নাম, যশ, অর্থ, ক্ষমতাশীল ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ এবং সুস্বাস্থ্য— তাহলে আপনি অবশ্যই ঈশ্বরের কাছ থেকে বরদান হিসেবে সুস্বাস্থ্যই বেছে নিতে চাইবেন! কারণ সুস্বাস্থ্য বজায় থাকলে যে কেউ বাকি সৌভাগ্য অর্জন করে নিতে পারেন। আর ভগ্নস্বাস্থ্য হলে বাকি সব সৌভাগ্য অধরা থাকতে বাধ্য! তাছাড়া শুধু সুস্বাস্থ্যই বা কেন, তার সঙ্গে দরকার আয়ু। কারণ এই বিরাট পৃথিবীতে রয়েছে কত কিছু উপভোগ্য। সুস্বাস্থ্য আর আয়ু— এই দু’টি বিষয় ধরে রাখার জন্য সেই প্রাচীনকাল থেকে মানুষের চেষ্টার শেষ নেই। সম্ভবত সুস্বাস্থ্যের সঙ্গে যৌবন ধরে রাখার বিষয়টিও জড়িয়ে থাকে। ফলে অন্ত নেই গবেষণার। অথচ সব গবেষণাকে প্রায় বুড়ো আঙুল দেখিয়ে প্রাকৃতিকভাবেই এই পৃথিবীতে কয়েকজন বেঁচে থাকেন একশো বছর! না, বিচ্ছিন্নভাবে বেঁচে থাকা কয়েকজন আশ্চর্য শতায়ুর কথা হচ্ছে না। আমরা কথা বলছি এক বিরাট জনগোষ্ঠীর কথা! তাঁরা সকলে শতায়ু!
ব্লু জোনের কথা
আমাদের এই পৃথিবীতে ব্লু জোন বলে কয়েকটি জায়গা রয়েছে যেখানকার মানুষেরা ১০০ বছরের অধিক আয়ু নিয়ে বেঁচে থাকেন। কেউ কেউ ১১০ বছরও বাঁচেন! জাপানের ওকিনাওয়া, ইটালির সারদিনিয়া, ক্যালিফোর্নিয়ার লোমালিন্ডা, কোস্টারিকার নিকোয়া, গ্রিসের ইকআরিয়া জায়গাগুলিকে লংজিভিটি হটস্পট বলা হয়। ব্লু জোন-এর মানুষেরা কোন ডায়েট অথবা কোন দামি সাপ্লিমেন্ট অথবা ভিগোরাশ এক্সারসাইজ ছাড়াই শতায়ু হয়েছেন তা নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে দেখা গিয়েছে, একেবারে জীবনের একেবারে শুরু থেকেই সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলা দরকার। ব্লু জোনের বাসিন্দাদের খাদ্যাভ্যাস পর্যালোচনা করে দেখা গেছে তাঁদের খাবারের মধ্যে ৭০ শতাংশ থাকে উদ্ভিজ্জ খাদ্য এবং ৩০ শতাংশ খাদ্য প্রাণিজ। মানুষের পরিপাকতন্ত্র ও দাঁতের গঠন দেখে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন মানুষ মূলত তৃণভোজী। মানুষের পৌষ্টিকতন্ত্রের দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট যা হরিণের ও তৃণভোজী প্রাণীদের পৌষ্টিকতন্ত্রের মতো। ‘দ্য সিক্রেট অব লিভিং লংগার’ পুস্তকের লেখক ডান বুয়েটনারের মতে আমাদের আয়ুবৃদ্ধি নির্ভর করে ২৫ শতাংশ প্রবাহী জিনের ওপরে এবং বাকি ৭৫ শতাংশ নির্ভর করে সুস্থ ও প্রাণবন্ত জীবন যাপনের কারণে।
আয়ুবৃদ্ধিতে মূলত প্রয়োজন সুষম খাদ্য তালিকা যা প্রোটিন, ফ্যাট, কার্বোহাইড্রেট, ভিটামিন, মিনারেল, জল, হরমোন, এনজাইম, বায়ো ইলেকট্রিক্যাল এনার্জি ফোর্স বা প্রাণশক্তি প্রভৃতি উপাদানের সঠিক আনুপাতিক মেলবন্ধন। বর্তমানে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা খাবারকে জীবিত এবং মৃত হিসেবে চিহ্নিত করছেন। তাঁরা বলছেন যতটা সম্ভব জীবন্ত খাবার যেমন ফল, পাতা, বীজ, ফুল, মূল, কন্দ, রজন, বাকল, শিকড় যা প্রকৃতিতে যেমনভাবে পাওয়া যায় ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে তেমনভাবেই খেয়ে নেওয়া ও হজম করা যায়। এই ধরনের খাবারে লাইফফোর্স অনেক বেশি মাত্রায় পাওয়া যায়। বিপরীতে কারখানায় তৈরি প্যাকেটজাত খাবার আসলে মৃত খাবার। প্রক্রিয়াকরণের ফলে তার প্রাণশক্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া রন্ধনের সময় তাপমাত্রা অধিক হলে তাতেও খাবারের বায়ো ইলেকট্রিক্যাল এনার্জি ও ফাইটো কেমিক্যাল কমতে থাকে। ব্লু জোনের কিচেনগুলিতে খাবারের রেসিপি অতি সাধারণ এবং যা কম তাপে ধীর প্রক্রিয়ায় বানানো হয়। এর ফলে খাদ্যের লাইফ ফোর্স অনেক বেশি পরিমাণে বজায় থাকে। এবার দেখে নিই সারাদিন কীভাবে নিজের খাওয়া দাওয়ার দিকে নজর দেবেন।
ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই কোনও ডিটক্স ওয়াটার অথবা পরিষ্কার জল দিয়ে দিন শুরু করুন। বাসি মুখে জল পান করুন। তাতে সারারাতে মুখের মধ্যে তৈরি হওয়া ভালো মাইক্রোব পেটের মধ্যে যেতে পারবে। এর পরে হার্বাল টি অথবা এক চামচ লেবুর রস দিয়ে এক গ্লাস জল খেয়ে নিন। এরপর রাত্রে ভিজিয়ে রাখা বাদাম অথবা বীজ অথবা শুকনো ফল অথবা টাটকা মরশুমি ফল খাওয়া শুরু করুন। ব্রেকফাস্ট করুন বাড়িতে তৈরি করা যে কোনও গরম জলখাবার দিয়ে। প্যাকেটের ব্রেকফাস্ট, কুকিজে প্রচুর পরিমাণে লুকানো চিনি ও রাসায়নিক থাকে। এগুলিকে খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিন। ব্রেকফাস্ট ও লাঞ্চের মাঝে খেতে পারেন গ্রিন জ্যুস। হুইট গ্রাস, ধনে পাতা, পুদিনা পাতা, লেটুস, থানকুনি প্রভৃতি পাতার জ্যুস বানিয়ে গুড় ও লবণ দিয়ে খাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে লেমন গ্রাস ও রোজ মেরি চা পান বিশেষ উপকারী। ব্লু জোনে জাসমিন চায়ের প্রচলন রয়েছে। দুপুরে লাঞ্চের আগে ১ কাপ স্যালাড খেয়ে নিন। যে কোনও খাবারের সঙ্গে স্যালাড রাখলে, স্যালাড সেই খাবারটির গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কমিয়ে দেয় এবং মাত্রাতিরিক্ত খাবার খাওয়ার ইচ্ছাকে দমন করে। তাই স্যালাড অত্যন্ত উপকারী। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে রাতের খাবার খেয়ে ফেলুন রাতের খাবারে মাছ, মাংস, ডিম না রাখাই শ্রেয়।
বিকেলবেলা সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের শরীরের সমস্ত ডাইজেস্টিভ এনজাইমগুলির ক্ষরণ কমতে থাকে। তাই সন্ধ্যার পর থেকে খাওয়া-দাওয়া নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
বিকেলে একটি ছোট্ট টিফিন আমাদের কাজ করার এনার্জি লেভেলকে ঠিক রাখতে সাহায্য করে। ভারতীয়রা সেক্ষেত্রে দু’টি ইডলি, একটি প্লেন ধোসা, এক বাটি ছোলা, মুড়ি, শসা একটি সেঁকা ভুট্টা অথবা একটি কলা— এই ধরনের হালকা জলখাবার খেতে পারেন বিকেলের দিকে। ডিনারে খেতে পারেন, ডাল ভাত অথবা ডাল রুটি। তার সঙ্গে থাকবে স্যালাড। রাতের খাবার কখনওই দেরি করে খাওয়া উচিত নয়। কারণ তা ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ঘুমোতে যাওয়ার দু’ঘণ্টা আগে ডিনার কমপ্লিট করুন। প্রতিটি খাবার গ্রহণের পরে রেস্ট নেওয়া ও তারপর একটি হালকা হাঁটাহাঁটি স্বাস্থ্য রক্ষায় সাহায্য করে।
দুপুরের একটি ছোট্ট ন্যাপ রাতে ভালো ঘুমের সহায়ক ও স্বাস্থ্যবর্ধক। জাপানি ভাষায় ‘হারা হাচি বু’ বলে একটি কথা প্রচলিত আছে যার অর্থ মডারেশন। খাবার সব সময় এমন ভাবে খেতে হবে যাতে পেটের এক চতুর্থাংশ জায়গা ফাঁকা থাকে এবং আপনার কিছুটা খিদে বাকি থাকে। খাবারে পেট পূর্ণ হয়ে গেলে পাচক রস ক্ষরণের জায়গা থাকে না। তাই পাচন ক্রিয়া বিলম্বিত হয়। এটিও একটি লাইফস্টাইল প্রক্রিয়া।
সবশেষে আসি অণুজীবদের কথায়। আমাদের দেহে থার্টি নাইন ট্রিলিয়ন মাইক্রোবিয়াল সেল রয়েছে যার শতকরা ৯০ ভাগই আছে আমাদের গাট-এ।
এদেরকে বলে প্রো বায়োটিক। এরা আমাদের সার্বিক স্বাস্থ্য, মস্তিষ্কের প্রসন্নতা, ক্রেভিং প্রভৃতি নিয়ন্ত্রণে রাখে। দই হল এই অণুজীবদের একটি খুব ভালো উৎস। এই অণুজীবদের খাদ্য ফাইবার বা আঁশ জাতীয় খাবার। তাই প্রতিদিনের খাবারে যাতে ফাইবার থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে এসবের সঙ্গে দরকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। প্রয়োজন মেডিটেশন বা ধ্যান করাও চলে। ধ্যান আমাদের মস্তিষ্কের কিছু বিশেষ অংশে কাজ করে স্মৃতিশক্তি, বোধশক্তি, অনুপ্রেরণা, মনোযোগ ইত্যাদি বাড়িয়ে তোলার ক্ষমতা রাখে। নিয়মিত মেডিটেশন উচ্চ রক্তচাপ ও স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।
ধ্যান করলে মস্তিষ্ক থেকে প্রতিদিন ৬০ রকমের রাসায়নিক বার্তা তৈরি হয় যার মধ্যে চারটি হ্যাপি হরমোন বলে পরিচিত। এগুলি হল— এন্ডোর্ফিন, ডোপামিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন। মস্তিষ্কে এদের প্রবাহ সঠিক থাকবে যদি কেউ নিয়মিত মেডিটেশন করেন। বিশ্বের সবথেকে সুখী মানুষ ম্যাথিউ রিচার্ড ৩৫ বছর ধরে মেডিটেশন করছেন। তিনি দলাই লামার অন্যতম প্রধান শিষ্য। প্রতিদিন আধঘণ্টা হালকা ব্যায়াম শরীরের প্রতিটি পেশি, জয়েন্ট, হাড় ও অন্তঃক্ষরা গ্রন্থিকে সচল সজীব রাখতে সাহায্য করে। রাতের ৮ ঘণ্টা ঘুম হল শরীরের সবথেকে বড় ডিটক্স প্রক্রিয়া। এই সময় শরীর তার যাবতীয় ক্ষতিপূরণের কাজে ব্যস্ত থাকে।
তাই রাতে শুতে যাওয়ার দু’ঘণ্টা আগে ব্লু লাইট বিকিরণ করে এরকম কোনও গ্যাজেট যেমন মোবাইল, ল্যাপটপ ব্যবহার করা বন্ধ করুন। ঘর অন্ধকার করে দিন। প্রতিদিন সকালে সূর্যের আলো গায়ে লাগান।
মানুষের সঙ্গে কথা বলুন, আড্ডা দিন। নিজের একটি শখ জীবিত রাখুন।
লেখক ডক্টর বি সি রায় শিশু হাসপাতালের প্রাক্তন পুষ্টিবিদ।