মৃত্যু জীবনের অন্তিম পরিণতি, এটি জানার পরও বলতে হয়—প্রথমত এই সুন্দর পৃথিবী, ভালোবাসা, আনন্দ আর সম্পর্কের মধুর স্মৃতি ছেড়ে যেন মন বিশ্ব ছেড়ে যেতে চায় না। দ্বিতীয়ত, নশ্বর দেহ থেকে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাক, কিন্তু আমাদের কৃতকর্ম যেন মানুষের মনে বেঁচে থাকে, একেই বলে মরে বেঁচে থাকা, অমরত্ব। কিন্তু দেহের কোনও অমরত্ব নেই। জীবনযাত্রা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সুষ্ঠু সমন্বয় গড়তে পারলে নীরোগ ও বলিষ্ঠ দেহ নিয়ে দীর্ঘকাল বাঁচা যায়। দীর্ঘজীবনের উপায় জানালেন ডাঃ সুকুমার মুখোপাধ্যায়, আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ডাঃ সুবলকুমার মাইতি, ডাঃ রামকৃষ্ণ ঘোষ, যোগবিশারদ পরিতোষকুমার হাজরা, পুষ্টিবিদ শতভিষা বসু। ব্লু জোন-এর শতায়ু মানুষদের আশ্চর্য জীবনযাত্রার কথা শোনালেন সঞ্চিতা চট্টোপাধ্যায়।
আয়ুর্বেদে দীর্ঘায়ু লাভের উপায়
ডাঃ সুবলকুমার মাইতি
‘মরিতে চাহি না আমি’— কবির আর্তনাদ কীসের ইঙ্গিত? তিনি তো জানতেন— জন্মিলে মরিতে হবে। মৃত্যু যে জীবনের অন্তিম পরিণতি, এই সত্যটি জানার পরও আমরা দু’টি বিষয় মাথায় রেখে এটি বলতে পারি। প্রথমত, এই সুন্দর পৃথিবী, ভালোবাসা, আনন্দ আর সম্পর্কের মধুর স্মৃতি ছেড়ে যেন মন মনোরম এই বিশ্ব ছেড়ে যেতে চায় না। দ্বিতীয়ত, আমার নশ্বর দেহটি থেকে প্রাণবায়ু বেরিয়ে যাক, তাতে দুঃখ নেই, আমার কৃতকর্ম যেন মানুষের মনে বেঁচে থাকে, একেই বোধ হয় বলে মরেও বেঁচে থাকা, অমরত্ব। কিন্তু দেহের কোনও অমরত্ব নেই। জীবনযাত্রা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার সুষ্ঠু সমন্বয় গড়তে পারলে নীরোগ ও বলিষ্ঠ দেহ-মন নিয়ে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকা যায়। তবে অত্যধিক রাগ থাকলে তা কোনওদিন সম্ভব নয়।
আয়ুর্বেদ চিকিৎসাশাস্ত্রের মূলকথা হল দু’টি। প্রথমটি হল— শরীরকে সুস্থ দীর্ঘ ও নীরোগ জীবনলাভের উপায়। দ্বিতীয়টি হল— শরীর ও মনে কোনও রোগ সৃষ্টি হলে তার চিকিৎসা করা।
মাতৃগর্ভে থাকাকালীন অবস্থাতেই জীবনের শুরু। আমাদের শরীর ও মনের গঠনে বাবা ও মায়ের অবদান থাকলেও মায়ের দিক থেকে আমাদের মস্তিষ্কের গঠন ও ক্রিয়াকলাপ সৃষ্টি হয়। যার জন্য গর্ভাবস্থায় মায়েদের অতি সতর্কভাবে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই সময় রাগ-হিংসা-দ্বেষ-লোভ প্রভৃতি আয়ত্তের মধ্যে রাখতে হয়। তাই আয়ুর্বেদে প্রতিমাসে সাধভক্ষণের উল্লেখ রয়েছে। মনকে ভালো রাখার জন্য পড়াশোনা-গানবাজনা-নানা প্রকারের জ্ঞানমূলক আলোচনার মধ্যে থাকতে হয়। জন্মের পর থেকেই মাতৃদুগ্ধ পানই শ্রেয়। আপাতত ৬ মাস, তারপর অন্যান্য খাবারের সঙ্গে সঙ্গে মায়ের দুধ ২ বছর বয়স পর্যন্ত খেতে পারলে শরীর ও মনের গঠনটা মজবুত হয়।
আগেকার দিনে তেল মাখানো, দূর্বা-হলুদ মিশ্রিত জলে স্নান করানো প্রভৃতি নানাপ্রকার নিয়মের মধ্যে শিশুকে রাখা হতো। মাকে ২-৩ মাস খুব সাবধানে থাকার নির্দেশ ছিল। আজকাল অনেক নিয়ম বদলে গেছে। বাচ্চাদের জন্মের সময় থেকেই টীকাকরণ বা ভ্যাকসিনেশন শুরু হয়ে যায়। চলে প্রায় ৫ বছর পর্যন্ত। আগেকার দিনে শিশুমৃত্যু ও প্রসবের সময় মায়ের মৃত্যু আকছার ঘটত। এখন অনেক উন্নতি হয়েছে। যার ফলে জীবনের প্রথম ভাগটা ভালোভাবেই গড়ে ওঠে।
আয়ুর্বেদের চিকিৎসা ব্যবস্থার মধ্যে মা ও শিশুর চিকিৎসা বিধান রয়েছে। চিকিৎসা ব্যবস্থার সুবিধার্থে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রকে আট ভাগে ভাগ করা হয়েছিল। প্রত্যেক বিভাগে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকটি বিষয়কে নিয়ে বহু গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। পরবর্তীকালে সেগুলির অধিকাংশই নষ্ট হয়ে গেছে। এখন মাত্র তিনটি মূলগ্রন্থ— চরক সংহিতা, সুশ্রুত সংহিতা, অষ্টাঙ্গ হৃদয় সংহিতা আছে। চিকিৎসাশাস্ত্রকে যে আটটি ভাগে ভাগ করা হয়েছিল, তা এইরকম ১) কায় চিকিৎসা (Works on the Practice of Medicine), ২) শল্যতন্ত্র (Works on Surgery), ৩) শালাক্যতন্ত্র (Works on Dieases of Eye, Ear, Nose, Throat etc), ৪) ভূতবিদ্যাতন্ত্র (Works on Mental Diseases), ৫) কৌমারভৃত্যতন্ত্র (Works on Diseases of Children), ৬) অগদতন্ত্র (Works on Toxicology), ৭) রসায়নতন্ত্র (Works on Methods of gaining Health and Longevity), ৮) বাজীকরণতন্ত্র (Works on Sexual invigoration)। প্রত্যেকটি শাখায় বহু গ্রন্থ সৃষ্টি হলেও সেগুলির সামান্য কিছু পাওয়া যায়। বহু পুস্তকের নামোল্লেখ থাকলেও সেগুলি পাওয়া যায় না অথবা দুর্লভ।
আদিকাল থেকে মানুষের কামনা— নীরোগ দীর্ঘায়ু লাভ। এজন্য জন্মের পর থেকেই নানাবিধ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জীবনকে পরিচালিত করতে হয়। মৃত্যুকে রদ করা যাবে না, কিন্তু তাকে বিলম্বিত করার চেষ্টা মানুষ করেই চলেছে। আর সেটি করতে হলে রোগকে প্রতিহত করে শরীর ও মনকে সুস্থ রাখতে হবে। এজন্য সঠিক আহার-বিহার (দৈনিক কাজকর্ম, যোগাসন, ভ্রমণ প্রভৃতি) এবং রোগের জন্য ওষুধের প্রয়োজন।
শরীরকে সুস্থ রাখতে হলে আয়ুর্বেদের স্বাস্থ্যবৃত্ত অধ্যায়টি সম্বন্ধে ভালোভাবে জানা দরকার। সেখানে আলোচিত হয়েছে— স্বাস্থ্য কী, তার লক্ষণ কী, শরীরে বায়ু-পিত্ত-কফের বৃদ্ধি ও ক্ষয়কে কীভাবে সাম্যাবস্থায় রাখা যায়। শরীরের অভ্যন্তরীণ বিষ ও টক্সিনকে কীভাবে বের করা যায়, তা বলা হয়েছে। সকালে শয্যাত্যাগ থেকে রাতে শয্যাগ্রহণ পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়টিতে নিত্যকার্যাদি যেমন— শয্যাত্যাগ, মুখ ধোওয়া, দাঁত মাজা, প্রাতকৃত্য সারা, তৈলমর্দন, স্নান, বস্ত্রধারণ, আহার ও মুখ ধোওয়া, দাঁত পরিষ্কার করা, তারপর কর্মে যুক্ত হওয়া। রাতে ফিরে বাড়িতে বিশ্রাম আহার এবং শয্যাগ্রহণ প্রভৃতি প্রত্যেকটি বিষয়ের ভালো-মন্দের বিচার-বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দিবা বা রাত্রি ভেদে, ঋতুভেদে রকমফের করা হয়েছে শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার জন্য।
বিহার অর্থে বিভিন্ন কাজকর্ম অর্থাৎ জীবনধারণের জন্য, পড়াশোনার জন্য যার যেমন কাজ তা সম্পন্ন করা এবং তারই ফাঁকে ফাঁকে ব্যায়াম, প্রাণায়াম, যোগাসন, উপাসনা, ভ্রমণ প্রভৃতির মাধ্যমে শরীরচর্চা প্রভৃতি বোঝায়। শরীর থাকলে কিছু না কিছু রোগ তো আসবে। যত বেশি বয়স হবে, ততই ঝামেলা হতে থাকবে। আর সেজন্য আছে ওষুধ-আহার-বিশ্রাম প্রভৃতি। শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকলে নানারকম সমস্যা পর পর আসতে থাকবে। এই সবকিছুকে এড়িয়ে ভালো থাকতে চাইলে রসায়ন ও বাজীকরণ চিকিৎসার সুযোগ নিতে হবে। সেজন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ সেবন করতে পারলে শরীরে চামড়া ও চুল ভালো থাকবে এবং টেস্টোস্টেরন হরমোনের অভাব পূরণ কিছুটা তো হবেই। মেয়েদের মেনোপোজের পর এটি কমে যায়, সেইসঙ্গে মনের মধ্যে উৎফুল্লতা কমে, ধীরে ধীরে বুড়িয়ে যেতে থাকে। পুরুষদেরও এমন একটা অবস্থা হতে পারে, তখন সেটিকে অ্যান্ড্রোপোজ বলা হয়। এ প্রসঙ্গে বলে রাখি, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, কারিপাতা, হলুদ, দারুচিনি, ধনে, লবঙ্গ, মরিচ, কালোজিরে প্রভৃতি হার্টের পক্ষে খুবই ভালো।
নীরোগ শরীরকে জরা-ব্যাধির হাত থেকে দীর্ঘকাল রক্ষা করার উপায় রসায়ন চিকিৎসার অন্তর্গত। মোটামুটি কয়েকটি তথ্য প্রথমে তুলে ধরার পূর্বে একটা কথা বলে রাখি— ছোটবেলা থেকে মনটাকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করা আসল কাজ। সে শিক্ষা প্রথমত মা-ই দিতে পারেন, তারপর বাবা ও অন্যরা। সেখানেই যদি গলদ থেকে যায়, তাহলে পরবর্তী নিয়ম-কানুন যতই মানার চেষ্টা করুন, ফাঁকি থেকে যাবে এবং ভবিষ্যৎটা অন্ধকারে ডুবে যাবে। সংসারের অবস্থা দেখে বুঝতে পারছেন না? মা যদি ছোটবেলা থেকে স্বার্থপর হিসেবে গড়তে না চান, তার মনে রাগ-হিংসা-অহংকার-বিবেকহীনতা প্রভৃতি বিষাক্ত বীজ যদি বপন না করেন, পরের জন্য কিছু ভাবনা, সমাজ-সংসার, দেশ সম্বন্ধে ইতিবাচক বীজ পুঁতে দেন, সে সন্তান সুস্থ থেকে সমাজের একজন হতে পারবে। এবার দৈনন্দিন নিত্যকর্মাদি নিয়ে ভাবনাও মনের ভেতর সে গ্রহণ করবে। চিরদিন কিছু কথা মেনে চলা, যেমন—
১. সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্ব মুহূর্তে শয্যাত্যাগ করা উচিত।
২. খালিপেটে সামান্য জল পান করার পর প্রাতঃকর্মাদি সেরে ফেলা।
৩. তারপর দাঁতমাজা। এজন্য কিছু নির্বাচিত গাছের ডাল (নিম, করঞ্জা, অপ মার্গ প্রভৃতি) ব্যবহার করতে পারেন অথবা চিকিৎসকের পরামর্শমতো বাজারজাত মাজন ব্যবহার করুন। জিভছোলার জন্য সোনা-রূপা-তামার তৈরি কিংবা এই তিনটির মিশ্রণে তৈরি জিভছোলা ব্যবহার করুন। একবার তৈরি হয়ে গেলে সারাজীবন চলতে পারে। উপহার হিসেবে দেওয়া-নেওয়া শুরু হোক না।
৪. দিনে ঘণ্টাখানেকের মতো ব্যায়াম ও প্রাণায়াম/ হাঁটা/ সাইকেল চালানো/ সাঁতার প্রভৃতির যে কোনও একটা করা উচিত। বয়স্কদের জন্য পায়ে হাঁটা ভালো।
৫. শরীরে যে কোনও একটি তেল মালিশ করে হালকা গরম জলে স্নান করে নেওয়াটা উচিত। কিন্তু বর্তমানের প্রেক্ষিতে একটা অদলবদল হতে পারে। পছন্দের যে কোনও একটি তেল লাগানোই ভালো। তবে ডাক্তারের নিষেধ থাকলে অন্য ব্যবস্থা করা যায়।
৬. নিয়মিত সময়ে খাওয়া-দাওয়া করা। সকালে জলখাবার কোনও পানীয় দিয়ে শুরু করবেন না। দুপুরে ও রাতে খাওয়ার মাঝখানের সময়টা ১০-১২ ঘণ্টা থাকলে সবচেয়ে ভালো। রাতের খাবার ১০টার মধ্যে সেরে ১১টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ুন। রাতে খাওয়ার ঘণ্টাখানেকের মধ্যে শুয়ে পড়ুন।
৭. জল পান খাওয়ার আগে ও পরে শ্রেয়। তবে প্রয়োজনে মাঝে সামান্য জল খেতে পারেন।
৮. বাড়ির তৈরি খাবার খাওয়ার অভ্যেস করা উচিত। সেই রান্নাগুলোও সঠিক নিয়মে করা উচিত। নুন, চিনি, ময়দা জাতীয় দ্রব্য খুব কম খেতে হবে। চিনির পরিবর্তে গুড় বা মধু ব্যবহার করতে পারেন। নুডলস না দিতে পারলে ভালো, তবে খুব কম খেতে দিতে হবে বাচ্চাদের। মায়েরা চিঁড়ে-মুড়ি-পান্তাভাত-খিচুড়ির পরিবর্তে সহজে মুখরোচক খাদ্য তৈরি করে বাচ্চাদেরকে খেতে দেন।
৯. কম পরিমাণে তাজা, পুষ্টিকর ও সহজপাচ্য খাদ্য খাবেন।
১০. ফাস্ট ফুড, জাংক ফুড, রং করা খাদ্যদ্রব্য, ফ্রিজের খাবার, অতিরিক্ত তেল-ঘি-চর্বি সংযুক্ত মশলাদার খাবার, গুরুপাক দ্রব্য, বাসি ও ঠান্ডা খাবার, ভাজাভুজি ও পোড়া খাদ্য যতটা কম খাওয়া যায়, ততটাই মঙ্গল।
১১. গ্রিন টি, পাতা চা, হারবাল টি, কফি, ডাবের জল, লেবুর রস ও মধু যুক্ত জল, ঘোল, ফলের রস বা তাজা ফল চিবিয়ে খাওয়া, সবুজ শাকসব্জি, লেবুর রস মাখানো স্যালাড, মরশুমি শাকসব্জি-ফলমূল নিয়মিত কমবেশি খাবেন।
১২. রাতের ঘুম গাঢ় অন্ধকারে ৬-৮ ঘণ্টা হলেই ভালো, না হলে কমপক্ষে ৬ ঘণ্টা। এটি না মানলে মস্তিষ্কের ক্ষতি হয় বেশি। পরবর্তীকালে অনিদ্রা, ডিমেনশিয়া, অ্যালঝাইমার্স, পারকিনসনস প্রভৃতি রোগের সম্ভাবনা থাকে।
১৩. দিবানিদ্রা সকলের জন্য নয়। ১০-১২ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু, ৬০ বছরের অধিক বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, গর্ভিণী ও প্রসূতি, রোগাক্রান্ত ব্যক্তি ও রোগ সেরে যাওয়ার পর দুর্বল ব্যক্তিরা দিনের খাওয়ার পর কিছুটা সময় দিবানিদ্রা দিতে পারেন। যাঁরা মাঠে-ঘাটে, কলকারখানায় কাজ করার পর দুপুরের আহার ১টা থেকে ২টার মধ্যে করেন, তাঁদের ঘণ্টাখানেক বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন, ঘুমোনো নয়।
১৪. চলাফেরা, বেড়ানো, টিভি দেখা, পড়াশোনা করার সময় খাওয়া-দাওয়া ঠিক নয়। খুব ধীরে ধীরে বা তাড়াতাড়ি খাওয়াও ভালো নয়। শহরাঞ্চলে প্রায় প্রতি বাড়িতে টেবিলে বসে খাওয়া হয়। আড্ডা দিয়ে খাওয়াটা ভালো হয়, একটু বেশি খাওয়া হয়ে যায়। যাঁরা মেঝেতে বাবু হয়ে বসে খান, তাঁরা শরীর ও মনের দিক থেকে অনেক সুবিধা ভোগ করেন। তাঁদের শরীরের ভেতরে এমন কিছু পরিবর্তনের আভাস পাওয়া যায়, সেগুলি হল— খাবার বেশি খাওয়া যায় না, দ্রুত হজম হয়, মনের মধ্যে একটা তৃপ্তিবোধ হতে থাকে, যার ফলে মানসিক চাপ কমতে থাকে। দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভালো থাকে। পেশি শক্তিশালী হয়, নিম্নাঙ্গে সমস্ত গাঁট সুস্থ থাকার পাশাপাশি কোমর, হাঁটু, গোড়ালির ব্যায়াম হয়ে যায়, হঠাৎ আড়ষ্টভাব আসে না। গাঁটে ব্যথা ও কোমরের ব্যথা থাকলে তাতে উপকার মেলে। রক্ত সঞ্চালন ভালো হওয়ার জন্য হৃৎপিণ্ডটি ভালো থাকে। মেদ জমতেও পারে না। অনেক উপকার, যদি পারেন মাঝে মাঝে খেয়ে দেখুন।
১৫. খিদে পেলে খাবেন। ঠিকসময়ে নিয়মিত খেতে পারলে দিনের একটা সময়েই ক্ষুধার উদ্রেক হবে। পূর্বের খাবার হজম না হলে পুনরায় খাবেন না। অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম খাবার খাবেন না। জল গ্লাসে করে খাওয়ার অভ্যেস করুন। বোতলের জল হাঁ করে খাবেন না। খেলে বদহজম, অম্ল, বায়ুর উপদ্রব প্রভৃতি দেখা দিতে পারে। রাতে এক গ্লাস জল তামার পাত্রে রেখে ভোরে উঠে খেয়ে নিন।
১৬. দুধ-দই-ঘোলের সঙ্গে কলা মিশিয়ে খাবেন না। দুধের সঙ্গে তো নয়ই। দুধের সঙ্গে লবণ খেতে নেই। মাছ-মাংস-ডিম রান্নার সঙ্গে দুধ বা দই মেশাবেন না।
১৭. মাছ-মাংস-ডিমের যেকোনও একটি পদ দিয়ে খাওয়া শেষ করুন। একসঙ্গে দুটি বা তিনটি খাবেন না। কোনও রান্নাতে আদা ও রসুন একসঙ্গে ব্যবহার করবেন না। মাছের তরকারিতে রসুন দেবেন না।
১৮. পাঁচফোড়নের ৫টি দ্রব্য একসঙ্গে বা পৃথক পৃথকভাবে ফোড়ন হিসেবে ব্যবহার করবেন। গুঁড়ো করে বা ভেজে বিশেষ কোনও রান্না ছাড়া নিত্যাদিনের রান্নায় দেবেন না।
১৯. রাতে দই ও বর্ষায় ছাতু খাওয়া নিষিদ্ধ।
২০. টক দই বা ঘোল খাওয়া উচিত। কিন্তু আমিষ খাওয়ার ঠিক পরেই খাবেন না। গরমের দিনে ঘোল আর শীতের দিনে টক দই খাওয়া ভালো। অন্যসময় ভেবেচিন্তে খেতে হবে। মিষ্টি দই কোনও সময়েই খাবেন না। ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় বলেছেন— ভালো ভালো খাবার খাওয়ার পর একবাটি মিষ্টি দই খাওয়া মানে এক বাটি বিষপান করা। মাছ-মাংস-ডিম যেকোনও একটি দিয়ে খাবার খাওয়ার ঘণ্টাচারেক পরে টক দই খেতে পারেন। টক দইতে গুড় মিশিয়ে মিষ্টি দই বানাতে পারেন।
২১. শোওয়ার সময় দুধ খাওয়া ভালো। যেদিন নিরামিষ খাবেন সেদিন। অধিক বয়সে দুধ ততটা উপকারী নয়। সেক্ষেত্রে ঘোল, ছানার জল, ছানা, টক দই প্রভৃতি খেতে পারেন।
২২. নিয়মমাফিক উপবাস করা ভালো। যখন-তখন উপবাস বা অনিয়মিত উপবাস করা উচিত নয়। উপবাসের পর প্রথমে দু’চারটে খেজুর খেয়ে তারপর নিরামিষ রান্না খেয়ে উপবাস ভাঙতে হবে। মাঝে মাঝে নিরামিষ খাবেন, তখন টক দই খেতে পারেন। আয়ুর্বেদশাস্ত্রে মাছ-মাংস-ডিম খাওয়া স্বীকৃত।
২৩. হালকা রঙের পোশাক, বিশেষত হালকা নীল বা আকাশি রঙের পোশাক-পরিচ্ছদ স্বাস্থ্যকর।
২৪. পানীয় জলের সমস্যা প্রায় সর্বত্র। বিচার-বিশ্লেষণ করে জল খাবেন।
২৫. অমাবস্যা-পূর্ণিমায়-একাদশীতে নিরামিষ খাবেন। উপবাসও করতে পারেন।
২৬. কাঁসা, স্টিল, কাচ বা চিনামাটির পাত্র বা থালাবাটি ব্যবহার করুন। পদ্মপাতা, শালপাতা বা কলাপাতা ব্যবহার করা যায়। তবে তা দিয়ে নিত্যদিনের আহার সমাপ্ত করা সহজ নয়। প্লাস্টিক, কাগজ বা থার্মোকলের থালা-বাটি-গ্লাস-চায়ের কাপ প্রভৃতি কোনও মতেই ব্যবহার করবেন না।
২৭. পলিপ্যাকে বাজার করবেন না। পলিপ্যাকের সঙ্গে চামড়ার সম্পর্ক হলে ক্ষতির সম্ভাবনা প্রবল। এমনকী কাঁচা শাকসব্জি, কাটা মাছ মাংস, ফলমূল পলিপ্যাকে রাখবেন না। খবরের কাগজে প্যাক করেও রাখতে নেই। পলিপ্যাকের সান্নিধ্যে শরীরের কোনও অংশ বারবার ঘষা খেলে চামড়ায় ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।
২৮. ডিম কেনার পর ভালোভাবে ধুয়ে ফ্রিজে বা রান্নাঘরে রাখুন।
২৯. ফ্রিজ ব্যবহারে অনেক রকমের সতর্কতা আছে, তা জেনেবুঝে ব্যবহার করবেন। কোন দ্রব্য কীভাবে রাখবেন, কতদিন রাখবেন তা জেনে নেবেন।
৩০. ডিম ও দুধ ভালোভাবে না ফুটিয়ে খাবেন না।
৩১. একটানা বেশিক্ষণ বসে কাজ না করে, মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে, হেঁটে পুনরায় কাজ শুরু করবেন।
৩২. ঋতুকালীন ও ঋতুসন্ধিকালীন দিনযাপন সাবধানে করতে হয়।
৩৩. মল ত্যাগ, প্রস্রাব, পিপাসা, বমি, খিদে, হাঁচি, কাশি, প্রভৃতির বেগ এলে তা আটকে রাখতে নেই। মোট ১৩ প্রকার বেগ আছে।
৩৪. রাত জেগে পড়াশুনা, টিভি দেখা, কম্পিউটার বা ল্যাপটপ চালানো একেবারে উচিত নয়। এখন রাত জেগে মোবাইল দেখাটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। যন্ত্রপাতি থেকে নিঃসৃত হালকা রশ্মিও ক্ষতিকর। শরীর ও মনের পুরো সিস্টেমটাই উলট-পালট হয়ে যায়। রাত না জেগে সকালে তাড়াতাড়ি উঠে সেই কাজই সারুন। রাতে নাইট বাল্বও জ্বালাবেন না।
৩৫. শ্রাবণ মাসে শাক, ভাদ্র মাসে দই ও লাউ এবং আশ্বিনে দুধ নিষিদ্ধ। বর্ষাকালে ও রাতে শাক না খাওয়াই ভালো, বিশেষত পত্রশাক।
৩৬. ধূমপান ও ধূমহীন নেশা করবেন না। যত রকমের নেশা আছে ত্যাগ করুন।
৩৭. কথায় কথায় অম্বলের ওষুধ খাবেন না। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনও ওষুধ বা মলম লোকের কথা শুনে ব্যবহার করবেন না। অ্যান্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েড ঘটিত ওষুধ কোনওভাবেই নিজে নিজে খেতে বা লাগাতে যাবে না।
৩৮. শিশুকে মাতৃদুগ্ধ তার জন্মের ঘণ্টাখানেকের মধ্যে খেতে দেবেন।
৩৯. তালশাঁস খাওয়ার পর গুড় ও কাঁঠাল খাওয়ার পর দুধ খেলে কোনও সমস্যা আসতে পারবে না।
৪০. সারাদিন ২-৩ ঘণ্টার বেশি টিভির সামনে বসলে পুরুষদের প্রজনন প্রক্রিয়া ব্যহত হবে। রাত্রিজাগরণ ও দিবানিদ্রা ভয়ঙ্কর ক্ষতিকর। রাত ১১টার পরে শুতে গেলে নারী ও পুরুষ সকলেরই সমস্যা বাড়বে।
৪১. খাদ্যে বাছবিচার— কোনটা কখন খেতে নেই, কোনটার সঙ্গে কোনটা খেতে নেই, কোনটা কাঁচা কোনও পাকা খেতে হবে, কোনটা সিদ্ধ করে জল ফেলে রান্না করতে হবে, তা একটু বিচার করে খাবেন। ভিটামিন আর ক্যালোরি বিচার করে সত্যি সত্যি পথ্য নির্বাচন করা খুবই কঠিন কাজ। কু-সংস্কার ভেবে ফেলে দেবেন না।
৪২. প্রসাধনী দ্রব্য সাবধানে ব্যবহার করা উচিত। সবচেয়ে ভালো হবে— কোনও চর্মরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করতে পারলে। পরিবেশ-পরিস্থিতি-কাল-জলবায়ু-শারীরিক গঠন-খাদ্যাভ্যাস বিচার করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হয়। সবকিছুর মধ্যে খাদ্যেরও পরম্পরা আছে, পূর্বপুরুষরা যে জিনিস খেয়ে আসছেন, সেটা খেলে শরীরের বিশেষ কোনও ক্ষতি হবে না। একেই বলে সাত্ত্বিক আহার।
৪৩. অবসর সময়ে বই-পত্র-পত্রিকা পড়ুন প্রয়োজনে কিছু কিছু লিখে রাখুন। বার্ধক্যে বাগান, চারাগাছ তৈরি সৃষ্টিধর্মী কাজ, বাচ্চাদের নিয়ে সময় কাটাবেন। স্ত্রীকে অফুরন্ত সময় দেবেন।
৪৪. কোনওকিছুর অতিরিক্ত ভালো নয়। রাগ-লোভ-হিংসা-অহংকার-পরশ্রীকাতরতা বাদ দিয়ে বাঁচুন।
যে খাদ্য খাই না কেন, তার মূল উপাদান হল— শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফ্যাট আর প্রতিটি কোষ তা খাদ্য হিসেবে নিয়ে থাকে। শারীরিক বিপাকক্রিয়ায় উৎপন্ন মল বা বর্জ্য ও বিষাক্ত পদার্থ জমতে থাকে। সেগুলিকে প্রত্যহ বের করে দিতে পারলে শরীর বুড়িয়ে যাবে না। অম্লধর্মী ও ক্ষারধর্মী পদার্থ দু’ভাগে শরীরে ঢোকে। অম্লধর্মী খাবার আমরা বেশি খাই, যেমন মাছ-মাংস-ডিম, দানাশস্য, চা, কফি, ময়দা, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য প্রভৃতি। ক্ষারধর্মী খাদ্য মূলত শাকসব্জি, ফলমূল— অথচ আমরা কম পরিমাণে খাই। এদিকে প্রোটিন ও শর্করা থেকে শরীর অম্লধর্মী বর্জ্য তৈরি করে। অম্লধর্মী বর্জ্য ও বিষাক্ত দ্রব্যগুলি ঘাম ও মল-মূত্রের মাধ্যমে বেরিয়ে যাওয়ার কথা, কিন্তু অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাত্রা এবং মদ্যপান, ধূমপান, খৈনি, জর্দা, নস্যি অতিরিক্ত মাত্রায় হলে, ক্ষারধর্মী জল কম খেলে তা বেরতে পারে না, কোষে কোষে জমা হয়। ক্ষারধর্মী খাদ্য কম খাওয়ায় ইউরিক অ্যাসিড শরীর থেকে বেরতে পারে না, সেগুলি গাঁটে গাঁটে কোষে কোষে জমা হতে থাকে। শরীরে জমে থাকা বর্জ্যপদার্থগুলি তাড়াতাড়ি বুড়িয়ে দেয়, হঠাৎ বার্ধক্য আসার এটি মূল কারণ। অল্প বয়সে রক্তে ক্ষারের পরিমাণ স্বাভাবিক (পিএইচ ৭.৪৪) থাকলেও বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমতে থাকে। এখানেই সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার। পিএইচ-টা ঠিক রাখতে পারলে, বয়স বাড়তে থাকবে, তবুও বুড়োটা মনে হবে না। ক্ষার অম্লকে অনেকটা নষ্ট করে দেয়।
খাদ্যে নানাপ্রকার অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট থাকায় শরীরকে রোগমুক্ত করে বার্ধক্যকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে। আয়ুর্বেদের চিন্তা ভাবনায় অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট নিয়ে কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তবে তাঁরা যেসব শাকসব্জি, ফলমূল, ঔষুধি দ্রব্য নির্বাচন করে গিয়েছেন, সেগুলির অধিকাংশই আজকের দিনের অ্যান্টি-অক্সিড্যান্টের বাহক। কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
টাটকা শাকসব্জি, আপেল, বেদানা, কিশমিশ, মনাক্কা, আমন্ড-আখরোট-পেস্তা-কাজু-চিনে বাদাম প্রভৃতি। আম, জাম, আতা, আনারস, খেজুর, ডাব ও নারকেল, কলা, পেয়ারা, পেঁপে, কমলা, কালো আঙুর, মিষ্টি আলু, মধু, আমলকী, হরীতকী, বহেড়া, চিরতা, যষ্ঠিমধু, অশ্বগন্ধা প্রভৃতি। বেদানা ইত্যাদি বীজসমেত হয়, এগুলি শক্তিশালী অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট সমৃদ্ধ। বেদানা ব্রেস্ট ও ফুসফুসের ক্যান্সার প্রতিরোধক। ধমনীর ভেতরের ময়লা সাফ করে। ত্বকে বয়স্কের ছাপ পড়ে না। দীর্ঘ যৌবন লাভের সঙ্গে নারী ও পুরুষ সবল সক্ষম থাকে। বাদাম জাতীয় খাদ্য, স্ট্রবেরি, মিষ্টি আলু, বিন জাতীয় খাদ্য, লাল শাক, পালং শাক, মেথি শাক, বেতো শাক, কুলেখাড়া, লাউশাক, পুঁই শাক প্রভৃতি বার্ধক্য প্রতিহত করে। আঙুরের বীজে ও গ্রিন টি-তে যেসব অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট পাওয়া যায় সেগুলি অত্যধিক শক্তিশালী। আঙুরের বীজে থাকে অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট- অলিগোমেরিক প্রো-অ্যান্থাসায়াসিন। এটি ভিটামিন-ই এর চেয়ে ৫০ গুণ ও সি এর চেয়ে ১০ গুণ বেশি শক্তিসম্পন্ন। গ্রিন টি থেকে প্রাপ্ত অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট ভিটামিন-ই এর চেয়ে ২০ গুণ ও সি-এর চেয়ে ১০০ গুণ অধিক শক্তিশালী। এগুলি বার্ধক্যকে বিলম্বিত করতে পারে।
শরীরে ক্ষার ও অম্লের সমতা থাকা উচিত। আর ভারী ধাতু— মার্কারি (পারদ), লেড (সীসা), সেঁকো বিষ (আর্সেনিক), ক্যাডমিয়াম প্রভৃতি যাতে শরীরে ঢুকতে না পারে সেদিকে নজর দিতে হবে। খাদ্যের মাধ্যমে শরীর ভালো থাকলেও যৌবনের শেষাশেষি রসায়ন ও বাজীকরণ ওষুধ খাওয়ার প্রসঙ্গ রয়েছে আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে। কী কী খাবেন আর কী কী খাবেন না, এ সম্বন্ধে চিকিৎসকের পরামর্শ নেবেন। শরীর সুস্থ রাখতে চাইলে অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-কড়াতে রান্না করবেন না। ফলে শরীরে এটির পরিমাণ বেড়ে গিয়ে পাকস্থলী, কোলন ও মস্তিষ্কের ক্ষতি (বুদ্ধিহীনতা) করবে।
বয়স হলে, রিটায়ারমেন্টের পর অথবা চাকরি না করে ব্যবসা বাণিজ্য-চাষাবাদ থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখে বিশ্রাম জীবনযাপন করতে চাইছেন, তাঁদের উচিত নিজেদের পছন্দমতো কাজ বেছে নেওয়া, তা থেকে হয়তো তেমন আয় হবে না, কিন্তু মানসিক শান্তি পেতে পারেন। এছাড়া বই পড়া, গান শোনা, টুকিটাকি লেখালেখি, বয়স্কদের বিনোদের আখড়ায় কিছুটা সুখ-দুঃখের অংশীদার হওয়া, শিশুদের কাছে কিছুক্ষণ শিশু হয়ে যাওয়া, এসব জীবনকে বাঁচতে শেখায়। যতদিন পারবেন নিজের কাজ নিজেই করবেন। সামান্য কষ্ট হলেও আনন্দ ও তৃপ্তির স্বাদ পাবেন।
এবার রসায়ন ও বাজীকরণ ঔষধের প্রসঙ্গে আসা যাক। আদিকাল থেকে মানুষের কামনা—স্বাস্থ্যকর নীরোগ দীর্ঘজীবন বা দীর্ঘায়ু লাভ। রসায়ন ওষুধ ব্যবহারে আয়ু, দেহ ও ইন্দ্রিয়ের বল, স্মৃতি ও মেধার বৃদ্ধি ঘটে এবং সমগ্র শরীরের পুষ্টি সাধন, রোগপ্রতিহত করার ক্ষমতা বৃদ্ধি, শরীর ও মনকে সর্বদা তাজা রাখতে সাহায্য করে। রসায়ন অর্থে কেবল ওষুধ নয়, তিনটি পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়— ওষুধ, পথ্য ও বিহার (দৈনন্দিন কাজকর্ম, শরীচর্চা প্রভৃতি)। উদ্দেশ্য— স্বাভাবিক স্বাস্থ্যরক্ষা, সুস্থ ও দীর্ঘ জীবনলাভ, স্মৃতি-মেধা-বুদ্ধি এবং যৌবন ও কান্তি লাভ। বয়স তো থেমে থাকবে না, সে তো বাড়তেই থাকবে। তা বাড়তে থাকুক, কিন্তু বুড়ো হওয়া চলবে না। আমৃত্যু তরতাজা-লাবণ্যমণ্ডিত চেহারা থাকবে। সেজন্য শরীরের বড় অংশ চামড়া যেন ভালো থাকে। রসায়ন ওষুধ দু’ভাগে ব্যবহার করা যায়। ১) রোগ বিনাশের জন্য। ২) সুস্থাবস্থায় ব্যবহারের জন্য। সুস্থাবস্থায় ব্যবহৃত ওষুধসমূহকে ২ ভাগে ভাগ করা হয়— রসায়ন ও বাজীকরণ। যেসব ওষুধ সেবনে হঠাৎ অকালবার্ধক্য আসতে পারে না, পুষ্টি ও পরমায়ু বৃদ্ধি পায়, সেগুলিকে রসায়ন ওষুধ বলা হয়। যেসব ওষুধ সেবনে পুরুষদের অশ্বের ন্যায় শক্তি জন্মে, সেগুলিকে বাজীকরণ ওষুধ বলে। এসব ওষুধ বালক ও বৃদ্ধদের (৭০ এর পরে) দিতে নেই। আবার চবনপ্রাশ একটি রসায়ন ওষুধ হলেও সব বয়সের মানুষ— নারীপুরুষ নির্বিশেষে খেতে পারে।
দীর্ঘকাল যৌবনকে ভোগ করার বাসনায় রসায়ন ও বাজীকরণ ওষুধের উত্তরোত্তর বৃদ্ধি। তাতে সমাজের সামান্য কিছু মানুষের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হতো। কিছু রসায়ন ও বাজীকরণের ওষুধের তালিকা দেওয়া হচ্ছে, যেগুলি চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাবেন না। যেমন— ভৃঙ্গরাজাদি চূর্ণ, শ্রীসিদ্ধমোদক, শ্রীমদনানন্দ মোদক, অশ্বগন্ধারিস্ট, মৃত সঞ্জীবনী সুরা, অষ্টাবক্র রস, মণ্মথ রস, নির্গুণী কল্প, বসন্ত কুসুমাকর রস, ত্রৈলোক্য চিন্তামণি রস, বৃহৎ পূর্ণচন্দ্র রস, ঋতু, রিতকী, শ্রীমহালক্ষ্মী বিলাশ রস, অমৃতার্নব রস, মকধ্বজ রসায়ন, নীলকণ্ঠ রস, অমৃতসার লৌহ, শিলাজতু রসায়ন, ত্রিফলা রসায়ন প্রভৃতি।
তবে বার্ধক্যে শিলাজতু রসায়ন ও মকরধ্বজ রসায়ন ব্যবহার করা যায় খুব সহজে, তবে তা চিকিৎসকের মতানুসারে। মকরধ্বজচূর্ণ, রসসিন্দুর চূর্ণ, কস্তুরী-মকরধ্বজচূর্ণ সাধারণ চিকিৎসা ও রসায়ন চিকিৎসায় ব্যবহার্য। হস্তীকর্ণ পলাশের মূলচূর্ণ ৫০০ মিলিগ্রাম থেকে ১ গ্রাম মাত্রায় মধু বা ঘৃত সহ দিনে একবার খেয়ে তারপর আহার করলে অশ্বের ন্যায় বলিষ্ঠ, মেধাবি, দীর্ঘজীবী ও বলবান হওয়া যায়। এটি রসায়ন ও বাজীকরণের সহজলভ্য ভালো ওষুধ। যৌবনের পর থেকে মাঝে মাঝে প্রয়োজনমতো খেতে পারেন।
লেখক : ভারত সরকারের আয়ুর্বেদ গবেষণা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসাবিজ্ঞানী, বনৌষধি গবেষক আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ও অধ্যাপক