বিশেষ নিবন্ধ

মোদি সরকারে বাস্তবে কিছু‌ই বদল হয়নি
পি চিদম্বরম

বিজেপির নেতৃত্বাধীন নরেন্দ্র মোদির সরকার শপথ নিয়েছে ৯ জুন। কিন্তু এই সরকারের সূচনাটি শুভ হয়নি। মোদিজিকে ‘হেড টেবিল’ শেয়ার করে নিতে হয়েছিল টিডিপি এবং জেডি (ইউ) নেতাদের সঙ্গে। কিছু মন্ত্রিপদও বরাদ্দ করতে হয়েছে তাঁদেরকে তো বটেই, আরও একাধিক সহযোগীকেও। এমনকী লোকসভার স্পিকার নির্বাচনের জন্য তাঁকে অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শের মধ্য দিয়ে এগতে হয়েছে। মোদিজি ২২ বছর যাবৎ কোনও-না-কোনও সরকারের শীর্ষকর্তা, কিন্তু মন্ত্রিসভা গঠন এবং স্পিকার নির্বাচনে এবার তাঁকে যে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পেরতে হল তা তাঁর জন্য স্বাভাবিক নয়। 

বেশকিছু ধাক্কা 
সরকার গঠনের পর মাত্র ২০ দিনেই ঘটে গিয়েছে বেশকিছু বিপর্যয়।  ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সির (এনটিএ) ভিতরে বিস্ফোরণ ঘটে গিয়ে থাকবে। আর সেই আগুন গ্রাস করে নিয়েছে কয়েক লক্ষ শিক্ষার্থীর আশা-আকাঙ্ক্ষা। জলপাইগুড়িতে ঘটে গিয়েছে একটি ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনা। জম্মু ও কাশ্মীরে অব্যাহত সন্ত্রাসবাদী হামলা। টোম্যাটো, আলু ও পেঁয়াজের দাম বেড়ে গিয়েছে—দামবৃদ্ধির হার যথাক্রমে ৩৯, ৪১ ও ৪৩ শতাংশ। সেনসেক্স এবং নিফটি যখন ঐতিহাসিক উচ্চতায় পৌঁছেছে, ঠিক তখনই মার্কিন ও ভারতীয় মুদ্রার ( ডলার ও রুপি) বিনিময় হার হয়ে গিয়েছে সর্বনিম্ন। এদিকে দুঃসংবাদ হাইওয়েগুলিতে—টোল ট্যাক্স বাড়ানো হয়েছে ১৫ শতাংশ। বিজেপির যেসব নেতা ‘অহঙ্কার’ প্রদর্শন করছেন, আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত তাঁদের ভর্ৎসনার পাশাপাশি উপদেশও দিয়েছেন। বিজেপির নেতৃত্ব তা নিয়ে বিড়বিড় করার পর নিজের মতো সিদ্ধান্ত নিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে বিচক্ষণতাতেই বীরের শ্রেষ্ঠত্ব। বিজেপির কয়েকটি রাজ্য সংগঠনে স্থানীয় স্তরে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়তেও দেখা গিয়েছে। 
সংসদের প্রথম অধিবেশন কেটে গিয়েছে স্পিকার নির্বাচন এবং রাষ্ট্রপতির অভিভাষণ দিয়েই, তার বাইরে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। কিন্তু রুটিন মাফিক আলোচ্যসূচিতে বিতর্কের অবকাশ বিদ্যমান। প্রথা অনুসারে, সর্বাধিকবার নির্বাচিত সদস্যই লোকসভায় নবনির্বাচিত সদস্যদের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে প্রো-টেম স্পিকার মনোনীত হন, তিনি সভাপতিত্ব করেন। এই ব্যাপারে কেরলের কংগ্রেস এমপি  কে সুরেশের নাম নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ ছিল না, কারণ তিনি এবার নিয়ে মোট আটবার জয়ী হয়েছেন, পরাজিত হয়েছিলেন মাঝে একবারই। কিন্তু সরকার পক্ষ তাঁকে বাদ দিয়ে, প্রো-টেম স্পিকার পদে, মনোনীত করেছিল ওড়িশার বিজেপি এমপি বি মহতাবকে। তিনি লোকসভা নির্বাচনে জিতেছেন মোট সাতবার—প্রথম দিকে বিজেডির টিকিটে ছ’বার এবং এবার জয়ী হয়েছেন পদ্মফুল প্রতীকে। 
যে বিতর্ক এড়ানোই যেত, বিজেপি তা নিয়েও শক্তিপ্রদর্শন করল কেন? সম্ভাব্য উত্তরগুলি হল: বিজেপি এটাই বুঝিয়ে দিতে চাইল যে লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলে তাদের ‘সুপ্রিম নেতা’ কোনোভাবেই দুর্বল হয়ে যাননি। তাঁর কর্মপদ্ধতির সামনে কোনও বাধা নেই। তাঁর অ্যাটিচুড এখনও ‘পছন্দ হলে থাকো অথবা ভাগো’র জায়গাতেই রয়ে গিয়েছে। আর-একটি উত্তর হতে পারে যে, আদালত-বিতর্কে ঝড় তোলা কিরেন রিজিজু সংসদ বিষয়ক মন্ত্রিপদ পেয়ে তাঁর আগমনবার্তা দিতে চেয়েছেন। তবে সবচেয়ে যুক্তিগ্রাহ্য উত্তরটি হল, বিজেডি ছেড়ে বিজেপিতে আসা মহতাবজিকে মনোনয়ন তাঁর জন্য দলত্যাগের পুরস্কার। এর মধ্যে দলত্যাগে উৎসাহের বার্তাই রয়েছে, যাতে অন্য দলের আরও এমপি আগামী দিনে বিজেপিতে চলে আসেন। 

অপূর্ণ আশ্বাস 
স্পিকার নির্বাচন একটি অপ্রীতিকর পরিবেশেই সম্পন্ন হয়েছিল। তবে তার ছায়া অধিবেশনের বাকি অংশে পড়ার দরকার ছিল না।  কিন্তু ৪৯ বছর (হ্যাঁ, ৪৯ বছর, ৫০ নয়) আগে জারি হওয়া জরুরি অবস্থার জন্য কংগ্রেসকে অস্বস্তিতে ফেলতে মাননীয় স্পিকার তাঁর জায়গা থেকে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করলেন। তাতে যোগ হল আরও তিক্ততা! সংসদ এর পরে, পাকিস্তান (১৯৪৭ সালে কাশ্মীর আক্রমণের জন্য), চীন (১৯৬২ সালের যুদ্ধের জন্য) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের (১৯৭১ সালে ভারতকে ভয় দেখাতে বিমানবাহী রণতরি পাঠানোর জন্য) নিন্দাসহ ইতিহাসের অন্যান্য অধ্যায়ের ‘শিক্ষা দিতে পারে’।  স্পিকারের এবারের প্রস্তাবটি ছিল একটি অযৌক্তিক উস্কানি।
ভুলভাল সূচনার পরে সৌজন্য পুনরুদ্ধারের একটি সুযোগ হতে পারত উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির অভিভাষণটি। কিন্তু সেই সুযোগটি হাতছাড়া হয়েছিল সরকার পক্ষের কারণে। এবার লোকসভায় শাসক এবং বিরোধী পক্ষের মধ্যে যে সংখ্যাগত পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে, রাষ্ট্রপতির অভিভাষণে তার স্বীকৃতি প্রত্যাশিত ছিল। এটাই সত্য যে, জোট সরকারের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল বিজেপির আসন সংখ্যা গরিষ্ঠতার চেয়ে ৩২ কম রয়েছে, অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী জোটের বাকিদের মতো সমান হয়েও বাড়তি সম্মাননীয়। দশবছর পর লোকসভা একজন বিরোধী দলনেতা পাচ্ছে। পরিতাপের বিষয় এই যে, রাষ্ট্রপতির ভাষণে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কোনও উল্লেখ ছিল না। 
নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের সময় বিজেপি যেসব দাবি করেছিল, রাষ্ট্রপতির ভাষণটি ছিল তারই এক পুনরাবৃত্তি। যদিও সেই দাবিগুলি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। এই নয়া সরকার আর একটি ‘বিজেপি’ সরকার নয়, একেবারে একটি ‘জোট’ সরকার। বিজেপি এই ‘বিটারসুইট ফ্যাক্ট’ মানতে পারছে না এবং রাষ্ট্রপতির ভাষণে পাওয়া গেল তারই প্রতিধ্বনি। তাঁর ভাষণে ‘কোয়ালিশন’ বা ‘জোট’ শব্দটি পাওয়া যায়নি। ‘ঐকমত্য’, ‘মুদ্রাস্ফীতি’ এবং ‘সংসদীয় কমিটি’র মতো কিছু শব্দ তাদের অনুপস্থিতিতেই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল। রাষ্ট্রপতির ভাষণে তফসিলি জাতি, তফসিলি জনজাতি এবং অনগ্রসর শ্রেণির উল্লেখ ছিল। কিন্তু অন্যদেরকে, বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল ‘সামাজিক ও ধর্মীয় গোষ্ঠী’ কথাটির মধ্যে। তাঁর ভাষণে মণিপুর ট্র্যাজেডির কোনও জায়গা হয়নি। ‘অগ্নিবীর’ এবং ‘ইউনিফর্ম সিভিল কোড’ বা ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’রও কোনও উল্লেখ ছিল না। অবশেষে, ভারত আর ‘বিশ্বগুরু’ নয়, বরং ‘বিশ্ববন্ধু’ হতে পেরেই সে সন্তুষ্ট!

আরও অনুরূপতা 
বিজেপির দৃষ্টিতে আপাতভাবে কোনোকিছুই বদলায়নি, এমনকী মানুষের মুড বা মেজাজও নয়। তাই, একই ক্যাবিনেট, মন্ত্রীরাও একই, প্রথম সারির মন্ত্রীদের মন্ত্রকও অপরিবর্তিত, রয়ে গিয়েছেন পুরনো স্পিকারই, প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারির বদল হয়নি, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টাও রয়ে গিয়েছেন আগের ব্যক্তিই, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোর শীর্ষকর্তাটিও একই, সরকারের ল অফিসারদের ক্ষেত্রেও কোনও বদল ঘটেনি, এবং আরও অনেকেই একই পদে রয়ে গিয়েছেন। আরও শুনছি যে, সোশ্যাল মিডিয়া ভরে রাখা হয়েছে টাকা দিয়ে পোষা সেইসব অর্ধশিক্ষিত লোকজনকে দিয়েই—যারা বিভ্রান্তি ছড়াতে ওস্তাদ, অশালীনতার প্রচারে এক্সপার্ট এবং অবশ্যই হেরো। জনগণের রায়ের পরও যে কিছুই বদলায়নি, এটাই তার প্রমাণ। এটা সত্যিই উদ্বেগের বিষয়।
বাজেটের প্রাক পর্বে মানুষের কাছে সবচেয়ে উদ্বেগের দুটি বিষয় রয়েই গেল—(১) বেকারত্ব এবং (২) মুদ্রাস্ফীতি। দ্য সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজের (সিএসডিএস) ভোট-পরবর্তী সমীক্ষা (দ্য হিন্দু/ ২৫ জুন, ২০২৪) অনুসারে, ‘মূল্যবৃদ্ধি/মুদ্রাস্ফীতি’ এবং ‘ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব’ যথাক্রমে ২৯ শতাংশ এবং ২৭ শতাংশ মানুষের কাছে বিজেপি সরকারের সবচেয়ে ‘অপছন্দের’ কাজ বলে বিবেচিত হয়েছে। এই মারাত্মক দুটি উদ্বেগ নিরসনের ব্যাপারে জনগণকে যার-পর-নাই হতাশ করেছে মোদিজির মন্ত্রিসভা গঠন এবং রাষ্ট্রপতির অভিভাষণ। এমাসেই, ২০২৪-২৫ অর্থবর্ষের যে বাজেট পেশ হতে চলেছে সেটি কি মোদি সরকারকে জাগাতে সক্ষম হবে? সংসদীয় শিষ্টাচার চায় যে আমরা যেন আশা রেখে যেতে পারি।
লেখক সাংসদ ও ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী। মতামত ব্যক্তিগত
1d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পেশাগত উচ্চবিদ্যার শিক্ষায় শুভ। সাহিত্যচর্চায় মানসিক আনন্দ। কর্মোন্নতি ও আয় বৃদ্ধির যোগ। ...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮২.৬৯ টাকা৮৪.৪৩ টাকা
পাউন্ড১০৩.৮৪ টাকা১০৭.৩০ টাকা
ইউরো৮৮.১২ টাকা৯১.২৪ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা