খাবার নিয়ে প্রচলিত এমন অনেক ধারণা আছে যা একেবারেই ভুল। কলা খেলে নাকি শ্লেষ্মা হয়। ইউরিক অ্যাসিডে মসুর ডাল নিষিদ্ধ। এসব কি ঠিক? খাবার নিয়ে নানা ভুল ধারণা ভেঙে দিলেন পুষ্টিবিদ স্বাগতা মুখোপাধ্যায়।
খাবারের সঙ্গে প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট মেশানো উচিত নয়: প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট শরীরের জন্য যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু যদি আমরা সাধারণ খাদ্যে থেকেই খাই তাহলে বাড়তি প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার প্রয়োজন নেই। তাছাড়া বাড়তি প্রোটিন খেলেই যে শরীর ভালো থাকবে তার কোনও অর্থ নেই। অতিরিক্ত প্রোটিন তাঁদের খেতে হয় যাঁরা দেহসৌষ্ঠব প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন, অ্যাথলিট কিংবা ডায়ালিসিস চলেছে এমন ব্যক্তিদের। অথবা অনেকদিন ধরে শরীর খারাপ, রোগা হয়ে গিয়েছেন, অপুষ্টিতে ভুগছেন এমন ক্ষেত্রেও প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খাওয়া যায়। না হলে একজন সুস্থ সবল মানুষের মোট ওজনের প্রতি কেজি ১ গ্রাম প্রোটিন গ্রহণই যথেষ্ট।
মোদ্দা বিষয়টি হল মাছ, মাংস, ডিম, ডাল, সয়াবিন পর্যাপ্ত মাত্রায় যার যতটা প্রয়োজন ততটা খেলেই আর কিছু দরকার নেই। তাছাড়া প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খাব বললেই তো হল না, হজম করতেও হবে। বিনা কারণে প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট খেলে পেটের গণ্ডগোল হবে এবং তা সামলানো মুশকিল হবে।
সূর্যাস্তের পর শর্করাজাতীয় খাদ্যও খাওয়া উচিত নয়: এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। কিছু নির্দিষ্ট ধর্মাবলম্বী মানুষ আছেন যাঁরা সূর্যাস্তের পর শর্করাজাতীয় খাদ্য খান না। এই রকম নির্দিষ্ট বিধিনিষেধ ছাড়া সূর্যাস্তের পরে শর্করাজাতীয় খাদ্য খেতে কোনও নিষেধ নেই।
আসলে সূর্য অস্ত যাওয়ার ঘণ্টা চারেকের মধ্যেই ডিনার সেরে ফেলা হয়। অনেকে আরও খানিকটা রাত জাগেন। এমন ব্যক্তিরা সন্ধেবেলায় একটু স্ন্যাক্স খান। সেই টিফিন অনেক সময়েই হয় পিৎজা, ইডলি, ধোসার মতো মুখরোচক খাবার। এই ধরনের খাদ্যগুলি সম্পূর্ণভাবে কার্বোহাইড্রেট জাতীয়। ফলে শরীরে ক্যালোরি অনেকখানি প্রবেশ করে। এরপর বেশি রাতে খাবার খাওয়ার সময়েও পাতে থাকে ভাত, রুটির মতো শর্করা। পর পর দু’বার শর্করাজাতীয় খাদ্য খেলে ওজন বেড়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকে। এই কারণেই সূর্যাস্তের পর শর্করাজাতীয় খাদ্য খাওয়ার ব্যাপারে অনেকের অনীহা থাকে।
কার্বোহাইড্রেট সবসময় ভেঙে গিয়ে গ্লাইকোজেন তৈরি করে যা আমাদের পেশিতে এবং লিভারে গিয়ে জমা হয়। এখন কেউ বাড়তি কার্বোহাইড্রেট খেলে তা পেশি ও লিভারে জমা হওয়ার পর তা ফ্যাটে রূপান্তরিত হয়। সেটা সম্পূর্ণ আলাদা বায়োকেমিক্যাল মেকানিজমে হয়। মোদ্দা বিষয়টা হল, বাড়তি কার্বোহাইড্রেটই ফ্যাটে পরিণত হয়। তা সে ভোরবেলা খান, দুপুরে বা রাতেই খান। অতএব শুধু রাতে কার্বস খেলে যে তা বার্ন হবে না, এমন কোনও কথা নেই।
ডায়েট মানে পেটে কিল মেরে থাকা:
অনেকেরই তাই ধারণা। অনেকেই পেটে কিল মেরে থাকেন। না খেয়ে থাকেন। ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং করেন। সারাদিনে কেউ কেউ শুধু আপেল খেয়ে থাকেন। আপাতদৃষ্টিতে দেখেশুনে মনে হয় ওজন কমছে। তবে সত্যিটা হল এভাবে ওজন কমলেও তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার মাত্রাও যথেষ্ট।
কারণ অনেকক্ষণ না খেয়ে থাকলে শরীরের বিপাকক্রিয়ার হার কমে যায়। শরীর ভাবে খাবারের অভাব হচ্ছে তাই ফ্যােট বার্ন হওয়ার বদলে দেহে ফ্যাট জমিয়ে রাখতে থাকে। শরীর দুর্বল লাগে, সর্বক্ষণ ক্লান্তিবোধ করে। এমনকী আপাতভাবে পেটে কিল মেরে থাকলে শরীরের রোজকার কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়ার জন্য যে এনার্জির প্রয়োজন হয়, তা শরীর পাবে না। কারণ এই শক্তি আসে শর্করাজাতীয় খাদ্য থেকে। একেবারে পেটে কিল মেরে থাকলে সেটুকু শর্করাও পাবে না শরীর। এর ফলে পেশিতে ও লিভারে জমে থাকা গ্লাইকোজেন ভাঙতে থাকবে দেহের সিস্টেম। সেই গ্লাইকোজেন শেষ হয়ে গেলে তখন শরীর পেশিগুলিকে ভাঙতে থাকবে। ক্রমশ পেশির ক্ষয় হবে ও পেশি দুর্বল হয়ে পড়বে। শেষে শরীর হাত দেবে জমে থাকা ফ্যাটে। ফ্যাট ভাঙতে থাকলে তখন শরীরে বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে তৈরি হবে কিটোনবডি যার ফলে শরীরের পুরো মেকানিজমটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
ফ্যাট খেলেই মোটা
এই ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল। আমাদের শরীরে ফ্যাটের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। প্রথমত আমাদের মস্তিষ্ক সম্পূর্ণভাবে ফ্যাটজাতীয় উপাদান দিয়েই তৈরি। ফ্যাট আমাদের মস্তিষ্কের কোষের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। এছাড়া ফ্যাট থাকে বলেই ভিটামিন এ, ডি, ই, কে-এর মতো ফ্যাটে দ্রবণীয় ভিটামিনগুলি শরীরে শোষিত হয়। ফলে ফ্যাট বাদ দিলে শরীরে ভিটামিনের অভাব ঘটবে। তাই বলে অতিরিক্ত ফ্যাট, অর্থাত্ বেশি ভাজাভুজি, তেলের জিনিস খাওয়া উচিত নয়। ফ্যাট খেতে হবে শরীরের প্রয়োজন মতো। বেশি খেলে তো ওজন বাড়বেই।
কলা খেলে বুকে শ্লেষ্মা হয়
কলা খেলে শ্লেষ্মা বা কফ হওয়ার কোনও আশঙ্কাই নেই। কলা খেলে ঠান্ডা লাগারও কোনও আশঙ্কা থাকে না। কফ বেরনো বা শ্লেষ্মা তৈরি হওয়ার সঙ্গে কলার কোনও যোগাযোগ নেই। উল্টে কলা খেলে শরীরে অনেক প্রয়োজনীয় খনিজ ও ভিটামিন প্রবেশ করে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কারণ কলায় থাকে সোডিয়াম-পটাশিয়াম যা হার্টের স্বাস্থ্যের পক্ষেও উপযোগী।
ডায়াবেটিক ও হার্টের রোগীরা ডিম খাবেন না
এই ধারণাও সম্পূর্ণ ভুল। আসলে ডিমের কুসুমে অনেকখানি কোলেস্টেরল থাকে বলে সুগার ও হার্টের রোগী গোটা ডিম খেতে ভয় পান। অথচ সত্যিটা হল, ডিমের সাদা অংশের মধ্যে প্রচুর প্রোটিন আছে। আছে ক্যালশিয়াম। এছাড়া ডিমের কুসুমে রয়েছে প্রচুর এইচডিএল, ভিটামিন, খনিজ। ফলে পুষ্টিগুণ এতটাই বেশি যে ডিম না খেলেই বরং লোকসান।
খাবার সময় জল পান উচিত নয়
কথাটি আংশিক সত্যি। কারণ খাবার খাওয়ার সময় আমাদের পাচনতন্ত্রে একাধিক এনজাইম বের হয়। এই এনজাইম খাবার হজম করতে সাহায্য করে। ফলে খাদ্য গ্রহণের সময়ে অতিরিক্ত জল পান করলে এনজাইমগুলি লঘু হয়ে যায়। বিশেষ করে ফ্যাটজাতীয় খাবার খেলে তারপর সঠিকভাবে এনজাইমের সহায়তা না পেলে ফ্যাট হজম হতে চাইবে না। তাতে দেখা দেয় আর এক সমস্যা। বিশেষত অ্যাসিডিটি হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই খাবার খাওয়ার অন্তত আধ ঘণ্টা পর জল পান করতে বলা হয়।
ডাল খেলে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ে
ছোলা, মসুর ইত্যাদি ডাল মাত্রাতিরিক্ত খেলে ইউরিক অ্যাসিড বাড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। তবে প্রেশার কুকারে রান্না করা হলে সেক্ষেত্রে অনেক সময় পিউরিন বন্ড ভেঙে যায়। এভাবে ডাল খেলে ইউরিক অ্যাসিড বৃদ্ধির আশঙ্কা হ্রাস পায়। এছাড়া আরও একটা কথা বলা দরকার। তা হল, ইউরিক অ্যাসিড জলে দ্রবণীয়। তাই পরিমাণ মতো জল পান করলে শরীরে ইউরিক অ্যাসিডের মাত্রা বৃদ্ধির আশঙ্কা থাকে না।
চিনি খেলে কৃমি হয়
চিনি খেলে বা মিষ্টি খাওয়ার সঙ্গে কৃমি হওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ, শরীরে কোনও প্যাইথোজেন থাকলে মিষ্টি খাওয়ার সঙ্গে তা দ্রুত ছড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। সাধারণত খুব অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বাচ্চারা যদি যাতায়াত করে, হাত দিয়ে মাটি ঘাঁটে ও সেই হাত মুখে দেয় তাহলে ওই হাতের মাধ্যমে মুখে ঢুকে যায় কৃমি বা ডিম। এরপর অন্ত্রে গিয়ে এই পরজীবী বাসা বাঁধে। খাদ্যবস্তুতে প্রচুর সুগার থাকলে ওই পরজীবী দ্রুত বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।
পক্স হলে নিরামিষ খেতে হয়
একেবারেই নয়। আগে পক্স হওয়ার সঙ্গে ধর্মীয় একটা যোগ বোঝার চেষ্টা করা হতো। তবে সময়ের সঙ্গে সেই ধারণা বদলেছে। আগে তো বাড়িতে কারও পক্স হলে মসুর ডালের প্রবেশ অবধি বন্ধ হয়ে যেত! এখন মানুষ সমস্যার পিছনে প্রকৃত কারণটি জানেন। খুব ভালো করেই বোঝেন যে এই সকল জটিলতার পিছনে দায়ী আসলে একটি ভাইরাস।
