বিশেষ নিবন্ধ

মধ্যবিত্তের বিশ্বজয়
সমৃদ্ধ দত্ত

ধর্মযাজক অ্যান্ড্রু ভ্যালান্স একটা ক্ষীণ কণ্ঠস্বর শুনতে পেলেন। রুমের বাইরে। বেরিয়ে এসে ভ্যালান্স দেখলেন জাস্টিন দাঁড়িয়ে। টেস্ট ম্যাচের সাদা পোশাক। প্রচণ্ড ঘামছেন।  জাস্টিন ল্যাঙ্গার অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটসম্যান। ১৯৯৯। পার্থ। ভ্যালান্স অবাক হলেন। এই সময় জাস্টিন এখানে কেন? আমি আপনাকে কিছু বলতে চাই অ্যান্ড্রু। বললেন জাস্টিন। অ্যান্ড্রু ভাবলেন চার্চে এসে এই কথা বলছেন যখন, কিছু কনফেস করবেন জাস্টিন। অ্যান্ড্রু যাজক হলেও তীব্রভাবে তাঁর ক্রিকেট অনুরাগ। তিনি জানেন জাস্টিনের ফর্ম তলানিতে। এই তো একমাস আগেই শ্রীলঙ্কা ট্যুরে রান পায়নি সে। যে কোনও 
সময় বাদ পড়ে যাবে টিম থেকে। জাস্টিন বললেন, অ্যান্ড্রু আমার একটাই প্রবলেম হচ্ছে। কিছুতেই মনকে স্থির করতে পারছি না। কেমন যেন একটা 
আবছায়া আত্মবিশ্বাসহীনতা ভর করছে ফিল্ডে। আমি যেটাই করছি বুঝতে পারছি সেটায় সম্পূর্ণ ফোকাস নেই। অ্যান্ড্রু জানতে চাইলেন, জাস্টিন শেষ কবে বাইবেল পড়েছো? 
জাস্টিনের পরিবার অত্যন্ত গোঁড়া ক্যাথলিক। শহরে থাকলে নিয়ম করে সে সেন্ট যোশেফ চার্চে যায় রবিবার। এমনকী তাঁর সঙ্গে সর্বদাই থাকে সেন্ট ক্রিস্টোফারের একটা ম্যাগনেট। 
একটু ইতস্তত করে জাস্টিন বললেন, অনিয়মিত। নিয়ম করে প্রতিদিন অথবা প্রতি সপ্তাহে এভাবে হয় না। বিক্ষিপ্তভাবে বলতে পারো। অ্যান্ড্রু বললেন, আচ্ছা। আমি তোমাকে দেব। এখন যাও। পরের সপ্তাহে ব্রিসবেনে পাকিস্তানের সঙ্গে ম্যাচ। জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে সি অফ করতে এয়ারপোর্টে গিয়ে যাজক অ্যান্ড্রু একটি বাইবেল দিয়ে বললেন, হোটেলরুমে পড়বে আজ থেকেই। 
দু’ সপ্তাহ পর পার্থে ফিরলেন জাস্টিন। আর এসেই অ্যান্ড্রুর সঙ্গে দেখা করলেন। অ্যান্ড্রু জাস্টিনকে আলিঙ্গন করলেন। 
কারণ, জাস্টিন হোবার্টে সেঞ্চুরি করেছে। নিয়মিত রানের মধ্যে ফিরেছে। আর খেলায় এক আগ্রাসী আত্মবিশ্বাস। কীভাবে হল? জাস্টিন বলেছিলেন, বাইবেলটা পড়ার পর থেকেই বুঝলাম আমার ভিতরে চেঞ্জ আসছে। এখন প্রতিটি ডেলিভারি কাছে আসার আগেই আমি নিজেকে বলি,প্রত্যেকটা বাধা পেরতে পারব তাঁর মাধ্যমে, যিনি আমার মধ্যে শক্তি দিয়েছেন। প্রতিটি বল খেলার আগে এই লাইনটা বলি। বাইবেলের ওই একটি পংক্তি জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে পাল্টে দিল। 
ওয়েস্ট ইন্ডিজে জামাইকার সাবাইনা পার্ক গ্রাউন্ডের পিচ কিউরেটর চার্লস যোশেফ ৭৩ বছর বয়সেও আতঙ্কে থাকেন। বাড়ি থেকে চলে আসেন টেস্ট ম্যাচ শুরু হওয়ার অন্তত এক সপ্তাহ আগে মাঠে। পিচের অবস্থা কী সেটা নিজের চোখে দেখতে। টিপে টিপে পরীক্ষা করেন। জোরে জোরে বল মারেন পিচে। এখন তাঁর এই চাকরিটা নেই। তিনি পেনশন পান। পিচ তৈরির দায়িত্বে অন্য ইয়ং কিউরেটররা। কিন্তু তাও আসেন তিনি। আর তাঁরাও এই বৃদ্ধ লোকটাকে কখনও কিছু বলেন না। কারণ, লোকটা এই পিচকে ৪৯ বছর ধরে যত্ন করেছেন। তিনি বলেন, সাবাইনা পার্কের পিচ তাঁর মেয়ে। কিন্তু এত ভয় কীসের? ১৯৯৮ সালের ২৯ জানুয়ারি দিনটা তিনি ভুলতে পারেন না। আজও প্রত্যেকটা ম্যাচ শেষ হওয়ার পর তিনি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেন আর খেলা শেষে কান্নায় ভিজে যান। সেদিন ইংল্যান্ড বনাম ওয়েস্ট ইন্ডিজের টেস্ট মাত্র ১০ ওভার পরই বাতিল হয়ে যায় এই গ্রাউন্ডে। কারণ, কার্টলে অ্যামব্রোসের কয়েকটি ওভারের পর বোঝা গেল এটা একটা মৃত্যুপুরী। ইংল্যান্ড বলল, এরকম পিচে খেলা অসম্ভব। এমনকী ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা আতঙ্কিত। সত্যিই তো, এরকম ভয়ঙ্কর কেন হল পিচ! সব দোষ গিয়ে পড়ল একজনের ঘাড়ে। কিউরেটর যোশেফ। অথচ যোশেফের দোষ নেই। সম্পূর্ণভাবে নতুন পিচ তৈরি হওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, অন্তত ৮ মাস যেন দেখা হয় পিচের চরিত্র। তার আগে বোঝা যায় না পিচ কেমন আচরণ করবে কখন। তাঁর কথা শোনা হয়নি। দ্রুত শিডিউল করে এখানেই খেলা দেওয়া হয়। অথচ অপরাধী এখন যোশেফ। সাসপেন্ড হলেন তিনি। হয়ে উঠলেন ভিলেন। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কেঁদেছেন যোশেফ। আজ এত বছর পরও তাই সাবাইনা পার্কে খেলা শুরুর এক সপ্তাহ আগে থেকে দিনে তো বটেই, মাঠেই রাত্রিযাপন করেন যোশেফ। নিজে হাতে দেখভাল করবেন বলে। আর কোনওদিন নিজের মেয়ের অপমান হতে দেবেন না তিনি।
ক্রিকেট অথবা যে কোনও খেলার মধ্যে নিছক জয় পরাজয়টাই প্রধান নয়।  মিশে আছে প্যাশন, স্বপ্ন এবং উত্তরণের সাফল্য। তার মধ্যে থেকে আমাদের মতো সাধারণ মানুষ খুঁজে পায় প্রেরণা। এই যে গত সপ্তাহে ১১ জন যুবক অথবা তাঁদের কোচ বিশ্বজয় করল ভারত থেকে অনেক দূরের এক শহরে, এটা নিছক কি নিজের দেশকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ দেখতে পাওয়ার সন্তোষ? মনে হয় না। তার থেকে আর একটু বেশি। আমাদের মতো আম জনতা, নিম্ন মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্তদের প্রত্যেকে একটি করে ব্যক্তিগত টি টুয়েন্টি খেলে চলেছি জীবনসংগ্রামে। আমাদের প্রত্যেকটি জীবনের স্বপ্ন নিজস্ব এক ফাইনাল ম্যাচে পৌঁছে জিতে যাওয়া। কেউ পারব। কেউ পারব না। কিন্তু এই যে ১৯৮৩ অথবা ২০০৭ কিংবা ২০১১ এবং ২০২৪ সালে ১১ জনের দলটি পারল, সেটা আমাদের কাছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এক আগুনশিখার মতো পথ প্রদর্শক। কেন? কারণ, লক্ষ্য করা যায় যে, এই যাঁদের মাধ্যমে দেশের সিদ্ধিলাভ হয়েছে, তাঁদের সিংহভাগ এসেছেন আমাদেরই মতো নিতান্ত সাধারণ মধ্যবিত্ত সংসার থেকে। এই উচ্চ সিংহাসনে যাওয়ার স্বপ্নটি তাঁরা লোকাল ট্রেনে, বাসে, পেটে একটু খিদে রেখে, অটো রিকশ চালিয়ে কিংবা বস্তি এলাকায় নিরন্তর শূন্যতার সাক্ষী হতে হতেই দেখেছে।  এটাই আমাদের কাছে এক অনুপ্রেরণা। 
ওই যে হার্দিক পান্ডিয়া। এক সময় যথেষ্ট স্বচ্ছল ছিল তাঁর পরিবার। আচমকা সেই গতি স্লথ হয়ে গেল। বাবা হিমাংশু পান্ডিয়া দুই পুত্রকে নিয়ে সুরাত থেকে ভাদোদরা চলে এসেছিলেন। হার্দিক ও তাঁর দাদা ক্রুনালের স্বপ্ন পৃরণ করবেন বলে। অর্থাৎ ক্রিকেটার হওয়া। কিন্তু জীবন সহজ নয়। অতএব হার্দিক পান্ডিয়ারা কখনও অটো রিকশ চালালেন। কখনও কিরণ মোরে ক্রিকেট অ্যাকাডেমি থেকে ফেরার পথে প্রচণ্ড খিদে পেলেও ম্যাগি খেয়েই খিদে হজম করতেন। কারণ খাওয়ার জন্য বরাদ্দ ছিল ৫ টাকাই। অ্যাকাডেমির মালির রান্নাঘরে গিয়ে গরম জল নিয়ে আসতে হতো। বদলে ঘাসে ও গাছে জল দেওয়ার কাজ। ছোটখাটো টুর্নামেন্ট খেলে ৪০০ টাকা আয় করে বাবার হাতে দিতেন। দিনের একবেলায় কখনও গাড়ির ডিলারের কাছে পার্ট টাইম কাজ করলেন। আজ সেই পান্ডিয়ার সম্পদের পরিমাণ ৯১ কোটি টাকা। 
যশবীর সিং বুমরাহ হঠাৎ অকালে চলে গেলেন সামান্য অসুস্থতায়। তাঁর স্ত্রী দলজিৎ সবথেকে বড় বিপদে পড়লেন। বহু কষ্টে জোগাড় হয়েছিল প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকতা। কিন্তু তার বাইরেও টিউশন করলেন দলজিৎ। দিনের মধ্যে ১৬ ঘণ্টা তাঁকে পরিশ্রম করতে হয়েছে ঘরের বাইরে। প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক থেকে নিজের চেষ্টায় একদিন নির্মাণ হাই স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল হওয়া দলজিৎ প্রথম থেকেই জানতেন ছেলেকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার করানো যাবে না। ও ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসে। তিনি বাধা দেননি। শুধু একটিই বিষয়ে তাঁর জেদ ছিল অনমনীয়। ইংরাজি শিখতে হবে। বলতে এবং পড়তে। তুমি যে কেরিয়ারেই যাও, ইংরাজি বলতে না পারলে কিছু হলেও পিছিয়ে থাকবে। যশপ্রীত বুমরা একটা সময় স্থির করেছিলেন যেভাবেই হোক মামার কাছে চলে যাবেন। মা দলজিৎ বলেছিলেন, একেবারেই নয়। নিজের স্বপ্ন পূরণের চেষ্টা করো। আমার যথাসম্ভব সঞ্চয় দিয়ে দেব। যশপ্রীত বুমরা যাননি। কানাডা নয়। ভারতই ছিল তাঁর ভাগ্যের কর্মভূমি। 
চেম্বুর থেকে ট্রেন সামান্য ফাঁকা পাওয়া যাবে। নচেৎ যে ট্রেনে সে চেম্বুরে নামতে হবে, সেটা প্রচণ্ড ভিড়। ময়দানে পৌঁছনোর আগেই তো ছেলে ঘেমেনেয়ে অর্ধেক এনার্জি নষ্ট করবে। আর অত বড় ক্রিকেট কিট কীভাবে ট্রেনে আনা সম্ভব? তাই চেম্বুর পর্যন্ত মোপেডে চাপিয়ে ছেলেকে স্টেশনে ড্রপ করে দিতেন অশোক যাদব। মুম্বইয়ের শহরতলিতে ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার কলোনির সরকারি আবাসনে থাকতেন। ভাবা অ্যাটমিকেরই কর্মী অশোক যাদব। ওই জার্নির সময়টায় সূর্যকুমার কি স্বপ্ন দেখতেন যে, একদিন তিনি একটি অনেক বড় মাঠের বাউন্ডারি লাইনে ক্যাচ নিয়ে সেই বলটাব আকাশে ছুঁড়ে দিয়ে আবার ঝাঁপ দিয়ে ভারতের জয়ের প্রাণভোমরার মতো তালুবন্দি করবেন? আর ১৪০ কোটি প্রাণ উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়বে সেই অলৌকিক দৃশ্য দেখে? তাঁর মা সবথেকে বড় ক্রিকেট ফ্যান। অতএব সূর্যকুমার যাদবকে বলেছিলেন, আমরা ধনী নই। কিন্তু সাধনা থাকলে তুমি পারবেই! সূর্য কুমার যাদব পেরেছেন।
আইপিএলে ২ কোটি ৬০ লক্ষ টাকার ডিলে স্বাক্ষর করার পর মহম্মদ সিরাজকে প্রশ্ন করা হয়েছিল কী করবেন এরপর? সিরাজ বলেছিলেন, বাবার জন্য একটা বাড়ি কিনে দেব। আর গাড়ি। মহমম্দ ঘাউস চিরকাল হায়দরাবাদের রাস্তায় অটো রিকশ চালিয়েছেন। এবার যাতে তিনি গাড়ি চালাতে পারেন সেই স্বপ্ন পূরণ করেছিলেন পুত্র সিরাজ। সাবালক হয়ে যাওয়ার বয়স পর্যন্ত মহম্মদ সিরাজ কোনওদিন ক্রিকেট শ্যু পরেননি। হাওয়াই চটি পরে খেলতেন পাড়ায়, মহল্লায়। ভারতের এই টি টুয়েন্টির বিশ্বজয়ীরা কমবেশি সকলেই এসেছেন এরকম সাধারণ পরিবার থেকে। অনেকদিন পর এমন একটি ম্যাচ দেখা গিয়েছে, যেখানে সকলে মিলে কিছু না কিছু করেছেন। কালেকটিভ চ্যাম্পিয়ন। এটাই হল আমাদের কাছে শিক্ষণীয়। 
মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত চিরকাল রূপকথা তৈরি করেছে। কেউ কলকাতায় ব্ল্যাকার্স কোম্পানিতে ১৬৪০ টাকার স্যালারি ছেড়ে আচমকা অজানা এক শহর মুম্বইয়ে ভাগ্যান্বেষণে যান। তারপর অহরহ ব্যর্থ হওয়ার পর আচমকা ‘জঞ্জীর’ নামক একটি সিঁড়ির সন্ধান পেয়ে চির সুপারস্টার হয়ে যান। কেউ খড়্গপুরের টিকিট কালেক্টরের চাকরি ছেড়ে ঝাঁপ দেন  ভবিষ্যতে এক ইউথ আইকন হয়ে ‘এমএসডি’ নামক ব্র্যান্ড নির্মাণ করবেন বলে। স্বাধীনতার পর বারংবার প্রধানমন্ত্রী অথবা মুখ্যমন্ত্রীরা হয়েছেন মিডল ক্লাস থেকেই। হিন্দি সিনেমার ভাষায়, পাওয়ার অফ কমন ম্যান!
2d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কারও সঙ্গে অপ্রত্যাশিত কলহে লিপ্ত হয়ে অপযশ। ব্যবসা ও পেশায় কিছুটা শুভ। অর্থাগম হবে।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮২.৬৪ টাকা৮৪.৩৮ টাকা
পাউন্ড১০৫.২৩ টাকা১০৮.৭২ টাকা
ইউরো৮৯.০৪ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা