বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
সাপ্তাহিক বর্তমান

কালভৈরব কে? কী কী সিদ্ধি দান করেন?

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে তিনি ধারণ, পোষণ করেন। কাল অর্থাৎ সময়কে যিনি শাসন করেন তিনিই কালভৈরব। সংসারের যাবতীয় ভয়, রোগ, শোক, ত্রিতাপ জ্বালা থেকে উদ্ধারকারী যিনি, তিনিই ভৈরব। তিনি শিবজাত কিন্তু রুদ্র নন, শান্ত। দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তাঁর পুজো বাড়িতে প্রতিমা গড়ে হয় না। কিন্তু তিনি এমন এক দণ্ডমুণ্ডের কর্তা যাঁকে তুষ্ট করতে পারলে আশীর্বাদের ডালি উজাড় করে দেন। কালভৈরবের কিছু প্রসিদ্ধ মন্দির আছে সারা দেশে। সেখানে তাঁর পুজো-প্রার্থনায় মেলে অশেষ ফল। কীভাবে তাঁর উপাসনা করলে তিনি তুষ্ট হন? লিখেছেন সোমব্রত সরকার। 

কালভৈরবের পুজো কারা করেন? কেন করেন?

ভৈরব
বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে যিনি ভরণ করেন অর্থাৎ একই সঙ্গে ধারণ ও পোষণ যিনি করেন তিনিই হলেন ভৈরব। ভী কথার অর্থ ভয়। ত্রাসজনিত রব— সাধকের আকুল কান্না, মনন ও চিন্তন থেকে যিনি জাত— জন্ম নেন তিনিই হলেন ভৈরব। সংসারের যাবতীয় ত্রাস, যা থেকে মানুষ মুক্ত হওয়ার বাসনায় চোখের জল ফেলছে, রোগ, শোক, ত্রিতাপ জ্বালা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য নানান চিন্তা-ভাবনা করছে— সংসারের নানা অবস্থার ভয়ে ভীত হয়ে মানুষ যখন ‘ভগবান, ভগবান’ বলে আর্তরব করে উঠছে— ভগবদ বিষয়ে মনটাকে বেঁধে রাখছে তখন তার হৃদয়চক্রে— মনের গভীর-গহনে পরমার্থরূপে যিনি স্ফুরিত হয়ে উঠে আসছেন তিনি হলেন ভৈরব। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, পক্ষান্তরে ভৈরবই হলেন শিব। 
সাধকেরা তাই বলেন, ‘বিশ্বময়— সর্বত্র স্ফুরিত তিনি। গোটা পৃথিবীটাই যে তাঁকে ধারণ ও পোষণ করে আছে।’ শিব ও শক্তি অভিন্ন। শক্তি হল তরঙ্গের স্ফুরণ। এই যে দীক্ষার পর বীজমন্ত্র নিষ্ঠা সহকারে জপ করা হয়— আকুলতার ভেতর দিয়ে, নিবিড় ভক্তি নিয়ে যখন গুরুর দেওয়া বীজমন্ত্রটি জপ করা হয় তখন হৃদয়চক্রে এক-একটা বুদবুদের মতো শিহরন জাগে— জপ গভীরে চলে গেলে দেহের মধ্যে এগুলো ঘটে— এটাই হল শক্তি।
সাধকরা শক্তির স্ফুরণকে বলছেন ‘বিদ্যা’। বিদ্যা লাভ হলে তা পরিণতি পায় মহাবিদ্যার স্তরে। উচ্চ তান্ত্রিক সাধনার ভেতর তাই সাধ্য কালী, তারা, ত্রিপুরসুন্দরী ইত্যাদি শক্তিনামের দশটি সিদ্ধবিদ্যার ক্রম রয়েছে। একত্রে এঁরাই ‘দশমহাবিদ্যা’। প্রত্যেক মহাবিদ্যার একজন করে ভৈরব আছেন।
শক্তিসঙ্গমতন্ত্রে দশমহাবিদ্যার ভৈরবদের নাম রয়েছে। কালীর ভৈরব হলেন মহাকাল, ত্রিপুরসুন্দরীর ললিতেশ্বর, মা তারার ভৈরব অক্ষোভ্য, ছিন্নমস্তার বিকরালক, ভুবনেশ্বরীর মহাদেব, ধূমাবতীর ভৈরব হলেন কালভৈরব, কমলার নারায়ণ, ভৈরবীর বটুক, মাতঙ্গীর সদাশিব এবং মা বগলার ভৈরব মৃত্যুঞ্জয়।
দশমহাবিদ্যা ও দশজন ভৈরবের প্রচলিত নামের বাইরে অন্যরকম নামও পাওয়া যায় চামুণ্ডাতন্ত্র, মালিনীবিজয়, তোড়লতন্ত্রে। শক্তিসঙ্গমতন্ত্রে মা ধূমাবতীর ভৈরব হলেন কালভৈরব কিন্তু তোড়লতন্ত্র মতে ধূমাবতী দেবী বিধবা বলে তাঁর ভৈরব নেই। আবার মহানীলতন্ত্রে ভৈরব নামেই আমরা একটি পীঠের উল্লেখ পাচ্ছি। পীঠাধিষ্ঠাত্রী হলেন ভৈরবী। তন্ত্রসাধকেরা বলেন যে উজ্জয়িনীর প্রসিদ্ধ মহাকাল বা কালভৈরবের স্থানই এই ভৈরবপীঠ। বিভিন্ন শাস্ত্রে রুদ্র-শিবের যে উল্লেখ রয়েছে তার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আচার্য সায়ন বললেন, ‘যিনি অন্তরালে সকলকে কাঁদান তিনি রুদ্র। মানুষের শত্রুকেও যিনি কাঁদিয়ে মারেন তিনিই রুদ্র। সংসার নামক দুঃখকে যিনি গলিয়ে দূর করেন তিনিই রুদ্র।’ বৈদিক রুদ্র আর পৌরাণিক ও তান্ত্রিকী ভৈরবের এভাবেই যেন মেলবন্ধন ঘটেছে উপাসকদের আত্ম-ভাবনায়।

চুরাশি মহাসিদ্ধ শ্মশানের কালভৈরব
শিবের ত্রিনয়ন, কিন্তু কৈলাসনাথের শিবের চতুর্মুখ ও চতুর্নয়ন। চারদিকে তাঁর নয়নমণির চারটি নাম রয়েছে। দক্ষিণ দিকের চোখে রয়েছে ঘননীলমণি, পশ্চিমে পদ্মরাগমণি, উত্তরে স্বর্ণমণি আর পূর্বে স্ফটিক।
কৈলাসনাথের প্রত্যেক দিক থেকে অর্থাৎ চারদিক থেকে চারটি নদীর মুখ বয়ে চলেছে। দক্ষিণমুখী স্রোতটা ময়ূরাকৃতির, পশ্চিমদিকের স্রোতধারাটি হাতির মুখের মতো, উত্তরে সিংহমুখ আর পূর্বদিকে অশ্বমুখ। এই অশ্বমুখী ঝর্ণা ধরে এগলেই কৈলাসনাথের পদতলে রয়েছে চুরাশি সিদ্ধযোগী শ্মশান।
শ্মশানে থাকেন বৌদ্ধ লামা-পুরোহিত। মাথায় জটা, গলায় রুদ্রাক্ষ, স্ফটিক আর মহাশঙ্খের মালা। এখানকার প্রচলিত নিয়ম হল চুরাশি মহাসিদ্ধ শ্মশানে প্রবেশ করতে হলে আগে কালভৈরবকে তুষ্ট করতে হয়।
এই বিদ্যায় কালভৈরব হলেন শ্মশানরক্ষক। তাঁর অনুমতি বিনা শ্মশানে যেতে নেই। তাতে বিপত্তি ঘটে। মহাশ্মশানে কালভৈরব জাগ্রত থাকেন বলে সাধকেরা সেখানে সাধন শুরুর আগে কালভৈরবের অনুমতি প্রার্থনা করেন। মহাশ্মশানে অশ্রদ্ধা নিয়ে প্রবেশ করলে শ্মশানরক্ষক কালভৈরব অসন্তুষ্ট হন। সাধনক্রিয়ায় নানান দুর্ঘটনা ঘটে।