এই ভাইরাস শরীরের রোগ প্রতিরোধী ক্ষমতাকে একেবারে দুর্বল করে দেয়। এর ফলে শরীরে অন্যান্য ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া আক্রমণের সুযোগ পেয়ে যায়। আগে অনেকসময়ই এই কারণে পক্সের পরেই কারও কারও নিউমোনিয়াও হতো। বিশেষ করে পক্স হলে অতিরিক্ত ওজন কমতে থাকে। এই কারণেই পক্স হলে হাই প্রোটিন হাই ক্যালোরি ডায়েট খেতে হয়। মোট কথা পক্সের সমস্যা মেটাতে হলে ফল, শাকসব্জি তো খেতেই হবে, তার সঙ্গে খেতে হবে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন। তাই পক্স হলেই পাতে রাখুন মাছ, ডিম, ডাল, চিকেন স্টু ইত্যাদি।
খালি পেটে ফল খেতে নেই
ফল অত্যন্ত ভারী খাদ্য। ফলে থাকে অনেকখানি কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন ও খনিজ। খালি পেটে ফল খেলে পেট ভরে যাবে। ফলে অন্যান্য খাবারও আমরা খেতে পারব না। আবার রক্তে সুগারের মাত্রাও হাই হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। প্রতিদিন এমন অভ্যেস বজায় রাখলে অন্যান্য পুষ্টি উপাদান থেকে শরীর বঞ্চিত হবে। বিশেষ করে প্রোটিনের মতো উপাদান থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এই কারণেই লা়ঞ্চ, ব্রেকফাস্টের পরে ফল খেতে বলা হয়।
মাছের তেল অপকারী
মাছের তেল সম্পূর্ণ অপকারী নয়। মাছের তেলে থাকে উপকারী ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। এই বিশেষ ফ্যাটি অ্যাসিড হার্টের পক্ষে অত্যান্ত উপযোগী। ফলে মাছের তেল খাওয়াই যায়। তাই বলে খুব বেশি বড় মাছ না খাওয়াই ভালো।
বড় মাছে স্বাস্থ্যাহানি
বড় মাছ খাবেন না বলে সবসময় বাটা, পোনা, মৌরলা খেতে হবে এমন কোনও অর্থ নেই। এক থেকে দেড় কেজি ওজনের মাছ নিশ্চিন্তে খাওয়াই যায়। তাতে শরীরের কোনওরকম ক্ষতি হয় না। এই মাছের তেলও আমাদের হার্টের পক্ষে উপকারী।
আনারস এবং দুধ একসঙ্গে খেলে মৃত্যু
প্রাণহানি হবে কি না জানা নেই, তবে একত্রে এই দুটি বস্তু খেলে কারও কারও ডায়েরিয়া হয়। আনারসে থাকে ব্রোমেলিন এনজাইম। এই এনজাইম দুধের কেসিন প্রোটিনের সঙ্গে বিক্রিয়া করে দুধকে দইয়ে রূপান্তরিত করতে পারে। ব্রোমেলিন এনজাইম অনেকে হজম করতে পারেন না। ফলে বমি, ডায়েরিয়া শুরু হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
ঘি খেলে হাঁটু সচল হয়
হ্যাঁ, অনেকেরই ধারণা ঘি খেলে তা পেট থেকে হাঁটুতে চলে যায় ও হাঁটুকে সচল রাখে। তবে ঘি হোক বা অন্য যে কোনও খাদ্যবস্তু, তা স্টমাকে পৌঁছনোর পর প্রথমে হাইড্রোক্লোরিক অ্যাসিড দ্বারা ভেঙে যায়। এরপর নানা এনজাইম দ্বারা সেটি আরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পুষ্টি কণায় পরিণত হয়। মোদ্দা বিষয়টা হল কখনওই পেট থেকে সোজা হাঁটুতে পৌঁছে জ্যামড লক-এর মতো লকড হাঁটু সচল করতে পারে না!
জোড়া কলা খেলে যমজ শিশু
এও এক মিথ। জোড়া কলা খেলে যমজ সন্তান হওয়ার কোনও আশঙ্কা থাকে না। কলা পাকস্থলীতে হজম হয়ে যায়। আর সন্তান উত্পাদনের পদ্ধতি সম্পূ্র্ণ ভিন্ন। সেক্ষেত্রে প্রয়োজন হয় একটি ওভাম, স্পার্ম-এর। কোনওভাবে সেই ডিম্বাণু থেকেই দুটি জাইগোট বা ভ্রূণ তৈরি হয়। তখন হয় যমজ সন্তান। ফলে কলা খাওয়ার সঙ্গে সমগ্র বিষয়টির যে সম্পর্ক নেই সেকথা আলাদা করে বলার দরকার নেই।
জন্মের পর মুখে মধু দিলে গলার স্বর শ্রুতিমধুর হয়: একেবারেই নয়। বাচ্চার জন্মের পর তার শুধুই মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার কথা। অন্য কোনও খাবার তাকে দেওয়া যাবে না। আর বাচ্চা কেমনভাবে কথা বলবে তা সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করে তার পিতা-মাতা, পরিবারের বাকি লোকেরা তার সঙ্গে কেমনভাবে কথা বলছে তার উপর। কারণ বাচ্চা সবসময় বড়দের দেখেই আচার আচরণ, কথা বলার ধরন শেখে।
জ্বর হলে টক খাবেন না
এই কথারও সত্যতা নেই। জ্বর হলে বুঝতে হয় শরীরে কোনও সংক্রমণ হয়েছে। সেই সংক্রমণের সঙ্গে লড়ার জন্য দরকার ইমিউনিটি বৃদ্ধির। আর তা বাড়াতে পারে লেবুজাতীয় ফল ও দইয়ের মতো টকজাতীয় খাদ্য। পাতিলেবু, কমলালেবু, মুসাম্বির মতো ফলে থাকে প্রচুর ভিটামিন সি ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট যা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। দইয়ে থাকে প্রচুর ভিটামিন ও উপকারী ব্যাকটেরিয়া। ফলে এই ধরনের খাদ্য খেলে বরং উপকার হওয়ার কথা।
ভাত খেলে জ্বর আসে
ভাত খাওয়ার সঙ্গে জ্বর আসার কোনও সম্পর্কই নেই। বরং জ্বরের সময় ভাত খেলে শরীরের উপকার হওয়ার কথা। আসলে ভাতে থাকে অনেকখানি জলীয় উপাদান। জ্বর হলে ডিহাইড্রেশনের আশঙ্কা বাড়ে। ফলে ভাত খেলে বরং ডিহাইড্রেশন হওয়ার আশঙ্কা কমে।
ভাতের তুলনায় রুটি দ্রুত ওজন কমায়
হিসেব মতো দেখতে গেলে ভাতই বরং ওজন দ্রুত কমাতে পারে। কারণ বেশিরভাগ বাড়িতে চাল ফুটিয়ে ফ্যান ফেলে দিয়ে ভাত খাওয়া হয়। ফ্যানের সঙ্গে অনেকখানি শর্করাও চলে যায়। তাহলে ভাত খেলে শরীরে অনেক কম ক্যালোরি প্রবেশ করার কথা। তবে তারপরেও কেন সকলে রুটির জয়গান গায়? আসলে রুটির সঙ্গে থাকে প্রচুর খাদ্যতন্তু বা ফাইবার। রুটির শর্করা ভাতের তুলনায় অনেক বেশি জটিল শর্করা। তাই রক্তে ভাতের তুলনায় রুটি ধীরে ধীরে সুগারের মাত্রা অনেক বাড়িয়ে তোলে। হজম হয় দেরিতে। পেট অনেকক্ষণ ভরা থাকে। খিদের চোটে উল্টোপাল্টা খাওয়া হয় না।
অন্যদিকে ভাত থেকে দ্রুত শর্করা বেরিয়ে যায়। হজমও হয় দ্রুত। এই কারণে কিছুক্ষণের মধ্যে খিদে পেয়ে যায়। ফলে ভাত খাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে একজন ব্যক্তি অন্য খাবার খেয়ে ফেলেন। বাড়তে শুরু করে ওজন। তবে ওজন বৃদ্ধিজনিত সমস্যার ক্ষেত্রে বলা যায়, ভাতের সঙ্গে সঠিকমাত্রায় শাকসব্জি খেলে ওজন বৃদ্ধির আশঙ্কা কমে যায়।
শাক খেলে ডায়েরিয়া
শাকপাতা অবশ্যাই শরীরের পক্ষে উপযোগী। তাই বলে মাত্রাতিরিক্ত শাকপাতা খেলে সমস্যা। হবেই। কারণ শাক পাতা হল ইনসলিউবল ফাইবার। বেশি মাত্রায় শাকপাতা অন্ত্রে সংক্রমণ ঘটিয়ে সমস্যা তৈরি করতে পারে। শাকপাতা বেশি খেলে আবার হতে পারে কনস্টিপেশনের সমস্যাও!
লাল চা খেলে কালো, দুধ চা খেলে ফর্সা
ত্বকের রং কেমন হবে তা সম্পূ্র্ণভাবে নির্ভর করে বংশগতির উপর। ফলে চা পানের সঙ্গে ত্বকের রঙের কোনও সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ, দেখা গিয়েছে লাল চা পানের অভ্যেস ত্বক ভালো রাখে।
রান্নার তুলনায় কাঁচা শাকসব্জি বেশি উপকারী
কাঁচা শাকসব্জি খেয়ে হজম করতে পারলে সমস্যা ছিল না। তাতে বরং ভালোই হতো। জ্বালানি খরচ বেঁচে যেত। সমস্যাটা হল কাঁচা শাকসব্জি আমরা হজম করতে পারব না। সামান্য হলেও সেদ্ধ করতে হবে। তাছাড়া কাঁচা শাকসব্জিতে অনেকসময়েই প্রচুর কীটনাশক থাকে। থাকে নানা জীবাণু। তাই শাক, পাতা, সব্জি, ভালোভাবে ধুয়ে ও ভাপিয়ে খেলে হজমে সুবিধা। তবে গাজর, শসা, বীট, পেঁয়াজের মতো সব্জি তো আমরা কাঁচাই খাই। অতএব কিছু সব্জি কাঁচা খাওয়া যায় সেগুলি আমরা খাই, আর কিছু সব্জি কাঁচা খাওয়া যায় না, সেগুলি আমরা খেতে পারি না।
মাছের মুড়োয় চোখের জ্যোতি বাড়ে
মাছের মুড়োয় প্রচুর ফসফরাস থাকে। ফসফরাস চোখের পক্ষে খুব ভালো। তাই বলে প্রতিদিন মাছের মুড়ো খেলে চলবে কেন? সব কিছুরই একটা মাত্রাজ্ঞান থাকা দরকার। বেশি কোনও কিছুই খাওয়া ভালো নয়।
আম খেলে আমাশয়
আমের মরশুমে একটা দুটো আম খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ভালো। তাই বলে একটার পর একটা আম খেলে আমাশয় বা ডায়েরিয়া হওয়াই স্বাভাবিক। বেশি মাত্রায় আম খেলে পেট ব্যথা, পেটের সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে।
মুরগির থেকে হাঁসের ডিমে বেশি পুষ্টি
ডিমের চাইতে পুষ্টিকর কিছু আর হতে পারে না। বিশেষ করে দীর্ঘদিনের রোগাক্রান্ত ব্যক্তি, রক্তাল্পতার সমস্যায় ভোগা মানুষ, বাড়ন্ত বাচ্চার জন্যা ডিম অত্যন্ত জরুরি খাদ্য উপাদান। সাধারণভাবে ১০০ গ্রাম মুরগির ডিমে প্রোটিন থাকে ১২-১৩ গ্রাম। শর্করা সামান্য। ফ্যাট থাকে ১০ গ্রাম। কোলেস্টেরল ৪০০ মিলিগ্রাম। ক্যালশিয়াম আছে প্রতি ১০০ গ্রামে ৪৫-৫৫ মিলিগ্রাম আর ফসফরাস আছে ১৮০-১৯০ মিলিগ্রাম। এছাড়াও থাকে প্রচুর উপকারী খনিজ যেমন আয়রন, আয়োডিন, সেলেনিয়াম, থায়ামিন, রাইবোফ্ল্যাভিন, ক্যারোটিন (রেটিনল)-এর মতো ভিটামিন। থাকে ভালো মাত্রায় ভিটামিন ডি এবং বি১২। জানার বিষয় হল, হাঁসের ডিমেও পুষ্টিগুণ থাকে একই। বরং মুরগির ডিমের তুলনায় হাঁসের ডিমে ক্যালোরি আর কোলেস্টরল থাকে একটু বেশি।
মদ্যপানের সময় মাংস খেলে শরীরের ক্ষতি হয় না
যাঁরা মদ্যপান করেন তাঁরা ছোট থেকেই শুনে আসছেন বেশি মদ্যপান করলে লিভার খারাপ হয়। তাঁদের ধারণা লিভার হল একটি মাংসপিণ্ড। মদ পেটে ঢোকার পর কাউকে হাতের কাছে না পেয়ে সরাসরি ওই মাংসপিণ্ডকেই আক্রমণ করে! যাইহোক, সত্যিটা হল, মদ শরীরের পক্ষে সম্পূর্ণ টক্সিক বা ক্ষতিকর পদার্থ। তাই পাকস্থলী ও পরিপাকতেন্ত্র প্রবেশের পর অ্যাালকোহল দ্রুত রক্তে মিশে যায়। তখন শরীর চায় ওই ক্ষতিকর পদার্থকে দ্রুত শরীর থেকে বের করে দিতে। শরীর থেকে ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দিতে পারে বা রক্ত শোধন করার ক্ষমতা রাখে একমাত্র লিভার। এমনিতেই লিভারকে সারাদিন ধরে শরীরে তৈরি হওয়া নানা ক্ষতিকর পদার্থ শোধন করতে হয়। এই ধরনের ক্ষতিকর পদার্থ শোধন করার সময় লিভারের অনেকগুলি কোষ মারা যায়। তবে লিভার পুনরায় কোষ তৈরি করার ক্ষমতা রাখে। সমস্যা হল, যখন একজন ব্যক্তি প্রচুর পরিমাণে মদ্যপান করেন তখন লিভারকে বেশি কাজ করতে হয়। বেশি মাত্রায় লিভারের কোষ নষ্ট হয়। ক্রমশ লিভার খারাপ হতে থাকে। ফলে যাঁরা ভাবছেন মাংস দিয়ে মদ খেলে শরীরের কোনও ক্ষতি হবে না তাঁরা আরও বড় ভুল করছেন। কারণ মদে এমনিতেই প্রচুর ক্যালোরি থাকে। তারপর তেল-মশলা দেওয়া মাংস খেলে শরীরে আরও বেশি ক্যালোরি প্রবেশের আশঙ্কা থেকে যায়। এর ফলে দেখা যায় স্থূলত্ব, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিসের সমস্যা আবার লিভার ডিজিজের আশঙ্কাও বাড়ায়।
গরম জল ও লেবু খেলে চর্বি কমে
দেহের অতিরিক্ত ওজন কমানোর সঙ্গে গরম জলে লেবুর রস মিশিয়ে খাওয়ার কোনও সম্পর্ক নেই। তবে হ্যাঁ সকালে উঠে গরম জল পান করে অনেকের পেট সাফ করতে সুবিধা হয়। তাঁরা পান করতে পারেন এমন জল। এছাড়া লেবুর রসে থাকে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ভিটমিন সি। তবে সেক্ষেত্রে লেবুর রস পান করতে হবে ঠান্ডা জল মিশিয়ে। কারণ গরমে ভিটামিন সি নষ্ট হয়ে যায়। মোট কথা অতিরিক্ত ওজন কমাতে হলে অবশ্যই এক্সারসাইজ করতে হবে। না হলে কোনও লাভ নেই।
সর্ষের তেলের থেকে অলিভ অয়েল বেশি ভালো
একেবারেই তেমনটি নয়। এসব হল পণ্য বিক্রির জন্য মার্কেটিং-এর কৌশল। সষের্র তেলে যথেষ্ট মাত্রায় থাকে ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড, পুফা, মুফার মতো হার্টের স্বাস্থ্যের পক্ষে উপযোগী উপাদান। তাই নিশ্চিন্তে খান সর্ষের তেল।
ব্রেকফাস্ট স্কিপ করলে মানুষ দ্রুত রোগা হয়
কখনওই প্রাতরাশ এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। কারণ দীর্ঘসময় খাবার খাওয়া এড়িয়ে চললে শরীরের মেটবলিজম স্লো হয়ে যায়। এর ফলে শরীর আরও বেশি ফ্যাট জমা করতে থাকে। তাই ব্রেকফাস্ট এড়িয়ে চললে একজন ব্যক্তি রোগা হওয়ার বদলে মোটা হতে থাকেন।
পরামর্শদাতা রুবি জেনারেল হাসপাতালের চিফ ডায়েটিশিয়ান।
লিখেছেন: সু্প্রিয় নায়েক