বিশেষ নিবন্ধ

মানুষের থেকে ক্রমে দূরে সরছে বঙ্গ বিজেপি 
হারাধন চৌধুরী

একুশের লম্ফঝম্পকে ছাপিয়ে যেতে পারেননি, তবে চব্বিশে বঙ্গে যা দেখিয়েছেন মোদিজিরা তা নিঃসন্দেহে একুশের বিজেপির সঙ্গেই টক্কর! ২০২১-এ, বাংলায় ২৯৪ আসনের বিধানসভা ভোটে বাজিমাত করার খোয়াব দেখেছিল গোটা গেরুয়া শিবির। দেশের প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি, রামরাজ্যের কাণ্ডারী প্রমুখ বাংলায় ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন সম্ভাব্য যুদ্ধজয়ের আনন্দে। আরও একাধিক দিল্লিওয়ালা গেরুয়া নেতার কারবার দেখে মানুষের মনে এই ধারণাই বদ্ধমূল হয়েছিল যে, তাঁরা বাংলাতেই স্থায়ী বসত গড়তে চলেছেন! তেমন হলে কারও আপত্তিরও কিছু থাকত না। কারণ বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের সৌন্দর্যেই বিশ্বাসী বাংলা এবং বাঙালির অতিথিবাৎসল্যের জুড়ি নেই। এই কারণেই শুধু মহানগর কলকাতা নয়, পশ্চিমবঙ্গের কয়েক ডজন ছোট-বড় শহরও আপন ছন্দে ‘মিনি ভারত’ হয়ে উঠতে পেরেছে। এজন্য বাংলা এবং এখানকার মানুষের একমাত্র চাহিদা একটু ভালোবাসা। বাংলা ও বাঙালিকে কেউ যদি একবার ভালোবাসতে পেরেছে, তবে সে নিজেরই অজান্তে হয়ে উঠেছে তাদের একান্ত আপনজন। ভালোবাসা দিয়ে বাংলাকে আপন করে নিলে এখানে কাউকেই পরবাসের যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় না।  
আর এখানেই বারবার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে বিজেপি, বঙ্গসন্তান শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের হাতে ও আদর্শে তৈরি একটি পার্টি, যে নিজেকে ‘পৃথিবীর সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি’ হিসেবে জাহির করে। তাদের ব্যর্থতার কারণ ওই একটাই, দলের জনক যে-মাটির সন্তান, বিজেপি ভালোবাসতে পারেনি সেই বাংলা ও বাংলার মানুষকে। তারা বাংলাকে নতুন একটা ক্ষমতার কেন্দ্র এবং লুণ্ঠনের এক লোভনীয় রত্নখনি বানাতেই আগ্রহী কেবল, ঠিক যেমনটা করেছিল ইংরেজ রাজশক্তি। এই স্বপ্নপূরণের জন্য বিজেপির প্রথম দরকার ছিল নবান্নের দখল নেওয়া। এজন্য ‘২০০ পার’-এর হুংকারসহ একুশের ভোটে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিল সারা দেশের গেরুয়া শিবির। কিন্তু মোদি-শাহদের অশ্বমেধের ঘোড়া একশোরও অনেক আগে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। আর যায় কোথায়? এমন স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণাকে প্রতিহিংসার রূপ দেওয়া হল একেবারে সর্বোচ্চ আসন থেকে। একের পর এক কেন্দ্রীয় প্রকল্পে, একেবারে পরিকল্পনামাফিক চলল লাগাতার বঞ্চনা। তাতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হল বাংলার কয়েক কোটি গরিব মানুষ। 
মোদি সরকার মনে করিয়ে দিল চূড়ান্ত ভারত-বিদ্বেষী ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিলের নিষ্ঠুরতার কথা। ইংরেজ শাসনের সবচেয়ে ঘন কালো অধ্যায়ের শীর্ষে রাখা হয় পঞ্চাশের (১৩৫০ বঙ্গাব্দ বা ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) মন্বন্তরকে। সুজলা-সুফলা-শস্য-শ্যামলা বাংলার বুকে সেবার অন্তত ৩০ লক্ষ মানুষ অনাহারে মারা গিয়েছিল। পরবর্তীকালে গবেষকরা প্রমাণ করেছেন যে, ক্ষুধার্তের কান্না আর মৃত্যুর শোকে বাংলার আকাশ বাতাস এইভাবে ভারী হয়ে উঠেছিল পাষণ্ড চার্চিলের নির্দেশে। সমস্ত কৌশল ব্যর্থ, যাবতীয় অত্যাচার সয়েও ভারতের বীরযোদ্ধারা ঋজুশির, লড়ে যাচ্ছেন বুক চিতিয়ে। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পতন যখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে, তখনই ওই প্রতিহিংসার আগুন জ্বালিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। 
বাংলার মানুষ এবার, ৮০ বছর আগে এক সাম্রাজ্যবাদীর হাতে জ্বালানো আগুনেরই আঁচ অনুভব করল যেন! একুশে নবান্ন দখলের ব্যর্থতার জ্বালা থেকে বাংলার গরিব মানুষের কাজের অধিকার (একশো দিনের কাজ) কেড়ে নেওয়া হল। বহু মানুষকে, পরোক্ষে বাধ্য করা হল ভিন রাজ্যে, দূর দূর দেশে কাজের সন্ধানে পাড়ি দিতে। সেখানে গিয়ে কিংবা ট্রেনে যাতায়াতের পথে দুর্ঘটনার কবলে পড়েও মারা গেল অনেকে। পাকা ঘর দেওয়া হল না বলে হাজার হাজার পরিবার কষ্ট পেল শীতে ও বর্ষায়। দেওয়াল চাপা পড়ে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে একাধিক জায়গায়। এছাড়া কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং পরিকাঠামো উন্নয়নের মতো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে বঞ্চনা অব্যাহত আজও। কেন্দ্রের বেনজির বিরোধিতা, অসহযোগিতা, শত্রুতা ও ষড়যন্ত্রের পরেও বাংলায় উন্নয়নের গতি থমকে যায়নি, সৌজন্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানবিক সরকার। ভাবতে সত্যিই ভয় হয়, মোদিতন্ত্রের উল্টোদিকে বাংলায় এমন একটি সরকার না-থাকলে আজ ঠিক কী কাণ্ডটি ঘটতে পারত এখানে! 
তবু আরও একবার চেষ্টা করেছিলেন বিজেপির বেনিয়ারা, লোকসভার ভোটে জিততে গাছের আগায় জল ঢালার প্ল্যান ছকেছিলেন, নিশ্চয় ভুলে গিয়েছিলেন গাছটির গোড়া যত্নসহকারে শেষ করেছেন তাঁরাই! ভাবলেন, ‘মোদির গ্যারান্টি’কে সামনে রেখে জোরদার প্রচার করলেই কেল্লা ফতে হবেই। হায়, ‘মোদির গ্যারান্টি’র চেয়ে ‘জুমলা’ যে ভূভারতে দ্বিতীয়টি নেই, ততদিনে মুখস্থ হয়ে গিয়েছে সকলের! তবু শেষ অস্ত্র হিসেবে মোদিকে দিয়ে সারা বাংলায় করানো হল মোট ২৩টি জনসভা এবং মহানগরে একটি মেগা রোড শো। জনসভা পিছু পার্টি বরাদ্দ করেছিল ৭৫-৮০ লক্ষ টাকা, মোট খরচ দেখানো হয়েছে ২০ কোটির মতো! কিন্তু আলটিমেট রেজাল্ট এটাই দাঁড়াল যে, ৪২টি আসনের মধ্যে জয় ১২টিতে, দলের রাজ্য সভাপতিসহ একাধিক প্রার্থী জিতেছেন রীতিমতো কেঁদে-কঁকিয়ে! যার জোশ আছে সেই তো বাড়বে, বিজেপি পরিষ্কার করে দিয়েছে, দম তাদের ফুরিয়ে আসছে—১৮ থেকে এবার তারা নেমে এসেছে ১২-তে।
বিজেপির হাঁড়ির হাল হবে নাই-বা কেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বেঁধে দেওয়া তারেই যে কোরাস গেয়েছে সবাই। বাংলা এবং বাংলার মানুষের প্রতি প্রথম দুই মোদি সরকারের ভূমিকা তুলে ধরেই তাঁর পার্টি স্লোগান দিয়েছিল ‘জনগণের গর্জন/ বাংলা বিরোধীদের বিসর্জন/ তৃণমূলই করবে অধিকার অর্জন’! ভিন রাজ্যের বাসিন্দা তিনজনকে তৃণমূলের টিকিট দেওয়া নিয়ে মমতা ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে কাউন্টার করতে চেয়েছিল বিজেপি। কিন্তু ভোটাররা তাঁদের বিপুল ভোটে জিতিয়ে বাংলাকে ভালোবাসার তত্ত্বেই আস্থা রেখেছেন। বাংলাকে ভালোবাসলে যেকোনও মানুষের প্রাদেশিক এবং জাতিগত ও ধর্মীয় পরিচয় এখানে অবান্তর হয়ে যায়। বাংলাজুড়ে ভোটযন্ত্রে জনগণ মোটামুটি মমতা-অভিষেকের ইউনিক স্লোগানেই সিলমোহর দিয়েছে। তাতে কালি যেটুকু ফ্যাকাশে মনে হচ্ছিল, সেটুকুও গাঢ় করে দিয়েছে বিজেপি নিজগুণে। মোদির নেতৃত্বে গঠিত কেন্দ্রের তৃতীয় সরকারেও বঙ্গসন্তানরা একেবারে এলেবেলে! কিন্তু এই ভয়াবহ বৈষম্য বারবার কেন? এখানকার একজন এমপিও ক্যাবিনেট মন্ত্রী হওয়ার যোগ্য নন! যত যোগ্য নেতা গুজরাত, ইউপি, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানে! যে-পার্টি বাংলার মতো অত্যন্ত রাজনীতি সচেতন একটি রাজ্যের এক ডজন এমপির মধ্যে থেকে দু-চারজন ওজনদার ক্যাবিনেট মন্ত্রী খুঁজে বার করতে পারে না, তাদের এখান থেকে পাততাড়ি গোটানোই উচিত।   
কথায় বলে, ‘আপন দোষে আপনি মরে খোদার বদনাম’—বিজেপির দশাও অবিকল! হেরে ভূত হওয়ার কারণ খুঁজতে রাজ্যে রাজ্যে সক্রিয় এখন পার্টির দুই চোখ বোজা ‘গোয়েন্দারা’। সর্বত্র দলের হাঁড়ির হাল সম্পর্কে দিল্লিকে নাকি ‘গ্রাউন্ড রিপোর্ট’ দেবেন তাঁরা শীঘ্রই। খবরে প্রকাশ, দেশজুড়ে অন্তত ১৬০টি ‘দুর্বল’ লোকসভা আসন চিহ্নিত করেছেন তাঁরা। তার ভিতরে এই এক বঙ্গদেশেই ‘উজ্জ্বল’ ২৪টি! এমন বিপদকালে, আরও দুঃসংবাদ রাষ্ট্র করেছে বঙ্গ বিজেপি—মোদি সরকারের কাছে তাদের কাতর আর্জি, বঙ্গদেশে তাদের সব পার্টি অফিস পাহারা দিক কেন্দ্রীয় বাহিনী! দলের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির কাছে বাংলার নেতারা যে কাঁদুনিই গান না কেন, লোকসভা ভোট-বিপর্যয়ের রামধাক্কা যে তাঁরা কাটিয়ে উঠতে পারেননি, সেটা খোলসা করে দিলেন তাঁরাই। বঙ্গ বিজেপির এই সাহস হল না যে, একবার মুখ ফুটে বলে, ‘আমাদের সঙ্গে ও পাশে বাংলার মানুষ আছে, সুরক্ষা ও নিরাপত্তার জন্য আমরা আর কাউকেই চাই না।’ এই প্রশ্ন বড় হয়ে উঠবেই—দেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলটি কেন বলতে পারল না, ‘আমরা ভয় পাই না, কারণ মানুষই আমাদের পাহারাদার।’ কিন্তু তারা এসব বলবে কীসের জোরে? মোদি সরকারের বাংলা-বিদ্বেষ যে ইতিমধ্যেই এবং একাধিকবার প্রমাণিত। বঙ্গ বিজেপিও ধ্বংস হচ্ছে ওই বেনিয়াদের সঙ্গে লাগাতার সঙ্গত করেই। জনবিচ্ছিন্নতার এর চেয়ে বড় নজির আর কী দেখবে বাংলা?
এই প্রসঙ্গেই মনের পর্দায় ভাসে, গৌড়ীয় মার্কসবাদীদের মুষল পর্বে পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র সিপিএম পার্টির অতিমাত্রায় পুলিস-নির্ভরতার ছবিটি। তাই এখনই হলফ করে বলে দেওয়া যায়, ছাব্বিশের চ্যালেঞ্জ যত নিকটবর্তী হবে গেরুয়া বাহিনীর এই অসহায়তাও তীব্রতর হবে তত। দিল্লির তরফে বাংলাকে সবরকমে হেলাফেলা করার এবং বাংলার মানুষের পাশে না-দাঁড়ানোর জবাব আরও জুতসই করার জন্যই কোমর বাঁধবে সবাই। 
2d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

চোখের সমস্যায় মানসিক অস্থিরতা ও উদ্বেগ। কর্মস্থলে অতিরিক্ত কাজের চাপ। আর্থিক দিক শুভ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮২.৭১ টাকা৮৪.৪৫ টাকা
পাউন্ড১০৪.৭৯ টাকা১০৮.২৭ টাকা
ইউরো৮৮.৫৯ টাকা৯১.৭৩ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা