সাপ্তাহিক বর্তমান

পোস্টমর্টেম কী

খুনের কিনারা করার জন্য সবথেকে প্রয়োজনীয় যে তথ্য তার সিংহভাগই পোস্টমর্টেম রিপোর্টে থাকে। হত্যার আগে ও সেই মুহূর্তে মনের অবস্থা, আচরণ কেমন ছিল ধর্ষক- হত্যাকারীর? সেটাই অপরাধের চালিকাশক্তি। আর সেই হদিশ মেলে পোস্টমর্টেমে। তদন্তের চাবিকাঠি ফরেনসিক রিপোর্ট। দেশের সাড়া জাগানো ধর্ষণ-প্রতিশোধমূলক হত্যার কথা লিখলেন সমৃদ্ধ দত্ত
ফরেনসিক এবং অটোপসি পরীক্ষা কী? খুন, অপঘাত, দুর্ঘটনা, আত্মহত্যা—সবকিছুরই প্রমাণ রয়ে যায় দেহে। খুন কি চাপা দেওয়া যায়? দক্ষ পরীক্ষক-বিশেষজ্ঞরা বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে উদ্ধার করে আনেন নিখুঁত সত্যকে। সেই কাজের ধরণ কেমন? ক্রাইমের আড়ালে থাকে এক অন্য থ্রিলার। ধাপে ধাপে এগন ফরেনসিক এক্সপার্টরা। কীভাবে? সেই রহস্যকথা শোনালেন ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ
ডাঃ অজয় গুপ্ত। 

পোস্টমর্টেম কী? এতে কী পাওয়া যায়?
একটি অপরাধের কিনারা করার জন্য সবথেকে প্রয়োজনীয় যে তথ্য ও নথি, তার সিংহভাগই পোস্টমর্টেম রিপোর্টে পাওয়া যায়। যতটা বিস্তারিত জানা সম্ভব একটি মৃতদেহ থেকে এক জীবিত মানুষ সম্পর্কে, ততটাই চেষ্টা করা হয়। প্রথমেই নোট করে নেওয়া হয় উচ্চতা, ওজন, শরীরের কোনও বিশেষ চিহ্ন বা আইডেন্টিফিকেশন মার্ক। ক্ষতচিহ্ন হতে পারে, উল্কি হতে পারে। অর্থাৎ ট্যাটু। সেই ট্যাটু কীভাবে করা হয়েছে? কোন কেমিক্যাল ব্যবহৃত? সেটাও। 
তিনরকম ভাবে শরীরকে কাটা হয়—এ, ওয়াই এবং ইউ। বুক থেকে তলপেট পর্যন্ত প্রথমে কেটে ফেলা হয়। তারপর ত্বক এবং টিস্যুকে পৃথক করা হয়। শ্বাসনালী, থাইরয়েড গ্ল্যান্ড, প্যারা থাইরয়েড গ্ল্যান্ড, ফুসফুস সবই পৃথকভাবে বিচ্ছিন্ন করা হয়। এভাবেই শরীরের অভ্যন্তরীণ অন্য অঙ্গগুলিকেও বিচ্ছিন্ন করে পৃথকভাবে রাখা হয়। স্কালের বিশেষ অংশ সার্জারির মতো করে কেটে এবার মস্তিষ্ক খোলার কাজ। প্রতিটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে পরীক্ষা করেন প্যাথোলজিস্ট। আরও বেশি প্রয়োজন হলে মাইক্রোস্কোপিক পরীক্ষা হয় টিস্যু স্তরেও। 
এই পরীক্ষাগুলির অন্যতম সন্ধান হল, সংক্রমণ হওয়ার মতো কিছু আছে কি না জানা। কেমিক্যাল বিশ্লেষণে জানা যায় ওষুধ বা রাসায়নিক কোনও বস্তুকে। কোনও কোনও সময় টিস্যুকে ফ্রোজেন অবস্থায় রেখে দেওয়া হয় আরও পরীক্ষার জন্য। অজানা বিষক্রিয়ার পোস্টমর্টেম সব থেকে বেশি হয়। সেক্ষেত্রে অটোপসির সময় পরীক্ষা করা হয় আলাদাভবে পাকস্থলী ও তার মধ্যে থাকা বস্তুসামগ্রী। লিভার, কিডনি, অন্ত্রের খণ্ডাংশ পাঠানো হয় রিজিওনাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে। সেখান থেকে রিপোর্ট পাওয়া যায় ঠিক কী ধরনের বিষ ব্যবহার করা হয়েছে। 
প্রতিটি মৃত্যুতেও একই রকমভাবে এইসব প্রক্রিয়া প্রয়োগ করা হয়? না। যেখানে যেমন প্রয়োজন এবং মৃত্যুর কারণের উপর নির্ভর করে সবটা। তদন্তকারী এজেন্সির ভূমিকা এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। তারা কী চাইছে, কী সন্দেহ করছে, প্রাথমিক তদন্তে কী জানা যাচ্ছে, গুরুত্বপূর্ণ এগুলোও। 
 কোনও মেথডে হয়তো প্রতিটি অঙ্গ পৃথকভাবে বের করে পরীক্ষা করা হয়। আবার কিছু ক্ষেত্রে একটিই অঙ্গকে পরীক্ষা করা দরকার। আবার এমনও হতে পারে যে আদৌ কোনও অঙ্গকে দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়োজনই পড়ল না। অর্থাৎ ফুলবডি এক্সপোজারের দরকারই নেই। 

ফরেনসিক এবং অটোপসি পরীক্ষায় কী হয়?
দুটি পরীক্ষাতেই কী কী দেখা হয়ে থাকে? প্রায় সবকিছু। এবং প্রতিটি বিন্দু একটি করে প্রমাণ বহন করে। দাঁত, ঠোঁট, ঠোঁটে কামড়ানোর চিহ্ন, সেখান থেকে পাওয়া যাবে লালার উপাদান। ধর্ষণের অভিযোগ অথবা সন্দেহ থাকলে যৌনাঙ্গ পরীক্ষা করে অনায়াসে ধরা পড়বে। কাউকে যদি বারংবার আঘাত করা হয়, তাৎক্ষণিক সে হয়তো মারা গেল না। হয়তো কয়েকদিন ধরে মাঝেমধ্যেই মারা হয়েছে। সেক্ষেত্রে অনেক পরে মৃত্যু হলেও জানা সম্ভব যে কতদিন ধরে এই নারী অথবা পুরুষকে আঘাত করা হয়েছে। শেষতম আঘাত কোনটা? সবথেকে পুরনো আঘাতই বা কোনটা? কী দিয়ে মারা হয়েছে? এমনকী অস্ত্রের ধরন সম্পর্কেও বহু অভিজ্ঞ ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ বলে দিতে পারেন। অন্তত একটি ধারণা দিতেই পারেন যে অস্ত্রটা আদতে দেখতে কেমন। অটোপসি করে শ্বাসনালী, থাইরয়েড গ্ল্যান্ড, ল্যারিংসের প্রবেশদ্বার পরীক্ষা করে ঠিক কীভাবে শ্বাসরুদ্ধ করা হয়েছে, সেটিও জেনে নেওয়া সম্ভব। গলা টিপে শ্বাসরোধ করা হয়। বালিশ মুখে চাপা দিয়েও শ্বাসরুদ্ধ করা যায়। আবার হত্যনকারীর শরীরে শক্তি বেশি থাকলে নিজের হাতে নাক ও মুখের উপর চাপা দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে হত্যা করা সম্ভব। এই প্রতিটি লক্ষণ স্পষ্ট হয় অটোপসিতে। 
ত্বকের নীচের অংশের রং হয়ে গিয়েছে নীলচে, নীলচে- বেগুনি অথবা বেগুনি-লাল। এই অংশ দেখেই অটোপসি ডাক্তার বুঝে যাবেন যে রক্তে হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ঠিক কতটা কমেছে। আর সেটা দেখে নিশ্চিত আন্দাজ করা যায় মৃত্যুর সময়। অর্থাৎ ঠিক ক’টা থেকে ক’টার মধ্যে ঘটেছে মৃত্যু। মৃতের শরীরের ঘাড়, গলা, মেরুদণ্ড শক্ত হয়ে যায়। রাইগর মর্টিস সেট ইন করা যাকে বলা হয়। মৃত্যুর ২ থেকে ৩ ঘণ্টা পর থেকে শরীরে পেশি শক্ত হয়ে জমে যেতে শুরু করে। 
শ্বাসরুদ্ধ হয়ে অথবা বিষক্রিয়ায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে বোঝা যায় যে কীভাবে, কখন মৃত্যু হয়েছে। বিশিষ্ট ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ ডক্টর টি কে ডোগরা নিজের জার্নালে বলেছেন, ‘একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার অটোপসি করার সময় অ্যাবডোমেন ওপেন করার সঙ্গে সঙ্গে একটা গন্ধ পান। সেই গন্ধ থেকেই তিনি বুঝে যান কোন ধরনের বস্তু শরীরে প্রবেশ করেছে। কেরোসিন হতে পারে, অ্যালকোহল হতে পারে বা সায়ানাইড— প্রত্যেকটার পৃথক পৃথক গন্ধ আসবেই। যে কোনও হত্যা, ধর্ষণের পর হত্যা, গণধর্ষণ করে হত্যা, বিষ খাইয়ে হত্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি প্রয়োজন ক্রাইম সিন অবিকল একই রেখে দেওয়া যথাসম্ভব।’ 
আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারাও জানি যে, পুলিসকে কোনও অস্বাভাবিক মৃত্যুর সংবাদ দেওয়া হলে, সর্বাগ্রে তাঁরা বলেন, কোনও জিনিসে হাত দেবেন না। বডিতেও কেউ হাত দেবেন না এখন। কারণ হল এভিডেন্স কালেকশন। ফরেনসিকে পাঠানো হবে নানাবিধ নমুনা। আর সবথেকে জরুরি হল ডিএনএ টেস্ট। বায়োলজিক্যাল পরীক্ষা যার মূলমন্ত্র। ঘটনাস্থল থেকে সংগ্রহ করতে হয় চুল, চাদরের ছেঁড়া অংশ, জামাকাপড়ের সুতো, কোনও রং, অকুস্থলের নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের ধুলো অত্যন্ত সংগ্রহ করা জরুরি। ওই ধুলোয় থাকে প্রচুর নমুনার সংকেত। পাঠাতে হয় ফরেনসিকে। 
সিমেন, লালা, রক্তের নমুনা, ঘাম। নিহতের শরীর জুড়ে আততায়ীর দেহের কোনও না কোনও নমুনা থাকবেই। ধস্তাধস্তি হলে তো কথাই নেই। অসংখ্য নমুনা পাওয়া যায়। তদন্তের কাজ সহজ হয়ে যায়। 

পোস্টমর্টেম ও ফরেনসিকে শুধুই কি শরীরের পরীক্ষা হয়?
একেবারেই নয়। পাওয়া যায় একইভাবে হত্যকারী কিংবা ধর্ষকের মানসিকতার আভাসও। সে কেমন অস্ত্র ব্যবহার করতে পছন্দ করেছে। কেন করেছে? একই ধরনের হত্যা বিভিন্ন হত্যাকারী নানাবিধ পৃথক অস্ত্র দিয়ে করে। নিছক যা হাতের কাছে পাওয়া যায় সেটা দিয়েই হত্যা করতে চায় বলে এই নির্বাচন? মোটেই নয়। অটোপসি বিশেষজ্ঞরা এবং ফরেনসিক এক্সপার্টরা অনেকটাই সাইকোলজিস্টের কাজও করেন।
তাঁরা বুঝতে চেষ্টা করেন যে, হত্যা করার জন্য আততায়ী ঠিক কোন পদ্ধতি প্রথমে বাছাই করেছে। কেউ হত্যা করার আগে ভাববে ঘুমের ওষুধ বেশি করে খাইয়ে দিই। কেউ ভাববে গলা টিপে হত্যা করব। কেউ ভাববে ছাদ অথবা পাহাড়চূড়া থেকে ঠেলে ফেলে দেব। কেউ আবার পিস্তলের খোঁজ করবে। কারও কাছে হামানদিস্তাই পারফেক্ট। কারও পছন্দ ধারালো অস্ত্র। কেউ সহজভাবে বিষ মিশিয়ে দেবে। যারা হত্যা করে তাদের মানসিক অবস্থান, তারা কতটা নির্দয়, কতটা সাহসী, কতটা ভীরু এবং কতটা মরিয়া, কতটা সতর্ক, এই সবই পরীক্ষা করে টের পাওয়া যায় অটোপসিতে। প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে তাই পোস্টমর্টেম হল মেরুদণ্ড। পোস্টমর্টেমের ভিত্তিতে তদন্ত অগ্রসর হয়। হত্যাকারী মাত্রই সে নিষ্ঠুর। সে একটি জীবনকে ধ্বংস করছে। কিন্তু অটোপসি বিশেষজ্ঞরা বলেন, মোটেই সেরকম নয়। সবথেকে ভালোবাসার মানুষকে সবথেকে নরম মনের একজন মানুষ যে কোনও পরিস্থিতিতে নির্মমভাবে হত্যা করতে পারে! হত্যার আগে এবং সেই মুহূর্তে মনের অবস্থা কেমন ছিল ধর্ষণ ও হত্যাকারীর? সেটাই চালিকাশক্তি অপরাধের। আর সেই হদিশ মিলবে পোস্টমর্টেম থেকেও। অতএব পোস্টমর্টেম মহাশক্তিশালী। ফরেনসিক রিপোর্ট হতে পারে তদন্তের চাবিকাঠি। 

বিষ এল কীভাবে? 
পুলিসের কাছে করা অভিযোগে কী ছিল? চার্জশিটে কী লেখা হয়েছিল? কী ছিল কেস ডায়েরিতে? দেখা যাক। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে একটা কাজ ছিল। হিন্দুস্তান রোডের বাড়ি থেকে খুব বেশি দূরে নয়। রিকশ করেই যাতায়াত করেন সুরূপা গুহ। ডাক নাম দোলা। ২৮ বছর বয়স। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজের স্নাতক। এই ১০ নম্বর হিন্দুস্তান রোডের অভিজাত পাড়ার অভিজাত বাড়িটির পরিবারের গৃহবধূ তিনি। সকাল ৯টা নাগাদ বেরিয়েছিলেন। বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে বায়োকেমিস্ট্রির রিসার্চ স্কলার। কখনও সকালে, কখনও দুপুরে যেতে হয় কলেজে। ৪ মে ১৯৭৬। সেদিন ছিল সকালে যাওয়া। 
তবে বেশিক্ষণ সময় লাগেনি। ১৫ মিনিট কলেজে নিজের ডিপার্টমেন্টে থেকে সুরূপা বেরিয়ে এসেছিলেন। ল্যাবরেটরিতে কিছু বকেয়া কাজ রয়ে গিয়েছিল। তাই আসা। কাজ শেষ। এবার যাবেন বাড়ি। রিকশ ডাকলেন। সামান্য পথ ফিরতেও বেশি সময় লাগল না। ফিরে যাওয়ার সময় বিশেষ কিছু খেয়ে যাননি। এবার খাবেন ব্রেকফাস্ট। তবে বেশি কিছু নয়। ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার সময়। 
পরিচারক ঝন্টুচরণ দত্ত। নিয়ে এসেছে একটা প্লেট এবং একটি গ্লাস। প্লেটে শসা। গ্লাসে লস্যি। সুরূপা খেলেন। একটু পরই শরীর কেমন যেন গুলিয়ে উঠছে। বমি পাচ্ছে। মাথাও ঘুরছে। সুরূপা উঠে গেলেন বাথরুমে। অনেকটা বমি করলেন। কিন্তু তাও যেন ঠিক স্বস্তি হচ্ছে না। বিছানায় এসে একটু শুলেন। আবার...আবার বমি পাচ্ছে। আবার বমি হল। দরদর করে ঘাম হচ্ছে। প্রেশার কমে যাচ্ছে। চারদিকটা কেমন যেন শূন্য হয়ে যাচ্ছে। দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। 
সুরূপার স্বামী ইন্দ্রনাথ গুহ গিয়েছিলেন নিজের কর্মস্থলে। কাছেই। বালিগঞ্জের কাছে একটি স্কুলের প্রিন্সিপাল তিনি। স্কুলে পরীক্ষা চলছে। তাই একটু বেশি ব্যস্ততা। তাঁর পিতা সতীকান্ত গুহ এই স্কুল স্থাপন করেছিলেন। অতএব পুত্রের উপরই প্রশাসন এবং সামগ্রিক শিক্ষা পরিকাঠামোর দায়িত্ব। তিনি খবর পেলেন যে, স্ত্রী অসুস্থ। দ্রুত ফিরছেন। তবে তার আগে পারিবারিক চিকিৎসককে সঙ্গে নিতে হবে। ডক্টর বিজিতেন্দ্র গুপ্ত। তাঁকে সঙ্গেই নিয়েই বাড়ি এলেন ইন্দ্রনাথ। 
ডাক্তার দেখলেন। সকাল ১১টা।  কিন্তু দেখেই তিনি বুঝলেন পেশেন্ট ঠিক স্টেবল নয়। বাড়িতে রাখা নিরাপদ হবে না। অতএব তাঁর পরামর্শ হাসপাতালেই ভর্তি করা উচিত। সুরূপাকে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হল এসএসকেএম হাসপাতালে। ইন্দ্রনাথ এবং তাঁর পিতামাতাও সঙ্গে গেলেন। কী হয়েছে হঠাৎ বাড়ির গৃহবধূর? তাঁরাও চরম উদ্বিগ্ন। 
ইমার্জেন্সিতে প্রাথমিক চিকিৎসায় বোঝা যাচ্ছে, কোনওভাবে শরীরে ঢুকেছে বিষ। খাবারের সঙ্গে হতে পারে। ওই যাকে বলা হয়, ফুড পয়েজনিং। সচরাচর বাড়িতে খাবার আঢাকা থাকলে কিংবা কোনও কারণে পচন ধরলে অথবা আরশোলা, টিকটিকির মতো বিষাক্ত কিছু খাবারে মিশ্রিত হলে এরকম হয়েই থাকে। 
কিন্তু এই পেশেন্টকে এভাবে রাখা সম্ভব নয়। ইমার্জেন্সিতেই চিকিৎসা করে কিছু ওষুধ প্রেসক্রিপশন হিসেবে লিখে দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলে বিকেলের মধ্যেই সুস্থতার লক্ষণ দেখা যাবে, এরকম তো মনে হচ্ছে না। অতএব ভর্তি করতে হবে। শুধু তাই নয়, ব্যাপারটা বেশ সঙ্কটজনক দিকেই গড়াচ্ছে। কর্তব্যরত চিকিৎসকদের পরীক্ষা করে সেরকমই মনে হচ্ছে। তাঁরা বললেন, আইসিউতে অ্যাডমিট করতে হবে। ইমিডিয়েট। সকাল সাড়ে ১১টা। 
দ্রুত সেই ব্যবস্থা হল। পিজি হাসপাতালের সিআই ব্লকের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ভর্তি হলেন সুরূপা গুহ। কীভাবে হল এই অবস্থা? পরিবার থেকে বলা হল, ভুল করে কিছু একটা নিশ্চয়ই খেয়েছে। বিষাক্ত। কী হতে পারে?
দুপুর দুটো নাগাদ ইন্দ্রনাথ গুহ গেলেন বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে। তিনি জানতে চান ঠিক কী হয়েছিল ওখানে? কলেজে কি কিছু খেয়েছে দোলা? তিনি দেখা করলেন বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজের অধ্যাপক এস কে বসুর সঙ্গে। যাঁর তত্ত্বাবধানে রিসার্চের কাজ করছিলেন সুরূপা। এখানে কি এমন কিছু পাওয়া যায় যা বিষ? ইন্দ্রনাথ জানতে চান।সেটা তো পাওয়া যাবেই। দুটো নাম তিনি লিখে নিলেন একটি কাগজে। কিন্তু সেই কাগজ কোথায়? এই মামলায় সরকার পক্ষের আইনজীবী তথা পুলিসের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সেই কাগজ ইন্দ্রনাথ কাউকে দেননি। হাসপাতালে চিকিৎসার সময় ডাক্তাররা জানতে চান, আপনি কী খেয়েছিলেন? আপনি কি নিজে কোনও বিষ খেয়েছেন? সুরূপা জানান, আমি নিজে থেকে বিষ খাইনি। কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে শুধুই শসা আর লস্যি খেয়েছি। তারপরই শরীর খারাপ হতে শুরু করে। 
সুরূপার শ্বশুর সতীকান্ত গুহ হাসপাতালে ডাক্তারদের একটি বোতল দেন। যেটায় রয়েছে হরলিকস। তিনি বলেন, এটা একটু পরীক্ষা করতে বলুন আপনাদের ল্যাবে। এটা খেয়ে থাকতে পারে। এটা থেকেই বিষক্রিয়া হয়নি তো? 
রাত সাড়ে ১০টা। ইন্দ্রনাথ গুহ বালিগঞ্জ থানায় অভিযোগ জানিয়ে রাখলেন। লিখলেন, তাঁর স্ত্রী ভুল করে হয়তো কিছু খাবার অথবা তরল খেয়েছেন যা বিষাক্ত। সেই কারণে তিনি এখন হাসপাতালে ভর্তি আছেন। 
সাড়ে ১১টার সময় সুরূপা গুহের মৃত্যু হল। তাঁর রয়েছে একটি পাঁচ বছরের কন্যা। ইতিমধ্যে স্বাভাবিকভাবেই খবর পেয়েছেন সুরূপার বাবা এবং পরিবার। তাঁরা কিন্তু এই ঘটনাকে নিছক ভুল করে বিষাক্ত কিছু খেয়ে নেওয়া মনে করছেন না। বরং তাঁদের ধারণা নিশ্চিতভাবে সুরূপাকে হত্যা করা হয়েছে। পরিকল্পনা মাফিকই বিষমিশ্রিত খাদ্য দিয়ে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কেন? 
পরিবারের অভিযোগ, ১৯৬৬ সালে বিবাহ হয় সুরূপার সঙ্গে ইন্দ্রনাথের। কিন্তু তাঁর কন্যার উপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার শুরু হয়েছিল। অনেকবারই বলেছে মেয়ে যে, মানসিক অত্যাচার চরমে উঠেছে। মায়ের অভিযোগ, জামাই প্রায়ই রাতে মত্ত অবস্থায় ফেরে। আর তার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করে। লালবাজার কন্ট্রোল রুমে রাত ১১টা ৪২ মিনিটে  সুরূপার কাকা রমেন্দ্রমোহন মুখার্জির বন্ধু বিজয় রায় টেলিফোন করে বলেন, সুরূপার মৃত্যু স্বাভাবিক নয়। তাঁকে হত্যা করা হয়েছে বলে তাঁদের সন্দেহ। অতএব পুলিস যেন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়। 
একই বয়ান জানিয়ে পরদিন ভোর ৫টা ১৫ নাগাদ সুরূপার পিতা রমেন্দ্রমোহন মুখার্জি সরাসরি এফআইআর করেন বালিগঞ্জ থানায়। তাঁর অভিযোগ, হয় শসা, নয়তো লস্যিতে বিষ মেশানো হয়েছিল। আর সেই কারণেই মৃত্যু হয়েছে তাঁর মেয়ের। এই পরিবার দীর্ঘদিন ধরেই অত্যাচার চালাচ্ছে মেয়ের উপর। এফআইআর হল। এই অভিযোগ পেয়ে এস এস সরকার পিও (প্লেস অফ অকারেন্স) ভিজিটের দায়িত্ব পেলেন। বালিগঞ্জ থানার সাব ইন্সপেক্টর তিনি। গেলেন ১০ নং হিন্দুস্তান রোডের গুহবাড়িতে। সুরূপার ঘর। খাটের নীচে কাপড় আর চাদর। যেটা  ছিল হাসপাতালে। যেখানে বমির দাগ। 
কীভাবে মৃত্যু হয়েছে সুরূপার? ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা হয়েছে, ‘কন্ডিওরেসপিরেটরি ফেলিওর ডিউ টু আননোন পয়জনিং’। একদিকে আননোন পয়জনিং। অন্যদিকে মৃতার পিতা ও পরিবারের গুরুতর অভিযোগ। এবং সর্বোপরি কলকাতার অন্যতম এলিট ধনী পরিবারের মধ্যে এই ঘটনা। এবং ওরকম এক খ্যাতনামা উচ্চবর্গের ব্যক্তিত্বদের বিরুদ্ধে এত বড় অভিযোগ। সুতরাং পুলিস যে প্রবলভাবে চাপে পড়বে তদন্তে কোনও সন্দেহ নেই। তাই যেভাবেই হোক দ্রুত তদন্ত পর্ব সমাপ্ত করতেই হবে। আর নিখুঁত তথ্য, নথি, প্রমাণ, সাক্ষ্য জোগাড় করা দরকার। নয়তো এই নিয়ে প্রবল হইচই হবে। 
হইচই আটকানো গেল না। কলকাতার সংবাদপত্রগুলিতে বিস্তারিত প্রকাশিত হল। কিন্তু প্রকৃত আগ্রহ ও কৌতূহল হল, সত্যিই কি গুহ পরিবার জড়িত? তাঁদের বিরুদ্ধে যে মারাত্মক অভিযোগ উঠেছে বধূহত্যার, সেটা সত্যি নাকি মিথ্যা? ঘটনা পরম্পরা কী বলছে? এভিডেন্সে  কী কী আছে?
তদন্ত করতে নামল পুলিস। লালবাজারের ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট। বেশিদিন নয়। পিতার এফআইআরের ভিত্তিতে তদন্ত করে পুলিস নিশ্চিত হল যে, এটা চক্রান্ত। পরিকল্পনা করেই হত্যা করা হয়েছে সুরূপা গুহকে। মামলা রুজু হল। কেস নং ১৮৮, বালিগঞ্জ থানা, ১৫ মে, ১৯৭৬। 
পুলিস ১৯৭৬ সালের ১৫ মে গ্রেপ্তার করল ঝন্টুচরণ দত্তকে। গুহ পরিবারের সেই পরিচারক। যার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে শসা এবং লস্যি দিয়েছিল সুরূপাকে। আর সেটা খেয়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন সুরূপা। যে বিষক্রিয়ায় অবশেষে মৃত্যু। কিন্তু সে একা কেন করবে? সে তো বাড়ির পরিচারক! নির্ঘাত মনিবদের নির্দেশেই হয়েছে! অতএব একে একে গ্রেপ্তার করা হল সুরূপার স্বামী ইন্দ্রনাথ, শ্বশুর সতীকান্ত, শাশুড়ি প্রীতিলতাকে। গ্রেপ্তার হলেন রমেন্দ্রনাথ লাহিড়ি। কলকাতার একটি বেসরকারি স্কুলের কর্মী। 
৫ মে লালবাজারে ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট তদন্ত শুরু করে। আর ১০ জুলাই চার্জশিট দিয়ে দেয় প্রত্যেকের নামে। চক্রান্ত ও হত্যার অভিযোগ। ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০ বি/৩২৮/২০১/৩০২ ধারা। কোথায় মামলা রুজু হল? সাবডিভিশনাল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, আলিপুরে। মামলার শুনানি এবং নিষ্পত্তির জন্য পাঠানো হল, একাদশ অতিরিক্ত সেশন জাজ আলিপুরের কাছে। সর্বাগ্রে কোনও অপরাধের প্রমাণ না পেয়ে ওই স্কুলেরই কর্মী রমেন্দ্র লাহিড়িকে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হল। 
কিন্তু বাকি প্রত্যেক অভিযুক্তকেই দোষী সাব্যস্ত করলেন বিচারপতি। কীসের ভিত্তিতে? প্রথমত ১২০ বি ধারা অনুযায়ী হত্যার চক্রান্ত। ১৯৭৬ সালের এপ্রিল মাসে গোলপার্ক রামকৃষ্ণ মিশনের গেস্ট হাউসে গিয়ে থাকছিলেন কেন সুরূপার শাশুড়ি প্রীতিলতা? সুরূপার মা অমিয়া মুখোপাধ্যায়ের অভিযোগ ছিল, তিনি একদিন সেই গেস্ট হাউসে বেয়ানের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে লক্ষ করেছিলেন ইন্দ্রনাথ, সতীকান্ত, ঝন্টুচরণ সকলেই উপস্থিত। আর ছিলেন মিসেস ভিনসেন্ট নামে এক স্কুল শিক্ষিকা। সেখানেই নাকি এই চক্রান্ত হয়। কারণ প্রীতিলতা একবার কথায় কথায় বলেছিলেন, ‘ওর রেহাই নেই।’  একথা কেন বলেছিলেন? কার রেহাই নেই? সুরূপার? 
বিচার প্রক্রিয়ায় প্রশ্ন উঠল, কেন সতীকান্ত একটা হরলিকসের বোতল দেখিয়ে তদন্তকে অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করলেন? কেন ইন্দ্রনাথ হঠাৎ এই ঘটনাকে আত্মহত্যা প্রমাণের জন্য মরিয়া হয়ে বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজে চলে গিয়েছিলেন? বিষপদার্থ কী সুরূপার নাগালে থাকতে পারে সেটা প্রমাণ করতে? 
পুলিস অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তর পায়নি। আর সেইমতোই অসঙ্গতি পেল অভিযুক্তদের বয়ানে। কয়েকটি সাক্ষ্যে। এই চার্জশিট, শুনানি, অসঙ্গতি এবং সাক্ষ্য। আলিপুর আদালত প্রত্যেককেই দোষী সাব্যস্ত করল। চক্রান্ত এবং হত্যা। দুই অভিযোগে। 
এখানেই কি সমাপ্ত হল কাহিনি? না। বরং শুরু হল। কারণ স্বাভাবিক এবং প্রত্যাশিতভাবেই অভিযুক্ত এবং দোষী সাব্যস্ত হওয়া গুহ পরিবার হাইকোর্টের দ্বারস্থ হল। দেখা গেল পুলিসের তদন্ত এবং চার্জশিটে অনেক ফাঁক। অভিযোগ তোলা হয়েছে। বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসল বস্তুটির অভাব ঘটেছে। কী? এভিডেন্স। যা যা অভিযোগ করা হয়েছে, সেই অনুযায়ী নিখুঁত তথ্য, নথি, সাক্ষ্য তো প্রমাণ হিসেবে রাখতে হবে! কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশের দুটি মামলার রেফারেন্স টেনে এনে আবেদনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল নিম্ন আদালত যখন কোনও নিশ্চিত তথ্যপ্রমাণ ছাড়াই একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দেবে, সেটি পুনরায় যাচাই করে যদি দেখা যায় সত্যিই সেই রায় দেওয়া হয়েছে নড়বড়ে প্রমাণের ভিত্তিতে তাহলে সেই রায়ের সংশোধন করাই কর্তব্য উচ্চ আদালতের। 
সুতরাং হাইকোর্টে শুরু হল পুনরায় মামলার শুনানি। কলকাতা এবং রাজ্য উত্তাল। সুরূপা গুহ হত্যা মামলা যেন প্রতিদিনের জীবনের অন্যতম প্রধান আলোচ্য। এমনিতেই চলছে জরুরি অবস্থা। সুতরাং সবরকম সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না দেশের। সংবাদের ক্ষেত্রে নানারকম সেন্সর করা হচ্ছে। সুতরাং এহেন এক টানটান রাজনৈতিক উত্তেজনায় আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল এই মামলা। এমনকী এই মামলা এতটাই ছিল মানুষের চরম কৌতূহলের কেন্দ্রে যে, হাইকোর্টের শুনানি শুনতে ভিড় ভেঙে পড়ত এজলাসে। সমস্ত আইনজীবী নিজেদের মামলা ছেড়ে এই মামলার সওয়াল জবাব শোনার জন্য হাজির। 
শুনানিতে সরকার এবং অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবীদের বাদানুবাদ, বাদ বিসংবাদ, সওয়াল জবাব, সাক্ষীদের প্রশ্নোত্তর প্রতিটি বিষয় বিস্তারিতভাবে সংবাদপত্রগুলিতে প্রকাশ করতেই হতো। কারণ যে সংবাদপত্র সুরূপা গুহ মামলার হিয়ারিং বিস্তারিত দেবে না, সেই সংবাদপত্র কম বিক্রি হবে। 
১২০ বি কেন? কেন চক্রান্ত? প্রশ্ন ছিল আবেদনকারীদের হয়ে আইনজীবীদের। সরকারপক্ষ জানায়, এপ্রিল মাসে ঝগড়ার কারণে প্রীতিলতা হিন্দুস্তান রোডের বাড়ি ছেড়ে চলে যান গোলপার্ক মিশনের গেস্ট হাউসে। সেখানে দেখা গিয়েছে গোটা পরিবারকে একসঙ্গে ঘরের মধ্যে কথা বলতে। 
গুহ পরিবারের আইনজীবী বলেছিলেন, এ থেকে কী প্রমাণ হয়? ওই যে সকলে একসঙ্গে কথা বলছিলেন, সেটা তো গোপন কিছু ছিল না! সেখানে এই হত্যার চক্রান্ত হয়েছে এটা তো একটা অনুমান! তার উপর ভিত্তি করে চক্রান্ত হিসেবে তকমা দেওয়া যায়? 
সরকারি আইনজীবী বলেছেন, এক সাক্ষী কিন্তু বলছে প্রীতিলতা উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ের সময় সুরূপাকে বলেছিলেন আত্মহত্যা করার কথা। অর্থাৎ তাঁরা চাইছিলেন সুরূপার মৃত্যু! 
আবেদনকারীর আইনজীবী বললেন, ওই বলা এবং প্রকৃত ঘটনার মধ্যে তো অনেকদিনের ফারাক। আর এই বলা কথা কীভাবে প্রমাণ করে যে হত্যার চক্রান্ত হয়েছে? 
ঝন্টুচরণ দত্ত যে শসা এবং লস্যি দিয়েছিল, সেটায় কি বিষ ছিল? ঝন্টুচরণ দত্তের উকিল বলেছেন যে, সুরূপা নিজেই বাথরুমে ছিল। ঘরের লাগোয়া। সেখানে বাথরুমের দরজা ভেঙে ঢুকতে হয়। সেখানে প্রায় ভেঙে পড়া অবস্থায় দেখা যায় সুরূপাকে। সেভাবেই তাঁকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু কই মৃতার বমিতে তো শসা কিংবা লস্যি পাওয়া যায়নি? পাকস্থলীতেও নয়! 
সতীকান্ত গুহ এবং প্রীতিলতা গুহের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণের মতো কোনও এভিডেন্সই পাওয়া যায়নি। তাই তাঁরা এই অভিযোগ থেকে মুক্তি পান। হাইকোর্ট থেকে পুনরায় পরবর্তী বিচার প্রক্রিয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয় আলিপুর সিক্সথ অ্যাডিশনাল সেশন জাজের এজলাসে। ইন্দ্রনাথ গুহ ও ঝন্টুচরণ দত্তকে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দেওয়া হয়নি। কিন্তু হত্যা অথবা হত্যার চক্রান্তে যুক্ত থাকার অভিযোগও প্রমাণিত হয়নি। আলিপুর আদালত যে নিছক সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্স আর কিছু অনুমানের উপর ভিত্তি করে চারজনের বিরুদ্ধে চার্জ ফ্রেম করবে, এটা মেনে নেওয়া হয়নি। পুলিস তদন্ত করলেও অকাট্য প্রমাণ কিন্তু দাখিল করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিছু সাক্ষ্য ছিল শুধু। সুরূপার ঠাকুরদা রবীন্দ্র মুখোপাধ্যায় সাক্ষী হিসেবে বলেছিলেন, মৃত্যুর ১০ দিন আগে আমাকে দোলা বলেছিল, অত্যাচার মাত্রাছাড়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু প্রতিটি অভিযোগের পর সেটি প্রমাণ করার একটি দায় থাকে যে কোনও তদন্তে। বহু আলোচিত সুরূপা গুহ মামলার সবথেকে দুর্বল জায়গা হল এটাই। 
 ইন্দ্রনাথ গুহকে দোষী সাব্যস্ত করা হল শুধুমাত্র কিছু অসঙ্গতিপূর্ণ বিবৃতি দেওয়া, কিছু তথ্যপ্রমাণ লোপাটের চেষ্টার চক্রান্ত ইত্যাদি কারণে। কী সাজা হল তাঁর? ২ বছরের জেল। গোটা মামলা কখনও আলিপুর নিম্ন আদালত, কখনও হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টেও পৌঁছয়। যদিও সুপ্রিম কোর্ট সরাসরি তদন্ত প্রক্রিয়া এবং হত্যা মামলার শুনানি করে রায়দান এই প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে চায়নি। কিন্তু এই মামলা তো বটেই, রায় নিয়েও ধোঁয়াশা কাটেনি। কারণ ইন্দ্রনাথ যদি তথ্যপ্রমাণ লোপাট করতে চাইছিলেন, তাহলে কি আদালত বিশ্বাস করেছে যে, কিছু একটা ঘটেছে? আত্মহত্যা যদি না হয়। যদি হত্যা হয়, সেক্ষেত্রে অন্য কেউ কি হত্যাকারী? ইন্দ্রনাথ কেন এবং কাকে আড়াল করার জন্য তথ্যপ্রমাণ লোপাট করবেন? এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব না দিয়েই যেন তড়িঘড়ি মামলায় যবনিকা পতন ঘটানো হয়েছিল। যা গুহ পরিবারের পক্ষেও যথেষ্ট অসম্মানজনক। আবার সুরূপার পিতৃগৃহ মুখোপাধ্যায় পরিবারেরও মনে হয়েছে তাঁরা বিচার পেলেন না যথাযথ! 
কিন্তু কলকাতার অভিজাত মহলে সুরূপা গুহ মামলা যে সাড়া ফেলেছিল তার কোনও নজির আর পাওয়া যাবে না। সাধারণ মানুষ থেকে হাই প্রোফাইল এলিট। এই একটি মামলা ছিল প্রবল আগ্রহ সৃষ্টিকারী। কতটা শোরগোল হয়েছিল? সাধারণ মহিলারা ঘরের কাজ ফেলে হাইকোর্ট এবং আলিপুর কোর্টে চলে আসতেন শুনানি চাক্ষুষ করার জন্য। 
এভিডেন্স মোক্ষম না জোগাড় করতে পারলে, সঠিক নথি ও সাক্ষ্যপ্রমাণ জমা দিতে না পারলে কিন্তু এভাবে এরকম সমাজের উচ্চবর্গের মানুষের নামে দুর্বল চার্জ ফ্রেম করা অন্যতম ব্যর্থতা। গরিব হোক অথবা ধনী, তদন্তকারী সংস্থাকে কিন্তু সবথেকে বেশি জোর দিতে এভিডেন্সে। আমরা দেশজুড়ে বহু মামলায় দেখতে পাই যে, গ্রেপ্তার হয়েছে অনেকে। যাদের দোষী হিসেবেই সমাজ তকমা দিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তথ্যপ্রমাণের অভাবে সেই মামলা মুখ থুবড়ে পড়েছে। 
এবার জানা যাক সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সুরূপা গুহের পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কী ছিল? ভিসেরা, রক্ত এবং অন্য কেমিক্যাল এক্সামিনেশন অনুযায়ী সুরূপার মৃত্যুর প্রধান কারণ সল্ট অব মার্কারি। শরীরে পাওয়া গিয়েছে মারকিউরিক ক্লোরাইড। ঝন্টুচরণ দত্তের আইনজীবী আদালতকে বলেছিলেন, সুরূপা আসলে আত্মহত্যা করেছেন। তিনি নিশ্চিত বালিগঞ্জ সায়েন্স কলেজ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন বিষাক্ত রাসায়নিক। 
পোস্টমর্টেমে পাওয়া গেল বিষ। ডেথবেডে অর্থাৎ মৃত্যুর আগে সুরূপা বলে গিয়েছেন, তিনি আত্মহত্যা করেননি। তিনি শসা আর লস্যি খেয়েছেন। তারপরই বমি এবং অসুস্থতা।  শরীরের একাধিক অঙ্গে বিষের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে। তাও আবার যথেষ্ট কড়া বিষ। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। প্রশ্ন হল, বিষ আছে। অথচ মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? অথবা কারা? সুরূপার মৃত্যু কীভাবে হল? হত্যা? নাকি আত্মহত্যা? সেই প্রশ্নের সঠিক এবং স্পষ্ট উত্তর কিন্তু পাওয়া যায়নি। কেন? এভিডেন্স নেই! 

বিদ্যুৎ নাকি বিষ?
রাত সওয়া ১২টা। নোয়াপাড়া থানার ব্রজনাথ পাল স্ট্রিটের বাসিন্দা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ শুনলেন একটা গোঙানির শব্দ। কোনও প্রাণীর কণ্ঠ থেকে আসছে? নাকি রাস্তায় কারও কিছু হয়েছে? দেওয়ালের অন্য প্রান্ত থেকে শব্দ আসছে। তার মানে ঘরের লাগায়া। তিনি দ্রুত বেরিয়ে এলেন। দেওয়ালের বাইরে এগিয়ে গিয়ে আঁতকে উঠে দেখলেন মুখে কাপড় গোঁজা, হাত, পা বাঁধা কেউ একজন গোঙাচ্ছে। মুখ বন্ধ করে কাউকে ফেলে রাখা হয়েছে। কে হতে পারে?
কাছে গিয়ে দেখা গেল পাশের বাড়ির মেয়ে সুদীপা। পাল বাড়ির মেয়ে। তার এই অবস্থা কে করল? কী হয়েছে? সুদীপার হাত মুখ পায়ের বাঁধন খুলে দিতেই সে ভয়ার্ত অবস্থায় হাত দেখাল বাড়ির মধ্যে। 
ততক্ষণে আরও কয়েকজন ছুটে এসেছে। প্রতিবেশী। বাড়ির আর সকলে কোথায়? দরজা খুলে দেখা গেল ভয়ঙ্কর দৃশ্য। সুদীপার ঠাকুরদা দেবেন্দ্রমোহন পালের দেহ একতলায় পড়ে আছে। তাঁর শরীর পা বাঁধা হয়েছে তামার তার দিয়ে। আর সেই তারের একটি অংশ বিদ্যুতের প্লাগ পয়েন্টে ঢোকানো। সোজা কথায় বোঝাই যাচ্ছে ডাকাতির ঘটনা। কে বা কারা ঢুকে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট করে মেরে ফেলেছে। 
কিন্তু সুদীপার বাবা, মা, ঠাকুমা কোথায়? দ্রুত দোতলায় যাওয়া হল। দেখা গেল অবিকল একই দৃশ্য। অর্থাৎ ১৫ বছর বয়সি সুদীপার বাবা সুভাষ পাল, তাঁর স্ত্রী সুলেখা পাল এবং ঠাকুমা লতিকা পাল দোতলার ঘরে ওভাবেই শুয়ে আছেন। তাঁদেরও পায়ে তামার তার জড়ানো। আর সেই তারের একাংশ প্লাগ পয়েন্টে। অর্থাৎ অপরাধীদের মোডাস অপারেন্ডি একই। প্রত্যেককে হাত-পা বেঁধে তামার তার জড়িয়ে বিদ্যুতের শক দিয়ে হত্যা করা। 
খটকা একটাই। সুদীপা কোথায় ছিল? তাকে কেন ঘরের মধ্যে পাওয়া গেল না? সে কি বাইরে কোথাও ছিল? যখন ডাকাতরা পালাচ্ছে, সেই সময় সে চলে আসে? আর তাড়াহুড়োয় তাকে বাইরে ধরে সামনে যা কিছু পাওয়া গিয়েছে, সেটা দিয়েই হাত পা মুখ বেঁধে পালিয়েছে দুষ্কৃতী ও হত্যাকারীরা? 
অস্বাভাবিক মৃত্যু। বোঝাই যাচ্ছে হোমিসাইড। অর্থাৎ হত্যা। মোটিভ জানা যাচ্ছে না। পুলিস তদন্তে এসেও প্রাথমিকভাবে ঠিক বুঝতে পারছে না এই হত্যার কারণ কী? একমাত্র ক্লু হল সুদীপা পালের জবানবন্দি। সে কোথায় ছিল? সে প্রথম বাড়িতে কখন এল? কী দেখল এসেই? নাকি সে আগে থেকে ঘরেই ছিল? তার চোখের সামনেই কি ঘটেছে যাবতীয় হত্যাকাণ্ড?
এতবড় একটা ঘটনার আঘাত ও অভিঘাতে ১৫ বছরের একটি মেয়ের চোখমুখে স্পষ্ট। থরথর করে কাঁপছে। চোখেমুখে আতঙ্ক। 
একতলা এবং দোতলার দুটি আলমারির দরজাই খোলা। জামাকাপড়, গহনার বাক্স, কিছু গিফট আইটেম সব লণ্ডভণ্ড হয়ে আছে। কী কী চুরি হয়েছে? সেটাও বা সুদীপার পক্ষে কীভাবে সম্পূর্ণ জানা সম্ভব? সে তো পরিবারের সবথেকে ছোট সদস্য। টাকা পয়সা, গয়নাগাঁটির কথা সামগ্রিকভাবে জানা সম্ভব নয়। 
১৯৯১ সালের ২৬ মার্চ। উত্তর ২৪ পরগনার নোয়াপাড়া থানার এই মামলায় কলকাতা এবং রা঩জ্যে তোলপাড় শুরু হয়। কেন? একই পরিবারের চারজনকে হত্যা করে ডাকাতরা জিনিসপত্র লুট করে পালিয়েছে, এটা ক্রাইম হিসেবে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ এবং নৃশংস। কিন্তু এরকম তো হতেই পারে। সাধারণত এরকম ‘ওপেন অ্যান্ড শাট কেস’ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে একটা রোষ সৃষ্টি হয়। পুলিস প্রশাসনের বিরুদ্ধে সৃষ্টি হয় ক্ষোভ। কিন্তু তার বেশি কিছু তো নয়। তাহলে এরকম রাজ্যজুড়ে আলোড়ন পড়ে গেল কেন? 
কারণ পোস্টমর্টেম। এবং তৎপরবর্তী তদন্তের বাঁক। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে, প্রত্যেকের শরীরে সায়ানাইড গ্রুপের বিষ পাওয়া যায়। সেই বিষের অস্তিত্ব পাওয়া যায় শ্বাসনালীতে, খাদ্যনালীতে, পাকস্থলীতে এবং রক্তে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টে কিছু কিছু তত্ত্বের রেফারেন্স লেখা হয়েছে, যা আদালতে জমা পড়ে। টক্সিওলজি সম্পর্কে। কী কী ব্যবহার করা হয়েছে? মারকিউরিক ক্লোরাইড। ক্লোরোফর্ম। এবং সর্বোপরি সোডিয়াম সায়ানাইড।

কী ধরনের বিষ? 
বিষও দেওয়া হল। আবার তামার তার জড়িয়ে বিদ্যুতের শকও দেওয়া হল? এরকম অদ্ভুত হত্যার ধরন কেন? এত সময় কীভাবে পাওয়া গেল? যে কোনও সময় তো কেউ এসে যেতে পারে! সন্ধ্যার ঘটনা। তদন্ত পুলিসের হাত থেকে চলে গিয়েছে সিআইডির কাছে। 
পোস্টমর্টেমে বিষ পাওয়ার পরই তদন্তকারীদের সংশয় বেড়ে যায়। কারণ ডাকাতি করতে এসে কেউ বিষ খাওয়াবে কেন? সেই অবকাশ ও সুযোগ কোথায়? তদন্তে বিস্ফোরণ ঘটল। কারণ কিছুদিনের মধ্যেই সুদীপা ব্রেক করল জেরায়। জানা গেল, সুদীপা নিজে এবং তার শিক্ষক রণধীর বসু এই ঘটনা ঘটিয়েছে। অর্থাৎ মেয়ে নিজের শিক্ষকের সঙ্গে চক্রান্??
3d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কাজকর্মে উন্নতি। ব্যবসায় গতি বৃদ্ধি। ব্যবসা ক্ষেত্রে লগ্নিবৃদ্ধির প্রচেষ্টায় সাফল্য। সন্তান বিষয়ে কোনও সুখবর পেতে...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৪.৯৬ টাকা৮৬.৭০ টাকা
পাউন্ড১০৪.৫৩ টাকা১০৮.২৪ টাকা
ইউরো৮৬.৫১ টাকা৮৯.৮৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা