বিশেষ নিবন্ধ

নিট দুর্নীতি হিমশৈলের চূড়া মাত্র!
মৃণালকান্তি দাস

অলখ পান্ডের পরিচয় ‘ফিজিক্সওয়ালা’ নামেই। বাড়ি উত্তরপ্রদেশের প্রয়াগরাজে। ছোট থেকে পদার্থবিদ্যার প্রতি টান ছিল। কিন্তু নিজে জয়েন্ট পরীক্ষায় বসে সফল হতে পারেননি। বি টেক পড়া মাঝপথে থামিয়ে কোচিং সেন্টার খুলে বসেন। শুরু করেন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে। সেই থেকে শুরু ‘ফিজিক্সওয়ালা’র ক্লাস। অলখের কোচিং সেন্টার থেকে অনেক পড়ুয়া জয়েন্ট বা নিটের মতো পরীক্ষায় সাফল্য পেয়েছেন। অলখের সংস্থা ‘ফিজিক্সওয়ালা’ মোট ৬১টি ইউটিউব চ্যানেল চালায়। সাবস্ক্রিপশনের সংখ্যা ৩ কোটির বেশি। গত বছর তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২ হাজার কোটি টাকা। 
এই অলখ পান্ডেই সুপ্রিম কোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে দেশের শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধানের গদি নাড়িয়ে দিয়েছেন। ‘ফিজিক্সওয়ালা’র ধাক্কায় নিট-এর পবিত্রতা খান খান হয়ে গিয়েছে! প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, ডাক্তারির প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট (ন্যাশনাল এলিজিবিলিটি কাম এনট্রান্স টেস্ট)-এর ভবিষ্যৎ নিয়েও। এখনও পর্যন্ত দুর্নীতির যতটুকু সারফেসে এসেছে, তাতেই আশঙ্কা করা হচ্ছে হাজার কোটি ছাড়িয়ে যাবে দুর্নীতির অঙ্ক। এমনকী ব্যাপম দুর্নীতিকেও হার মানাবে। প্রাথমিকভাবে তদন্তকারীদের অনুমান, কেলেঙ্কারির জাল ছড়িয়ে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, হরিয়ানা, গুজরাত, ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশ, কর্ণাটক-সহ একাধিক রাজ্যে। কয়েকটি কোচিং সেন্টারও আতশকাচের নীচে। রয়েছে পরীক্ষা-মাফিয়াদের দলও। নাম জড়িয়েছে উত্তরপ্রদেশের যোগী ঘনিষ্ঠ বিধায়ক সুহেলদেব বেদীরামের।
তবে সবাইকে চমকে দিয়েছে মোদিজির গুজরাত। ২০০২-এ মোদির মুখ্যমন্ত্রিত্বের গোড়ার দিকে দাঙ্গার কারণে শিরোনামে উঠে আসা গোধরা এবারে নিট-কেলেঙ্কারির দৌলতে ফের শিরোনামে। সেখানকার জয় জলরাম স্কুলে পরীক্ষা দেওয়া ৩০ জন সন্দেহের তালিকায়। যাঁদের মধ্যে অনেকেই ভিন রাজ্যের (ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড, কর্ণাটক) পড়ুয়া। প্রশ্ন উঠছে, নিজের রাজ্য ছেড়ে গোধরার ওই কেন্দ্রে তাঁরা পরীক্ষা দিতে গেলেন কেন? প্রাথমিক তদন্তে পুলিসের অনুমান, ওই গোটা কেন্দ্রটিই জালিয়াতিতে যুক্ত! আঙুল উঠেছে ‘রয় ওভারসিজ কোচিং সেন্টার’ নামে একটি কোচিং সেন্টারের দিকে। তদন্তে প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছে, বেশ কিছু পড়ুয়ার বাবা-মা ওই কোচিং সেন্টারটির পাশাপাশি কয়েকজন শিক্ষক ও সেন্টার সুপারভাইজারকে ২ কোটি ৬৮ লক্ষ টাকা দিয়েছিলেন। অর্থাৎ গোটা পরীক্ষাকেন্দ্রটিই বিকিয়ে গিয়েছিল! পড়ুয়াপিছু ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকার বিনিময়ে উত্তর লিখে দেওয়ার ভার পেয়েছিলেন কয়েকজন শিক্ষক। ওই স্কুলের প্রিন্সিপালও এই কাণ্ডে জড়িত ছিলেন বলে অভিযোগ। সব মিলিয়ে ওই একটি কেন্দ্রেই অন্তত ১২ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছিল বলে পুলিসের প্রাথমিক অনুমান।
নিটের নিয়ম অনুযায়ী, একটি প্রশ্নের ঠিক উত্তরে ৪ নম্বর পান পরীক্ষার্থীরা। উত্তর ভুল হলে বাড়তি আরও এক নম্বর কাটা যায়। অর্থাৎ, কেউ ভুল উত্তর লিখলে পাঁচ নম্বর কাটা যাওয়ার কথা। এই হিসাবে, সব ক’টি প্রশ্নের উত্তর ঠিক হলে ৭২০ পেতে পারেন পরীক্ষার্থীরা। একটি প্রশ্নের উত্তর না লিখলে ৭১৬ পাওয়ার কথা। একটি প্রশ্ন ভুল লিখলে সর্বোচ্চ ৭১৫ নম্বর পেতে পারেন পরীক্ষার্থী। অভিযোগ, নিটের ফলপ্রকাশের পর দেখা গিয়েছে, কেউ ৭১৮ বা ৭১৭ নম্বরও পেয়েছেন। যা সাধারণ হিসাবে সম্ভব নয়। এই নম্বর নিয়েই প্রশ্ন তোলেন অলখ পান্ডে। এনটিএ-র দাবি, কিছু পরীক্ষার্থী পরীক্ষাকেন্দ্রে দেরি করে পৌঁছনোয় তাঁদের বাড়তি নম্বর দেওয়া হয়েছিল। সেই কারণেই এমন নম্বর পেয়ে থাকতে পারেন কেউ কেউ। এই দাবির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে মামলা হয়। অভিযোগ, এই দুর্নীতি চাপা দেওয়ার জন্যই লোকসভার নির্বাচনী ফল ঘোষণার দিনই ‘নিট’-এর ফল ঘোষণা করা হয়। যাতে নজর ঘুরিয়ে দেওয়া যায়।
প্রথম থেকেই কেন্দ্রীয় সরকার ও পরীক্ষা পরিচালক সংস্থা (এনটিএ) শীর্ষ আদালতের ২০১৮ সালের একটি রায়কে ঢাল করে সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছে। সুপ্রিম কোর্টের অন্য প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রেক্ষিতে দেওয়া এই অতিরিক্ত নম্বরের রায়, যেখানে পরিষ্কার বলে দেওয়া আছে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি প্রবেশিকা পরীক্ষায় এই রায় প্রযোজ্য নয়। ফলে পরিচালক সংস্থার কথা অনুযায়ী তারা যে ১৫৬৩ জনকে পরীক্ষায় কম সময় পাওয়ার জন্য অতিরিক্ত নম্বর দিয়েছে তা সম্পূর্ণ বেআইনি। আরও অভিযোগ আছে যে, যেখানে কম সময় পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে সেই বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি সেখানে এই ধরনের কোনও ঘটনাই ঘটেনি। ফলে এনটিএ-র দেওয়া ১৫৬৩ জনের তালিকা প্রশ্নের মুখে পড়ে যায়। স্বভাবতই সুপ্রিম কোর্টের রায়ে তাদের পরীক্ষা বাতিল হয়।
একইসঙ্গে ওঠে প্রশ্নফাঁসের অভিযোগও। কীভাবে এই কেলেঙ্কারির পর্দাফাঁস হয়? বিহার পুলিসের করা এফআইআর অনুযায়ী, গত ৫ মে দুপুর ২টোর সময় নিটের পরীক্ষা শুরু হয়। ঠিক ২টো ৫ মিনিট নাগাদ ফোন আসে, ন্যাশনাল টেস্টিং এজেন্সি (এনটিএ) আয়োজিত নিট পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে গিয়েছে। কিছু ছাত্র এবং পরীক্ষা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত কিছু কর্মীর যোগসাজশ রয়েছে। ‘রহস্যময়’ যে ফোনটি এসেছিল, তাতে বলা হয়েছিল রেনো ডাস্টার গাড়িতে ওই চক্রের সদস্যরা ঘুরছে। সেই ফোন পাওয়ার পরই ওই গাড়ির খোঁজ শুরু হয়। বেলি রোডের রাজবংশী নগর মোড়ের কাছে নাকাতল্লাশি শুরু করে পুলিস। ফোনের সেই বর্ণনা অনুযায়ী, বেলি রোডে একটি সাদা রঙের রেনো ডাস্টার গাড়িকে আসতে দেখে পুলিস সেটিকে আটকানোর চেষ্টা করে। ওই গাড়িতে তিনজন ছিল। চালক গাড়ি ঘুরিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সেই গাড়িকে তাড়া করে পুলিস ধরে ফেলে। ধরা পড়ে সিকন্দর যাদবেন্দু, অখিলেশ কুমার এবং বিট্টু কুমার। পুলিস গাড়ির ভিতর থেকে নিট পরীক্ষার চারটি অ্যাডমিট কার্ডের ফোটোকপি পায়। এফআইআর অনুযায়ী, সেই অ্যাডমিট কার্ডগুলি ছিল, অভিষেক কুমার, শিবনন্দন কুমার, আয়ুষ রাজ এবং অনুরাগ যাদবের। ঘটনাচক্রে, এই অনুরাগ যাদবের আত্মীয় সিকন্দর যাদবেন্দু। জেরায় সিকন্দর স্বীকার করে, তাদের কিছু পরীক্ষার্থী পাটনার আলাদা আলাদা কেন্দ্রে পরীক্ষা দিয়েছে। ওই পরীক্ষার্থীদের জন্য প্রশ্নপত্র জোগাড় করার কাজ করেছিল রাজীব সিং, রকি নীতীশ এবং অমিত আনন্দ। কিছু পরীক্ষার্থীকে ওঁরা নিজেদের সঙ্গে রেখেছিল। তাদের প্রশ্নপত্র দেওয়া এবং উত্তরও তৈরি করে দেওয়ার কাজ করেছিলেন অমিত।
৫ মে দুপুর সাড়ে ৩টে। নিটের প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর উপর মহলকে জানানো হয় পুলিসের তরফে। ধৃত তিনজনকে জেরা করে পুলিস একটি পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছয়। সেখানে আয়ুষ রাজ পরীক্ষা দিচ্ছিলেন। (যাঁর অ্যাডমিট কার্ডের ফোটোকপি পাওয়া গিয়েছিল সিকন্দরদের কাছে।) পরীক্ষা শেষ হতেই আটক করা হয় আয়ুষকে। তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিস জানতে পারে, রামকৃষ্ণনগর থানার অন্তর্গত লার্ন বয়েজ হস্টেল এবং লার্ন প্লে স্কুলে পরীক্ষার আগের দিন রাতে তাঁদের নিয়ে গিয়ে নিটের প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়। শুধু তা-ই নয়, উত্তরও তৈরি করানো হয়। আয়ুষ আরও জানান, তিনি শুধু একা নন, ২০-২৫ জন পরীক্ষার্থীকে ওই প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছিল। এই সব প্রকাশ্যে আসতেই বিহার পুলিস এবং আর্থিক দুর্নীতি দমন শাখা চার পরীক্ষার্থী অভিষেক, শিবনন্দন, আয়ুষ এবং অনুরাগকে গ্রেপ্তার করে। খোঁজ শুরু হয় ‘সলভার গ্যাং’-এর। এই দল চালাত বিহারের নালন্দা জেলার বাসিন্দা সঞ্জীব সিং মুখিয়া। তার অন্যতম সহযোগী ছিল রবি অত্রি। যে সে লোক নয় সঞ্জীব। তার স্ত্রী মমতা দেবী বর্তমানে বিহারের ভুথাখার পঞ্চায়েতের প্রধান। গত বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির শরিকদল লোক জনশক্তি পার্টির টিকিটে লড়েছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। পুলিস রবিকে গ্রেপ্তার করলেও সঞ্জীব মুখিয়া এখনও অধরা ।
অভিযোগ, এই নেতা-মন্ত্রী ঘনিষ্ঠদের খেলায় একটি দিনের একটি পরীক্ষায় উড়েছে কোটি কোটি টাকা! পরীক্ষার দিনকয়েক আগেই হোয়াটসঅ্যাপ এবং টেলিগ্রাম চ্যানেলে বিভিন্ন গ্রুপ খুলে টাকার বিনিময়ে প্রশ্ন পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। বিষয়পিছু টাকার অঙ্কটা কমবেশি ১৫ থেকে ২০ লক্ষ। অর্থাৎ চারটি বিষয়ের জন্য ৬০ থেকে ৮০ লক্ষ টাকা! উত্তর লিখে দেওয়ার জন্য ‘সলভার গ্যাং’ও রয়েছে। তারা সঠিক উত্তর লিখে দেওয়ার জন্য পরীক্ষার্থী-পিছু ১০ থেকে ১৫ লক্ষ টাকা নিয়েছে বলে প্রাথমিক অনুমান। কয়েক লক্ষ টাকার বিনিময়ে নিজের রাজ্যের বদলে ভিন রাজ্যে গিয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন বহু পড়ুয়া! সেখানে প্রায় কোনও উত্তর না লিখলেও ওএমআর শিটে ‘সঠিক উত্তর’ লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল! এ জন্য একাধিক পড়ুয়ার পরিবারের তরফে ব্ল্যাঙ্ক চেকও দেওয়া হয়েছে! ডাক্তারির সর্বভারতীয় প্রবেশিকা পরীক্ষা নিট-এর ২০২৪ সালের ফলাফল নিয়ে কেলেঙ্কারির পরে পুলিসের তদন্তে এমনই নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসছে। সব মিলিয়ে কত টাকার খেলা? কেউ জানে না!
বিরোধী দলগুলির অভিযোগ, প্রায় ২৪ লক্ষ পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ নিয়ে এভাবে ছিনিমিনি খেলার অধিকার কে দিয়েছে মোদি সরকারকে। গোটা বিষয়টিতে কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী যেভাবে এনটিএ-কে আড়াল করতে ব্যস্ত ছিলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। একইসঙ্গে এই মাপের কেলেঙ্কারির পরেও বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরবতাকে আক্রমণ করেছে ‘ইন্ডিয়া’ জোট। বিরোধী নেতাদের বক্তব্য, প্রায় ২৪ লক্ষ পড়ুয়ার ভবিষ্যৎ-ই শুধু নয়, এ ভাবে টাকা দিয়ে প্রশ্ন কিনে বা অন্য উপায়ে পাশ করে যাঁরা আগামী দিনে ডাক্তার হবেন, তাঁদের হাতে দেশবাসীর স্বাস্থ্য কতটা সুরক্ষিত থাকবে?
তদন্তকারীরা মনে করছেন, এখনও পর্যন্ত যতটুকু প্রকাশ্যে এসেছে সবই দুর্নীতির হিমশৈলের চূড়া মাত্র। কেন্দ্রের তরফে এই পরীক্ষা-কেলেঙ্কারির রহস্য উন্মোচনে যতই তদন্তের আশ্বাস দেওয়া হোক, প্রধানমন্ত্রীর নীরবতায় দেশবাসী হতাশ। বাংলার মানুষ বিভ্রান্ত বঙ্গ বিজেপির মাতব্বরদের নীরবতায়। যাকে বলে নিপাট নির্লজ্জতা!
2d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

শ্লেষ্মা ও বাতজ রোগ বৃদ্ধিতে কাজকর্মে ব্যাঘাত। গৃহাদি নির্মাণ বা সংস্কারে শত্রুর বাধা। ধর্মে মতি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮২.৬৪ টাকা৮৪.৩৮ টাকা
পাউন্ড১০৪.৯০ টাকা১০৮.৩৯ টাকা
ইউরো৮৮.৮১ টাকা৯১.৯৭ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা