সাপ্তাহিক বর্তমান

হোমিওপ্যাথিতে অসুখ নিরাময়
ডাঃ রামকৃষ্ণ ঘোষ

১৭৯৬ সাল। ওই বছরই বিজ্ঞানী হ্যানিম্যান হোমিওপ্যাথি নামে একটি চিকিৎসা পদ্ধতি বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেন। যেখানে রোগীকে একসঙ্গে একটি মাত্র ওষুধ দিয়ে সুস্থ করে তোলাই হল চিকিৎসার মূলমন্ত্র। এই চিকিৎসায় দীর্ঘদিন ধরছে ভুগছে এমন একজন পুরাতন ও জটিল রোগীকে এবং তাঁর রোগ সম্পর্কে জানতে ক্ষেত্রবিশেষে বেশ কয়েক ঘণ্টা পর্যন্ত সময় ব্যয় করেন চিকিৎসক। অত্যন্ত সহানুভূতি ও যত্ন সহকারে রোগ এবং রোগীর সম্পূর্ণ ইতিহাস সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা হয়। ফলে রোগী বা রোগিণী তাঁর চিকিৎসক সম্পর্কে আস্থাশীল হতে পারেন। এই কারণে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসককে মানুষের মন সম্পর্কে (সাইকোলোজি) সম্যক ধারণা রাখতে হয়। অনেক সময় ওষুধের পাশাপাশি সাইকোথেরাপিও ভীষণভাবে প্রয়োজন হয়। কখনও কখনও ওষুধ অনেক ক্ষেত্রেই গৌণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। হোমিওপ্যাথিকে বুঝতে গেলে একটি সাধারণ বিষয়কে মাথায় রাখতে হবে। যদি কোনও সুস্থ স্বাভাবিক ব্যক্তিকে হোমিওপ্যাথিক ওষুধ খাওয়ানো হয়, সেক্ষেত্রে তার শরীরে বেশ কিছু শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতার লক্ষণ দেখা দেবে। যেমন—গা ব্যথা, মাথা ব্যথা, হালকা জ্বর, বমি বমি ভাব, কিছু ভালো না লাগা ইত্যাদি  লক্ষণগুলিকে রেকর্ড করা হয়। যাকে হোমিওপ্যাথির  পরিভাষায় ‘ড্রাগ প্রুভিং’ বলা হয়। যে বইয়ে এই সমস্ত লক্ষণাবলি লিপিবদ্ধ করা থাকে তাকে হোমিওপ্যাথিক মেটেরিয়া মেডিকা বলে। সেই সমস্ত লক্ষণাবলি যখন কোনও একজন মানুষ অসুস্থ হলে দেখা যায় তখন তার উপর ভিত্তি করেই ওই রোগীকে কী ওষুধ দেওয়া হবে তা ঠিক করা হয়। 

হোমিওপ্যাথি কীভাবে শরীরে অসুখ নিরাময় করে? 
যাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা কম, তাদের অল্পতেই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা থাকে। ধরা যাক কোনও ব্যক্তি জ্বরে আক্রান্ত হয়েছেন। তিনি যদি হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করাতে চান, তাহলে ওই ব্যক্তিকে বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয়,রোগ এবং রোগীর সম্পর্কে— জ্বর কখন আসছে, কখন কমছে, জ্বরের সঙ্গে আর কী কী লক্ষণ রয়েছে, মাথা ব্যথা আছে কি না, ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে কি না ইত্যাদি। এই লক্ষণগুলির সঙ্গে যে ওষুধের লক্ষণাবলির সবচেয়ে বেশি মিল আছে সেটাই সদৃশবিধান মতে, এক্ষেত্রে এই রোগীর ওষুধ হিসেবে ধরা হয়। মূলত ড্রাগ প্রুভিং-এর মাধ্যমে লিপিবদ্ধ লক্ষণগুলির সঙ্গে যে ওষুধটির সবথেকে বেশি সাদৃশ্য আছে সেটাই এক্ষেত্রে তাঁর ওষুধ বলে বিবেচিত হবে। 
হোমিওপ্যাথি ওষুধ শরীর ও মনকে শক্তিশালী করে। ফলে মানুষটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথির সঙ্গে ভ্যাকসিনের অনেকটা সাদৃশ্য আছে। আমরা জানি, ভ্যাকসিন হল একরকম অ্যান্টিজেন, যেটা দিলে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। পরবর্তীতে যখন একই ধরনের অ্যান্টিজেন শরীরের মধ্যে প্রবেশ করে সেটা ভাইরাস বা  ব্যাকটেরিয়া হতে পারে, তখন তাদের সঙ্গে লড়াই করে ওই রক্তে থাকা সদৃশ অ্যান্টিবডিগুলো। হোমিওপ্যাথির ক্ষেত্রেও ব্যাপারটি অনেকটা একই রকম। একজন অসুস্থ ব্যক্তিকে এই সদৃশ পদ্ধতিতে হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাওয়ানোর পর তার শরীরে অসুস্থতার লক্ষণগুলি ধীরে ধীরে চলে যায়। শুধু তাই নয় ওই রোগীর মধ্যে একটা দীর্ঘস্থায়ী রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করতেও সাহায্য করে। কিন্তু ভ্যাকসিনের সঙ্গে মৌলিক তফাৎ হল ভ্যাকসিনের তুলনায় হোমিওপ্যাথি ওষুধের ডোজের পরিমাণ অনেকটা কম। তিনটি মূল নীতির উপরে সমগ্র হোমিওপ্যাথির চিকিৎসা পদ্ধতিটা দাঁড়িয়ে আছে। ১) সদৃশ পদ্ধতিতে হোমিওপ্যাথি ওষুধ নির্বাচন। ২) একসঙ্গে একটি মাত্র ওষুধ খাওয়া। ৩) যতটা সম্ভব কম ডোজ দেওয়া।   

হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক কী কী পদ্ধতি মেনে চিকিৎসা করবেন? 
যিনি হোমিওপ্যাথি ডাক্তার একটি নির্দিষ্ট রোগীর জন্য লক্ষণ অনুযায়ী যে ওষুধ প্রয়োজন শুধুমাত্র সেটাই প্রয়োগ করবেন। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক একই সময়ে মাত্র একটি ওষুধই রোগীকে দেবেন, তার বেশি নয়। এছাড়া তিনি রোগীকে যতটা পারবেন কম ডোজের ওষুধ দেবেন। তবে অনেক সময় দেখা যায়, রোগীর একাধিক শারীরিক অসুস্থতার লক্ষণ রয়েছে। কিন্তু তিনি চিকিৎসকের কাছে সব রোগের লক্ষণ বলতে ভুলে গিয়েছেন। রোগী যে অসুস্থতার কথাগুলি বলতে ভুলে গিয়েছেন, অনেক সময় দেখা যায় সেই লক্ষণগুলিও সেরে যায় হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাওয়ার ফলে। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায়, একটি ওষুধই একাধিক রোগ সারিয়ে তুলতে পারে। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকরা প্রায়ই বলে থাকেন ব্যাকটেরিয়া অবশ্যই রোগের কারণ, তবে একমাত্র কারণ নয়। 

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হোমিওপ্যাথি ওষুধ
হোমিওপ্যাথি ওষুধ খাওয়ার ফলে প্রথমত আপনি কোনও রোগের শিকার হলে তা সেরে যায়। পাশাপাশি বেশকিছু হোমিওপ্যাথি ওষুধ আছে যেগুলো খেলে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ে। অনেক হোমিওপ্যাথিক ওষুধ গাছগাছড়া থেকে তৈরি হয়। এখন অনেকে অল্পতেই জ্বর, সর্দি, কাশি, টনসিলাইটিস ইত্যাদি একাধিক রোগের শিকার হন। এই ধরনের রোগগুলিকে প্রতিরোধ করার জন্য বেশকিছু ওষুধ রয়েছে, যাকে বলা হয় কনস্টিটিউশনাল মেডিসিন। উদাহরণ হিসেবে ক্যালকেরিয়া কার্ব, সালফার, সাইলেসিয়া,  সোরাইনাম, ব্যাসিলিনাম, টিউবারকুলিনাম ইত্যাদির কথা বলা যায়। এই ধরনের ওষুধগুলি সদৃশ মতে ব্যবহার করলে রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা অনেকাংশে বেড়ে যায়। আবার হোমিওপ্যাথি ওষুধ ব্যবহার করে জ্বর, সর্দি, কাশি থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। 

হোমিওপ্যাথি ওষুধ ব্যবহার করলে কি আয়ুষ্কাল বাড়ে?
আয়ুষ্কালের বিষয়টি শুধুমাত্র হোমিওপ্যাথি ওষুধ ব্যবহারের উপর নির্ভর করে না। আয়ুষ্কাল বাড়ানোর জন্য প্রথমত সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপনের দরকার। দ্বিতীয়ত, যাদের বংশগত পরম্পরা সূত্রে বড় কোনও রোগের ইতিহাস রয়েছে (সেরিব্রাল অ্যাটাক, হার্ট অ্যাটাক, হাঁপানি, ডায়াবেটিস, বিভিন্ন রকমের ক্যান্সার ইত্যাদি) তাদের সাবধানে থাকা উচিত। কারণ এই রোগগুলি অনেকসময় পরবর্তী প্রজন্মের ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে এবং সেক্ষেত্রে সাধারণ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় তাদের আয়ুষ্কাল স্বল্প হতে পারে। তবে সঠিকভাবে হোমিওপ্যাথি ওষুধ প্রয়োগ করলে জটিল রোগ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। হোমিওপ্যাথি ওষুধ ব্যবহারের সঙ্গে পরোক্ষভাবে আয়ুষ্কাল বাড়ার সম্পর্ক তো আছেই। উপরিউক্ত বংশগত রোগগুলো সঠিক হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার দ্বারা সারিয়ে তুলতে পারলে আয়ুষ্কাল শুধু বেড়ে যাবে তাই নয়, বাকি জীবনের মানোন্নয়ন ঘটবে। 
ত্বকের বয়স ধরে রাখতে কি হোমিওপ্যাথি ওষুধ ব্যবহার করা যেতে পারে?
ত্বকের ঔজ্জ্বল্য বা সৌন্দর্যের জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধের ব্যবহার করা হয় না। তার জন্য প্রয়োজন হেলদি ডায়েটের। এছাড়া পর্যাপ্ত পরিমাণ জল পান করতে হবে। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় প্রচুর টাটকা শাকসব্জি, টক দই, পর্যাপ্ত পরিমাণ ফল রাখতে হবে। যতটা সম্ভব বাড়ির খাবার খেতে হবে। এড়িয়ে চলতে হবে ফাস্টফুড, জাঙ্কফুড, প্রক্রিয়াজাত খাবার। প্রত্যেকদিন হাঁটাচলা, পারলে যোগব্যায়াম করতে হবে। অতিরিক্ত রাত না জাগা। ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ করা। একজন সাধারণ মানুষ যদি এই সমস্ত নিয়মগুলি মেনে চলেন তাহলেই তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকবেন। একজন মানুষ যদি পুরোপুরি সুস্থ থাকেন তাহলেই তার ত্বক, চুল, সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সুস্থ থাকবে এবং এই ধরনের একাধিক সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন। 

কোন কোন ক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি ওষুধে রোগ সারে না?
এতক্ষণ ধরে আলোচনা করা হয়েছে হোমিওপ্যাথি ওষুধ আমাদের কী কী উপকার করে সেই সংক্রান্ত বিষয়ে। তবে সব রোগীই যে হোমিওপ্যাথিতে সারবে এমনটা নয়। শুধুমাত্র সারার মতো অবস্থায় আছে এরকম (সার্জিক্যাল কন্ডিশন বাদে) রোগীই সারবে। পাশাপাশি কোনও রোগ যদি সঠিক পরিমাণ খাবার ও পুষ্টিগুণের অভাবে হয় সেটা শুধুমাত্র ওষুধে সারে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কোনও গরিব ঘরের বাচ্চা যে অপুষ্টির শিকার তাকে শুধুমাত্র হোমিওপ্যাথি ওষুধ দিয়ে রোগ সারানো যাবে না। কারণ বাচ্চাটির দরকার পুষ্টিকর খাবার, ওষুধ নয়। 
মাথায় রাখতে হবে ওষুধ কখনওই খাবারের পরিপূরক হতে পারে না। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, একটি বাচ্চার পুষ্টিকর খাবার খাওয়া সত্ত্বেও ঠিক মতো গ্রোথ হচ্ছে না বা সহজেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে, শীর্ণ চেহারা। সেই বাচ্চাটির জন্য আদর্শ হল কনস্টিটিউশনাল হোমিওপ্যাথি ওষুধ যা পূর্বেই আলোচিত হয়েছে। কারণ পুষ্টিকর খাবার খেলেও অনেক সময় খাবার ঠিকমতো হজম হয় না। সেক্ষেত্রে হোমিওপ্যাথি ওষুধের মাধ্যমে হজমশক্তি বাড়ে। ওষুধ খাওয়ার বেশ কিছুদিনের মধ্যেই এর সুফল পাওয়া যায়।

হোমিওপ্যাথি ওষুধে কি ক্যান্সার সারানো সম্ভব?
ক্যান্সার, এই রোগের নাম শুনলেই আঁতকে ওঠেন অনেকেই। আসলে এই মারণ রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খান বহু মানুষ। অনেকে আবার টাকার কথা চিন্তা করেই কিছুটা পিছিয়ে যান। আর যাঁদের টাকা খরচ করে চিকিৎসা করানো সম্ভব তাঁরা অনেক সময় বিদেশে গিয়েও এই রোগের চিকিৎসা করিয়ে থাকেন। কিন্তু, তা অনেকের পক্ষে সম্ভব হয় না। তবে এক্ষেত্রে বলে রাখা ভালো হোমিওপ্যাথি কখনওই সরাসরি ক্যান্সার বা অন্য কোনও রোগের নাম ধরে চিকিৎসা করে না। 
কোনও ব্যক্তি ক্যান্সার, ডায়াবেটিস, আর্থ্রাইটিস, না ব্রেন টিউমারে আক্রান্ত তা দেখে হোমিওপ্যাথি ওষুধ নির্বাচন করা হয় না কারণ হোমিওপ্যাথি ওষুধ রোগের নামের উপরে নির্ভর করে নির্বাচন করা হয় না। 
রোগীর সার্বিক লক্ষণাবলীর উপর নির্ভর করে চিকিৎসা করা হয়। তাই প্রথম অবস্থা থেকে সঠিক চিকিৎসা করলে অনেক ক্ষেত্রে ক্যান্সার বা আরও অন্যান্য দূরারোগ্য রোগী দীর্ঘদিন ভালো থাকেন, সম্পূর্ণরূপে সিম্পটম ফ্রি হয়ে যায়, এমনকী কিছু ক্ষেত্রে সেরেও যেতে পারে। আবার অনেক ক্যান্সারের রোগীর শেষ অবস্থায় যন্ত্রণা কমিয়ে রাখার ক্ষেত্রেও হোমিওপ্যাথি একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফলে অনেক সময় অন্য চিকিৎসাতেও সুফল না পেয়ে আমাদের কাছে দ্বারস্থ হন। দরকার পড়লে হাসপাতালে ভর্তি রেখেও চিকিৎসা করা হয়। 
লেখক: ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হোমিওপ্যাথির সার্জারি বিভাগের প্রধান
4d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

কাজকর্মে উন্নতি। ব্যবসায় গতি বৃদ্ধি। ব্যবসা ক্ষেত্রে লগ্নিবৃদ্ধির প্রচেষ্টায় সাফল্য। সন্তান বিষয়ে কোনও সুখবর পেতে...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৪.৯৬ টাকা৮৬.৭০ টাকা
পাউন্ড১০৪.৫৩ টাকা১০৮.২৪ টাকা
ইউরো৮৬.৫১ টাকা৮৯.৮৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা