কীভাবে ভালো রাখবেন হার্ট? এই নিয়ে নানা মুনির নানা মত। কেউ বলছেন ‘সুপারফুড’ খেতে, আবার কেউ বলছেন ‘ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং’ করতে। এছাড়াও আছে ‘অল্টারনেটিভ মেডিসিন’-এর নানা চমকদার ‘থেরাপি’। অনেকে ‘গোপন’ টোটকার কথাও বলেন। কিন্তু এর মধ্যে কোনটা কার্যকর? সত্যিই কি হার্ট ভালো রাখার জন্য বিশেষ কিছু করতে হয়? এই নিয়ে আলোচনা করা যাক।
খাদ্য
হার্টের অসুখ আটকাতে খাদ্যের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। যেমন, নিয়মিত ফল বা সব্জি খাওয়া। যাঁদের হার্টের অসুখ আছে, তাঁদের ক্ষেত্রে কিছু খাদ্যের নিয়ম আছে যাতে অসুখ আর না বাড়ে। সুতরাং হার্ট ভালো রাখতে খাবারের ব্যাপারে প্রথমেই যত্নবান হতে হবে। এটাও বলা প্রয়োজন, খাবারের এই যে অভ্যাস, সেটা কিন্তু তৈরি করতে হবে ছোট থেকে। যাদের ছোট থেকে খুব বেশি ফ্যাটযুক্ত খাবার খাওয়ার অভ্যাস, তাদের কিন্তু হার্টের অসুখ শুরু হতে পারে জীবনের তৃতীয় বা চতুর্থ দশক থেকেই। একবার হার্টের অসুখ হয়ে গেলে তখন খাদ্য পরিবর্তন করেও পুরো নিরাময় সম্ভব নয়। ফলে শিশু বয়স থেকেই শুরু করতে হবে সুষম খাদ্যের অভ্যাস। পৃথিবীর বেশ কিছু দেশ আছে যেখানে শিশুদের স্কুলের কাছে ফাস্ট ফুড দোকান থাকা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এছাড়া শিশুরা যে সব টিভি প্রোগাম দেখে, সেখানে ফাস্ট ফুডের বিজ্ঞাপন দেখানো নিষিদ্ধ। এভাবে এই সব দেশে শিশুদের মধ্যে ফাস্ট ফুডের নেশা কমানোর একটা সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। দেখা গেছে যে, শিশু বয়সে ফাস্ট ফুড কমালে পরবর্তীকালে স্থুলতা কমে এবং অবশ্যই হার্টের অসুখ, স্ট্রোক, ক্যান্সার ইত্যাদি দূরে থাকে। আমাদের দেশে দেখবেন স্কুলের সামনেই রোল, কেক, চিপসের দোকান। যখন সামাজিকভাবে শিশুদের এইসব ফাস্ট ফুড থেকে আড়াল করার প্রচেষ্টা একদম এখানে নেই, তখন বাবা-মাকে, দায়িত্ব নিতে হবে শিশুদের মধ্যে স্বাস্থ্যকর খাবার অভ্যাস গড়ে তোলার।
এখন সবাই কাজে ব্যস্ত। ফলে বাড়ির শিশুদের জন্য খাবার বানিয়ে দেওয়ার সময় অনেকেরই থাকে না। এই কারণে অনেক মা-বাবাই অনলাইনে খাবার আনিয়ে শিশুদের বায়না মেটান। এরকম করলে ভবিষ্যতে সেই শিশু কিন্তু সাধারণ খাবার আর খেতেই চাইবে না। অনেক মা-বাবাই কিশোর-কিশোরীদের ডাক্তারের কাছে এনে অভিযোগ করেন যে সে ফল-শাক-সব্জি কিছুই খায় না। এক্ষেত্রে চিকিৎসকের কিছু করার নেই। আপনি ছোট থেকে তাকে যেরকম অভ্যাস করিয়েছেন, সে সেটাই পরবর্তী জীবনে বহন করবে। যত বড় হবে, তত চারদিকে দেখবে বিরিয়ানি, কাবাব, রোল, আইসক্রিম, কেকের বিজ্ঞাপন। মিডিয়া হাতছানি দেবে রোজ নতুন রেস্তরাঁ ট্রাই করার। এইসব খাবারে আছে অতিরিক্ত চিনি, অতিরিক্ত নুন এবং ট্র্যান্স ফ্যাট। এগুলি নিঃশব্দে শরীরের ক্ষতি করে চলবে।
এখন সবাই জানেন যে কোলেস্টেরল হার্টের জন্য খারাপ। রক্তে কোলেস্টেরল বাড়লেই শিরায় প্লাক তৈরি হয় এবং রক্ত চলাচল কমে যায়। এ থেকেই হয় করোনারি আর্টারি ডিজিজ এবং হার্ট অ্যাটাক। সুতরাং, খাবারে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। কোলেস্টেরল আসে শুধুমাত্র প্রাণিজ খাবার থেকে। মাংস, ডিম, দুধ, চিজ ইত্যাদি খাবারেই কোলেস্টেরল থাকে।
আমরা রান্নায় যে ভোজ্য তেল ব্যবহার করি, সেই পাম তেল, সর্ষের তেল বা নারকেল তেলে কোলেস্টেরল নেই, যেহেতু এগুলি আসে উদ্ভিদ থেকে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে রান্নায় তেল যত খুশি ব্যবহার করা যাবে। রান্নার তেলে কোলেস্টেরল না থাকলেও রয়েছে স্যাচুরেটেড ফ্যাট। বিশেষত পাম তেল, নারকেল তেলে অনেকটাই স্যাচুরেটেড ফ্যাট আছে। এটাও কিন্তু হার্টের জন্য খারাপ। বিদেশে যেমন প্রাণিজ চর্বি, যেমন লার্ড বা ট্যালো দিয়ে রান্নার চল আছে, সেটা আমাদের দেশে নেই। এইসব প্রাণিজ চর্বি দিয়ে রান্না করলে খাবারে কোলেস্টেরল অনেকটাই বেড়ে যায়। অবশ্য আমাদের দেশে এইসব প্রাণিজ ফ্যাট দিয়ে রান্নার চল না থাকলেও রাস্তার খাবারের দোকানের কমদামি
খাবারে যে কী তেল আছে, সেটা কে গ্যারান্টি দেবে?
প্রথমেই বললাম ফল খাওয়ার কথা। টাটকা ফলে নানা ভিটামিন, ফাইবার থাকে। এগুলি শুধু হার্ট নয়, অন্যান্য অনেক অঙ্গের উপকারে আসে। এখন অনেকে ফল না খেয়ে ফলের রস খান। বাজারে অনেকরকম ফলের রস পাওয়া যায়। সেগুলো রোজ খেয়ে অনেকে ভাবেন যে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া হল। কিন্তু এই প্যাকেটজাত রস টাটকা ফলের সমান নয়। প্যাকেটে যে রস থাকে, তাতে নানা প্রিজারভেটিভ থাকে। এ থেকে শরীরে সোডিয়াম বৃদ্ধি পায়। আর এভাবে প্রক্রিয়াজাত খাদ্যে অনেক ভিটামিন নষ্ট হয়ে যায়। সুতরাং গোটা ফল কামড়ে খেতে হয়। কিছু মা-বাবা আছেন যাঁরা বেশি যত্ন নিতে গিয়ে শিশুদের ফলের খোসা ছাড়িয়ে খেতে দেন। এতেও ক্ষতি। আপেল জাতীয় ফলে খোসায় যে ফাইবার থাকে, সেটা পেটের উপকারে আসে। খোসা ছাড়ানো আপেল, নাশপাতি বা পেয়ারা খেলে পেটে ফাইবার যাবে কোথা থেকে? তারপর তাঁরাই অভিযোগ করেন যে কিশোর বা কিশোরীর কোষ্ঠকাঠিন্য কমছে না! তাই গোটা ফল খেতে দিন, ফলের রস নয়। অনেকে আপেল সেদ্ধ করে খান। কেন খান? আপনি কী কঠিন অসুখে ভুগছেন? যদি তা না হয়, তাহলে আপেল সেদ্ধ করে তার সব ভিটামিনের গুণ নষ্ট করছেন কেন?
ব্যায়াম
নিয়মিত ব্যায়াম করা হার্টের জন্য শুধু নয়, সারা দেহের সব অঙ্গের জন্যই ভালো। হার্ট ভালো তো থাকেই, হজম ভালো হয়, কোষ্ঠকাঠিন্যর সমস্যা কমে, ঘুম ভালো হয়, মানসিক স্বাস্থ্য ভালো থাকে। আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি যে গাইডলাইন প্রকাশ করেছে, সেখানে বলা হয়েছে ১৭ বছরের নীচে কিশোর-কিশোরীদের দিনে অন্তত এক ঘণ্টা শারীরিক কসরত করা উচিত। প্রাপ্তবয়স্কদের দিনে অন্তত ৩০ মিনিট। এবার শারীরিক কসরত মানে কী?
বাঙালিদের কাছে দৈনিক ব্যায়াম বলতে গল্প করতে করতে মর্নিং ওয়াক। কিন্তু সেটা একদমই গুরুত্বহীন। গল্প করতে করতে রাস্তায় হাঁটা কোনও ব্যায়ামই নয়। রোজকার কাজে বেরিয়ে সবাইকেই হাঁটতে হয়। সেটাতেই যদি হয়ে যেত, তাহলে এত বড় একটা সংস্থা আলাদা করে ব্যায়ামের গাইডলাইন প্রকাশ করত না! ব্যায়াম করতে হলে এমনভাবে করতে হবে, যাতে ঘাম বেরবে এবং নিঃশ্বাসের গতি দ্রুত হবে। যেমন দৌড়ানো বা ডনবৈঠক বা স্কিপিং। সকালেই ব্যায়াম করতে হবে, এরকম কোনও নিয়ম নেই। বিদেশে অনেকেই সারাদিনের কাজ শেষ করে রাত্রি ন’টার সময়ে সাঁতার কাটতে যান বা সন্ধে সাতটায় রানিং শু পরে মাঠে দৌড়ানো শুরু করেন। দিনের যে সময়ে সুবিধা, সেই সময়েই ব্যায়াম করুন। মর্নিং ওয়াক হয়নি মানে সারাদিন শুয়ে বসে কাটাবেন, সেটা কী কেউ বলেছে?
ব্যায়াম অনেক রকম হয়। আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি বলেছে যে মাল্টিকম্পোনেন্ট ব্যায়াম করতে। মানে ব্যালান্স ট্রেনিং থাকবে, মাসল শক্ত করার ব্যায়াম থাকবে, অ্যারোবিক ব্যায়াম থাকবে। এইখানেই একটা প্রশ্ন চলে আসে: চারদিকে এখন এত জিম, সেখানে জয়েন করা ভালো, নাকি নিজেই বাড়িতে করা ভালো?
জিম করা খারাপ নয়। কিন্তু কী ধরনের ট্রেনিং সেখানে নেবেন, সেটা নির্ভর করবে অনেক কিছুর ওপর। যেমন, আপনার বয়স কত, আপনার কী কী ওষুধ চলে এবং শেষে, অবশ্যই জানতে হবে, আপনার লক্ষ্য কী? আপনি জিমে যাচ্ছেন কেন? শুধু হার্ট ভালো রাখতে জিমে যাচ্ছেন নাকি বডি বিল্ডিং আপনার লক্ষ্য? সেই মতো আপনার ট্রেনিং হবে।
সেই জন্য নিজে নিজে জিমে গিয়ে মেশিনে উঠে ব্যায়াম শুরু করে দেবেন না। আগে একজন প্রশিক্ষিত ট্রেনারের কাছে গিয়ে আলোচনা করুন। দরকার হলে নিজের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান। তারপর জিমে জয়েন করুন। জিমে গিয়ে ঘাম ঝরালেই শরীর ভালো থাকবে না। বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। যেমন, কিছুদিন আগেই বিখ্যাত কিছু অভিনেতা এবং তথাকথিত সেলিব্রিটি জিম করতে গিয়ে মারা গেছেন। আজকাল অনেকেই অনলাইনে জিমের যন্ত্রপাতি কিনে ইউটিউব দেখে বাড়িতে ব্যায়াম শুরু করেন। এটাও ঠিক নয়। পঞ্চাশ বছরের বেশি বয়স হলে তো কারও পরামর্শ ছাড়া জিম করাই যাবে না। যাদের বয়স কুড়ি-বাইশ, তাদেরও বিপদ হতে পারে। কিছু কিছু জিনগত অসুখ রয়েছে, যেমন লং কিউ টি সিন্ড্রোম, যেখানে খুব জোরে ব্যায়াম করার সময়ে হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে। এছাড়া কিছু অসুখ আছে যেখানে হার্টের ভাল্ভ খারাপ হয়ে যায় বা হার্টের দেওয়াল মোটা হয়ে যায়। সেই সব রোগী হঠাৎ জিম শুরু করলে বিপদ হতে পারে। এইজন্য ব্যায়াম করা ভালো, কিন্তু ঠিক লোকের পরামর্শ নিয়ে; একা একা নয়।
শেষে অনেকেই জানতে চান যোগাসন কতটা ভালো। এটি নানা কারণে শরীরের জন্য উপকারী। কিন্তু হার্টের জন্য কোনটা ভালো, সেটা কোনও বিশেষজ্ঞের কাছে জেনে নেওয়া উচিত। মনে রাখবেন, বজ্রাসনের মতো ব্যায়াম করলে কিন্তু হাঁটুর ব্যথা বেড়ে যেতে পারে। সুতরাং নিজের শরীর বুঝে যোগাসন করা দরকার। তবে হার্ট ভালো রাখার জন্য যা যা শারীরিক কসরত দরকার, সেটা কিন্তু শুধু এক জায়গায় বসে যোগাসনে পূরণ হয় না। সঙ্গে অন্য ফ্রি হ্যান্ড বা সাঁতার ইত্যাদিও করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি অসুখ যেমন ক্যান্সার, আলসার বা ডায়াবেটিস থাকলে কী ব্যায়াম করা যাবে?
এর জন্য বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ক্রনিক অসুখ থাকলে অবশ্যই ব্যায়াম করা যায়। ডায়াবেটিসের মতো অসুখে তো আরও বেশি করে করা উচিত, কারণ সেখানে হার্ট ভালো রাখা বেশি দরকার। ডায়াবেটিস কোন স্টেজে আছে, তার সঙ্গে কিডনির অসুখ বা নিউরোপ্যাথি আছে কিনা, এর ওপর নির্ভর করবে যে কী ব্যায়াম করবেন।
ধূমপান
ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর শুধু ধূমপান কেন, যে কোনও ধরনের তামাক শরীরের পক্ষে ক্ষতিকর। তামাক থেকে যে ক্যান্সার হয়, সবাই জানেন। কিন্তু ক্যান্সার ছাড়াও রয়েছে হার্টের অসুখ, ডায়াবেটিস, পায়ের শিরা শুকিয়ে যাওয়া, সিওপিডি। কার যে কোনটা হবে, বলা মুশকিল; আর আরও বলা মুশকিল যে এর মধ্যে কটা অসুখ একসঙ্গে ধূমপায়ীদের আক্রমণ করবে। তবে এটা বলাই যায় তামাক সেবন করলে, সেটা সিগারেট হোক বা খইনি, একসময় হার্টের কিছু না কিছু সমস্যা হবেই। ডাক্তার সিগারেট খেতে বারণ করলে অনেকে খইনি বা গুটখা খাওয়া শুরু করেন। এঁরা যুক্তি দেন যে ধোঁয়া না ছড়ালে তামাক থেকে কোনও ক্ষতি হবে না। এটা কিন্তু একদম ভুল ধারণা। ইউরোপ এবং আমেরিকায় গবেষণায় দেখা গেছে যে নস্যি বা অন্যান্য ধূম্রহীন তামাক দ্রব্য থেকেও হার্টের ক্ষতি হতে পারে।
অনেকে ভাবেন যেহেতু তাঁদের কোনও উপসর্গ নেই, সুতরাং তাঁদের হার্টের অসুখ নেই। তাঁরা যত খুশি সিগারেট, বিড়ি টানতে পারবেন। কিন্তু হার্টের অসুখ অনেকসময় থাকে অন্তরালে। সবথেকে চিন্তার কারণ অবশ্যই করোনারি আর্টারি ডিজিজ। হার্টের পেশিতে রক্ত সরবরাহ করে যে সব আর্টারি, সেগুলি এই অসুখে ধীরে ধীরে রুদ্ধ হয়ে যায়। এর ফলে হার্টের নিজের কাজ করার জন্য যে রক্ত দরকার, সেটা আর আসে না। ফল? মায়ওকার্ডিয়াল ইনফার্কশান। এটা হলে হার্টের পেশির কিছুটা অংশ চিরকালের জন্য নষ্ট হয়ে যায় এবং কর্মক্ষমতা কমে যায়। এছাড়া রক্ত চলাচল কমে গেলে হার্টের ছন্দপতন হতে পারে। ওয়ার্ল্ড হেলথ অরগানাইজেশানের তথ্য অনুযায়ী প্রতি বছর ১৯-২০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয় তামাকের কারণে। মনে রাখবেন যে তামাকের জন্য মৃত্যুর মোট যে সংখ্যা, এটা তার মধ্যে একটা ছোট অংশ মাত্র। তামাক থেকে প্রতি বছর মৃত্যুর মিছিল (ক্যান্সার, সি ও পি ডি, অ্যানিউরিজম ইত্যাদি ধরে) এর অনেক বেশি।
যিনি ধূমপান করছেন, তারই যে বিপদ, সেটা নয়। প্যাসিভ বা সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং থেকেও হার্টের ক্ষতি হতে পারে। আমেরিকার গবেষণা বলছে, প্রতি বছর প্রায় ৩০ হাজার মানুষ সেই দেশে মারা যান সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকিং থেকে উদ্ভূত অসুখের ফলে। তার মানে, হার্ট ভালো রাখতে আপনি যে নিজে ধূমপান করছেন না, সেটাই যথেষ্ট নয়। চারপাশে তামাকের ধোঁয়া থাকলেও ক্ষতি। মনে রাখবেন যে, ২০০৮ সালের পর থেকেই কিন্তু ভারতে পাবলিক স্পেসে স্মোকিং পুরোপুরি নিষিদ্ধ করে আইন পাশ হয়েছে। সুতরাং, আগে যে ব্যাপারটা ছিল, অফিসে বা বাস-ট্রামে কেউ ধূমপান করছে, আর আপনি নিরুপায় হয়ে সেই ধোঁয়া নাকে টানছেন, সেদিন কিন্তু আর নেই। এখন আপনার পাশে দাঁড়িয়ে বা বসে যে কেউ ধূমপান করে যদি আপনার অসুবিধা সৃষ্টি করে, তাহলে আপনি এই আইনের পরিপ্রেক্ষিতেই তার প্রতিবাদ করতে পারেন এবং সেই ব্যক্তিকে হয় স্থানত্যাগ করতে, নইলে সিগারেট ফেলে দিতে বাধ্য করতে পারেন। অন্যের ধূমপানের জন্য যে ক্ষতি সহ্য করতে হতো, সেটা এখন কিন্তু আর হবে না। একই কথা প্রযোজ্য নিজের বাড়িতে। সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোক থেকে গর্ভবতী মহিলার ক্ষতি হতে পারে। কেউ ধূমপান করবে কি না, সেটা ব্যক্তিগত স্বাধীনতা; কিন্তু সেই স্বাধীনতা ফলাতে গিয়ে সেকেন্ড হ্যান্ড স্মোকে অন্যের ক্ষতি করার অধিকার কারও নেই।
সিগারেট বন্ধ করে আজকাল অনেকে শুরু করেন ভেপিং বা ইলেকট্রনিক সিগারেট ব্যবহার। বলা হয় এটি নাকি নিরাপদ। নেশার আমেজটুকু থাকবে, কিন্তু শরীরের কোনও ক্ষতি হবে না। কিন্তু আমেরিকার ন্যাশানাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের প্রকাশনা বলছে, ইলেকট্রনিক সিগারেট থেকেও হার্টের ক্ষতি হয়। সুতরাং ভেপিং হয়তো তামাকের ধোঁয়ার থেকে নিরাপদ, কিন্তু একেও ধোয়া তুলসীপাতা বলা যাবে না। আর ২০১৯ সালে আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি তো বলেই দিয়েছে যে ই-সিগারেটে হার্ট ডিজিজ এবং স্ট্রোকের সম্ভাবনা বাড়ে।
গাঁজা, কোকেন ইত্যাদি মাদক:
মাদকের নেশা অনেকের মধ্যেই দেখা যায়। আর গাঁজা তো ঐতিহ্যগতভাবেই আমাদের সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে। গাঁজা সেবনেও হার্টের ক্ষতি হয়। বিশেষত, গাঁজার ধূমপান হার্টের পক্ষে সবথেকে ক্ষতিকর। গাঁজা সেবনের পর অনেকের বুকে ব্যথা শুরু হয়। আর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে গাঁজা সেবনে শরীরের শিরা সংকুচিত হয়ে শরীরের নানা অঙ্গে রক্তচলাচল কমে যেতে পারে। একে বলে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস এবং এ থেকে স্ট্রোক বা কিডনির অসুখ হতে পারে। সুতরাং, যাঁদের আগে থেকেই হার্টের অসুখ আছে, তাঁদের কিন্তু গাঁজা সেবনে বিপদ বাড়তে পারে। আমেরিকান গবেষণায় দেখা গেছে গাঁজার ধোঁয়ায় যে সব রাসায়নিক থাকে, তামাকের ধোঁয়ায় তার অনেকগুলিই আছে। নিয়মিত গাঁজা সেবনে করোনারি আর্টারি ডিজিজ প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।
ঠিক একইভাবে, কোকেন সেবনেও হার্টের অসুখ হতে পারে। কোকেন নেওয়ার পর হঠাৎ রক্তচাপ বেড়ে যেতে পারে। এ থেকে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক—সবই হতে পারে। কোকেন সরাসরি হার্টের পেশিতে বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং এর থেকে ক্ষণিকের মধ্যে মৃত্যু হতে পারে। বারবার কোকেন নিলে রক্তচাপ চিরস্থায়ীভাবে বেড়ে যায়। এ থেকে ভবিষ্যতে হার্টের সমস্যা হতে পারে। যাঁরা বছরের পর বছর এই মাদক ব্যবহার করছেন, তাঁদের হার্টের পেশি ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায় এবং তখন হার্ট ফেলিওর হয় (কার্ডিওমায়োপ্যাথি)।
আজকাল পার্টিতে নানা মাদকের ব্যবহার চালু রয়েছে। বেশিরভাগ মাদকেই রক্তচাপ বেড়ে যায়। যাঁদের আগে থেকে হার্ট দুর্বল, তাঁরা এইসব মাদক সেবন করলে সমূহ বিপদ।
জিনের গলদ:
এত কিছু করার পরেও হার্টের অসুখ হতে পারে। তার কারণ হল জিন। ব্যায়াম করে বা সিগারেট ছেড়ে কিন্তু সব জিনগত অসুখ থেকে রক্ষা মেলে না। বিদেশে যত গবেষণা হচ্ছে, ততই হার্টের নতুন নতুন জিনগত অসুখের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। এইসব অসুখ চিরকাল ছিল। কিন্তু জেনেটিক্স এতটা উন্নত হওয়ার আগে এইসব অসুখের কারণ জানা যায়নি। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে কম বয়সে হার্টের অসুখ বা হঠাৎ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কারণ থাকত অজানা। কিন্তু এখন জিন পরীক্ষার দ্বারা অনেক ‘অজানা’ অসুখের কারণ প্রকাশ্যে এসেছে।
এর মধ্যে কিছু আছে বংশগত। তার মানে, যদি বাড়িতে ফার্স্ট ডিগ্রি আত্মীয়দের মধ্যে কারও কম বয়সে হার্টের অসুখের ইতিহাস থাকে, তবে অন্যদের সাবধান হতে হবে এবং দরকার হলে বাইরে থেকে জিন পরীক্ষা করাতে হবে। এবার আপনি বলতে পারেন যে, জিন পরীক্ষা করে লাভ কী? এটা তো আর সারবে না! যেটা নিয়ে জন্মেছেন, সেটার জন্য ভুগতে হবেই। কিন্তু এই ধারণা ঠিক নয়। জিনের প্রভাব থাকলেও অনেক চিকিৎসা আছে যার দ্বারা জিনের অসুখ না সারানো গেলেও হার্টের ক্ষতি কমিয়ে আনা যায়। সেই চিকিৎসা ঠিক সময় শুরু করার জন্য এবং মৃত্যু আটকানোর জন্য তাড়াতাড়ি অসুখ নির্ণয় করা প্রয়োজন। আগে আমাদের এখানে জিন পরীক্ষা খুব বেশি জায়গায় হতো না। কিন্তু কোভিড মহামারীর পর ভাইরাস পরীক্ষার জন্য পিসিআর যন্ত্র বহু জায়গায় চলে এসেছে। এই যন্ত্রে তো আর শুধু ভাইরাস পরীক্ষা হয় না, অনেক জিন পরীক্ষা হয়। ফলে জিন পরীক্ষা এখন সহজেই করা সম্ভব।
ব্রুগাডা সিনড্রোম নামে একটি অসুখ রয়েছে। এটি পাওয়া যায় প্রতি দশ হাজারে ৩-৪ জনের মধ্যে। এ ক্ষেত্রে হার্টের রিদমে গণ্ডগোল থাকে এবং অনেক সময়ে ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হয়। তবে জেগে থাকা রোগীর যে কিছু হবে না, সেটা কিন্তু নয়। হঠাৎই হার্টের ছন্দ পুরো উল্টোপাল্টা হয়ে যায় এবং রোগী অজ্ঞান হয়ে যেতে পারে। এই অসুখের বিপদ আসে কম বয়সে। আই সি ডি নামে একটি যন্ত্র হার্টের পাশে বসিয়ে দিলে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেকটাই কমে।
এর আগে লং কিউ টি সিন্ড্রোমের কথা বললাম। এতেও এরকম হঠাৎই হার্টে রিদম নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আপাতভাবে সুস্থ রোগীর ক্ষেত্রে হতে পারে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট; বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এরকম মর্মান্তিক পরিণতি হয় তরুণ বয়সে। খুব বেশি শারীরিক পরিশ্রমের পর কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের সম্ভাবনা থাকে, যেমন ক্রস-কান্ট্রি সাইকেল চালানো বা পাহাড়ে ওঠা। নানা জিনের ডিফেক্ট থেকে এই অসুখ হয়; এর অনেকগুলি প্রকারভেদ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হল লং কিউ টি সিনড্রোম-১। এতে দেখা যায় যে রোগী সাঁতারে নামার পর বা জলে ঝাঁপ দেওয়ার পর কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হচ্ছে। জিনের গণ্ডগোল থাকলে এরকম সাঁতারের সময়ে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বাড়ে। এই অসুখের ক্ষেত্রেও চিকিৎসা আছে। ওষুধ আছে, আই সি ডি তো আছেই। এগুলি ঠিকমতো ব্যবহার হলে মৃত্যুর সম্ভাবনা অনেকটাই কমবে।
এছাড়াও এরকম জিনের অসুখের মধ্যে রয়েছে শর্ট কিউ টি সিনড্রোম এবং ডব্লিউ পি ডব্লিউ সিনড্রোম। জিনের অসুখের ক্ষেত্রে মুশকিল হল বাইরে থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই। দিব্যি সুস্থ মানুষ, ঘুরছে-ফিরছে, সব কাজ করছে। হঠাৎ একদিন দৌড়ে বাস ধরতে গিয়ে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে গেল। তাহলে কী করবেন? রুটিন হেলথ চেক আপ করার সময় চিকিৎসক কয়েকটি রিপোর্ট দেখে সন্দেহ করলে তবেই এই অসুখ ধরা পড়া সম্ভব। যদি কারও এই রোগ ধরা পড়ে, তাহলে কিন্তু তার পরিবারের অন্যদেরও পরীক্ষা করা উচিত।
ওষুধ
ওষুধ মানুষের প্রাণ বাঁচায়, আবার প্রাণ কেড়ে নিতে পারে। হার্টের কাজ ঠিকমতো চালানোর জন্য যেমন অনেক সময় ওষুধের দরকার হয়, তেমন আবার কিছু ওষুধ হার্টকে থামিয়েও দিতে পারে। সুতরাং, হার্ট ভালো রাখতে হলে ওষুধ খাওয়ার ব্যাপারেও সচেতন হতে হবে। এর দুটি ভাগ আছে: প্রথম হল, হার্টের ওষুধ চিকিৎসককে না জানিয়ে বন্ধ না করা। দ্বিতীয় হল, অন্যান্য ওষুধ খাওয়ার আগে বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া।
