ড কিনছে। কিন্তু সেই সংস্থাগুলির নাম এবং কোন দলকে তারা ওই টাকা দিচ্ছে, তা জানা যাচ্ছে না।
জওহরলাল নেহরুকে ছুঁতে চেয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। পরপর তিনবার প্রধানমন্ত্রী। যে রেকর্ড ইন্দিরা গান্ধীরও নেই। সেই স্বপ্ন সফল হয়েছে মোদির। নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে ভালো হতো, দেশ-বিরোধী-সমাজের উপর ঘোরানোর ছড়িটা আরও শক্ত হয়ে উঠত। তা হয়নি। কিন্তু তাতেও খুব একটা সমস্যা নেই। ২৪০ আসন পেয়েছেন। শরিকরাও মোটামুটি ম্যানেজ হয়ে গিয়েছে। মাঝেমধ্যে ফোঁস করে ওঠা? ওটা ছোট শরিকদের চরিত্র। গা করতে নেই। তাই ধীরে ধীরে স্বমহিমায় ফিরছেন মোদিজি। তাঁর মুকুটে পালক এমনিতেই কম নেই! নোট বাতিল বা জিএসটির মতো ব্যর্থ প্রশাসনিক নীতিকে তিনি চাপা দিতে পারেন সার্জিক্যাল স্ট্রাইক দিয়ে, চূড়ান্ত আগ্রাসী হয়ে সংসদে দাঁড়িয়েই বিরোধীদের কর্মসূচিকে ‘নখরা’ বা ‘ন্যাকামো’ বলার সাহস দেখান, আবার মূল্যবৃদ্ধি বা বেকারত্বের মতো জ্বলন্ত ইস্যুকে ২৫ বছরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভুলিয়ে রাখেন। এরপরও যদি বলা হয়, ইন্দিরা গান্ধীর সবচেয়ে সুযোগ্য ছাত্র তিনি, তাহলে কি খুব ভুল হবে? এই দু’জনেরই একটি বিষয় ভীষণভাবে কমন—আধিপত্য। ক্ষমতা। ভক্তরা বলতেই পারেন, ইন্দিরা গান্ধী দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন। ওই ইমার্জেন্সি ভারতের জন্য এক কলঙ্কিত অধ্যায়। ওই একটি ক্ষেত্রেই তো নরেন্দ্র মোদি আলাদা হয়ে যান মিসেস গান্ধীর থেকে! সত্যিই কি তাই? জরুরি অবস্থা নিয়ে ৫০ বছর পরও মানুষের মনে এতটা আতঙ্ক এবং ঘৃণা কেন? কারণ আমরা জানি, ইমার্জেন্সি জারি হয়ে যাওয়া মানে নাগরিকের মৌলিক অধিকারের পঞ্চত্বপ্রাপ্তি। মত প্রকাশের অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাবার, পরিকাঠামোর দাবি... কোনওটাই আর সহজলভ্য নয়। সংবিধানের একটি ধারা ব্যবহার করে সংবিধানকেই স্রেফ শেলফে তুলে রাখা। নাঃ, নরেন্দ্র মোদি সংবিধানের ৩৫২ নম্বর ধারা কার্যকরের সুপারিশ রাষ্ট্রপতির কাছে করেননি। কিন্তু মৌলিক অধিকার সব বজায় আছে তো? বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো? কাজ করে পারিশ্রমিক পাওয়াটা যে কোনও দেশবাসীর সাংবিধানিক অধিকার। বাংলার যে মানুষগুলো ১০০ দিনের কাজে শ্রম দেওয়ার পর পারিশ্রমিকের আশায় বছরের পর বছর অপেক্ষা করেছেন, তাঁদের মৌলিক অধিকার কি লঙ্ঘিত হয়নি? মত প্রকাশ করলেই কি সমাজকর্মী বা সাংবাদিকদের দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া হয়নি? সরকারি হিসেবই বলছে, ২০১৮ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় ৬ হাজার নাগরিক ইউএপিএ বা সরাসরি রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে অভিযুক্ত হয়েছেন। তাঁরা প্রত্যেকেই কি দোষী প্রমাণিত? না। মোদি সরকাররের রিপোর্টই বলে, ২০১৪ সাল থেকে যত রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দায়ের হয়েছে, তার ৯৭ শতাংশই ছাড়া পেয়ে গিয়েছেন। তাহলে এভাবে আইনের ব্যবহার করে মত প্রকাশে তালা লাগানোর ঘটনা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা কি অস্বাভাবিক? এটা কি অলিখিত জরুরি অবস্থা নয়?
তুমি আঞ্চলিক দল হিসেবে নির্বাচনে জিততেই পারো। কিন্তু আমার ছত্রচ্ছায়ায় থাকতে হবে। না হলে বন্ধ হবে সরকারি সুবিধা, ধেয়ে যাবে এজেন্সি। বিরোধী কোনও নেতা বা নেত্রী মোদি সরকার বা বিজেপির বিরুদ্ধে সরব হলে দরজায় কড়া নাড়বে ইডি। আর তার ভবিষ্যদ্বাণী করবেন সেই গেরুয়া দলেরই কোনও তল্পিবাহক নেতা। কীভাবে? সবটাই কি প্ল্যান্টেড? উদ্দেশ্যপ্রণোদিত? এটাও কি জরুরি অবস্থা নয়? বেআব্রু হয়ে পড়বে মহামান্য ভারত সরকারের দুর্নীতি। আর সেই নিট পরীক্ষায় নতুন প্রজন্মের লক্ষ লক্ষ প্রতিনিধির আঘাতের কথা বলতে গেলে সংসদের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাবে বিরোধী দলনেতার মাইক। তাঁর কথা শুনবে না দেশ। শুনবে না অধিবেশন। নাঃ, ইমার্জেন্সি চলছে না। কিন্তু তাও সমালোচনা শোনা যাবে না। শুনতে দেওয়া যাবে না। এরপরও একে অলিখিত ইমার্জেন্সি বলা যাবে না? শোনা যায়, বিভিন্ন পত্রিকা ও চ্যানেলের সম্পাদকদের নিয়ে বৈঠকে বসেন ‘কোনও এক দলের’ শীর্ষ নেতা। প্রত্যেককে খুব বিনয়ের সঙ্গে কিছু প্রশ্ন করেন। একেবারে ব্যক্তিগত প্রশ্ন। বুঝিয়ে দেন, আপনাদের হাঁড়ির সব খবর আমাদের কাছে আছে। আর বলেন, ভোটে একটু দেখবেন। তারপর বৈঠক ছেড়ে বেরিয়ে যান। একে কী বলা যায়? গণতন্ত্র?
হয়তো তাই। সেই জোট ভরসায় ঠেলেঠুলে সরকারে আসার পর প্রথম অধিবেশনেই ইমার্জেন্সিকে রেজল্যুশন হিসেবে তুলে ধরে এনডিএ সরকার। ৫০ বছর আগের তিক্ত ক্ষতকে খুঁচিয়ে তোলে। রাষ্ট্রপতির অভিভাষণেও একটা বড় জায়গা করে নেয় সেই ইমার্জেন্সি। তুলে ধরা হয় তার কলঙ্কিত অধ্যায়। কিন্তু একবারও বলা হয় না, ওই ২১ মাস থেকে তারা কী শিখেছে। একবার এই সরকার বলে না, কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষের মতকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। তৈরি করে না কোনও নিষেধের তালিকা। এমন সমালোচনা করার মানে কী, যার থেকে কোনও শিক্ষার অবকাশ নেই? ইমার্জেন্সির প্রতিটি কলঙ্ক যদি নিখুঁতভাবে অনুসরণ করা হয়, তার নিন্দা করার কৃতিত্বই বা কোথায়?
তাও নরেন্দ্র মোদি সেটাই করছেন। করবেনও। এটাই যে তাঁর অস্ত্র! বিরোধীর শক্তিক্ষয় করে নিজের শক্তি বাড়িয়ে নেওয়া। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর লক্ষ্য, কিন্তু তাঁর প্রধান শত্রুও। লক্ষ্য কেন? একনায়কতন্ত্রের শিকড় তিনিই ভারতের মাটিতে মজবুত করেছিলেন। আর শত্রু কেন? মিসেস গান্ধী দেশের জন্য যতটা নিজেকে উজাড় করেছিলেন, যেমন নীতির প্রণয়ন করেছিলেন, তার ছিটেফোঁটাও দেওয়ার ক্ষমতা নেই এই সরকারের। ব্যাঙ্ক অধিগ্রহণ, গৃহহীন শ্রমিকদের মাথার উপর ছাদের ব্যবস্থা করা, ভূমি সংস্কার আইন, বন্ডেড লেবার প্রথার অবলুপ্তি, গরিব মানুষের ঋণ মকুব, আয়ের অনুপাতে মধ্যবিত্তকে কর কাঠামোয় সুবিধা, সবুজ বিপ্লব... তালিকা দীর্ঘ। আর এর সবই তিনি করেছিলেন ইমার্জেন্সির ওই ২১ মাসের মধ্যে। মিসেস গান্ধীর সাজিয়ে যাওয়া বাগানের ফুল তুলে এখনও সুগন্ধের কৃতিত্ব দাবি করে মোদি সরকার। কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখে, এই দেশের সংস্কারে আদৌ কতটা ভূমিকা তাদের রয়েছে?
হয়তো ইন্দিরা গান্ধী স্বৈরাচারী ছিলেন। কিন্তু তাবৎ বিশ্ব তখন জেনেছিল, ভারতের মেরুদণ্ড আছে। পাকিস্তানের পরাধীনতা থেকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ গঠনে প্রধান ভূমিকা ছিল তাঁর। স্বৈরতন্ত্রের মুখোশের আড়ালে লুকিয়ে ছিল গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষক একটি মুখ। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে ছাত্র-যুব-দেশবাসীর আন্দোলনকে দমন করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। কিন্তু শিক্ষা নিয়েছিলেন তার থেকে। তাই জরুরি অবস্থার আঁচে নির্বাচনে ভরাডুবির পরও ফিরে এসেছিলেন তিনি। স্বমহিমায়। ৫০ বছর পেরিয়েছে। আরও একটি দুর্নীতি নিয়ে ক্ষোভ দানা বাঁধছে ছাত্র-যুবর অন্দরে। প্রশ্নফাঁস... পরীক্ষা... শিক্ষা... অধিকার। এই ভারতের বিস্ফোরণ ঘটলে পরিণতি কী হবে? তখনও কি অলিখিত ইমার্জেন্সিই দমন করবে অধিকারবোধকে? নাকি হবে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি? ছাত্র নরেন্দ্র মোদির পরীক্ষা কিন্তু এখনও বাকি।