গয়াকে কেউ বলে তীর্থ, কেউ বলে ক্ষেত্র, কারও কাছে পরিচিত ধাম নামে। ইতিহাস-কিংবদন্তি-লোকথায় জড়িয়ে আছে গয়া। শুধু তীর্থই নয় পর্যটনেও গয়া প্রসিদ্ধ। শহরটির উত্থান ভৌগোলিকতাকেও হার মানায় পুরাণের রোমাঞ্চকর কাহিনি। এখানেই গয়াসুর বধ হয়। এখানেই আছে প্রাচীন অক্ষয়বট, বিষ্ণুপাদপদ্ম। এমন কোনও মহাপুরুষ নেই যিনি এখানে আসেননি। আছে রহস্যময় গদাধর শিলা আর প্রেতশিলা! মৃত্যুর পর মানুষের আত্মার ঠিকানা স্থির হয় এখানেই। মৃতের কল্যাণে আছে নানা বিধিব্যবস্থা। তবে সবকিছুকেই ছাড়িয়ে যায় গয়ার নানা মিথ। কেন এটি মুক্তিতীর্থ? অজানা, রহস্যময় গয়ার কথা লিখেছেন ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়।
জগৎ সৃষ্টির প্রথমাবস্থা শ্বেতকল্পকাল। ভগবান শ্রীবিষ্ণুর নাভিকমল থেকে প্রজা সৃষ্টির ইচ্ছামাত্র সৃষ্টি হলেন লোকপিতামহ ব্রহ্মা। তাঁরই ইচ্ছায় ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্টি করতে লাগলেন। ব্রহ্মার স্বত্ত্বগুণী দেবভাব থেকে সৃষ্টি হল দেবতা। আর তমগুণী ভাব থেকে অসুরদের সৃষ্টি করলেন। কিন্তু তেলে জলে যেমন মেশে না তেমনই দেবাসুরে ভাব বা বৈরিতা লেগেই থাকে। গয়াসুর প্রবল বলশালী ও পরম বৈষ্ণব। তাঁর বাবা ত্রিপুরাসুর ও মা প্রভাবতী— ইনি পরাক্রমী দৈত্য শুকের কন্যা। গয়াসুরের দেহটি ছিল বিশাল— উচ্চতায় একশো পঁচিশ যোজন আর স্থূলত্বে ষাট যোজন।
কোলাহল পর্বতে গয়াসুর গভীর তপস্যায় মগ্ন। বহু সহস্র বছর নিশ্বাস বন্ধ করে কুম্ভক সমাধিযোগে তপস্যা করছেন। তার কঠিন তপস্যার প্রভাবে উৎপন্ন প্রবল তাপ ছড়াতে লাগল। ইন্দ্রাদি দেবগণ এতে ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন। তাঁদের মনের কোণে উঁকি দিতে লাগল অজানা ভয় ও শঙ্কা। কথায় বলে ‘ঘরপোড়া গোরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পায়।’ ইন্দ্রাদি দেবতাদেরও এখন সেই অবস্থা। অতীতে যখনই কোনও অসুর তপশক্তির প্রভাবে দেবতার বরে বলীয়ান হয়েছে, তখনই তারা দেবতাদের পরাজিত করে রাজ্যচ্যুত করেছে। কখনও দাসও করেছে। গয়াসুর পরম বৈষ্ণব হলেও সে তো অসুর অংশজাত— তাকে বিশ্বাস কী? তাই গয়াসুরের সাধনায় তাঁরা যেন অশনি সংকেত পেতে লাগলেন।
দেবতারা সবাই মিলে ব্রহ্মলোকে লোকপিতামহ ব্রহ্মার কাছে গিয়ে তাঁদের অবস্থা ও চিন্তার কারণ জানালেন। প্রার্থনা করলেন, ‘হে সৃষ্টিকর্তা, গয়াসুরের প্রবল তপস্যার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে আমাদের রক্ষা করুন।’
তখন ব্রহ্মা দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে কৈলাসপতি মহাদেবের কাছে গেলেন। বললেন কেন তাঁরা এসেছেন; তাঁরা গয়াসুরের থেকে কী করেই বা রেহাই পাবেন!
মহাদেব তখন বললেন, ‘এ তো ভীষণ কঠিন পরিস্থিতি। তোমরা সবাই আমার সঙ্গে ক্ষীরসাগরে চল। সেখানে নারায়ণ শয়নে রয়েছেন। তিনিই এই সমস্যার সমাধান করে সব অমঙ্গল কাটিয়ে দেবেন। তিনিই জগতের তারণহার, মঙ্গলময়।’
এরপর শিবাদি দেবতারা ক্ষীর সাগরের তীরে গিয়ে শ্রীবিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন। তাঁদের স্তবে তুষ্ট হয়ে ভগবান বিষ্ণু দর্শন দিয়ে বললেন, ‘হে শিবাদি দেবগণ, আপনারা কী জন্য আমার কাছে এসেছেন— ‘কিমর্থমাগতা দেবা।’
দেবতারা বললেন, ‘গয়াসুরের ভয় থেকে আমাদের আপনি রক্ষা করুন— ‘গয়াসুরভয়াদ্দেব রক্ষাসম্মানব্রবীদ্ধরিম্।’
দেবতাদের কথা শুনে বিষ্ণু বললেন, ‘আপনারা গয়াসুরের কাছে যান, তারপর আমিও সেখানে যাচ্ছি।’
শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণব গয়াসুরকে বরদান করতে গরুড় বাহনে করে বিষ্ণু গয়াসুরের কাছে এসে বললেন, ‘বৎস গয়াসুর, কী জন্য তুমি এই কঠোর তপস্যা করছ? তোমার তপস্যায় আমি প্রসন্ন হয়েছি। বল, তুমি কী বর চাও?’
গয়াসুর এক তাৎপর্যপূর্ণ বর প্রার্থনা করলেন, ‘হে ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর প্রমুখ দেবগণ, আপনারা আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। আমার প্রতি সন্তুষ্ট জেনে আপনাদের কাছে বর প্রার্থনা করছি। আপনারা আমাকে এই বর দিন যেন, আমি সব দেবতা, ব্রাহ্মণ, বিশ্বের যজ্ঞশিলা, ঋষি, অব্যয় শিব, মন্ত্র, দেবদেবী, সব রকমের যোগী, কর্মত্যাগী, ধার্মিক ও অতি পবিত্র গতির থেকেও যেন আরও পবিত্র হই।’
— ‘সর্ব্বদেবাদ্বিজাতিজ্যো যজ্ঞ তীর্থশিলাচ্চয়াৎ।। ১৬
দেবেভ্যোঽতিপবিত্রোঽহমৃষিভ্যোঽপি শিবাব্যয়াৎ।
মন্ত্রেভ্যো দেবদেবীভ্যো যোগিভ্যশ্চাপি সর্ব্বশঃ।। ১৭
ন্যাসিভ্যশ্চাপি কর্ম্মিভ্যো ধম্মিভ্যশ্চ তথা পুনঃ।
যতিভ্যোঽপবিত্রেভ্যঃ পবিত্রঃ স্যাং সদা সুরা।। ১৮
(বায়ুপুরাণ ষড়ধিকশতমহোধ্যায়ঃ)।’
ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বরাদি দেবগণ গয়াসুরের বর প্রর্থনায় খুশি হয়ে বললেন— ‘পবিত্র হও’-‘পবিত্রমস্তু’। এহেন বরদানের পর দেবতারা গয়াসুরকে দর্শন ও স্পর্শ করে নিজ নিজ ধামে চলে গেলেন। গয়াসুরের প্রভাবে ত্রিলোক (স্বর্গ-মর্ত-পাতাল) ও যমপুরী শূন্য হয়ে গেল। আসলে বিষ্ণুর বলে পরম পবিত্র গয়াসুরকে দর্শন করা মাত্রই এই ঘটনা ঘটেছে।
দেবতাদের আর বিপদের শেষ নেই। ত্রিলোক শূন্য হওয়ার তাঁরা প্রমাদ গুনলেন। আবারও তাঁরা সমবেতভাবে বিষ্ণুর কাছে গিয়ে তাঁদের সমস্যার কথা তুলে ধরলেন।
অনন্তলীলাময় শ্রীবিষ্ণুর লীলার অন্ত নেই। আপাত অমঙ্গলের মধ্যেও তিনি লুকিয়ে রাখেন জগৎকল্যাণের বীজ।
শ্রীবিষ্ণু পিতামহ ব্রহ্মাকে বললেন, ‘আপনি গয়াসুরের কাছে গিয়ে তাঁর দেহটি যজ্ঞের জন্য প্রার্থনা করুন।’ তখন ব্রহ্মাদি দেবতারা গয়াসুরের কাছে গিয়ে মধুর বাক্যে তাঁকে যজ্ঞের জন্য তাঁর পবিত্র শরীরটি প্রার্থনা করলেন। গয়াসুর দেবতাদের প্রণাম করে বললেন, ‘আজ আমাদের জন্ম ও তপস্যা সার্থক হল। কারণ আজ আমার অতিথি স্বয়ং ব্রহ্মা। আর আদেশটি দিয়েছেন আমার পরমারাধ্য শ্রীবিষ্ণু। তাই আজ আমি সবকিছুই প্রাপ্ত হলাম। হে ব্রহ্মা আপনি আমায় আদেশ করুন। বলুন, আমি আপনার জন্য কী করতে পারি।’
ব্রহ্মা গয়াসুরের ভক্তিতে প্রসন্ন হলেন। সস্নেহে বললেন, ‘সমগ্র পৃথিবী ভ্রমণকালে যেসব তীর্থ দেখেছি তার মধ্যে যজ্ঞের উপযুক্ত কোনও পবিত্র তীর্থ পাইনি। বিষ্ণুর বরে একমাত্র তোমারই দেহ সর্বাপেক্ষা শুদ্ধ। সেই জন্য তোমার পরম শুদ্ধ দেহটি যজ্ঞের জন্য আমাকে দান কর।’
ব্রহ্মার কথায় গয়াসুরের আনন্দের সীমা রইল না। তিনি বললেন, ‘হে দেবেশ, আপনি যজ্ঞের জন্য আমার এই দেহটি প্রার্থনা করেছেন। ধন্য হলাম, সঙ্গে আমার পিতৃকুলও ধন্য হলেন। আপনি আমার এই দেহ সৃষ্টি করেছেন। আর আপনিই আমার এই দেহ পবিত্র করেছেন। এবার এই দেহের উপর আপনারই পৌরোহিত্যে অনুষ্ঠিত যজ্ঞে সকলের অসীম কল্যাণ হবে।—
‘ধন্যোহহং দেবদেবেশ যদ্দেহং প্রার্থ্যতে ত্বয়া
পিতৃবংশ কৃতার্থো মে দেহে যাগং করোষি চেৎ।।
ত্বয়ৈবোৎপাদিত্যে দেহঃ পবিত্রস্তু ত্বয়া কৃতঃ।
সর্ব্বোষামুপকারায় যগোহ্বশ্যং ভবত্বিতি।।’ (ত্বদেব)
এরপর গয়াসুর কোলাহল পর্বতের দক্ষিণ-পশ্চিম নৈঋত দিকে গিয়ে উত্তর দিকে মাথা ও দক্ষিণ দিকে পা রেখে যজ্ঞের জন্য দণ্ডবৎ হয়ে ভূমিতে আশ্রয় নিলেন।
ব্রহ্মা এরপর মহাযজ্ঞের প্রস্তুতি শুরু করলেন। যজ্ঞের যাবতীয় দ্রব্য সামগ্রী জোগাড় করলেন। তারপর এই যজ্ঞের পৌরোহিত্য কর্মের জন্য শ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণদের মানস প্রজারূপে সৃষ্টি করলেন। এঁরা হলেন— অগ্নিশর্মা, অমৃত, শৌণিক, শান্ত স্বভাব, জাজলি, কাশ্যপ, কুথুমি, কৃপ, গর্গ, বৃদ্ধ পরাশর, কণ্ব, গোভিল, দারুণ, আত্রেয়, গোকর্ণ, শিখণ্ড, ভার্গব, দধিপঞ্চমুখ, বিপ্রশ্রেষ্ঠ কর্ক, কাত্যায়ণ, গৌতম, অঙ্গিরা, উমাব্রত প্রমুখ। এঁদের মধ্যে মহাতপস্বী অগ্নিশর্মার মুখ থেকে পঞ্চঅগ্নি সম্ভূত হয়, যা থেকে এই যজ্ঞ প্রতিষ্ঠিত হল। এই পঞ্চঅগ্নির নাম হল— দক্ষিণাগ্নি, গার্হপত্য, অহবনীয়, সভ্য ও আবসস্য। যজ্ঞ প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের দক্ষিণা দান করলেন। যজ্ঞে পূর্ণাহুতি দিয়ে অবভূত স্নান করলেন। সেই সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কর্মগুলিও সম্পন্ন করা হল।
এরপর ব্রহ্মার প্রস্থানের সময় হঠাৎ গয়াসুর কেঁপে উঠলেন। ব্রহ্মা ধর্মরাজ যমকে বললেন, ‘তোমার পুরীতে একটি বিশেষ শিলা জন্মেছে। আমার আজ্ঞায় ওই শিলা তাড়াতাড়ি এনে গয়াসুরের মস্তকের উপর রাখ, এক্ষেত্রে কোনওরূপ বিচার করবে না।’
ব্রহ্মার কথায় যমরাজ সেই শিলা গয়াসুরের মাথায় রাখার পরও গয়াসুর বিচলিত হতে লাগলেন। বেগতিক বুঝে ব্রহ্মা বিপদভঞ্জন শ্রীবিষ্ণুর স্তব করতে লাগলেন। এভাবে কিছু সময় কেটে যাওয়ার পরও বিষ্ণুর পার্শ্বচর বিষ্বকসেন বিষ্ণুকে গিয়ে বললেন, ‘ব্রহ্মা আপনার স্তবে ব্যস্ত আছেন।’
তখন বিষ্ণু বললেন, ‘ব্রহ্মাকে এখানে আসতে বল।’
ব্রহ্মা এসে বললেন, ‘হে দেব দেবরূপিনী শিলা গয়াসুরের মস্তকের ওপর রেখে যজ্ঞ সমাহিত করেছি। তবুও গয়াসুর বিচলিত হচ্ছে। এমনকী ভগবান রুদ্রসহ সকল দেবতারাও ওই শিলার ওপর অবস্থান করছেন। তবুও ওই শিলা কাঁপছে! প্রভু আপনি কৃপা করে ওই শিলাকে নিশ্চল করুন।’
এরপর শ্রীহরি নিজ দেহ থেকে এক মূর্তি আকর্ষণ করে গয়াসুরকে শান্ত করার জন্য ব্রহ্মাকে দিলেন। ব্রহ্মা ওই মূর্তি গয়াসুরের ওপর রাখা শিলায় স্থাপন করলেন। কিন্তু তাতেও গয়াসুরকে স্থির করা গেল না। তখন আদিগদাধর বিষ্ণু ক্ষীরসাগর থেকে এসে ওই শিলার ওপর অবস্থান করলেন। এখানে তাঁর নাম হল জনার্দন ও পুণ্ডরীকাক্ষ। এভাবেই ব্রহ্মাণ্ড পিতামহ, প্রপিতামহ, ফলগ্বীশ, কেদার ও কনকেশ্বর এই পাঁচ নামে বিভক্ত হয়ে ওই শিলায় অবস্থান করলেন। তারপর বিনায়ক, গয়াদিত্য, উত্তরার্ক ও দক্ষিণার্ক রূপে তিনভাবে বিভক্ত সূর্য; সীতা নামে লক্ষ্মী; মঙ্গলাহ্বয়া নামে গৌরী; গায়ত্রী, সাবিত্রী ও সরস্বতী এই ত্রিধাবিভক্ত সন্ধ্যা; ইন্দ্র, বৃহস্পতি, পুষা, মহাবল, অষ্টবসু, বিশ্বদেব, অশ্বিনীকুমারদ্বয়, পবন এবং যক্ষ, ঔরগ, গন্ধর্বগণ ও নিজ নিজ শক্তিসহ দেবগণ ওই শিলায় অবস্থান করলেন। শ্রীহরি আদিগদা দিয়ে গয়াসুরকে স্থির করলেন। এজন্য তাঁর নাম হয় আদিগদাধর। এই আদ্য গদাটি বিষ্ণু কর্তৃক বধিত গদ নামের অসুরের হাড় দিয়ে বিশ্বকর্মা তৈরি করেন। বিষ্ণু ওই গদাটি আদ্যগদা ধারণ করে আদিগদাধর হলেন।
গয়াসুর এরপর দেবতাদের বললেন, ‘আপনারা কেন আমার সঙ্গে এই অন্যায় আচরণ করলেন? শ্রীবিষ্ণুর আদেশে আমি তো শরীর আগেই দিয়ে দিয়েছি। শ্রীবিষ্ণু আদেশ করলেই তো আমি স্থির হতাম। আপনারা যা করলেন সত্যিই কি তার প্রয়োজন ছিল? আপনাদের নিজ নিজ পদ ও বিষ্ণুগদা দিয়ে আমাকে পীড়িত ও ব্যথিত করেছেন। তবুও আমি আপনাদের কাছে অনুগ্রহ প্রার্থনা করছি, আপনারা প্রসন্ন হন।’
গয়াসুরের বিনয়বাক্যে আদিদেব গদাধর সহ দেবগণ সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে বর প্রার্থনা করতে বললেন। তখন গয়াসুর প্রার্থনা করলেন, ‘যে পর্যন্ত পৃথিবী, পর্বত, চন্দ্র, সূর্য, তারা থাকবে সেই পর্যন্ত ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরসহ অন্য সব দেবগণ এই শিলায় অবস্থান করবেন। আর আমার নামে এই ক্ষেত্র প্রসিদ্ধ হোক। পাঁচ ক্রোশ গয়াক্ষেত্র ও ক্রোশমাত্র গয়াশির— এর মধ্যে সব তীর্থ বর্তমান থেকে মানবগণের মঙ্গল বিধান করুন। মনুষ্যগণ আমার দেহে প্রতিষ্ঠিত। ওইসব তীর্থ স্নান, তর্পণ, পিণ্ডদান করে হাজার হাজার কুল উদ্ধার করুক। এবং আপনারা সদাসর্বদা ব্যক্ত অব্যক্ত রূপে এখানে অধিষ্ঠিত হন। গদাধর স্বয়ং নিখিল লোকের পাপ নাশ করুন। আর এখানে যে সব সপিণ্ডদের শ্রাদ্ধ করা হবে তারা ব্রহ্মলোকে গমন করুক। এই তীর্থ সেবীদের ব্রহ্মহত্যাদি পাপ বিনিষ্ট হোক। নৈমিষারণ্য, পুষ্কর, গঙ্গা, প্রয়াগ ও অবিভক্ত বারাণসী এইসব ও অন্যান্য সব তীর্থ, স্বর্গ, ভূতল ও অন্তরিক্ষ থেকে দেবগণ সবসময় এখানে এসে মানুষের কল্যাণ সাধন করুন। হে সুরগণ, এর বেশি কী আর বলব? আমার প্রার্থনা অনুসারে এই স্থানে যদি একটিও দেবতা অবস্থান না করেন তাহলে আমিও অবস্থান করতে অসমর্থ। তাই আপনারা আমার এই প্রার্থনা পূরণ করুন।’
দেবগণ গয়াসুরের এহেন প্রার্থনা শুনে বললেন, ‘তুমি যা কিছু প্রার্থনা করছ তা সবই সিদ্ধ হবে এবং আমাদের পাদপদ্ম পুজো করে তুমি পরমগতি প্রাপ্ত হবে। এই বরপ্রাপ্তির পর গয়াসুরও তুষ্ট হলেন। একেই বলে ঘটনার ঘনঘটা। একের পর এক ঘটনা ও পরে তা থেকে উত্তরণ। যজ্ঞাদির কাজ সম্পূর্ণ। গয়াসুর স্থির হয়েছেন। ব্রহ্মা যজ্ঞের ব্রাহ্মণদের প্রচুর দানে ভরিয়ে দিলেন।— গৃহ, পঞ্চক্রোশীগয়ায় পাঁচটি করে গ্রাম, কল্পবৃক্ষ, পারিজাত থেকে শুরু করে কামধেনু সবই দান করলেন। এরপর ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের শর্ত দিলেন, ‘আপনারা কারও কাছে আর কিছু চাইবেন না।’
ব্রহ্মার কাছ থেকে থেকে প্রচুর দান গ্রহণের পরও লোভী ব্রাহ্মণদের বিত্ত লালসা গেল না। এরপর ধর্মারণ্যে ধর্মের যজ্ঞে তাঁরা বহুধন ও সম্পদ গ্রহণ করলেন। কুপিত হলেন ব্রহ্মা। ব্রাহ্মণদের অভিশাপ দিলেন, ‘আজ থেকে তোমরা সবসময় অতিরিক্ত ঋণযুক্ত ও ঐশ্বর্যহীন হবে।’
ব্রহ্মার অভিশাপে ব্রাহ্মণদের সর্বসম্পদ বিনষ্ট হয়ে গেল। তাঁরা ভুল বুঝতে পেরে ব্রহ্মার প্রসন্নতা কামনা করে নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য জীবিকার উপায় প্রার্থনা করলেন। তাঁদের কাতর প্রার্থনায় ব্রহ্মার মনে দয়ার উদয় হল। তিনি ব্রাহ্মণদের আশীর্বাদ করে বললেন, ‘পৃথিবীতে যতদিন চন্দ্র, সূর্য থাকবে ততদিন এই মহাতীর্থ থেকে আপনাদের জীবিকা অর্জিত হবে।’
শিলাটির পরিচয়
গয়াসুরকে স্থির করার জন্য ব্রহ্মার আদেশে ধর্মরাজ যম যে শিলাটি তাঁর পুরী থেকে এনে গয়াসুরের মাথায় রাখলেন সেটির স্বরূপ কী? কী তার নাম, রূপ ও মাহাত্ম্য কী?
শাস্ত্র এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। ঋষি শ্রীসূতের বাক্য—
বহুকাল পূর্বে পরমজ্ঞানী ও মহাতেজস্বী এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তাঁর নাম ধর্ম। ধর্মের পত্নী হলেন পরম সুশীলা স্বামীব্রত পরায়ণা বিশ্বরূপা। এঁদের কন্যা লাবণ্যময়ী ধর্মব্রতা বা ধর্মব। তিনিও মহাতাপসী; শুধুমাত্র বায়ু ভক্ষণ করেই এক অযুত যুগ তপস্যা করেন। তাঁর তপস্যার সময় একদিন ব্রহ্মার মানসপুত্র মহর্ষি মরীচি ধর্মবকে দেখতে পান। ধর্মবের রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে পত্নীরূপে পেতে চাইলেন। তখন ধর্মব মরীচিকে বললেন, ‘আপনি আমাকে পত্নীরূপে পেতে চাইলে আমার পিতাকে গিয়ে সে কথা বলুন।’
মরীচি ধর্মের কাছে গিয়ে নিজের অভিপ্রায় বললে ধর্ম তাঁর আদরের দুলালীকে মরীচির হাতে অর্পণ করলেন।
মরীচিও প্রত্যুত্তরে বর দিলেন, ‘তোমার মঙ্গল হোক।’ এরপর স্বপত্নী মরীচি নিজ আশ্রমে ফিরলেন।
মরীচির ঔরসে ধর্মবের গর্ভে শতপুত্র জন্মাল। স্বপত্নী ঋষিবর তাদের সঙ্গে পরম সুখ শান্তিতে সংসার ধর্ম পালন করতে লাগলেন।
কিন্তু বিধি বাম হলে যা হয় আর কি! চিরদিন কারও সমান যায় না। ক্ষণিকের ভুলে ধর্মব আর মরীচির জীবনে ঘটে গেল এক মহা বিপর্যয়।
একদিন মরীচি বন থেকে ফুল, ফল সংগ্রহ করে অত্যন্ত ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরলেন। খাওয়াদাওয়া শেষ করে ধর্মবকে বললেন, ‘আজ আমি খুবই পরিশ্রান্ত। তুমি আমার পদসেবা করে দাও।’
পতির কথামতো ধর্মব পরম শ্রদ্ধাসহকারে তাই করছেন। মরীচি ঘুমিয়ে পড়লেন। এইসময় মরীচির বাবা ব্রহ্মা সেখানে উপস্থিত। ধর্মব পড়লেন মহা ফ্যাসাদে— একদিকে পতির আজ্ঞা, অন্যদিকে পতির পিতা অর্থাৎ শ্বশুর। তিনি তখন ধর্মসঙ্কটে পড়ে সিদ্ধান্ত নিলেন। নিদ্রিত পতির বদলে পূজনীয় শ্বশুর ব্রহ্মার পুজো করে তাঁকে শয্যায় বিশ্রাম করতে বললেন।
এদিকে ঘুম থেকে উঠে মরীচি দেখলেন ধর্মব তাঁর পদসেবা করছেন না। তাঁর আদেশ অমান্য করছেন। তখন তিনি তাঁকে অভিশাপ দিলেন, ‘তুমি শিলা হও।’
স্বামীর এহেন আচরণে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে মহাতাপসী ধর্মবও পাল্টা অভিশাপ দিলেন, ‘আমি ধর্মবুদ্ধিতেই এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছি। আপনি ঘুমিয়ে ছিলেন। পিতা ব্রহ্মা যিনি লোকপিতামহ তিনি স্বয়ং এখানে উপস্থিত। তাই ধর্মমতেই তিনি পূজিত। তাই আমি নির্দোষ। তবুও আপনি আমাকে বিনা দোষে গুরুদণ্ড দিলেন। আমিও আপনাকে অভিশাপ দিচ্ছি আপনিও মহাদেবের দ্বারা অভিশাপিত হবেন।’
ঘটনার আকস্মিকতা কেটে গেলে পরস্পর অনুশোচনা ও বিবেকের দংশনে জ্বলতে লাগলেন। এরপর ধর্মব ব্রহ্মাকে প্রণাম করে ‘গার্হপত্য’ নামক অগ্নির ওপর বসে আরও কঠিন তপস্যায় মগ্ন হলেন। মহর্ষি মরীচিও ওইরকম কঠিন তপস্যা করতে লাগলেন।
তাঁদের তপস্যায় দেবতারা প্রমাদ গুনলেন। তাঁরা ভগবান বিষ্ণুর কাছে গিয়ে তাঁদের আশঙ্কার কথা বললেন। তখন ব্রহ্মাদি দেবতারা বিষ্ণুর সঙ্গে ধর্মবর কাছে গেলেন।
দেবতারা সহ শ্রীবিষ্ণু ধর্মবকে বললেন, ‘তুমি যে কঠিন তপস্যা করছ তা জগতে দুর্লভ। আমরা তোমার ওপর প্রসন্ন। তুমি বর প্রার্থনা কর।’
ধর্মব দেবতাদের বললেন, ‘স্বামী মরীচির আমাকে দেওয়া অভিশাপ ব্যর্থ হোক— এই বর দিন।’
দেবতারা বললেন, ‘মরীচির দেওয়া অভিশাপ ব্যর্থ করার ক্ষমতা ত্রিজগতে কারও নেই। তাই ধর্ম রক্ষার্থে অন্য বর প্রার্থনা কর।’
ধর্মব বা ধর্মব্রতা বললেন, ‘আপনারা আমাকে স্বামীর অভিশাপ থেকে যদি মুক্ত করতে অক্ষম হন তাহলে আপনারা আমাকে এই বরদান করুন, যাতে আমি শিলা হয়েও ব্রহ্মাণ্ডের মধ্যে নদ, নদী, সরোবর, তীর্থ, দেব, ঋষি, মুনি ও প্রধান প্রধান দেবতাদের থেকেও অতি পবিত্র ও শুভফল দানকারিণী হই এবং ত্রিজগতে ব্যক্ত ও অব্যক্ত যত লিঙ্গ আছে সেই সবই যেন তীর্থরূপে সর্বদা আমার শিলাময় দেহে প্রতিষ্ঠিত থাকে। এই তীর্থে স্নান, তর্পণকারী ও সপিণ্ডদের শ্রাদ্ধদাতারা ব্রহ্মালোকে গমন করে। গদাধর, সব তীর্থের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দৃশ্যতীর্থ হোক। এখানে শ্রাদ্ধাদি করে পিতৃগণের মুক্তি হোক। শ্রীহরির অর্চনায় যেমন সব যজ্ঞের পূর্ণতা হয় তেমনই এই তীর্থে স্নান, শ্রাদ্ধ, তর্পণ সব যেন অক্ষয় ফল দানকারী হয়। আমার দেহে জপকারী ব্যক্তি যেন অচিরে সিদ্ধিলাভ করে। এখানে যে শ্রাদ্ধাদি করবে সে নিজের সঙ্গে পিতৃগণকে উদ্ধার করে নিঃসংশয়ে বিষ্ণুলোকে গমন করবেন। যতদিন ব্রহ্মাণ্ড থাকবে, ততদিন এই শিলাও যেন থাকে এবং আপনারাও এই শিলাখণ্ডে অধিষ্ঠান করবেন। আমার এই শিলাময় দেহে জপ, তপ ও অগ্নিতে আহুতি প্রভৃতি সব ক্রিয়াই যেন অক্ষয় ফল প্রদানকারী হয়।’
বিষ্ণু প্রমুখ দেবতারা একসঙ্গে ‘তথাস্তুঃ’ বলে ধর্মবের প্রার্থনা পুরণ করবেন বলে অঙ্গীকার করে বললেন, ‘তুমি যতদিন গয়াসুরের মাথায় স্থির হয়ে অবস্থান করবে আমরাও ততদিন তোমার শিলারূপে পা রেখে অবস্থান করব।’
পৃথিবীতে অবস্থানের সময় ত্রিলোকে বিখ্যাত হল ‘বিচিত্র শিলাতীর্থ’ নামে। এদিকে আর এক কাণ্ড। ওই শিলার সংস্পর্শে আসামাত্রই লোকেরা বিষ্ণুলোকে গেলেন। ক্রমে ত্রিলোক ও যমপুরী শূন্য হয়ে গেল। ধর্মরাজ যমদেব কর্মহীন হলেন। সমস্যার সমাধানে ইন্দ্র, যম প্রমুখ দেবতারা ব্রহ্মার কাছে গিয়ে বললেন, ‘একদা আপনার দেওয়া এই ‘যমদণ্ড’ আপনার কাছেই রাখুন; আজ আর এটার কোনও প্রয়োজন নেই।’
যমরাজের এই কাণ্ডের পর ব্রহ্মা বললেন, ‘তোমার বাড়িতে ওই শিলা তুমি নিয়ে যাও।’ এর ফলে যমরাজ আবার নিজ অধিকার ফিরে পেয়ে পাপীদের শাসন করতে লাগলেন।
ওই শিলাখণ্ডটি তো যমপুরীতে স্থান পেল। কিন্তু ওই শিলায় ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিবাদি দেবতারা অবস্থান করায় তা পৃথিবীতে দেবরূপিণী গুরুতর শিলা নামে বিখ্যাত হলেন। এই শিলার অসীম গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য থাকায় গয়াসুরের মাথার ওপর স্থাপিত করা হয়েছিল। কারণ গয়াসুরের মাথা ও ওই শিলা দুটোই পবিত্র। যা একসঙ্গে মিলিত হয়ে পিতাদের মুক্তি দিতে পারছে।—
‘গয়াসুরস্য শিরসি গুরুদ্বাদ্বারতা যতঃ।’
অতঃ পবিত্রযোর্যগঃ পিতৃণাং মোক্ষদায়কঃ।।’
এই দুটি বস্তু যোগ হওয়াতেই ব্রহ্মা সেই পরম পবিত্র স্থানে অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন। এই যজ্ঞভূমিতে বিষ্ণুআদি দেবতাদের উপস্থিত দেখে ওই শিলা তাঁদের বলেন— ‘আপনারা প্রতিজ্ঞা করুন, পিতৃগণের মুক্তির জন্য আপনার এই শিলায় অবস্থান করবেন।’
পূর্বের প্রতিজ্ঞা অনুসারে বিষ্ণুআদি দেবতারা ‘তাই হোক’ বলে কেউ শিলারূপে, কেউ পা দিয়ে, কেউ মূর্তি দ্বারা, কেউ বা মূর্ত হয়ে আবার অনেকে অমূর্ত রূপে ওই শিলায় অবস্থান করতে লাগলেন।
যেহেতু পবিত্রতম গয়াসুরের মস্তকে ওই পরমপবিত্র শিলা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেই জন্য মুণ্ডপৃষ্ঠ পর্বত পিতৃগণের ব্রহ্মলোকপ্রদ হয়েছে। আর ওই শ্রেষ্ঠ শিলাকে প্রভাস পর্বত আচ্ছাদিত করায় সূর্যদেব ওই পর্বতকে ভেদ করায় শিলায় এক অঙ্গুষ্ঠ নির্গত হয়েছে। অঙ্গুষ্ঠ থেকে উঠে আসা ওই মহাদেবই প্রভাসেশ নামে কীর্তিত হয়েছেন। ওই অঙ্গুষ্ঠের একটি অংশকে বলা হয় প্রেতশিলা— ‘শিলাঙ্গুষ্ঠৈকদেশো যঃসা চ প্রেতশিলা...।’
গয়ায় শ্রাদ্ধপিণ্ড দান কারা করতে পারেন?
১) মৃত ব্যক্তির বার্ষিক সপিণ্ডকরণ (বাৎসরিক কার্য) না করে গয়ায় পিণ্ডদান করা যায় না। তাই আগে সপিণ্ডকরণ করে পরে গয়াকার্য করতে হয়।
২) আগে মৃত ব্যক্তির শাস্ত্রীয় নিয়মে শ্রাদ্ধ করার একবছর পরে মাসিক শ্রাদ্ধ ও সপিণ্ডকরণ করে গয়াক্ষেত্রে পিণ্ডদান করাই বিধেয়।
৩) মৃতব্যক্তির যদি একটিমাত্র পুত্রসন্তান থাকে সে ক্ষেত্রে শ্রাদ্ধের পরেই বাড়িতে সপিণ্ডকরণ করা যেতে পারে। (এক্ষেত্রে একবছর অপেক্ষার প্রয়োজন নেই) এবং তারপর গয়ায় সে পিণ্ড দিতে পারে।
৪) পতি-পুত্রবতী নারী কারও পিণ্ডদানের অধিকার নেই। অর্থাৎ এরা পিণ্ডদানের অধিকারিণী নয়।
৫) পিতা বেঁচে থাকলে পুত্র গয়াতে মায়ের পিণ্ডদান করতে পারে না। (মা বেঁচে থাকলেও পুত্র মৃত বাবার পিণ্ডদান করতে পারে)।
৬) মৃত্যুর পর বছরের শেষে সেই নির্দিষ্ট তিথিতে সপিণ্ডকরণ করা না হলে যে কোনও অমবস্যা বা কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে মৃতের সপিণ্ডকরণ সম্পন্ন করে তারপর গয়া পিণ্ড দান করা যায়।
৭) যে কেউ যার তার নামে গয়ায় পিণ্ডদান করতে পারে। মৃত ব্যক্তির গোত্র বা শ্রেণি বিচার এক্ষেত্রে করা হয় না।
৮) মৃত ব্যক্তির প্রতিনিধি হয়ে ব্রাহ্মণ মৃত সকলের পিণ্ডদান করতে পারেন।
৯) অপঘাতে মৃত ব্যক্তির উদ্দেশে পিণ্ডদান করতে হয়— ফল্গু, অক্ষয়বট, বিষ্ণুপাদপদ্ম আর প্রেতশিলায়।
গয়াকার্যের বিশেষ কিছু সময়
সকলের সেরা তীর্থ গয়াধাম। সব তীর্থক্ষেত্র এই স্থানে অবস্থান করেন। তাই তো গয়াধামকে তীর্থপতি বলে। শাস্ত্রবাক্য হল গয়াক্ষেত্রে পিণ্ডদানই ত্রিলোকের দুর্লভ কাজ। যে কোনও কালে ও যে কোনও সময়ে গয়াধামে পিণ্ডদান করা যায়। তবে বিশেষ কিছু সময়ে গয়া কর্মে বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ ফল লাভ হয়। বিভিন্ন শাস্ত্রে এ বাক্যের সমর্থন পাওয়া যায়। শাস্ত্রবর্ণিত শুভ কালগুলি হল—
১) চৈত্র, পৌষ, বৈশাখ, আশ্বিন এবং জ্যৈষ্ঠ মাসে রবি যখন রাশিচক্রে মীন, ধনু, মেষ, কন্যা এবং বৃষরাশিতে অবস্থানের সময়।
২) মাঘ মাসে সূর্যগ্রহণের সময় গয়াকার্যে বিশেষ শুভ।
৩) মলমাস, জন্মদিন, চন্দ্র ও সূর্যগ্রহণ, বৃহস্পতি গ্রহের সিংহরাশিতে অবস্থানের সময়, শুক্র ও বৃহস্পতি গ্রহের অস্তের সময় গয়ায় পিতৃপুরুষকে পিণ্ডদানাদি কর্ম বিশেষ মাহাত্ম্যপূর্ণ কাল।
৪) সম্পূর্ণ পৃথকভাবে মায়ের শ্রাদ্ধ শুধুমাত্র গয়াধামেই সম্ভব। অন্যথায় মায়ের শ্রাদ্ধ পিতার সঙ্গে হয়ে থাকে। তবে মাতৃশ্রাদ্ধ পৃথকভাবে করা যায়— অষ্টকা, বৃদ্ধি আর মৃতাহে— এই তিন সময়ে।
ক্ষতাদি দোষ
তীর্থরাজ গয়া ক্ষেত্রে শ্রাদ্ধ বা পিণ্ডদানের সময় যে কোনও ক্ষতাদি দোষ সম্পূর্ণ মুক্ত হয়। তবে অপরাপর তীর্থগুলিতে পিতৃকর্মে ক্ষতাদি দোষ ধরা হয়। তাই সেখানে এই কর্ম তখন বিধেয় নয়।
গয়ায় পিণ্ড দ্রব্য
পায়স, চরু, যবচূর্ণ, পিষ্টক, তণ্ডুল, তিল, ফলমূল, ঘি-এর সঙ্গে গুড়, দই, উৎকৃষ্ট মধু প্রভৃতি দ্রব্য পিণ্ডরূপে গয়াক্ষেত্রে দান করলে পিতৃগণ তা পরম তৃপ্তি সহকারে হবিষান্ন রূপে গ্রহণ করেন। এই পিণ্ড গ্রহণের ফলে নরকগামী মৃতের স্বর্গলাভ ও স্বর্গগামীর মুক্তিলাভ হয়ে থাকে— ‘পায়সেনাম চরুণা শক্তৃনা... যাতি স্বর্গস্থাঃ মোক্ষমাপ্নুয়াঃ।’
গয়ার কোন কোন স্থানে পিণ্ডদান করা যায়?
গয়াক্ষেত্রের একাধিক স্থানে পিণ্ডদানের শাস্ত্রীয় নিয়ম আছে। কারণ এখানে সব দেবদেবীর অবস্থান। তবে এইসব স্থানে পিণ্ডদান ব্যয় ও সময়সাপেক্ষ। তাই অসমর্থ মানুষ, যারা বিভিন্ন স্থানে পিণ্ডদান করতে পারে না, তাদের ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য নয়। তবে তারা কী করবে? তাদের পূর্বপুরুষের গতিই বা কী? গয়াক্ষেত্রে পিণ্ডদানের তিনটি বিশিষ্ট স্থান আছে। এগুলি হল ফল্গুনদীর তীর, বিষ্ণুপাদপদ্ম ও অক্ষয়বট। এই তিনটি স্থানে সবাইকেই পিণ্ডদান করতে হয়। তবে অপঘাতে মৃত্যু হলে মৃতের আত্মার শান্তি ও মুক্তির জন্য ফল্গুনদীর তীর, বিষ্ণুপাদপদ্ম ও অক্ষয়বটে পিণ্ডদানের পর প্রেতশিলা পর্বতের ব্রহ্মকুণ্ডে স্থান-তর্পণ পিণ্ডদান আর দক্ষিণাদান করতে হয়।
ফল্গুতীর্থ: এটি গয়াধামের একটি মুখ্যতীর্থ। পিতৃপুরুষদের আত্মা ফল্গুতীর্থে মুক্তিলাভ করে। এখানে অর্থাৎ ফল্গুনদীর তীরে ফল্গুর পুণ্যবারিতে শ্রীবিষ্ণু ও দেবতাদের উদ্দেশে তর্পণ করতে হয়। এরপর পরলোকবাসী পিতৃপুরুষদের আত্মার উদ্দেশে তর্পণ করতে হয়।
শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্ম: ১৭৬৬ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোরের মহারানি অহল্যাবাঈ ভগবান শ্রীবিষ্ণুর মন্দিরটি নির্মাণ করেন। শিলায়িত গয়াসুরের বুকের উপর ভগবান বিষ্ণুর শ্রীচরণের চিহ্নটি আজও শোভা পায়। তাঁর শ্রীচরণের দৈর্ঘ্য কমবেশি এক ফুট এক ইঞ্চি। এই শ্রীচরণের পঞ্চাঙ্গুলি উত্তরমুখী। এক ফুট উচ্চাকার পাথর দিয়ে গর্ভগৃহের এই স্থানটির চারদিক ঘেরা। ফল্গুনদীর তীরে অবস্থিত। মন্দিরের নিকট মধুশ্রবা নামে আর একটি নদী আছে। ভগবান বিষ্ণুর পাদপদ্মে পিণ্ডদান করলে মৃত পিতৃপুরুষের আত্মার মুক্তিলাভ হয়। সে বৈকুণ্ঠলাভ করে।
অক্ষয়বট: প্রচলিত মতে ত্রেতাযুগ থেকে গয়াক্ষেত্রে অবস্থান করছে অক্ষয়বট। এটি শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্ম মন্দির ও ব্রহ্মযোনি পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত। সাক্ষীরূপে অক্ষয়বট সত্যকথা বলায় সীতমাতা তাকে অক্ষয় হবার বর দান করেন। এখানে পিতৃ পুরুষের উদ্দেশে যা কিছু দান করা হয় তা অক্ষয় ফল প্রদান করে। এখানে শেষ পিণ্ডদান করলে পরলোকবাসী আত্মার মুক্তি হয়। গয়াকর্মের সাক্ষীও হলেন অক্ষয়বট।
প্রেতশিলা: প্রেতশিলা নামটি বিখ্যাত। প্রেতশিলার আদিনাম প্রেতপর্বত। গয়া থেকে প্রায় সাত কিমি দূরে অবস্থিত। ব্রহ্মকুণ্ড থেকে প্রেতশিলায় যেতে হয় কমবেশি ৭০০টি সিঁড়ি দিয়ে উঠে। সিঁড়ির ধাপগুলির উচ্চতা একটু বেশি। প্রভাস, প্রেতকুণ্ড ও গয়াসুরের মস্তক এই তিন স্থানেই প্রেতশিলা বিদ্যমান। শাস্ত্রমতে ধর্মই নিজ মাহাত্ম্য প্রচারেই দেবময় শিলা হয়ে বিরাজ করছেন। প্রেতশিলা পাহাড়ের নীচে একটি পুষ্করিণী আছে। এটিই হল ব্রহ্মকুণ্ড। এটির চারদিকে বাঁধানো ঘাট আছে। এখানে স্নান করে পরলোকগত তৃপ্ত বা অতৃপ্ত আত্মা; বিশেষ করে অতৃপ্ত আত্মার উদ্দেশে পিণ্ডদান করা হয়। এই পিণ্ডদানের দ্বারা তারা অর্থাৎ মৃত আত্মা কষ্টকর প্রেতযোনি থেকে মুক্তিলাভ করে। এখানে একটি ছোট কালীমন্দির আছে। মানুষ ভক্তিভরে মায়ের পুজো করেন। আর আছে লোকপিতামহ ব্রহ্মার চরণচিহ্ন। এই ক্ষেত্রে পিণ্ডদান করলে মৃত ব্যক্তির পরলোকগত আত্মার অসীম তৃপ্তিলাভ হয় এবং ব্রহ্মালোক প্রাপ্ত হন। অনেকে অতৃপ্ত আত্মার উপদ্রব থেকে বাঁচতে প্রেতশিলার কালীমন্দিরে সেই মৃত প্রিয়জনের ফটো রেখে আসেন। এতে তারা সেই সমস্যা থেকে চিরতরে মুক্ত পান। প্রেতশিলায় পিণ্ডদানে অতৃপ্ত আত্মার উপদ্রব বন্ধ হয় তার আত্মার শান্তি হয়। কারণ প্রেতশিলায় পিণ্ডদান না করলে আত্মার মুক্তি হয় না।
গয়াক্ষেত্রে পিণ্ডদানের প্রাচীনত্ব
সৃষ্টির সূচনা লগ্নে শ্বেতকল্প কাল থেকে গয়াধাম মহাতীর্থের প্রকাশ। সেই শুরু থেকে এখনও পর্যন্ত ত্রেতা, দ্বাপর পার হয়ে বর্তমান কলিকালেও তা স্বমহিমায় বিরাজমান। যুগে যুগে অসংখ্য মহর্ষি, ব্রহ্মর্ষি, অবতার, সিদ্ধযোগী সবাই এই মহাতীর্থে এসেছেন, ক্রিয়াদি দ্বারা তাঁদের পূর্বপুরুষের তৃপ্তিসাধন করেছেন, নিজেরা মুক্ত হয়েছেন নিজ নিজ পিতৃ-মাতৃ দায় থেকে।
মহর্ষি ভরদ্বাজ মুনি তাঁর পিতৃগণের উদ্দেশে গয়ায় পিণ্ডদান করেন। কিংবদন্তি আছে, তাঁর পিতা ও পালক পিতা যথাক্রমে শ্বেতবর্ণ ও কৃষ্ণবর্ণর হাত প্রসারিত করে পুত্র ভরদ্বাজের কাছ থেকে পিণ্ড গ্রহণ করে ঊর্ধ্বগতি লাভ করেন।
ত্রেতাযুগের কথা। দশরথের মৃত্যুর পর তাঁর জ্যোষ্ঠ শ্রীরামচন্দ্র গয়াক্ষেত্রে রুদ্রপদে শ্রাদ্ধাদি ক্রিয়া শেষে যখন পিণ্ডদান করতে যান সেই সময় দশরথ তাঁর দু’হাত প্রসারিত করেন আদরের দুলাল রামের দিকে, পিণ্ড গ্রহণের জন্য। কিন্তু রাম ওই পিণ্ড পিতার হাতে না দিয়ে রুদ্রপদেই দান করেন। এতে দশরথ রামকে আশীর্বাদ করেন—তুমি পিণ্ড আমায় হাতে না দিয়ে রুদ্রপদে দিয়েছ বলেই আমার রুদ্রলোক প্রাপ্তি হয়েছে। না হলে তা হতো না। সীতাদেবীর দেওয়া বালির পিণ্ড শ্বশুর দশরথ গ্রহণ করেন। চালের অভাবে তিনি বালির পিণ্ড দান করেন। এই পিণ্ডদানের সাক্ষী থাকেন ফল্গুনদী, তুলসীবৃক্ষ ও অক্ষয়বট। পরে শ্রীরামের সামনে ফল্গুনদী ও তুলসী বৃক্ষ মিথ্যাসাক্ষী দেওয়ায় সীতাদেবী তাদের অভিশাপ দেন। আর অক্ষয়বট সত্যি কথা বলে তাঁর আশীর্বাদ লাভ করেন।
দ্বাপর যুগে পিতামহ ভীষ্মদেব তাঁর পিতা শান্তনুর শ্রাদ্ধাদিকর্ম করার পর যখন পিণ্ডদান করতে যাবেন সেই সময় তাঁর পিতা দুই হাত প্রসারিত করে পিণ্ড গ্রহণ করতে চান। কিন্তু ভীষ্মদেব সেই পিণ্ড শান্তনুর হাতে না দিলে বিষ্ণুপাদপদ্মে দান করেন। পুত্রের এই এই কর্মে পরম তৃপ্তি পান ও আশীর্বাদ করেন। বলেন, ‘তুমি যেন ত্রিকালদর্শী হও, ইচ্ছানুসারে তোমার মৃত্যু হোক আর মৃত্যুর পর বিষ্ণুপদে স্থান লাভ কর।’
ব্যাসদেবের পুত্র পাণ্ডুর শ্রাদ্ধের পর তাঁর পুত্র যুধিষ্ঠিরের পিণ্ডদানের সময় পাণ্ডু দুই হাত বাড়িয়ে তাঁর কাছ থেকে পিণ্ড গ্রহণ করতে চান। কিন্তু যুধিষ্ঠির পিতার হাতে পিণ্ডদান না করে তা শিলাতে দান করেন। এতে পাণ্ডু পরম তৃপ্তিলাভ করেন। যুধিষ্ঠিরকে বলেন, ‘ভাইদের সঙ্গে সশরীরে স্বর্গে গমন কর।’ পাণ্ডু শাশ্বত অব্যয় পদ লাভ করেছিলেন।
শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু তাঁর পিতার মৃত্যুর পর গয়াক্ষেত্রে পিণ্ডদান করেন। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় গয়াক্ষেত্রে বিষ্ণুপাদপদ্মে পিতৃপুরুষদের উদ্দেশে পিণ্ডদান করেন। এরপর গদাধরের আশীর্বাদে স্বয়ং গদাধর আসেন সন্তান রূপে। ক্ষুদিরাম সন্তানের নাম দিলেন গদাধর। ইনিই হলেন অবতার বরিষ্ঠায় ঠাকুর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস। গয়াধামে যোগীরাজ বাবা গম্ভীরানাথের সিদ্ধ যোগাসন আছে। ওই স্থানটি হল কপিলধারা।
জীবিত ব্যক্তি কি নিজ পিণ্ডদান করতে পারে?
জীবিত ব্যক্তি গয়াধামে তার নিজের জন্য বা অপর ব্যক্তির জন্য পিণ্ডদান করতে পারে। একাধিক শাস্ত্রমুখে এই বাক্যের সমর্থন পাওয়া যায়। গয়ায় ভষ্মকুট পর্বতে স্বয়ং জনার্দন সদা বিরাজ করেন। এখানে জনার্দনের বামহাতে দধিমিশ্রিত পিণ্ডদান জীবিত ব্যক্তি করতে পারেন। এই পিণ্ডদান নিজের বা অন্যেরও করা যায়। কিন্তু এই পিণ্ডে তিল মিশ্রিত করা যায় না। অর্থাৎ কোনওরূপ তিল ছাড়াই এই পিণ্ড শ্রীজনার্দনের হাতে পিণ্ড অর্পিত হয়, তাঁরা সকলেই বিষ্ণুলোকে গমন করেন। তবে এই পিণ্ডদানের সময় ভক্তি শ্রদ্ধাসহ কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করতে হয়। কী সেই প্রার্থনা! সেটিও শাস্ত্র বলে দিয়েছেন—
‘হে জনার্দন আমার বা যাদের উদ্দেশে তোমার হাতে এই পিণ্ডদান করলাম, আমি বা সেই সব ব্যক্তির মৃত্যু হলে তুমি গয়াশিরে এই পিণ্ড পৌঁছে দিও। হে জনার্দন