স্বামী বিবেকানন্দ বলে গেছেন, মৃত্যু চিন্তা ভালো। কারণ এই জগৎ কতটা মিথ্যা সেটা বোঝার জন্য। তবে মৃত্যুভয় ভালো নয়। জগতের বড় বিস্ময় মৃত্যু। মৃত্যুকালে মানুষের শুদ্ধ চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দেয় অন্ধকার। সাধক-যোগীরা সেই অন্ধকারকে কাটাতে পারেন। বীরের মতো দেহ ছেড়েছেন বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী, রাম ঠাকুর, বালানন্দ ব্রহ্মচারি, নিগমানন্দ ঠাকুর, পরমহংস যোগানন্দ স্বামী, দুর্গাপুরী মাতাজি। মৃত্যুযোগ যাঁরা অভ্যাস করেন তাঁরাই নিজের মৃত্যুকালটি জানতে পারেন। সাধারণ মানুষ কীভাবে বুঝবেন মৃত্যুকাল আসন্ন? মৃত্যুকালে মানুষের মুখ কেন খোলা থাকে? শাস্ত্রে আছে, কারও যদি মনে হয় সূর্যের তেজ কমে আসছে, তাহলে তার আয়ু বেশিদিন নেই। রয়েছে আরও কিছু পূর্ব লক্ষণ। মৃত্যুর পূর্বে মানুষ নানারকম স্বপ্ন দেখেন, কী সেই স্বপ্ন? লিখেছেন সোমব্রত সরকার।
মৃত্যুর ঠিক আগে
মানুষের মধ্যে রয়েছে জ্ঞান আর আনন্দ। উপনিষদের ঋষি নিজের মধ্যে এই দুটি বিদ্যাকে আবিষ্কার করার পন্থা আমাদের শিখিয়ে গিয়েছেন। ঋষি বললেন, ‘নিজের শরীরের মধ্যে শুদ্ধ চৈতন্য এবং শুদ্ধ আনন্দ আবিষ্কার করতে হবে। হৃদয় থেকে নিষ্কাশিত হবে শুদ্ধ জ্ঞান ও অমৃত সমান আনন্দ।’
শিষ্য বলল, ‘কী করে হবে গুরুদেব?’
আচার্য ঋষি বললেন, ‘এটা এক-দু’দিনে হওয়ার মতো ব্যাপার নয়। অসীম ধৈর্যের সঙ্গে হৃদয়-কন্দরে ঢুকতে হবে, আবার ভেতর থেকে বাইরে বেরতে হবে সেখানকার শান্ত- নির্জন তন্ময়তার আবেশ নিয়ে। এরকম যদি করতে পার দিনের কোনও নির্দিষ্ট সময়ে, নেশা লেগে থাকবে শরীরে। এইরকম করে ক্রমশ বাইরেটা তোমার রূপান্তরিত হয়ে যাবে।’
নচিকেতা এই তত্ত্ববিদ্যা এবং যোগবিধি শিখতে গিয়েছিলেন মৃত্যুর কাছে। কঠোপনিষদে উত্তর-প্রত্যুত্তর রূপে আছে শিষ্য নচিকেতা আর গুরু যমের কথাবার্তা। যম হলেন মৃত্যু, অর্থাৎ শূন্য। মৃত্যুকে জানতে হলে হতে হবে নচিকেতা। ন-চিকেতা— যে কিছু জানে না। গুরুর কাছে শিষ্য যাবে শুদ্ধ ও মৃদু হয়ে। গুরুর কোনও রং নেই, তিনি শূন্যবৎ অথচ তাঁর আকর্ষণ শক্তি রয়েছে। সাদা কাগজের মতো মন না হলে মৃত্যুকে কখনও জানা যায় না। মৃত্যুকে জানতে হলে শূন্য, রিক্ত হয়ে গুরুর কাছে যেতে হবে। এ হল পরম জ্ঞান। কঠোপনিষদের ঋষি আমাদেরকে সতর্ক করে বললেন, ‘যদি তুমি মনে কর জানো, তাহলে কিছুই জানো না। যদি মনে কর জানো না, তাহলে কিছু জেনেছ।’
যম বললেন, ‘মৃত্যুর দুটো অর্থ আছে, নচিকেতা। এক মরে যাওয়া— যখন চেতনা ও প্রাণ মানুষের শরীর থেকে চলে যায়। সে সাধারণ মৃত্যু। এবার যাঁরা যোগী, সাধক তাঁদের মৃত্যু এভাবে হয় না। কয়লার আগুন নিভে যাওয়ার মতন মানুষের মৃত্যু হয়। যোগীর যখন মৃত্যু হয় তখন প্রদ্যোৎ জ্যোতি ছড়িয়ে গিয়ে বিচ্ছুরিত হয়ে ওঠে।’
নচিকেতা প্রশ্ন করল, ‘সেটি কী গুরুদেব?’
যম বললেন, ‘দীপ্যমান এক দিব্যশক্তি থাকে যোগীর শরীরে। সাধারণ মানুষের চেতনা ঘা খেলে মুষড়ে পড়ে। যোগীর হৃদয় ঘা খেলে ঝলমল করে ওঠে। মানুষের মেরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে সৌরপথ, মস্তিষ্কে সৌরমণ্ডল। একে ভেদ করে এগিয়ে চলেন যোগীরা, সাধকেরা।’
নচিকেতার আবার প্রশ্ন, ‘মানুষ যখন ইহলোককে অতিক্রম করে, তারপর তার কিছু থাকে না?’
যম উত্তর দিলেন, ‘যারা মনে করে, এরপর কিছুই নেই, তারা পুনঃ পুনঃ মরে, তারা বারবার মৃত্যুর কবলে পড়ে। সাধকেরা মৃত্যুর পর পৃথিবীতে ফিরে আসেন না, সাধনার জোরে তাঁরা দেবযানের পথ ধরে এগিয়ে চলে যান। তাঁদের ক্রমমুক্তি ঘটে। মানুষেরা বিদেহ হয় মৃত্যুতে, যোগীরা বেঁচে থাকতেই বিদেহ হতে পারেন ধ্যানে, সমাধিতে। তাঁরা সর্বময় হয়ে যান। জগতের সঙ্গে একাকার হয়ে যান। যেমন বুদবুদ একটু ছুঁলেই সমুদ্রের সঙ্গে একাকার হয়ে যায়।’
জ্ঞানীদের মনের তিনপ্রকার অবস্থা থাকে। এক অবস্থাতে তাঁরা মনে করেন, আমরা সূর্য থেকে এসেছি, সূর্যের একেকটা কিরণ মাত্র। আরেক অবস্থার জ্ঞানীরা ভাবেন, আমরা সূর্যে ফিরে যাব। এর জন্য সাধনা করতে হবে। সাধনার মাধ্যমেই ফের সূর্যের সঙ্গে এক হব। উচ্চকোটির সাধক, যোগীদের অবস্থা শুধু সূর্যে পৌঁছনো নয়, সূর্যদ্বার ভেদ করে চলে যাওয়া— মহাশূন্যে পৌঁছনো।
উপনিষদের ঋষিরা সর্বোচ্চ স্তরের যোগী। তাঁরা বললেন, ‘এমন জায়গায় চলে যেতে হবে যেখানে সূর্যের প্রকাশ হয় না, সেখানে চাঁদ ও নক্ষত্রেরও দেখা মেলে না, বিদ্যুৎ চমকায় না, আগুনও জ্বলে না, কিছুই না, অথচ একটা কিছু রয়েছে যার প্রভায় সমস্ত শোভা পাচ্ছে। প্রভার অতীত যে সত্তা, মহাশূন্য, সেই অবস্থাতে পৌঁছতে হবে।’
ধ্যানে বসেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। বসামাত্র এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন হলেন, যেখানে সূর্য, চাঁদ, তারার আলো নেই। স্বামীজি দেখলেন সমগ্র মহাবিশ্ব আকাশে একটি ছায়ার মতো ভাসছে। মহাবিশ্ব উত্থিত হচ্ছে, ভাসছে এবং ডুবে যাচ্ছে। এই প্রক্রিয়া নিরন্তর চলেই যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ছায়াগুলো একটা বিরাট গর্ভে প্রবেশ করল। সেখান থেকে ধারা উঠল, ‘আমি, আমি।’ তারপর সেই ধারাও বন্ধ হয়ে শূন্যে মহাশূন্যে মিলিয়ে গেল। তিনি সমাধিতে প্রবেশ করলেন।
১৮৮৭ সালে মাদ্রাজে সমাধি সম্বন্ধে অন্তরঙ্গবৃত্তে বলবার পর স্বামী বিবেকানন্দ লিখলেন বিখ্যাত সেই গান, ‘নাহি সূর্য নাহি জ্যোতি নাহি শশাঙ্ক সুন্দর, ভাসে ব্যোমে ছায়া-সম ছবি বিশ্ব চরাচর।’ স্বামীজির কথাতে উপনিষদের ঋষিদেরই অনুরণন পাওয়া গেল।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য তাঁর স্ত্রী মৈত্রেয়ীকে মৃত্যু সম্বন্ধে বোঝাতে গিয়ে বললেন, ‘মানুষ যখন প্রয়াণ করে, প্রাকৃত ভূমি ছেড়ে অপ্রাকৃত অবস্থাতে চলে যায়, তখন কোনও সংজ্ঞা থাকে না।’ মাতৃসাধক রামপ্রসাদও একই কথা বললেন, ‘বল দেখি ভাই কী হয় মলে। যেমন জলের বিশ্ব জলে উদয়, জল হয়ে সে মিশায় জলে।’
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কেন্দ্র করে মৃত্যুযোগ অভ্যাসের কথা বলে গেলেন। অর্জুন এখানে শিষ্য। গুরু শ্রীকৃষ্ণ। জিজ্ঞাসা করলেন অর্জুন, ‘মন চঞ্চল, তাকে কী করে স্থির করা যায়?’
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, ‘প্রাণ আর মন দুটিকেই গুটিয়ে আনবার চেষ্টা কর। প্রাণায়াম মুদ্রা দিয়ে একাগ্রভূমিতে পৌঁছে গেলে মন স্থির হয়ে যাবে। এ হল অভ্যাসযোগ। রোজ অনুশীলন করতে হবে তোমাকে। নাহলে হবে না, অর্জুন। হৃদয়, ভ্রূ আর মূর্ধা (মস্তিষ্কের ব্রহ্মস্থান)— এই তিনটি দেশ দিয়ে প্রাণবায়ু চেতনায় প্রসারিত হতে থাকে। মানুষ যখন মারা যায়, শুদ্ধ চেতনাকে আচ্ছন্ন করে দেয় অন্ধকার। যাঁরা যোগী তাঁরাই অন্ধকারটিকে হটিয়ে দিতে জানেন।’
বৈদিক ঋষিরা বৈবস্বত-মৃত্যুর কথাটিও আমাদের বলে গেছেন। আত্মজ্যোতি (আত্মা) ব্রহ্মজ্যোতিতে (পরমাত্মা) মিলে গেলেই বৈবস্বত-মৃত্যু। নিজের মধ্যে বুদবুদের ভাঙা-গড়া অনুভব করতে করতে মৃত্যুযোগী পরমপুরুষের নিজের বোধে সমাসন্ন হন। যোগিনী মীরাবাঈ বললেন, ‘জ্যোৎমে জ্যোৎ মিলা জানা— জ্যোতিতে জ্যোতির মিলিয়ে যাওয়া।’ এই হল তাঁর পরমপুরুষ শ্রীকৃষ্ণকে অনুভব করার সাধনপন্থা। আত্মজ্যোতির লয় হচ্ছে পরঃ কৃষ্ণ নীলিমার অতলে।
আচার্য ঋষি বললেন, ‘মানুষের চোখের মাঝখানে নীল কৃষ্ণ মণির চারদিকে সাদা ভাগ রয়েছে। ওখানে কোনও ছাপ পড়ে না। মানুষ বাইরে যা দেখ, চোখের মধ্যকার নীল মণির ভেতর দিয়েই দেখ। চোখের মধ্যে রয়েছেন হিরন্ময় পুরুষ। মানুষের চোখের মধ্যে তিনি প্রকাশিত। বাইরে চোখ মেলে আলো না দেখে চোখ বন্ধ করে মানুষ যদি অন্তরে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে অন্ধকার দেখতে থাকে, একটা সময় পর অন্ধকারের মধ্যেই প্রকাশিত হবেন— ‘নীলং পরঃ কৃষ্ণ’।’
বাইরে দেখ, সমস্তটাই ব্রহ্ম। ভেতরটা দেখার সময় ভাব, তুমিই ব্রহ্ম। ঋষিরা এই প্রণালীতেই আত্মদর্শনের সাধনা শিখিয়ে গেলেন। আত্মদর্শন হলেই ঊর্ধ্বে ওঠা যাবে।
অর্জুনকে শ্রীকৃষ্ণ এই উপরে ওঠার কথাই বললেন, ‘প্রাণবায়ুকে ভ্রূমধ্যে নিয়ে তুমি ওপরে ওঠো। মেরুদণ্ডের মধ্যে রয়েছে ইড়া, সুষুম্না, পিঙ্গলা নাড়ি তিনটি। মধ্যে সুষুম্না, বাঁ-দিকে ইড়া আর ডানদিকে রয়েছে পিঙ্গলা নাড়ি। সুষুম্নার মধ্যেই ঢুকে বজ্রিনী নাড়ি, আবার তার মধ্যে চিত্রাণী, এর ভেতরেই ব্রহ্ম নাড়ি। মূলাধার পদ্ম হতে সহস্রদল পদ্ম আছে শরীরের মধ্যে। মেরুদণ্ডের মধ্যে মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা— এইভাবে ছয়টি পদ্মচক্রের অবস্থান। পদ্মগুলো ব্রহ্ম নাড়ির সঙ্গে আটকে আছে। সবার ওপরে রয়েছে সহস্রদল পদ্ম। এই হল মানুষের আত্মশক্তি। প্রাণবায়ুর সাহায্যে একে জাগাতে পারলে নিজের শরীরটা যে ব্রহ্মস্বরূপ এটা ভালো করে বোঝা যাবে। বুঝতে বুঝতে একটা সময় মনে হবে, স্থূল শরীরটা আর নেই! তখনই সূক্ষ্ম নাড়ির মধ্যে চলে গেছে শরীর! মৃত্যুর সময় যোগীরা প্রাণবায়ুকে এই পথেই নিয়ে চলে যান। এভাবেই তাঁরা মৃত্যুকে জয় করে ফেলেন। বিনা সাধনায় মৃত্যুকে জয় করা যায় না, অর্জুন। একে বলে অক্ষরব্রহ্ম যোগ। এই যোগকে তুমি অভ্যাস কর অর্জুন।’
মৃত্যুযোগ
যোগী, সাধকেরা বলে থাকেন যে, মৃত্যুযোগ যাঁরা জীবনে অভ্যাস করেন তাঁরাই নিজের মৃত্যুকালটি ধরতে পারেন। মৃত্যুকালে মানুষ মুখ খুলে দেয়। মারা যাওয়ার সময়ে মানুষের খাওয়া- দাওয়া, পান-ভোজনের ব্যাপার তো থাকে না, তথাপি মৃত্যুর সময় মুখটা খোলা রেখেই মারা যায় প্রত্যেকে। এর কারণ, মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে মানুষের দেখা-শোনা-চিন্তা সবই বন্ধ হয়ে যায়, কিন্তু প্রাণবায়ুটি থাকে শরীরের মধ্যে। ঋষিরা একেই বলেছেন, ‘মুখ্যপ্রাণ।’ মানুষ যতই খাওয়া - দাওয়া করুক না কেন, বেঁচে থাকে একমাত্র মুখ্যপ্রাণের শক্তিতে। যাঁদের এই শক্তিটি অত্যধিক বেশি তাঁদের বেশিমাত্রায় খাবার-দাবার দরকার হয় না। অনেক যোগীর জীবনী থেকে জানা যায়, এঁরা একটা সময় পর খাওয়া-দাওয়া একেবারেই ছেড়ে দেন, ভক্তদের অনুরোধে মাঝেমধ্যে সামান্য কিছু গ্রহণ করেন।
মহাত্মা রাম ঠাকুর খাদ্যবস্তু গ্রহণ করতেন না। কোনও প্রকার আহার গ্রহণ না করাতে তাঁর পাকস্থলী কুঞ্চিত হয়ে যায়, মলমূত্র ত্যাগ হয় না— কিন্তু তাঁর ঘর্মগ্রন্থির ক্রিয়া ঠিক থাকে। শরীরটা বাঁশপাতার মতো দুলতে থাকলেও চামড়া তাঁর কোমল ও দৃঢ়। এ অবস্থাতে তিনি নব্বই বছর অবধি শরীরে ছিলেন।
মা আনন্দময়ী ন’টি ভাতের দানা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। তেরো-চোদ্দো দিন পর সামান্য একটু জল খেতেন। এভাবে চলার পর দীর্ঘকাল তিনি জল খাওয়া ছেড়ে দিলেন। পরে সকলের অনুরোধে জল গ্রহণ করার পর মা আনন্দময়ী বললেন, ‘দেখলাম জল না খেয়ে কেমন লাগে? কিন্তু দেখছি জলের ব্যবহারই ভুল হয়ে যাচ্ছে। যদি একবার ভুল হয়ে যায় তবে আমাকে নিয়ে তোমাদের মুশকিলই হবে, তাই আবশ্যকতা না থাকলেও জল খেলাম।’
রাজরাপ্পা-ছিন্নমস্তাতে এক যোগিনী মা রয়েছেন, আমি তাঁর কাছে যখন গেলাম, তিনি খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। শুধুমাত্র অমাবস্যার দিন একমুষ্টি অন্ন গ্রহণ করেন। আমি তাঁকে বললাম, ‘আপনি কী প্রমাণ করতে চাইছেন, মা?’
যোগিনী মা মৃদু হেসে বললেন, ‘নব্বই পেরনো এই শরীরের কোনও কিছু আর দরকার নেই, বাবা। মেরুদাঁড়াতে সৌরশক্তি রয়েছে। সুষুম্নার মধ্য দিয়ে ওই শক্তি ওপরে তুলতে জানলে খাদ্য-খাবারের দরকার পড়ে না। মানুষ যে দেহ নয়— আত্মা, এ যে মিথ্যা নয়, বাবা!’
যোগীরা মুখ্যপ্রাণের ব্যবহার জানেন। এর ব্যবহার সাধারণত আমরা জানি না বলেই গুচ্ছের খাবার-দাবার খেতে হয় গোটা একটা দিনের ভেতরে। খাবার প্রবণতা নিয়েই মারা যায় মানুষ, আর মৃত্যুর আগে অভ্যাসগত ভাবে অন্ন-পানাদি বন্ধ হলেও মুখ্যপ্রাণের ক্রিয়া তো আর স্তব্ধ হয় না— মুখ দিয়ে মুখ্যপ্রাণ বের হয়ে যায় বলে মৃত্যুর সময় মানুষ মুখ খুলে দেয়। আমরা ভাবি জল খেতে চাইছে। মৃত্যুর সময়ে শিয়রে বসে থাকা ব্যক্তিটি তাই মৃত্যুপথযাত্রীর মুখে জল তুলে দেয়।
উপনিষদের ঋষিরা বারবার আমাদের বোঝাতে চেয়েছেন, মুখপ্রাণই হল শরীরের সমস্ত অঙ্গের রস। এর নাম তাই আঙ্গিরস। আঙ্গিরস ব্যবহার করেই উচ্চকোটির সাধক সাধিকারা খাদ্যবস্তু না খেয়েও বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকেন। এমন ধরনের যোগী যোগিনীরা যখন শরীর ছেড়ে দেন, মৃত্যুর পরেও অধিক কাল তাঁদের শরীরে উষ্ণতা থাকে। পণ্ডিচেরীতে শ্রীঅরবিন্দ শরীর ছাড়ার পরও তাঁর শরীর পাঁচ দিন উষ্ণ ছিল, আর শ্রীমার শরীর উষ্ণ ছিল তিন দিন। আনন্দময়ী মা যখন দেহ রাখলেন, তাঁর শরীরও জ্যোতির্ময় হয়ে উঠেছিল।
মৃত্যুর নির্দিষ্ট সময়
যোগী পরমহংস যোগানন্দ ১৯৫২ সালে দেহ রাখেন ক্যালিফোর্নিয়ার লস অ্যাঞ্জেলস শহরে। মৃত্যুর কুড়ি দিন পরেও তাঁর দেহে কোনও প্রকার শারীরিক বিকার দেখা যায়নি। দেহ পচেনি, দুর্গন্ধ ছড়ায়নি। ৭ মার্চ মহাপ্রয়াণের রাতে তাঁর দেহ যেরূপ ছিল, ২৭ মার্চেও তাঁর সেই দেহ একইরূপ স্বাস্থ্যোজ্জ্বল, পচনশূন্য, অবিকৃত দেখাচ্ছিল। যাঁরা দেখেছেন সকলেই বলেছেন, ‘পরমহংস যোগানন্দজির দেহত্যাগ আমাদের অভিজ্ঞতায় একেবারে অভূতপূর্ব।’
মাউন্ট ওয়াশিংটনে একদিন ধ্যানে বসছেন যোগানন্দ। হঠাৎ তাঁর অন্তরের অন্তস্থলে যুক্তেশ্বর গিরির স্বর ধ্বনিত হয়ে উঠল, ‘ভারতবর্ষে ফিরে এসো, তোমার জন্য আমি পনেরো বছর ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে বসে আছি। শীঘ্রই আমি দেহত্যাগ করে অনন্তের দিকে পাড়ি জমাব। যোগানন্দ, চলে এসো!’
চোখের পলকে দশ হাজার মাইল অতিক্রম করে গুরুদেবের আহ্বান যোগানন্দজির অন্তরে এসে পৌঁছল— বিদ্যুৎচমকের মতো। যোগানন্দ এসেছিলেন ১৯২০ সালে। পনেরো বছর ধরে তিনি গুরুর শিক্ষা আমেরিকায় প্রচার করে এসেছেন। এখন গুরু তাঁকে ডাক দিলেন।
শ্রীরামপুর আশ্রমে এসে উপস্থিত হলেন যোগানন্দ কিছু গোলাপফুল আর ফলমূল নিয়ে। ১৯৩৫ সালে প্রয়াগে চলছে কুম্ভমেলা। যোগানন্দ সেখানে যাবেন বলে গুরুর অনুমতি চাইলেন। গুরুদেবের চক্ষু দুটি স্থির, স্নিগ্ধ। শান্তভাবে বললেন, ‘পৃথিবীতে আমার কাজ ফুরিয়েছে, তোমাকেই এখন থেকে সব চালাতে হবে।’
শুনে ভয়ে যোগানন্দজির বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল।
যুক্তেশ্বর গিরি বললেন, ‘পুরীতে আমাদের আশ্রমের ভার নেওয়ার জন্য কাউকে পাঠিয়ে দিও। তোমার হাতে আমি সবই দিয়ে যাচ্ছি। তুমি তোমার জীবন আর এই প্রতিষ্ঠানের তরি, ঠিকই সাফল্যের সঙ্গে স্বর্গের বেলাভূমিতে ভিড়োতে পারবে।’
অশ্রুপ্লাবিত নয়নে যোগানন্দ গুরুদেবের পা দুটি জড়িয়ে আশীর্বাদ নিয়ে চলে গেলেন কুম্ভে। ফেরার পর শ্রীরামপুর আশ্রমে এসে শুনলেন গুরুদেব গিয়েছেন পুরীতে। পরদিন সন্ধ্যাবেলা ট্রেন ধরার জন্য যাত্রা করলেন। তখন প্রায় সাতটা বাজে। একটা ঘন কৃষ্ণবর্ণ সূক্ষ্ম মেঘ হঠাৎ কোথা থেকে এসে আকাশ আচ্ছন্ন করে ফেলল। ট্রেন পুরীর দিকে ছুটে চলেছে, যুক্তেশ্বর গিরিজির মূর্তি হঠাৎ যোগানন্দজির সম্মুখে এসে আবির্ভূত হল। মূর্তিটি তাঁর কাছে এসে বসল। অত্যন্ত গম্ভীর মূর্তি। মূর্তির দু’ধারে আলো।
করজোড়ে অনুনয় করে যোগানন্দ বললেন, ‘সব কি শেষ হয়ে গেছে?’ গুরুদেব একটু মাথা নেড়ে ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
পরদিন সকালে পুরী প্ল্যাটফর্মে এসে নামলেন যোগানন্দ। মনে তখনও ক্ষীণতম আশা। এমন সময় একজন অপরিচিত লোক তাঁর কাছে উপস্থিত হয়ে বলল, ‘আপনার গুরুদেব দেহরক্ষা করেছেন।’ বলেই লোকটা চলে গেল।
যোগানন্দজির শরীর অস্থির-অস্থির করতে থাকল। অজ্ঞান হওয়ার মতো যখন অবস্থা তখনই তিনি নিজের মধ্যে গুরুদেবের আওয়াজ শুনতে পেলেন, ‘শান্ত হও, স্থির হও।’
আশ্রমে পৌঁছে যোগানন্দ শুনলেন গতকাল সন্ধ্যা সাতটার সময় যুক্তেশ্বর গিরি দেহ রেখেছেন। যোগানন্দজির সামনে গুরুদেব কাল আবির্ভূত হয়েছিলেন ওই একই সময়ে!
মহাপ্রয়াণ
ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে শ্রীরামকৃষ্ণের একমাত্র সন্ন্যাসিনী শিষ্যা গৌরী মাতার আশ্রম। কয়লা রাখার জেটির গায়ে মায়ের পঞ্চবটি, অনেক দেবদারু গাছ, এর পর কপালেশ্বর শিবের থান। গৌরী মা এখানে বসে ধ্যান করেন।
আষাঢ় মাস। আকাশে ঘন কৃষ্ণমেঘ জমছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। আশ্রমে আজ উৎসব। প্রচুর লোকজন এসেছে। গৌরী মা ঠাকুরের আরতি করছেন একেবারেই ভাববিহ্বল হয়ে। হঠাৎ তাঁর হাতের পঞ্চপ্রদীপ কাঁপতে লাগল। শ্রীরামকৃষ্ণের মুখমণ্ডলে আরতি করতে গিয়ে মায়ের হাত থেকে পঞ্চপ্রদীপ মাটিতে পড়ে সবকটি শিখা দপ দপ করে নিমেষের মধ্যে নিভেও গেল! এমন সময় গৌরী মা আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘মঠে কি সর্বনাশ হল রে! নরেন বুঝি ফাঁকি দিলে।’
উপস্থিত সকলের বুক আশঙ্কায় কেঁপে উঠল। বিকেলে যাঁরা স্বচক্ষে স্বামীজিকে মঠে দর্শন করে ব্যারাকপুর আশ্রম এসেছেন তাঁরা গৌরী মায়ের আশঙ্কা বিশ্বাস করতে না পারলেও আড়ষ্ট হয়ে রইলেন। তাঁরা যে মঠে স্বামী বিবেকানন্দকে হাঁটতেও পর্যন্ত দেখে এলেন, এর মধ্যেই এ কী করে সম্ভব!
মায়ের ব্যাকুলতা দেখে ভক্ত মুচিরাম বলল, ‘মা, তুমি অমন কথা বোলো না, আমি এক্ষুনি বেলুড় থেকে খবর নিয়ে আসছি।’
বেলুড় থেকে সংবাদ এসে পৌঁছল তৎক্ষণাৎ— স্বামীজির মহাপ্রয়াণ হয়েছে। গৌরী মা দুর্গা মাকে সঙ্গে করে মুচিরামের নৌকাতে বেলুড় মঠে রওনা হলেন।
একদা যখন গৌরী মা বেলুড় মঠে গিয়েছিলেন। স্বামীজির সঙ্গে দেখা হতে তিনি মাকে বললেন, ‘আমার কাজ শেষ হয়ে এল এবার। মেয়েদের কাজ রইল, আর তুমি রইলে।’
গৌরী মা বাধা দিয়ে বললেন, ‘ষাট্ ষাট্, ওসব অলক্ষুণে কথা বলতে নেই।’
কিয়ৎকাল গম্ভীর থেকে স্বামীজি মাথা নেড়ে বললেন, ‘ঠাকুরের কথা কী নড়চড় হবার জো আছে, গৌরী মা!’ আবার হাসতে হাসতে বললেন, ‘তোমরা মায়েরা চাও আমাকে কোলের বাছা করে চিরকাল ধরে রাখতে। তা কি হয়?’
স্বামীজির কাঁধে চড়ে তাঁর বুকের দু’ধারে দুটি ফর্সা পৃথুল পা দাপাদাপি করতে করতে গোটা বেলুড় মঠের চত্বর ঘুরে বেড়াতেন সারদা মায়ের একমাত্র সন্ন্যাসিনী শিষ্যা দুর্গা মা। গৌরী মা অমন করতে বারণ করলে ছোট্ট মেয়েটি বলত, ‘এই পায়ে একদিন সক্কলে প্রণাম করবে গো।’
শেষবার জয়রামবাটি যাওয়ার আগে মা সারদা তাঁর সন্ন্যাসিনী শিষ্যাকে ডেকে চিবুক স্পর্শ করে আদর করে নিজের গলা থেকে রুদ্রাক্ষের মালাটি খুলে বললেন, ‘এইটি ঠাকুরের জপের মালা, ষোড়শী পুজোর সময় তিনি আমাকে দিয়েছিলেন, সেই থেকে এই পবিত্র বস্তু আমি গলায় রেখেছি। আমি এটি তোমাকে দিচ্ছি। এ সিদ্ধ বস্তু তুমি নাও, এখনই। মন যখন অশান্ত হবে, এটি বুকে রাখবে, মন শান্ত হবে।’
মা সারদা নিজের হাতে সেই সিদ্ধমালা দুর্গা মায়ের আঁচলের কোণে বেঁধে দিলেন। দুর্গা মা পরে শিষ্যভক্তদের বলেছিলেন, ‘আমি দু’হাতে অঞ্জলি করে মায়ের পদ্মহস্ত থেকে সেই পবিত্র বস্তু প্রথমে গ্রহণ করে মাথায় ঠেকিয়ে প্রণাম করলাম। মনে হল, দৈবীশক্তির এক বিদ্যুৎ প্রবাহ আমার দেহে বয়ে গেল।’
১৯৬৩ সালের ১৪ নভেম্বর, কালীপুজোর আগের দিন। দুর্গা মা বললেন, ‘আমার স্নানের ব্যবস্থা আজ সকাল সকাল করে দিও তোমরা, এরপর মুশকিল আছে।’ মুশকিল কীসের তা কেউ অনুমান করতে পারলেন না। মাকে সত্বর স্নান করে পুজোর আসনে বসিয়ে দেওয়া হল। পুজো শেষে মালা জপতে বসলেন মা। জপ শেষে আর উঠতে পারলেন না। ধরে ধরে তাঁকে বিছানায় বসিয়ে দেওয়া হল। ডাক্তার এলেন। অক্সিজেন সিলিন্ডার আনা হল।
মা পঞ্জিকা দেখতে বললেন— ‘চতুর্দশী তিথি শেষ হবে কখন? অমাবস্যা পড়বে কখন?’ পঞ্জিকার তিথি নক্ষত্রের হিসাব শুনে দুর্গা মা বললেন, ‘আমার পুজো কাল হবে।’
এই বাক্যের তাৎপর্য কী, এটা কীসের ইঙ্গিত, তখন কেউই ধরতে পারলেন না। রাত দশটা থেকে মায়ের শরীর খারাপ হতে থাকল। সকালে ইনজেকশনের ব্যবস্থা হতে দুর্গা মা বললেন, ‘এসব আর কেন? এখন তো মৃত্যুপথযাত্রী।’
মা একটি ছোট্ট আয়না চাইলেন। নিজের মুখটা দেখে বালিশে হেলান দিয়ে বসলেন। আশ্রমের এক সন্ন্যাসিনী জিজ্ঞেসা করলেন, ‘কষ্ট হচ্ছে, মা?’
দুর্গা মা অতি প্রশান্তভাবে বললেন, ‘না মা, ভালো আছি, কোনও কষ্ট হচ্ছে না আমার।’ এর পরেই মা তাঁর দৃষ্টির সম্মুখে থাকা দেয়ালের দেবদেবীর ছবিগুলোর প্রতি দৃষ্টিনিক্ষেপ করে উচ্চারণ করলেন, ‘মা, ত্রিপুরসুন্দরী!’
কী আশ্চর্য, মা কিছু দেখতে পেলেন! দিব্যজ্যোতিতে ভরে উঠল মুখ। অমাবস্যা লেগে গেছে সে সময়। কালীপুজো। মা দুর্গা মহাপ্রয়াণ করেছেন।
দেহী অদেহী
নীলাচল থেকে ১৯৩৬ সালের নভেম্বর মাসে বেলঘরিয়ার ভক্ত সুধীররঞ্জন রায়ের বাসাবাড়িতে এসে উঠলেন নিগমানন্দদেব। খবর পেয়ে শিষ্যরা জড়ো হতে তিনি তাঁদের বললেন, ‘আমি স্থূল দেহে আর বেশিদিন থাকব না। কোনও মহাপুরুষই অমর নন। আমি অদেহী হলে আর কিছু দেখতে পাব না— এরূপ যাদের ধারণা তারা গুরুকেও নিজেদের মতো অজ্ঞান বলে ভাবে। জ্ঞানসিদ্ধ গুরু দেহী বা অদেহী— সর্বাবস্থায় তিনি সাক্ষী চেতা।’
ডাক্তার দেখানোর তোড়জোড় শুরু হল। ডাঃ যোগেশ মুখার্জি তিন-চার বছর ধরে তাঁর প্রায় সব অসুখের সময় চিকিৎসা করে থাকেন। তিনি এলে নিগমানন্দদেব বললেন, ‘দেখ, মনটন সব তো ভগবানকে দিয়ে ফেলেছি— এই পচা গলা স্থূল দেহটা তোমাদের দেব বলে এসেছি।’
ডাঃ মুখার্জি বললেন, ‘এ আপনার কৃপা। তবে কলকাতায় থাকলে চিকিৎসার সুবিধা হয়।’
দু-তিন দিনের মধ্যে তাঁকে আনা হল বিডন স্ট্রিটের ভাড়া বাড়িতে। শিষ্যভক্তদের ইচ্ছে স্বনামধন্য চিকিৎসক বিধান রায় এসে দেখে যান। নিগমানন্দদেব প্রস্তাব শুনে হেসে বললেন, ‘এবার বিধানের বিধান আর খাটবে না।’
বিধান রায় এলেন। নিগমানন্দদেবকে পরীক্ষা করে কোনও রোগ নির্ণয় করতে পারলেন না। নিরুপায় হয়ে তিনি বললেন, ‘স্বামীজি, আপনার অসুখের কথা আপনিই বলুন।’
নিগমানন্দদেব বললেন, ‘একটি শান্ত পুকুরের ভেতরে একটা ঢিল নিক্ষেপ করলে তরঙ্গ উঠে তা যেমন ক্রমশ পুকুরে লয় হয়ে যায়— আমার ভেতরকার অবস্থাটাও ঠিক তদ্রূপ।’
ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় এ কথার মর্মার্থ ধরতে পারলেন না। কিছু ওষুধের ব্যবস্থা করলেন। তাতে কাজ হল না।
নিগমানন্দদেব বললেন, ‘আমার সব দ্বার এখন খোলা— সব একাকার। জীবন্মুক্তের দেহাবসানে সূক্ষ্ম বা কারণ-দেহ থাকে না। স্থূল দেহ খসে পড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্রহ্মনির্বাণ।’
এইবার আরেক বিশিষ্ট চিকিৎসক নীলরতন সরকার এলেন। ওষুধ দিলেন। ফল হল না। ডাঃ যোগেশ মুখার্জি এসে নাড়ি দেখলেন। নিগমানন্দদেব হেসে বললেন, ‘কী দেখলে?’
ডাঃ মুখার্জি বললেন, ‘কী করে বলি!’
নিগমানন্দদেব বললেন, ‘নাড়ি নেই, এই তো?’
বিছানায় বসে আছেন। চোখ দুটি বোজা। কারও ডাকে আর সাড়া দিচ্ছেন না— ডুব ডুব রূপসাগরে আমার মন! কেবলমাত্র মাঝে মাঝে ডাকের উত্তরে ‘উঁ’ এই একটু শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর একেবারে স্থির হয়ে গেল শরীর।
ভয় পেয়ে সেবক ভুবন ব্রহ্মচারী তারস্বরে ডাকলেন, ‘ঠাকুর, ঠাকুর।’
মুদিত নেত্রে ঠাকুর বললেন, ‘আর কেন ডাক! আমাকে ভেতরে ডুবে যেতে দাও।’ ধ্যানগম্ভীর জীবন্ত মূর্তিতে শরীর ত্যাগ করলেন নিগমানন্দদেব।
আয়ুষ্কাল
ঢাকার গেণ্ডিরিয়া আশ্রমে রোজ পড়া হয় গুরুগ্রন্থসাহিব। গুরুদেবকে পড়ে শোনান শিষ্য অধ্যাপক হারানচন্দ্র চাকলাদার। বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী হারানচন্দ্রকে আদেশ করলেন, ‘গুরুগ্রন্থসাহিব তুমি বাংলাতে অনুবাদ কর।’
হারানচন্দ্র বললেন, ‘এখনই আমার পঞ্চাশ পেরনো বয়স। এত বড় বই অনুবাদ করতে যে অনেক সময় লাগবে গুরুদেব! এ জীবনে আর সম্ভব নয়।’
বিজয়কৃষ্ণ বললেন, ‘এখনই অনুবাদ হবে না, বাবা। শেষজীবন তোমার সন্ন্যাসীর। আমি দেখতে পাচ্ছি যে, আমার সমাধিমন্দির আগলে তুমি রয়েছ। ওখানে বসে বৃদ্ধ বয়সে অনুবাদ করছ গুরুগ্রন্থসাহিব। এই গ্রন্থ ধর্মজগতের কোহিনুর। নিশ্চিন্তে অনুবাদ কোরো পুরীতে বসে। তোমার আয়ুকালে তা যদি সম্ভব না হয় হারান, চিন্তা কোরো না, আরও কুড়ি বছর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল তোমার আয়ু।’
জীবনের শেষ কুড়ি বছর— ১৯৩৭ থেকে ১৯৫৭ পর্যন্ত পুরীতে গুরুদেবের সমাধিমন্দিরে বসেই অধ্যাপক হারানচন্দ্র চাকলাদার গুরুকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি মতো গ্রন্থসাহিবের অনুবাদ শেষ করে ৮৪ বছর বয়সে দেহত্যাগ করলেন।
করিমপুর, তেহট্ট পেরিয়ে নন্দনপুর। সেখানে এক বৈষ্ণব মহাত্মা থাকতেন বাঁশবেড়ার ছোট্ট আশ্রমে। তাঁর কাছে বৈষ্ণবতন্ত্রের অনেক হাতে লেখা পুঁথি-পত্র ছিল। গবেষকেরা যেতেন সেসব থেকে কিছু উদ্ধার করবেন বলে।
গাঁয়ের লোকেরা এসবের মর্ম ধরতে না পারলেও গোঁসাইকে শ্রদ্ধা করতেন। এলাকায় দেবানন্দ গোস্বামী প্রভুর সুনাম ছিল। শেষ সময় তিনি এক শিষ্যের কাছ থেকে টাকা চাইলেন। সকলে অবাক হলেন। এতকাল ধরে আছেন এখানে, তাঁর যে আকাশবৃত্তি— কারও কাছে কিছুই চাইতে পারবেন না কোনওদিন। যা জুটত খেতেন, না জুটলে উপোস। আজ সাধু টাকা চাইলেন কেন!
টাকা নিয়ে দেবানন্দ গোঁসাই বললেন, ‘এখানে একটা সমাধি বানাও তো দেখি।’ যে ঘরে আছেন, সেখানেই সমাধি বানাতে বললেন সাধু। গ্রামের সকলে মিলে বাঁধানো সমাধি বানিয়ে ফেললেন মান্য গোঁসাই ঠাকুরের কথায়।
দু’দিকে উঁচু করা বালিশে হাত দিয়ে, দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছেন দেবানন্দ গোস্বামী। কাঠের মতন শুকনো তাঁর প্রাণোচ্ছল দেহ। অসীম জীবনীশক্তি। নবদ্বীপ ও বৃন্দাবন থেকে বৈষ্ণব পণ্ডিতরা আসতেন তাঁর কাছে তত্ত্বজ্ঞান শুনতে। নন্দনপুর গাঁয়ে তাঁর নাম কাঠসাধু।
সাধু অপেক্ষা করে আছেন। ভক্তদের বললেন, ‘কৃষ্ণপক্ষ গেছে যে বাবা। আজ অমাবস্যা। জল দিয়ে দেহটা মুছে, নতুন একটা কাপড় পরিয়ে আমাকে আজকে দু’পাশে বালিশ দিয়ে সমাধিঘরে বসিয়ে দাও। বসানোর আগে শরীরে একটু সরিষার তেল মাখিয়ে দিও।’
তেল মাখাতে মাখাতেই সাধু চলে গেলেন। করিমপুরের পথে নন্দনপুরে ভৈরব নদীর পাড়ে কাঠসাধুর সমাধিমন্দির দেখতে এখনও অনেক মানুষ আসেন। এলাকার প্রবীণেরা বলেন, ‘স্বচক্ষে দেখেছি গো, যোগবলে তিনি নিজের মৃত্যুর সময় জানতে পেরে সমাধি করালেন।’
বীরভূমের ইলামবাজারের খয়েরবুনি গ্রামে গেছি নব্বই বছর বয়সি মহাত্মা নির্মলেন্দু গোস্বামীকে দর্শন করতে। যমুনা মা বেরিয়ে এলেন কুটির থেকে। তাঁরও যথেষ্ট বয়স হয়েছে। দুপুর একটা নাগাদ গিয়েছি। এ সময়টা সাধুগুরুদের অন্নসেবার সময়। দু’একজন শিষ্যও আছেন আশ্রমে। তাঁরা পদ্মপাতাতে ভাত বেড়ে দিলেন। পোস্তর বড়া, একপলা ঘি, ছানার রসা দিয়ে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে মুখ ধুতে যাব, চোখ গেল বেলতলাতে দু’দুটি খোলা সমাধিতে।
চারদিকে ভালো করে সিমেন্ট বাঁধানো। গর্তের চারধারে চৈতন্যদেব, নিত্যানন্দ সহ নানান গোস্বামীগণের ছবি। জল, ফুল দেওয়া হয়। দাওয়ার ওপর এসে বসবার পর যমুনা মা আমার কৌতূহল ভাঙলেন, ‘এই যে ছেলে, সময় হয়ে গেছে যে! ও যা দেখলে, আমার আর গোঁসাইয়ের খাঁচা রাখবার জায়গা।’
ইলামবাজার থেকে ফিরে কিছুদিনের মধ্যেই খবর পেলাম একইসঙ্গে দেহ রেখেছেন খয়েরবুনির সেই বৈষ্ণব সাধক-সাধিকা।
রাজরাপ্পার যোগিনী মাঈ আগে থাকতেন বীরভূমের মল্লারপুরে। একদিন ওঁর কুঠিয়ায় গেছি, দেখলাম কাশী থেকে এসেছেন সুমেরু মঠের সোমানন্দ অবধূত। তিনি শঙ্করাচার্যের উপাস্য ভদ্রকালী মূর্তির পুজো করেন। ধ্যানের নানান পদ্ধতি বলছিলেন তিনি। সেখানে এসে বসলেন যোগিনী মাঈ। কিছু পর এলেন মায়ের গুরুবোন কঙ্কালী মা। তারাপীঠের শ্মশান সাধিকা তিনি। কিছুসময় পর কঙ্কালী মা চলে গেলে রাজরাপ্পার সিদ্ধা মা সোমানন্দ অবধূত ঠাকুরকে বললেন, ‘আমার গুরুবোনের কাশী যাওয়া হবে না। আমি একাই যাব। দুপুরে যখন ও দাওয়ার দিকে উঠে আসছে, চড়া রোদে ওর শরীরের ছায়া মাটিতে পড়েছে।’
অবধূত বললেন, ‘এ তো স্বাভাবিক ব্যাপার মা।’
যোগিনী মাঈ বললেন, ‘সবই তো বুঝলাম। কিন্তু ওর মাথাবিহীন শরীরের ছায়া পড়েছে উঠানে। মুণ্ডবিহীন ছায়া মানেই দোরগোড়ায় এসে গিয়েছে মৃত্যু। আমার বিদ্যা যদি আয়ত্তে থাকে এখনও গুরুজির কৃপায়, কাল সকালে সূর্য পাবে না ও। চলে যাবে।’
যোগিনীর কথাকে সত্য করেই পরদিন ভোররাতে কঙ্কালী মা দেহ রাখেন তারাপীঠের কাষ্ঠগড়া গ্রামে নিজেরই সাধন কুঠিয়ায়।
পরমায়ু স্থির করার শিক্ষা
যোগীরা শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর লক্ষ ও সংযম রেখে জীবন চালান। পবন বিজয় স্বরোদয়ঃ যোগশাস্ত্রের একটি অতি পুরনো পুঁথি। নর্মদার প্রাচীন সাধুরা স্বরোদয় শাস্ত্রের চর্চা করতেন। ন’বছর বয়সে ব্রহ্মচারী হয়ে নর্মদা পরিক্রমা শুরু করলেন উজ্জ্বয়িনীর পীতাম্বর। দুর্গম নর্মদা ঝাড়ি বহু বছর ধরে পরিক্রমা করে যুবক পীতাম্বর পৌঁছল গঙ্গোনাথে। পাহাড়ের ওপর থাকেন একজন মহাপুরুষ ব্রহ্মানন্দ স্বামী মহারাজ। পীতাম্বর তাঁর তত্ত্বাবধানেই স্বরোদয় শাস্ত্রমতে সাধনা করলেন। কিশোর বয়সে পথে বেরিয়ে গেছেন বলে গুরু তাঁর নাম রাখলেন বালানন্দ। ঝাড়খণ্ড দেওঘরের তপোবন পাহাড়ে স্বরোদয় যোগশাস্ত্রের শিক্ষা দিতেন ব্রহ্মচারীজি। ১৯৩৭ সালে তিনি দেহ রাখার পর তাঁর শিষ্য মোহনানন্দজি প্রাচীন পুঁথির শিক্ষা দিতেন। এই পরম্পরার মধ্যে এখনও স্বরোদয় শিক্ষা বর্তমান আছে। স্বরোদয় হল মানুষের মধ্যকার বাতাসের গতিবিধির অধ্যয়ন। তন্ত্রের এ এক জ্ঞানকাণ্ড। শরীরের শ্বাসবহনের গতিবিধি ধরে তার ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান বলে দেওয়া যায়। শরীরের অভ্যন্তরে অনেক প্রকার নাড়ি সুবিস্তৃত হয়ে আছে। এর মধ্যে কিছু নাড়ি আছে যেগুলো সমস্ত রকমের বায়ুপ্রবাহক। মানুষের নাক দিয়ে আকৃষ্ট হয়ে নাভিগ্রন্থি পর্যন্ত যে বায়ু গমনাগমন করে, তাকে প্রাণবায়ু বলে। শরীরে গুহ্যদেশ থেকে নাভি অবধি বয় অপানবায়ু। দুই বায়ু যদি নাভিগ্রন্থি পেরনোর আগে এক হয়ে চলতে শুরু করে তাহলে মানুষের মৃত্যু অবধারিত। যোগীরা বলেন, মানুষের শরীরে প্রধান পাঁচটি বায়ু আর পাঁচটি উপবায়ু মিলে শ্বাস-প্রশ্বাসক্রিয়া চলে। তান্ত্রিকেরা বলেন, কুণ্ডলিনী থেকে বেরয় প্রাণবায়ু। প্রাণ হল মানুষের মেরুদণ্ডের শক্তি। এর মধ্যে থাকে জ্ঞান, ইচ্ছে ও ক্রিয়া। শরীরের যাবতীয় যন্ত্রকার্য তিনরূপে বিভক্ত হয়ে চলে। যোগীরা শরীরের মধ্যকার তিনটি সত্তার স্রোতধারাকে বলেন, জ্ঞানশক্তিপ্রবাহিণী, ইচ্ছাশক্তিপ্রবাহিণী আর ক্রিয়াশক্তিপ্রবাহিণী নাড়ি। এই তিনটি নাড়ির ব্যবহার জানেন বলেই যোগী, সাধক, তান্ত্রিকেরা শরীরের মধ্যকার গতিবিধিগুলো অনায়াসে টের পেয়ে যান। কখন শরীর অসুস্থ হবে, কখন কাজকর্ম করলে বিশেষ ফলদায়ক হবে, কখন অশুভ সময় আসবে, কখন শরীরে রোগ ব্যাধি আক্রমণ করবে— কীভাবে জ্ঞান, ইচ্ছা ও ক্রিয়াশক্তি দিয়ে তার প্রতিরোধ করা যাবে, কখন মৃত্যু এসে হানা দেবে— সমস্ত কিছুর আগাম সংকেত স্বরোদয় যোগীরা জানতে পারেন। স্বরোদয় শাস্ত্র হল শরীরবিজ্ঞান। এই বিজ্ঞান যাঁরা জানেন তাঁরা এর মাধ্যমে জীবিত থাকা, আরোগ্য, বিজয়, জাগতিক চাহিদা মেটানো— সব করতে পারেন। এঁরাই মৃত্যুযোগ ধরতে পারেন। যে ??