ভোজনরসিক বাঙালি খেতে বসলে হুঁশ থাকে না। ভাত-রুটি, ডাল-তরকারি, মাছ-মাংসে রসনা তৃপ্তি হয় বটে, কিন্তু এইসব খাবার কতটা প্রয়োজনীয়? কতটা ক্ষতিকর? আয়ুর্বেদে আছে সব খাবারই ভালো, কিন্তু সংযোগ দোষে তা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। দেশ, কাল, অগ্নি, কোষ্ঠ, সংস্কার, পরিহার, উপচার, সম্পদ —এইরকম ১৭টি বিরোধ খাদ্য এড়িয়ে চলা দরকার। কোন খাবারের সঙ্গে কোন খাবার খাবেন না? কোন খাবার দিনে খাবেন? কোন ফল কখন খেতে হয়? বিরুদ্ধ খাদ্য কেন খাবেন না? লিখেছেন ডাঃ সুবলকুমার মাইতি।
শরীর ও মনকে সুস্থ রাখার জন্য চরক সংহিতা ও সুশ্রুত সংহিতায় আহার সম্বন্ধীয় আলোচনায় বিশদভাবে বর্ণনা রয়েছে। মানুষের খাদ্যাখাদ্যের বিচার ও খাবার গ্রহণ বিষয়ে।
সব খাবারই সবার পক্ষে যেমন হিতকর নয়, নানাভাবে আহার্য দ্রব্য শরীরের পক্ষে অহিতকর হয়ে যেতে পারে। সব দ্রব্যগুলিই ভালো, কিন্তু সংযোগ দোষে তা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়। এভাবে দেশ, কাল, কোষ্ঠ, অবস্থা প্রভৃতি বহু বিরোধের কথা হাজার হাজার বছরের গবেষণায় ফসল হিসেবে বিভিন্ন পুস্তকে উল্লেখিত হয়েছে।
এমন কিছু সংযোগ বিরুদ্ধ আহারের উল্লেখ আছে, যা আজও বিস্ময় সৃষ্টি করে। যেটুকু নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, সেগুলির অধিকাংশই সত্য। বর্তমানের গবেষণাতেও সংযোগ বিরুদ্ধের তালিকায় দীর্ঘতর হচ্ছে।
সংযোগ বিরুদ্ধ নানাভাবে হয়ে থাকে। তা বলার আগে সুশ্রুত সংহিতার অভিমতটা কী, তা দেখা যাক। কোনও কোনও আচার্য বলে থাকেন— যেটি বায়ুর পথ্য, সেটি পিত্তের অপথ্য। এমন কোনও দ্রব্য নেই, যা একান্ত হিত বা অহিত। কেননা দ্রব্যসকল স্বভাবত বা সংযোগবশত একান্ত হিত বা একান্ত অহিত বা হিত ও অহিত উভয়ই হতে পারে।
স্বভাবত একান্ত হিতদ্রব্যগুলি হল— জল, দুধ, ঘি, অন্ন প্রভৃতি। এসব দ্রব্য মানুষের পক্ষে সাত্ম্য। একান্ত অহিত দ্রব্য হল— অগ্নি, ক্ষার, বিষ প্রভৃতি। এগুলি সকলের পক্ষে ক্ষতিকারক। আবার কোনও কোনও দ্রব্য হিত ও অহিতও হয়ে থাকে। সংযোগবশত, বিষতুল্যের বিশাল ভাণ্ডারের মধ্যে একটা সাধারণ উদাহরণ এখানে দিয়ে রাখি, যেমন দুধ আর মাছ একসঙ্গে খেতে নেই, খেলেই বিষতুল্য।
সকলের উপযোগী হিতকর দ্রব্যসমূহের মধ্যে কয়েকটি হল— ধানের মধ্যে ষষ্টিক (শ্বেতষষ্টিক, যেটি ৬০ দিনে পাকে), রক্তশালি, পাণ্ডুশালি, পীতশালি, সুগন্ধশালি, কলমশালি, কর্দমক শালি, প্রমোদকশালি, কালকাশনক শালি, কাংনী ধান, উড়িধান, কোদোধান, বন্য কোদোধান, শ্যামাধান, গোধূম, বেণুযব (বাঁশের চাউল) প্রভৃতি। মাংসের মধ্যে নানাপ্রকার কপোত, কয়ার, বটের লাব, কৃষ্ণ তিতির, শ্বেত তিতির, ভারুই প্রভৃতি পাখির মাংস এবং ডালের মধ্যে মুগ, বনমুগ, মসুর, মটর, ছোলা, অড়হর ডাল, বাঁটুল কলায় প্রভৃতি। শাকের মধ্যে বেতো শাক, শুষনি শাক, নটে শাক, ব্রাহ্মী শাক, থানকুনি প্রভৃতি। এছাড়া গোরুর দুধের ঘি, সৈন্ধব লবণ, দাড়িম ও আমলকী প্রভৃতি সকলের জন্য হিতকর।
খাদ্যের সংযোগ বিরুদ্ধের প্রকারভেদ সংখ্যায় বহু প্রকার হলেও এখানে কয়েকটিকে নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে—
১) দেশ বিরোধ: ভেষজবিদদের মতে দেশ ৫ প্রকারের
(ক) জাঙ্গল দেশ, (খ) আনূপ দেশ, (গ) ধন্বন দেশ, (ঘ) সাধারণ দেশ, (ঙ) পার্বত্য দেশ।
জাঙ্গল দেশ: যেখানে প্রচুর আলো বাতাস, গাছপালা অপেক্ষাকৃত কম, বায়ু ও পিত্তের আধিক্যজনিত রোগের প্রকোপ, সেটিকে জাঙ্গল দেশ বলে।
আনূপ দেশ: স্যাঁতসেতে মাটি, নদীনালা ডোবায় ভরা এবং গাছগাছালিতে ভর্তি জলাসন্নভূমি বেষ্টিত পরিবেশ, যেখানে আম, পেয়ারা, জাম, কাঁঠাল, কলা, নারিকেল প্রভৃতি বেশি থাকে, সেটিকে আনূপ দেশ বা অঞ্চল বলা হয়। বায়ু ও কফের প্রাবল্যজনিত রোগে এখানকার মানুষজন বেশি ভোগেন।
ধন্বন দেশ: চলতি কথায় মরুভূমি প্রধান দেশ, কাঁটাযুক্ত গাছপালা বেশি দেখা যায়। এখানকার মানুষজন দুধ, ঘি, মাখন খেতে ভালোবাসেন। শরীরে পিত্তের প্রকোপ বেশি। এইসব অঞ্চলকে আয়ুর্বেদ মতে আরোগ্যকর দেশ বলা হয়।
সাধারণ দেশ: সমস্ত দেশের কিছু কিছু চরিত্র মিলে মিশে থাকে সাধারণ দেশে।
পার্বত্য দেশ: পাহাড়-পর্বত ঘেরা অঞ্চল, সেখানকার মতো গাছপালা, শৈত্যপ্রবাহ প্রভৃতি থাকে। এসব স্থানের মানুষেরা একটু বেঁটে ও ফর্সা হয়ে থাকে। এখানকার আবহাওয়া, জল প্রভৃতির উপযোগী ওষুধ ও পথ্য গ্রহণ করতে হবে। না মানলে সেটাকে দেশবিরোধ বলা হবে।
২) কালবিরোধ: মানুষের জীবনে তিন কালে তিন দোষের প্রাদুর্ভাব ঘটে। যেমন— বাল্যে শ্লেষ্মা, যৌবনে পিত্ত ও বার্ধক্যে বায়ু। তেমনই সকালে শ্লেষ্মা, দুপুরে পিত্ত ও বিকেলে বায়ুর প্রভাব বৃদ্ধি হয়। এই হল কালের স্বরূপ। বাল্যের আহার যেমন যৌবনে চলে না, তেমনই যৌবনের আহার বাল্যে চলে না। এই কাল বিচার করে আহার যেমন দেহের ক্ষেত্রেও দরকার তেমনই
শীতকালের খাদ্যগুলো গ্রীষ্মে খাওয়া ভালো নয়। সেইরকমই বর্ষার খাদ্য শীতকালেও খাওয়া ভালো নয়। শৈশবে দুধ, যৌবনে দই আর বার্ধক্যে ঘি উপযোগী।
৩) মাত্রাবিরোধ: ঘি ও মধু খাওয়া ভালো। কিন্তু সমান মাত্রায় খেলে তা বিষাক্ত হয়ে যায়। চিনি আর জল সমান মাত্রায় শরবত বানিয়ে খাওয়া উচিত নয়। ঠাকুর পুজোয় যে সিন্নি তৈরি করে খাই, তা শুধু মাত্রা বিরুদ্ধ নয়, সেটি সংযোগ বিরুদ্ধও হয়ে যায়। যেমন দুধ ও পাকাকলা একসঙ্গে চটকে খাওয়া। এগুলি না মানলে অজীর্ণ, অগ্নিমান্দ্য, বমি বা বমিবমি ভাব, আমাশা, উদাবর্ত (কণ্ঠগত উদানবায়ুর বিকার জনিত সমস্যা প্রভৃতি) দেখা দেবে।
৪) সাত্ম্যবিরোধ: এটি ৪ প্রকারের—
ক) গর্ভসাত্ম্য: মাতৃগর্ভে থাকার সময় থেকে বড় হওয়া পর্যন্ত যেসব খাদ্য খেয়ে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি, তারপর হঠাৎ সেই খাদ্য বাদ দিয়ে নতুন নতুন খাদ্য খাওয়া শুরু করলে শরীরে নানাপ্রকার অসুবিধা দেখা দিতে পারে। এটিকে গর্ভসাত্ম্য বিরোধ বলা হয়ে থাকে। দীর্ঘদিন খেতে খেতে যেটি ভালোভাবে সহ্য হয়ে যায়, তাকে সাত্ম্য বলে।
খ) দেশসাত্ম্য: যে দেশে যাওয়া হয়, সেই দেশের খাদ্য না খেলে, আয়ুর্বেদ বিরুদ্ধ শরীর অসুস্থ হতে পারে। তখন দেশসাত্ম্য বিরোধ বলা হয়। জোর করে ভারতের সব খাবার খাব, অথচ বিলেত-আমেরিকার খাদ্য খাব না, অথবা ভারতের কোনও প্রদেশে বসে সেখানকার খাদ্য না খেয়ে শুধু বিদেশের খাদ্য খাব— মোটেই ভালো না।
গ) কালসাত্ম্য: গরমের দিনে খুব বেশি তেল মশলা দিয়ে খাবার তৈরি করে খেলে অথবা গুরুপাক করে পিঠে পুলির পায়েস তৈরি করে খেতে চাইলে শরীর তো খারাপ হবেই। এগুলি শীতকালের খাদ্য, গরমের দিনে বেশি না খাওয়াই ভালো, একেই কালসাত্ম্য বিরোধ বলা হয়। যেমন শরৎ, গ্রীষ্ম, বসন্তে দই খেতে হয়, না খেলে কালবিরুদ্ধ বা কালসাত্ম্য বিরোধ দোষ।
ঘ) ক্রিয়াসাত্ম্য: যদি ঠান্ডা ঘরে বসে বরফ দিয়ে শরবত খাওয়া যায় কিংবা গরমে বসে ঘি খাওয়া হয়, অথবা চা পানের পর ঠান্ডা জল খেলে আমদোষ আসতে পারে। একেই ক্রিয়াসাত্ম্য বিরোধ বলে।
এইসব সাত্ম্যবিরোধের ফলে শিরোরোগ, হৃদ্দৌবল্য প্রভৃতি দেখা দেয়।
৫) অগ্নিবিরোধ: স্বাভাবিক কারণে যাদের পাচকাগ্নির বল কম, সহজে হজম হতে চায় না, তাদেরকে যদি ঘি, পায়েস, মাংস প্রভৃতি গুরুপাক দ্রব্য খাওয়ানো হয়, তাদের ক্ষয়মূলক জ্বর, মাথার রোগ, ঊর্ধ্বগত উদাবর্ত প্রভৃতি রোগ দেখা যায়। অতএব পেটের হজম ক্ষমতার বিচার বিশ্লেষণ করে না খেলে শরীর অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন সেটিকে অগ্নিবিরোধ দোষ বলে।
৬) দোষ বিরোধ: যেক্ষেত্রে বরফ লাগানো দরকার, সেক্ষেত্রে যদি গরম বালি বা কাপড়ের সেঁক দেওয়া হয়, সেটি উল্টো হয়ে গেল।
৭) সংস্কার বিরোধ: একটা সংস্কার মেনে চলছেন, একদিন এতদিনের সংস্কার ভুলে খাওয়া দাওয়া শুরু করলেন, সেই খাবারের দোষে অসুস্থ হওয়ার যোগ সৃষ্টি হয়। তবে শরীরে প্রচুর বল থাকলে কোনও কোনও ক্ষেত্রে অসুবিধা হয় না। কাঁসার পাত্রে ঘি ১০ দিন রাখার পর খেতে নেই। মধু কোনও গরম দ্রব্যে মিশিয়ে বা গরম পাত্রে রেখে, বা গরম করে খেতে নেই। তিলবাটা দিয়ে পুঁইশাক রান্না করে খেতে নেই। সর্ষের তেল দিয়ে পায়রার মাংস রান্না করে খেতে নেই। এগুলি না মেনে চললে সেটি সংস্কার ভেদে বিরুদ্ধ আহার হয়ে যায়। তখন শরীর নানাভাবে অসুস্থ হয়ে পড়বে।
৮) পরস্পর বিরোধ দোষ: আয়ুর্বেদ মতে দ্রব্যাদি (খাদ্য বা ভেষজ) মূলত বীর্য ভেদে ২ প্রকার। শীতলবীর্য ও উষ্ণবীর্য। উদাহরণ স্বরূপ— বরফ ঠান্ডা কিন্তু উষ্ণ বীর্য, দুধ শীতল কিন্তু প্রকৃতিতে সে স্নিগ্ধ উষ্ণ বীর্য, গরম তেল কিন্তু গরম নয়, সেটি প্রকৃতিতে শীতল। এই রকম দুধের সঙ্গে মাছ, মাংসের সঙ্গে দই, ঘি ও সর্ষে তেলে ভাজা তরকারির সঙ্গে দুধ বা দই মিশিয়ে কোনও তরকারি রান্না খেতে নেই। এটিকে বীর্যবিরোধ আহার বলা হয়। এভাবে খেলে শরীর খারাপ হবেই।
৯) কোষ্ঠবিরোধ দোষ: কোষ্ঠ সাফের ক্ষেত্রে প্রথমে বিচার করতে হবে সামান্য কোষ্ঠবদ্ধতা না শক্তিশালী কোষ্ঠবদ্ধতা। যেখানে সামান্য বিরেচক দিলে কোষ্ঠ সাফ হয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে তীক্ষ্ণ বা শক্তিশালী বিরেচক ঔষধ প্রয়োগ করলে হৃদদৌর্বল্য বা হৃদরোগ স্বাভাবিকভাবে চলে আসে। কোমল কোষ্ঠ ব্যক্তির শ্লেষ্মাঘটিত রোগে শোষক ঔষধ দিলে হৃদরোগ ও হাঁপানি অনিবার্য।
১০) অবস্থাবিরোধ: যাঁরা সামান্য পরিশ্রমে, উপবাসে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তাঁরা যেসব খাদ্য খেয়ে পরিতৃপ্ত লাভ করতেন, আজ সেগুলিই শরীরে বিরোধ সৃষ্টি করে নানাপ্রকার জটিল রোগ ডেকে আনতে পারে। প্রথমেই বোঝা গেলে সেসব বর্জন করা সহজ হবে। যেমন পান্তাভাত, দই, কলা, সন্দেশ, বেলের শাঁস প্রভৃতি খেলে আমাশার সম্ভবনা থাকবে। তারপর গ্রহণী রোগের (Chronic Diarrhoea and Dyspepsia) প্রাদুর্ভাব ঘটবে। একেই বলা হয় অবস্থা বিরোধ দোষ।
এমনিতেই দই কলা একসঙ্গে খেতে নেই, এটি তখন সংযোগ বিরুদ্ধ আহার হয়ে যায়। পান্তাভাত সব ঋতুতে খেলে অনেক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, বিশেষত হজমের সমস্যা থাকলে। তারপর শরীরটি যদি ভারী আর আলসেমি সঙ্গী হয়, তাঁদের খুব সাবধানে থাকতে হবে। এখানে ওজন কমানো ও আলসেমি পরিত্যাগ না করতে পারলে লাইন ধরে আসতে থাকবে— উচ্চ রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, মধুমেহ, কিডনির সমস্যা, তখন শরীর একটা সমস্যায় পড়ে যাবে, ভাবতে ভাবতে হার্টের রোগ, লিভারে চর্বি জমে লিভারের জটিল রোগগুলিকে আমন্ত্রণ জানাবে, শেষে মস্তিষ্কের এলোমেলো অবস্থা, জীবন তখন অবিন্যস্ত হয়ে যাবে। আহার সম্বন্ধে কিছুটা মেনে চলতে পারলে ৯০ পর্যন্ত ওষুধপত্র খেয়েও বেশ ভালো থাকবেন। আপনারও ইচ্ছেটা জাগুক। যত বয়স হোক না কেন, আজ থেকেই ভাবুন। সময় চলে গেছে বলে হাল ছাড়বেন না। বার্ধক্যের বেশকিছুটা দিন কাটাতে চাইলে আহার সচেতন হতে হবে প্রথমে, সেইসঙ্গে দিনযাপনের বিধিনিষেধ মেনে চলা। মনটাকে সংসারের জটিল চাওয়া পাওয়ার ঘুর্ণিপাক থেকে দূরে রাখতে পারলে, দিনে ২-৩ ঘণ্টা পড়াশোনা করলে স্মৃতিধরও হতে পারবেন।
১১) ক্রম বিরোধ— খাওয়ার একটা নিয়ম আছে, কার পর কোনটা খাবেন। সাধারণত প্রথম পাতে সামান্য একটু তেতো তরকারি দিয়ে খাওয়া শুরু করাটাই ভালো। আর এই তেতোর মধ্যে লুকিয়ে থাকে ঝাল ঝাল কষা কষা রস। এটি বেশি খেতে নেই। তারপর মিষ্টভাবাপন্ন দ্রব্য, তাতে কোনও মিষ্টি জাতীয় (গুড়, চিনি, মিছরি, বাতাসা, মধু প্রভৃতি) দ্রব্যের ব্যবহার করা উচিত নয়, বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া। শেষে টক জাতীয় দ্রব্য, সেটি আমিষ (মাছ জাতীয় দ্রব্য) বা নিরামিষ হতে পারে। টক-মিষ্টি চাটনি (আনাজপত্র, ফলমূল দিয়ে) খেতে পারেন। কোনও কিছু না মানলে সেটি ক্রমবিরোধ দোষে পরিণত হয়ে যাবে। অজীর্ণ ও অগ্নিমান্দ্য রোগ তখন পেছন ছাড়বে না।
১২) পরিহার বিরোধ: গরম চায়ে চুমুক দেবেন আর মিষ্টি খাবেন তারিয়ে তারিয়ে, সেটা করবেন না। ভাতের শেষে দই খেতে নেই। তবে সম্পূর্ণ নিরামিষ আহারের শেষে টক দই খেতে পারেন, যদি রান্নাটি অত্যধিক কম তেল-মশলায় করা হয়। মাংস ভাত বা মাংস লুচি খেয়ে, দুধ, ক্ষীর, দই অথবা দুধ দিয়ে তৈরি যে কোনও খাদ্য (মিষ্টান্ন, আইসক্রিম প্রভৃতি) খেতে নেই, আপাতত ঘণ্টা চারেক। এসব বিধি মেনে খাবেন, না মানলে তখন সেটি পরিহার বিরোধ দোষে দুষ্ট হয়ে নানা রোগের শিকার হবেন। পরিণতিতে পেটের নানা সমস্যায় ভুগতে ভুগতে রক্তপিত্ত ও নানাপ্রকার শিরোরোগের সম্ভাবনা থাকবে।
১৩) উপচার বিরোধ: কোন ঋতুতে কোথায় কীভাবে বসে কী কী দ্রব্য খেলে এবং উপবাসের সময় শরীর আর মনের অবস্থা ভেদে খাদ্য নির্বাচন করতে পারলে, সেই সময়কার খাদ্যদ্রব্য পেট ভর্তি করে খাওয়া যাবে কি যাবে না, এই বিচার করতে পারলে শরীর ও মন ঠিক থাকবে। সঠিক নির্বাচন না করতে পারলে এটিকে উপচার বিরোধ দোষ বলে। তখন রক্তহীনতা, জ্বর প্রভৃতি হতে পারে। নিজের মতো করে চলতে না পারলে সর্বক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
১৪) পাক বিরোধ: কোন ফল কাঁচা খেতে হয়, কোন ফল পাকা খাওয়া উচিত, তা ভালোভাবে জেনে খাবেন। ভাত-রুটি-লুচির সঙ্গে গুড়-চিনি-মধু বা দই কোনটা কীভাবে খাবেন, কী খাবেন না, তা জেনে বুঝে খাওয়া উচিত। না জেনে খেলে পাকবিরোধ দোষে আক্রান্ত হয়ে নানা রোগের শিকার হতে হয়।
১৫) হৃদ বিরোধ: ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় কোনও নিষিদ্ধ দ্রব্য অথবা কোনওদিন খাওয়া হয়নি এমন দ্রব্য অন্যের জবরদস্তিতে খেলে পরবর্তী সময়ে হৃদরোগের সমস্যা আসতে পারে। শুধু এই কারণটাই যে হৃদরোগের কারণ, তা কিন্তু নয়, যে কোনও অনিয়মের দীর্ঘ পরিক্রমায় নানা রোগে ভুগতে ভুগতে হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেবে।
১৬) সম্পদ বিরোধ: কোন দ্রব্য কীভাবে কোন কোন অবস্থায় খাওয়া উচিত, তা প্রথমেই জানা দরকার। তা বুঝেসুঝে না খেলে অজীর্ণ, কৃমিতে ভুগতে হতে পারে। যেমন খেজুর, বেল, আখরোট, বাদাম, মূলা, টম্যাটো, আমড়া, চালতা, চালকুমড়ো, শসা, আম, জাম, কলা, কুল, কিছু শাক-সব্জি প্রভৃতি কাঁচা ভালো না পাকায় ভালো, কচি ভালো না বুড়োয় (পাকার পূর্বাবস্থায়) ভালো, না শুকনোয় ভালো, রান্না করে খাওয়া ভালো না কী কেবল সিদ্ধ করে খাওয়া ভালো, বেশি তেল মশলা না কম তেলমশলায় রান্না করে খাওয়া ঠিক, এসব ভালোভাবে জেনে খাওয়া উচিত। উল্টো-পাল্টা খেলে সম্পদ-বিরোধ দোষে ভুগতে হবে। পেট থেকে মাথার নানা সমস্যা দেখা দেবে।
১৭) বিধি বিরোধ: সব রকমের আচার-বিচার এবং আহার ও বিহার মেনে জীবন যাপন করা অসম্ভবের পর্যায় পড়ে। সেজন্য চিকিৎসক, গুরু, বংশ পরম্পরায় খাওয়া-দাওয়ার যে চলটা চলে আসছে, তাঁদের দ্বারায় পরীক্ষিত হয়ে যেসব খাদ্য বিধি ভালো বা হিতকর মনে হয়েছে, দীর্ঘদিন মেনেও আসছি, মোটামুটি কোনও সমস্যায় হচ্ছে না, তারপর হঠাৎ সেগুলিকে কুসংস্কার ভেবে পরিত্যাগ করে আপাতত রুচিকর-পুষ্টিকর ভেবে যদি আহার ও বিহারের তালিকা বদলে ফেলার পর নানা সমস্যায় পড়ে কোনও না কোনও রোগে আক্রান্ত হলে তাকে বিধিবিরোধ দোষ বলা হয়। যেমন—রাতে দই খেতে নেই, এটা সকলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। দইয়ের সঙ্গে ছাতু খাওয়াও ভালো নয়। এছাড়া রাতে খিচুড়ি, পায়েস খাওয়াটা নিষেধ করা হয়েছে। তিথি ভেদে খাদ্যাখাদ্য বিচার ব্যবস্থাটিকে না বুঝে পাক্কা কুসংস্কারের দলে ফেলে দিয়েছি। সেটাকে নিয়ে প্রত্যেকের শরীর মোতাবেক ভাবনা-চিন্তার অবকাশ থেকে যাচ্ছে বই কি!
নিরামিষ বা আমিষ খাবার নিয়ে কম ঝামেলা নেই। মাছ, মাংস, ডিম একসঙ্গে খাওয়া উচিত নয়, যে কোনও একটি বেছে নিতে হয়। পোড়া তেলে কোনও খাদ্য (চপ, ভাজাভুজি, চচ্চড়ি এবং অন্য কোনও রান্না) তৈরি করবেন না। রান্নার সময় কম তেল দিয়ে ভেজে বাকি তেলটা ফেলে দেওয়ার মানসিকতা তৈরি করুন। দোকানদারদের অনুরোধ করব, ভাজাভুজিতে কম তেল দিয়ে চপ, কাটলেট, তেলেভাজা ভাজুন। পোড়া তেল ফেলে দিন। খরচ বেশি হলে খদ্দেররা তা মেটাবেন। লোকে কিনবেন না ভেবে ভুল করবেন না। নগরজীবনকে সুস্থ্য রাখার দায়িত্ব আপনারও আছে। একদিন টাকায় ৮-১০টা আলুর চপ, বেগুনি, পেঁয়াজি যাঁরা খেয়েছেন, আজ ৫-১০ টাকায় একটা চপ কিনে তাঁরাই খাচ্ছেন। সামান্য পচে গেলে বা ছাতা পড়লে সবটাই ফেলে দিন।
মাত্রা মতো মাছ, মাংস, ডিম খান কেবলমাত্র দিনের বেলায়। খুব প্রয়োজনে সামান্য পরিমাণে আমিষ খাবেন রাতে। রাতে নিরামিষ খাবেন। ডাল খেলে হালকা পাতলা জলটি খাবেন। প্রোটিনের উৎস শুধু আমিষে নেই, নিরামিষেও আছে। ১০০ গ্রাম সয়াবিন খেলে যা প্রোটিন পাবেন, ৫০০ গ্রাম মাংস ও ডিমে জুটবে না। কিছু কিছু দ্রব্যের খোসা ছাড়িয়ে খাবেন না। যেমন শসা।
১৮) সংযোগ বিরুদ্ধ দোষ: কোন কোন দ্রব্যের সঙ্গে কোন কোন দ্রব্য মিশিয়ে খেলে তা শরীরের মধ্যে খারাপ প্রতিক্রিয়া হতে পারে, সে আলোচনা পূর্বে কিছুটা করা হলেও এখানে বিস্তৃতভাবে করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
দই এর সঙ্গে ছাতু ও চিনি মিশিয়ে খাওয়া ঠিক নয়।
রসুনের ফোড়ন দিয়ে কাঁচা কলার তরকারি খাবেন না।
পোড়া বেগুনে পেঁয়াজ-রসুন কুঁচিয়ে না মাখিয়ে সামান্য লঙ্কা-ধনেপাতা মিশিয়ে খেতে পারেন। স্বাদের জন্য খাঁটি সর্ষের তেল মেশাতে পারেন। এটি কেবলমাত্র শীতকালের জন্য ব্যবহার করবেন।
শাকের তরকারিতে জোয়ানবাটা, লাউয়ের তরকারিতে আদা বাটা, চালকুমড়োর তরকারিতে বা শুক্তোয় সর্ষে বাটা ব্যবহার করবেন না। দুটোর সংযোগে বিরুদ্ধ আহার বা অহিতকর আহার হয়ে যাবে।
শাস্ত্রে অহিতকর দ্রব্যের তালিকাটি দেখুন—শিম্বী ধান্যের মধ্যে মাষকলাই, লবণের মধ্যে উষ্ণ দেশজাত লবণ গ্রীষ্ম ঋতুতে বর্জনীয়।
ফলের মধ্যে ডেলোমাদার, শাকের মধ্যে সর্ষে শাক, মাংসের মধ্যে গোমাংস, চর্বির মধ্যে মহিষের চর্বি, দুধের মধ্যে ভেড়ার দুধ, তেলের মধ্যে কুসুম তেল, অর্ধপক্ব (জলের মতো পাতলা) আখের রস মোটেই হিতকর নয়। অর্থাৎ না খেলেই ভালো। সর্ষে শাক নিয়ে দীর্ঘ বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এটিকে কেন অহিতকর বলা হয়েছে। এবং আধুনিক বিজ্ঞানে এর গুণাগুণ বিচারে কেন ও কীভাবে খেতে হয় তা বলা হয়েছে। সর্ষে শাক ও মুলো শাক সমান ভাগে নিয়ে কেটে হালকা ভাপিয়ে জল ফেলে রান্না করে খান।
মাছ ও জনবহুল স্থানের পশুর মাংস দুধের সঙ্গে খেতে নেই।
পায়রার মাংস সর্ষের তেলে ভেজে রান্না করতে নেই।
গুড়াদি মিষ্টি দ্রব্য ও মধু দিয়ে মাছ রান্না করে খাওয়া নিষেধ।
মাংস ও ছাতুতে দুধ মিশিয়ে খেতে নেই।
গরম দ্রব্যের সঙ্গে দই খাবেন না।
উষ্ণ দ্রব্যের বা বৃষ্টির জলের সঙ্গে মধু খাবেন না।
খিচুড়ির সঙ্গে পায়েস নিষিদ্ধ। পায়েসের সঙ্গে জলও নিষিদ্ধ।
ঘোল, দই ও বেলের সঙ্গে পাকা কলা খেতে নেই।
রান্না করা খাবার পুনরায় গরম করে খাওয়া নিষেধ—প্রাচীনকালের ঋষিতুল্য মানুষের বিচার।
তেল, ঘি, মধু, দুধ, চর্বি, পানীয় দ্রব্য একসঙ্গে মেশালে বিরুদ্ধগুণ হয়।
নানা জাতীয় মাংস একসঙ্গে মিশিয়ে রান্না করে খেতে নেই। এর দ্বারা পরস্পর বিরুদ্ধ হয়।
রোগ ও পথ্য বিচার করলে এক সময়ের হিতকর ও সাক্ত্য খাদ্য বাদ দিয়ে নতুন করে আহার্য দ্রব্যের তালিকা তৈরি করতে হয়।
বিচার-বিশ্লেষণের ধারাবাহিকতায় আমাদের অনেক কিছু নজরে আসে, সেগুলির কিছু কিছু এখানে তুলে ধরা হল।
আলু, বেগুন, উচ্ছে, কাঁচা কলা, সজনে ডাঁটা ও বড়ি দিয়ে দীর্ঘকালের শুক্তো রান্নার তালিকায় হঠাৎ রদবদল ঘটালে অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। শুক্তোয় পেঁপে দেবেন না। কারণ তাতে উচ্ছে আছে। পেঁপের তরকারিতে টম্যাটো দেবেন না, রক্তহীনতা হতে পারে। উচ্ছে ও পেঁপে একসঙ্গে ভেজেও খাবেন না। বিষাক্ত হয়ে যায়।
ঢেঁড়শের সঙ্গে উচ্ছে খাবেন না।
দুধ-দই-ঘোলের সঙ্গে কলা খাওয়া, দুধ-দই দিয়ে মাছ-মাংস রান্না করা, দুধের সঙ্গে নুন খাওয়া, মিষ্টি দই খাওয়া, আদা ও রসুন একসঙ্গে কোনও রান্নায় ব্যবহার করা উচিত নয়। সংযোগ বিরুদ্ধ খাদ্য শরীরের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর।
পাঁচফোড়নের ৫টি দ্রব্য (জিরে, কালো জিরে, মৌরী, মেথি ও রাঁধুনি) কেবল ফোড়ন হিসেবে ব্যবহার করবেন। অন্যভাবে ব্যবহার করতে পারেন ভেবেচিন্তে খুব প্রয়োজন হলে।
খিদে পেলে খাবেন। দুটি আহারের মধ্যেকার সময়টা বিচার করে খাবেন। খুব ধীরে ধীরে বা খুব তাড়াতাড়ি খাবেন না। কথা বলতে বলতে, ফোন বা টিভি দেখতে দেখতে খাবেন না। খেতে খেতে কথা বলার সময় মাছ-মাংস খেলে বিপদের আশঙ্কা থাকে। জল গ্লাসে খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। অতিরিক্ত ঠান্ডা বা গরম খাবার খাবেন না।
চায়ের সঙ্গে দুধ চিনি ফুটিয়ে খাবেন না। মাটির ভাঁড়ে, চীনামাটি বা কাচের পাত্রে চা খাবেন।
মাছ, মাংস, ডিম দিয়ে ভাত বা রুটি খাওয়ার ঘণ্টা চারেকের মধ্যে দুধ বা দুধ দিয়ে তৈরি কোনও খাবার খাবেন না।
প্লাস্টিকের থালা, বাটি, গ্লাস, চায়ের কাপ ব্যবহার করা ১০০ শতাংশ নিষিদ্ধ। জেনে বুঝে ব্যবহার করলে সেটি অপরাধের মধ্যে পড়ে, প্রাচীন শাস্ত্র মতে বলা হয় ‘প্রজ্ঞাপরাধ’। প্লাস্টিক যেভাবেই ব্যবহার করুন না কেন, সেটাই যে মানুষের ধ্বংসের অন্যতম একটি কারণ হবে, সে বিষয়ে বিজ্ঞানীরা প্রায় একমত।
ডিম ও দুধ ভালোভাবে না ফুটিয়ে খাবেন না। ডিমে অতি সামান্য নুন ব্যবহার করলেও দুধে করবেন না। ভাজাভুজি গাঢ় রঙের হলে খাবেন না। পারতপক্ষে কোনও ভাজাভুজি না খাওয়ার ব্রত নিন। সিদ্ধ করে সামান্য তেল দিয়ে অথবা তেল ছাড়া মেখে খান।
আহারের (খাদ্যের) পর বিহারের কথা। দৈনন্দিন জীবনচর্চা সঠিকভাবে মানতে হবে। সকালে ঘুম থেকে ওঠা, সময়মতো দাঁতমাজা, স্নান করা, চা ও টিফিন, হিসেব মতো কাজকর্ম এবং দুপুর ও রাতের খাওয়া এবং সময়মতো ঘুমানো এবং সকাল ৬টা নাগাদ ওঠা। রাতের গভীর নিদ্রা ৬-৮ ঘণ্টা হওয়া চাই। এখানে কাজের কোনও অজুহাত চলবে না। এতে মস্তিষ্কের ক্ষতিকর কোনও রোগ এবং অনিদ্রা আসতে পারবে না। অন্ধকার ঘরেই শুতে হবে, এটি ভুলে যাবেন না।
এবার একটু মনের কথা কই—অল্পে সন্তুষ্ট হওয়া, অভাবের মধ্যে থাকা ও ছেলেমেয়েকে মানুষ করার চেষ্টা, অপরের জন্য চিন্তা ভাবনা, লোভ ক্রোধ, অহঙ্কার থেকে দূরে থাকা, হিংসা থেকে দূরে থাকার সাধনা করা। উত্তেজনা-উদ্বেগ, দুঃশ্চিন্তার শিকার হওয়ার চেষ্টা করলেই সুস্থ হয়ে বাঁচার স্বপ্নটা একদিন ভেঙে চুরচুর হয়ে যাবে।
লেখক: ভারত সরকারের আয়ুর্বেদ গবেষণা বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানী, অধ্যাপক, বনৌষধি গবেষক আয়ুর্বেদ চিকিৎসক।