হার্টের অনেক ওষুধ সারাজীবন খেয়ে যেতে হয়। যেমন স্ট্যাটিন বা বিটা ব্লকার। অনেক রোগী ওষুধ শুরু করেও কিছুদিন পরে বন্ধ করে দেন। এদের কথা হল, ‘যেহেতু আমার কোনও অসুবিধা নেই, তাই এখন আর ওষুধ খাচ্ছি না।’ এরকম করলে কিন্তু ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে। হার্টের অসুখ মানে এই নয় যে সবসময় উপসর্গ থাকবে। সুতরাং আপনার শরীরে কোনও উপসর্গ নেই মানেই যে অসুখ সেরে গেছে, তা নয়। এর ওপর ওষুধ বন্ধ করে দিলে আবার একদিন হার্ট অ্যাটাক হতেই পারে।
দ্বিতীয় কথা হল, অনেক অন্য ওষুধ আছে, যা থেকে হার্টের ক্ষতি হতে পারে। যেমন, ব্যথার ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক। এইসব ওষুধ খাওয়ার আগেও চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলুন। কিছু মানসিক রোগের ওষুধ থেকেও এরকম হয়। এমনকী কিছুদিন আগে অবধি চালু থাকা গ্যাসের ওষুধ, সিসাপ্রাইড অবধি হার্টের ক্ষতি করতে পারে। তাই যে কোন ওষুধ খাওয়ার আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
স্বাস্থ্যপরীক্ষা
সব শেষে যেটা খুব জরুরি, সেটা হল স্বাস্থ্য পরীক্ষা। আমাদের দেশে লোকের মধ্যে স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা কম। যা আছে, সেটা হল নানা বিষয়ে প্রচুর ভুল ধারণা। যেমন খালি পায়ে ঘাসের ওপর হাঁটলে চোখ ভালো থাকে বা বাঁধাকপি খেলে থাইরয়েড-এর সমস্য হয়, ইত্যাদি। এই সব ভুল ধারণা ছেড়ে নিজের শরীরের পরীক্ষা করান। আপনারা দেখবেন অনেক মানুষ হার্ট অ্যাটাকে শয্যাশায়ী হয়ে পড়ার পর তার বাড়ির লোক বলে যে, ‘ভালো মানুষ, কিছুই অসুখ ছিল না। হঠাৎ বিপদ এসে গেল!’ এটা সত্যি নয়। আপনার হার্টের অসুখ আছে কি না, সেটা কি ঠিক মতো পরীক্ষা করিয়েছিলেন? যদি না করে থাকেন, তবে কী করে জানলেন যে তলে তলে হার্ট রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিল কি না? হার্টের অসুখের ক্ষেত্রে নিঃশব্দে আসতে পারে শমনের ডাক। ফলে আপনার আজকে উপসর্গ নেই মানে আপনি হেলথ চেক আপ করাবেন না, সেটা ঠিক নয়। বছরে একবার তো পরীক্ষা করতেই হবে। সেটা কী কী পরীক্ষা হবে, সেই বিষয়ে শ্রেষ্ঠ পরামর্শ দেবেন আপনার ডাক্তার। সেটা না হলে কিন্তু একদিন রাতে হঠাৎ বুকে ব্যথার জন্যই রেডি থাকতে হবে।
হার্ট ভালো রাখতে হলে নিজেকেই দায়িত্ব নিতে হবে। চল্লিশের ওপর বয়স হলেই খাবার-দাবারে নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। ধূমপান ছাড়তে হবে। দিনের মধ্যে কিছুক্ষণ রিল্যাক্স করতে হবে। বুকে অস্বস্তি হলে সেটাকে গ্যাসের ব্যথা না ভেবে ডাক্তার দেখাতে হবে। আর পরামর্শ নেবেন সঠিক বিশেষজ্ঞের। আমরা এরকম রোগীও পেয়েছি যারা বুকের ব্যথা হলে বাড়ির অন্যকে দেওয়া ওষুধ খেয়ে নেন। তাদের যুক্তি হল, বাড়ির একজনকে যখন ডাক্তার হার্টের ওষুধ দিয়েছে, তখন অন্য যে কেউ সেই ওষুধ খেতে পারেন! এভাবে যদি আপনি বেশিদিন চালান, তখন কিন্তু বিপদ এলে কূল পাবেন না।
শেষে বলি, এখন বিজ্ঞান যে জায়গায় গেছে, তাতে হার্ট ভালো রেখে আশি বছর বয়সে পাহাড়ে ওঠা কোনও ব্যাপারই নয়। বা পঁচাশি বছর বয়সে ম্যারাথন দৌড়ানো। কিন্তু এর জন্য আপনাকে বিজ্ঞানের সাহায্য নিতে হবে। বাড়িতে বসে থেকে হার্ট ভালো থাকবে না।