শ্মশান আর মহাশ্মশানে কিছু পার্থক্য আছে। শ্মশান মানেই কিন্তু মহাশ্মশান নয়। যে শ্মশান লাগোয়া নদীর ঘাটে জোয়ার-ভাটা খেলে না সেটিই মহাশ্মশানে পরিণত হয়। আর মহাত্মাদের দীর্ঘকালীন সাধনশক্তিতে শ্মশান মহাশ্মশান বলে পরিগণিত হয়। আর এ সমস্ত শ্মশানেই শ্মশানরক্ষক কালভৈরব জাগ্রত থাকেন বলে তাঁর অনুমতির জন্য প্রার্থনা করে মহাশ্মশানে প্রবেশ করেন সাধকেরা। কালভৈরবের উদ্দেশে ভোগ চড়ান। চুরাশি মহাসিদ্ধ শ্মশানে কপালপাত্র — মানুষের মাথার খুলিতে কালভৈরবকে দেওয়া হয় পঞ্চবিষ।
তান্ত্রিকগুরুদের কাছে কপালপাত্র থাকে। অনেকেই সেটিকে রুপো দিয়ে বাঁধিয়ে নেন। কপালপাত্রে  শৈবতন্ত্রের সাধকেরা শিব-ভৈরবকে ভোগ নিবেদন করেন।
কালভৈরবের নামে চুরাশি মহাসিদ্ধ শ্মশানে যে ভোগ দেওয়া হয় তাকে বলা হয় পঞ্চবিষ। এই বিষের একটা তত্ত্ব আছে। সমস্তগুলোই দেহজাত দ্রব্য। মনের ঘৃণা ও ভয় থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য চুরাশি মহাসিদ্ধ শ্মশানে কালভৈরবকে পঞ্চবিষের কপালপাত্র নিবেদন করতে হয়। শ্মশান-পুরোহিতকে মূল্য ধরে দিলে তিনিই ব্যবস্থা করে নেন। এইসব শ্মশানে অনেক মহাযোগী ও সিদ্ধপুরুষরা জীবনের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে গিয়ে যোগাসন থেকে আর ওঠেননি। এখানেই শরীর ছেড়ে মহানির্বাণের দিকে তাঁরা চলে গেছেন।

স্কন্দপুরাণে কালভৈরব
কাশীর চক, চৌখাম্বা পেরিয়ে পূর্বদিকে বড় পোস্ট অফিসকে বাঁ-হাতে রেখে দক্ষিণদিকে গলিপথে কিছুটা গেলেই আরও বাঁক পেরিয়ে কালভৈরবের বিখ্যাত মন্দির। এ পথ দিয়ে কালভৈরব দর্শন করতে তান্ত্রিক ও অঘোরী সাধুরা আসেন। এ পথটি পেছন দিকের।
দক্ষিণদ্বার দিয়ে প্রবেশ করে সাধকেরা কালভৈরবকে দর্শন করেন। উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত সামনের দ্বার দিয়ে বেরিয়ে যে গলি পোস্ট অফিস পর্যন্ত গিয়েছে তাকে বলে কালভৈরবের গলি। এ পথ দিয়ে সাধারণত দর্শনার্থীরা আসেন।
দক্ষিণদিকটা যমের। শরীরের দক্ষিণদিকে থাকে মানুষের প্রবল ইন্দ্রিয়— কামনার সাড়া। সেজন্যই দক্ষিণদিকটা, দক্ষিণদ্বারের শ্বাসটা সাধকেরা স্বাভাবিক গতি থেকে কমিয়ে নেন। এতে দেহ ও মন ঠান্ডা থাকে। জাগতিক চাহিদা ও মনের অস্থিরতা কমে যায়।
দক্ষিণদিকেই যমপুরী। তাই কাশীপুরীর কোতোয়াল কালভৈরবকে দর্শন করতে অঘোরী ও তান্ত্রিকগুরুরা দক্ষিণদ্বারটিই ধরেন। দেহের দক্ষিণ— ডান। বাম ও দক্ষিণ। ইড়া ও পিঙ্গলা নাড়ির অবস্থান। যার যত পিঙ্গলা নাড়ির শ্বাসের গতিবেগ বেশি তার তত জীবনে অস্থিরতা বেশি।
কাশী যে শিবের ত্রিশূলের উপর স্থাপিত তা বেশ বোঝা যায় রিকশ চড়ে এলে। দক্ষিণদিকটা ত্রিশূলের এক ফলার মতো। তারপরে রাস্তা ঢালু হতে হতে গোধূলিয়া পর্যন্ত এলে আবার চড়াই আরম্ভ হল। আদি বিশ্বনাথ পর্যন্ত দারুণ চড়াই, রিকশওয়ালারা খুব দম নিতে নিতে নেমে টানতে টানতে রিকশ নিয়ে যায়। শূলের মধ্য ফলার মতো এ পথটা। তারপরে আবার রাস্তা উতরাই। শেষে কালভৈরবের গলির কাছে এসে রাস্তা এবার উঁচু হতে শুরু করে। এ দিকটা ত্রিশূলের তৃতীয় ফলার মতো।
কাশীর কালভৈরবের মন্দির এমন কিছু বড় নয়। মাঝখানে ছোট গর্ভমন্দিরে উত্তরমুখী দরজা। পূর্ব-পশ্চিমে আরও দুটি দরজা আছে। প্রাচীন মন্দির নষ্ট হওয়ার পর পুনার পেশোয়া বাজিরাও ১৮২৫ সালে এটি তৈরি করেছিলেন, কিন্তু বিগ্রহটি অতীব প্রাচীন। গর্ভমন্দিরের চারদিকে ঘেরা বারান্দা। সামনে উত্তরমুখী প্রবেশদ্বার। দ্বারের একপাশে ভৈরবের বাহন একটি কালো পাথরের সারমেয়র মূর্তি। দ্বাররক্ষীর মতো  সদাসতর্ক হয়ে পাহারা দিচ্ছে। তাছাড়া দণ্ড হাতে দুটি দ্বারপাল মূর্তিও আছে।
মন্দির আগে প্রদক্ষিণ করে সাধক কালভৈরবকে দর্শন করেন। সিঁড়ির পাশেই তামা দিয়ে বাঁধানো ত্রিশূল— কালভৈরবের দণ্ড। এই দণ্ডে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম জানিয়ে তাঁরা দু’তিনটি সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠেন। সামান্য খোলা জায়গা। তিনদিক খোলা নাটমন্দিরের মতো। এখান থেকে সকলেই কালভৈরবকে দর্শন করেন। সাধুসন্তেরা গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করে স্পর্শ করে প্রণাম করেন। শ্মশানরক্ষক কালভৈরবের মূর্তি গৃহীদের ছুঁতে নেই।  দূর থেকে প্রণাম করে বিভূতির পাত্র থেকে কপালে টিকা লাগিয়ে নেমে আসতে হয়।
গর্ভমন্দিরে উঁচু পাথরের বেদির ওপর সর্বাঙ্গ রক্তবর্ণের পট্টবস্ত্রাবৃত কালভৈরবের তিন ফুটের মতো বিগ্রহ। মুখে রুপোর মুখোশ লাগানো, বড় বড় চক্ষু। মাথায় মুকুট। সর্বাঙ্গে নানা ফুলের গয়না।
ভৈরবের বামদিকের বস্ত্র একটু তুলে ধরে পুরোহিত তেল-সিঁদুর মাখানো কালভৈরবের শরীরের কিছু অংশ দর্শন করান। সন্ন্যাসীরা বেলপাতা দিব্য অঙ্গে লাগিয়ে দিয়ে প্রার্থনা করেন, ‘কাশীকাপুরাধিনাথ কালভৈরব ভজে।’ এরপর কর্পুর আরতি করেন। শঙ্করাচার্যের লেখা কালভৈরবাষ্টক স্তোত্র পাঠ করেই অঘোরী সাধুরা কালভৈরবকে প্রণাম করেন।
কুকুরের পিঠে এক পায়ের ওপর অন্য পা দিয়ে বসে আছেন কালভৈরব। বিরাট দেহ, নীল রং তাঁর গায়ের, গলায় সাপের পৈতে— সর্পযজ্ঞোপবীত। কপালে চন্দ্রকলা ও ত্রিনেত্র, ব্যাদিত বদন— প্রসারিত মুখ। চতুর্ভুজ, হাতে ত্রিশূল, টঙ্ক নামের এক অস্ত্র, পাশ ও দণ্ড ধারণ করে আছেন। কোমরে সোনার কিঙ্কিণী, পায়ে রত্নখচিত পাদুকা। মাথার জটা সুবর্ণবর্ণ— সোনার রঙের— সমস্ত পিঠ ছড়িয়ে রয়েছে।
কালভৈরব মৃত্যুদর্পনাশক — মৃত্যুর অহংকারকে নষ্ট করেন — মৃত্যুকে আটকে রাখেন, ভুক্তিমুক্তিদাতা — ভোগবাসনা থেকে মানুষের বাঁধনকে আলগা করেন, দৃষ্টিপাতের দ্বারাই সকলের সমস্ত পাপ নাশ করেন।
কালভৈরবের গলায় কপালমালা, তিনি কোতোয়াল — শাসক হয়ে মৃত্যুকে আটকে জীবনের সমস্ত রকম ভোগকে শিকল পরিয়ে বেঁধে দেন। এজন্যই মোক্ষকামীরা কালভৈরবের পুজো করেন।
একসময় ব্রহ্মার খুব অহংকার হল। তিনি তাই ত্রিশূলপাণি, ভাললোচন, নাগভূষণ মহাদেবকে দর্শন করে অবাক হয়ে বলে উঠলেন, ‘এই যে চন্দ্রশেখর, তুমি ত্রিশূল ধরে, সাপকে গলায় বেঁধে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রয়েছ, ভুলে যেও না যে, তুমি আমার ললাট থেকে উদ্ভূত হয়েছ। কপাল থেকে বেরিয়ে তুমি তো ভীষণ কাঁদছিলে, তাই তোমার নাম আমি দিয়েছিলাম রুদ্র। তুমি আমার ছেলে, আমার শরণ নাও। আমি তোমাকে রক্ষা করব— মামেব শরণং পাহি পুত্র রক্ষাং করোতি মে।’
প্রজাপতি ব্রহ্মার মুখে এইসব অহংকারের কথা শুনে শিব ভয়ঙ্কর রেগে গিয়ে ভৈরবের আকৃতির এক পুরুষকে সৃষ্টি করে তাকে বললেন, ‘কালভৈরব, তুমি এই পদ্মযোনি ব্রহ্মাকে শাসন কর — পঙ্কজজন্মাসৌ শাস্যস্তে কালভৈরব। কালের মতো তুমি দীপ্তিমান, সেজন্য তুমি কালরাজ। সমগ্র বিশ্বকে ভরণ করতে তুমি সমর্থ। সেজন্য তুমি ভৈরব। কালও তোমাকে ভয় পায়, তাই তুমি হলে কালভৈরব। তুমি রুষ্ট হয়ে দুষ্টদের মর্দন করবে— মেরে ফেলবে। তাই তোমার আরও একটি নাম আমর্দ্দক।’
এটুকু বলেই ক্ষান্ত হলেন না। শিব আরও বলতে লাগলেন, ‘ভক্তদের পাপকে তুমি ভক্ষণ করবে — খেয়ে নেবে বলেই তোমার আরেক নাম হল গিয়ে পাপভক্ষক। আমার এই মুক্তিক্ষেত্র কাশী সকল তীর্থের সার। তুমি কালরাজ বলেই এখানকার অধিপতি হয়ে সবাইকে শাসন করবে।’
স্কন্দপুরাণে কালভৈরবের এই মাহাত্ম্যটি রয়েছে। বিশ্বনাথ কর্তৃক সৃষ্ট, বর্ধিত ও আদিষ্ট হয়ে ভৈরব এবার নিজের শক্তিতে ব্রহ্মার একটি মাথা তাঁর বাঁ হাতের ছোট্ট আঙুলটি দিয়ে ছেদন করে দিলেন শিবকে তুচ্ছজ্ঞান করার অপরাধে।
আগে ব্রহ্মাও পঞ্চানন ছিলেন। কিন্তু কালভৈরবের কোপে তাঁর পঞ্চম মস্তকটি ছিন্ন হয়ে তিনি চতুরানন হলেন। এদিকে ব্রহ্মার মাথাটি এবার কালভৈরবের হাতে আটকে গেল। সেটিকে তো আর কোনওভাবেই কালভৈরব ফেলতে পারছেন না।
শিব তাঁকে বললেন, ‘তুমি তীর্থে তীর্থে ঘুরতে থাক। তীর্থের মাহাত্ম্যে ব্রহ্মার নরকপাল তোমার হাত থেকে খসে পড়বে।’
বিশ্বনাথের আদেশে কালভৈরব ভারতের সমস্ত তীর্থে ঘুরতে লাগলেন। ব্রহ্মার কপালটি কোথাও খুলে পড়ল না! বিশ্বনাথের আদেশ পেয়ে কালভৈরব ব্রহ্মাদেবকে অহেতুক অহংকার করার কারণে শাস্তি দিলেন অথচ তাঁর নরকপাল ভৈরবের হাতে আটকালেন কেন দেবাদিদেব? এর কারণ হল, জীবনে চলার পথে প্রয়োজন বুঝে তোমার স্বজনবর্গের দিকে তাঁদের কৃত অপরাধের জন্য তুমি আঙুল তোল, বুঝিয়ে দাও যে, যেগুলো তোমরা করছ, ভালো করছ না। মানে শুধু বোঝাও তাঁদের— হিতের বিপরীতে— ভালো কাজের বিরুদ্ধে কখনও কিছু করতে নেই— এগুলো শুধু ব্যক্ত কর, আগ বাড়িয়ে কোনও শাস্তি দিতে যেও না। না হলে তোমাকেও কৃতকর্মের দায় নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে।
কর্মফল মানুষকে শাস্তি দেয়। মানুষের মানুষকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার নেই। তা যদি হয় এতে হিতে বিপরীত ফল হয়। শিব কালভৈরবকে ব্রহ্মার মাথা উড়িয়ে দিতে তো বলেননি। হাতে ক্ষমতা পেয়ে মানুষও তো মাঝে মাঝে এরকমভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে থাকেন। কালভৈরবের হাতে যে মুণ্ড, ওটি হল কর্মের ফল।
সব মানুষের হাতেই থাকে কর্মের ফল। ঘরে ঘরে যে গোপাল— বালগোপালের মূর্তি থাকে তাঁর হাতের লাড্ডুটি আসলে মানুষের কৃতকর্মের ফল। কর্ম ঠিক হলে মানুষ গোপালের মতো বালকবৎ সরল হয়ে যান, তাঁকে সবাই সমাদর করে থাকেন। গোপালমূর্তির যে তিনবেলা সেবাপুজো তা ওই মানুষের ভালো কর্মফলেরই সমন্বয়ক। ব্রহ্মাকপাল মোচন করবার উদ্দেশে কালভৈরব শিবের নির্দেশেই তীর্থযাত্রা করলেন ঠিকই কিন্তু কর্মফল থেকে রেহাই তো পেলেন না। মানুষও একইভাবে কর্মফলের মাথা দিয়ে তীর্থে তীর্থে ঘোরেন— দেবতার সাহায্য চান, অশান্তি ও দুর্ভোগ কাটাতে পুজো দেন, যাগযজ্ঞ করেন, তন্ত্র-মন্ত্র, তাবিজ-কবচ কিছুই বাদ যায় না, কিন্তু কর্মস্খলনের যে ফলটা তা থেকে তাঁর নিষ্কৃতি যে নেই!
কাশীতে সাধকেরা বাস করেন কর্মফল স্খলন করতেই। কালভৈরব সমস্ত তীর্থ পরিক্রমা করে কাশীতেই এসে থিতু হলেন। কাশীই একমাত্র তীর্থ যেখানে ব্রহ্মাকপাল মোচন সম্ভব— কাশী তাই মুক্তিকামীদের প্রধান জায়গা।
কাশীর জালালিপুরাতে রয়েছে অন্যতম প্রাচীন একটি স্তম্ভ, যার নাম লাটভৈঁরো— লাটভৈরব। তার দক্ষিণ পাশে একটা বিরাট পুষ্করিণী আছে। এর উত্তর পাড়ে স্তম্ভটি প্রোথিত। এই পুষ্করিণীটিকেই বলা হয় কপালমোচন কুণ্ড।
ব্রহ্মা-নির্যাতনের অপরাধে কালভৈরব কাপালিকব্রত নিয়ে কপাল সমেত গোটা ভারত ঘুরে এসে বিশ্বনাথের শরণ নিলে তাঁর কৃপাতে এইখানে তাঁর হাত থেকে ব্রহ্মাকপাল খুলে পড়ে যায়। সেই ব্রহ্মাকপাল মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে এই বিরাট কুণ্ডটি সৃষ্টি হয়। কালভৈরব সর্বপাপ মুক্ত হয়ে ফের কাশীর শাসনকর্তার কাজে লেগে পড়েন। এখানে পুষ্করিণীর ধারে অনেকেই পূর্বপুরুষদের শ্রাদ্ধাদি করেন। একটি ছোট্ট মন্দিরে কালভৈরবের মূর্তি আছে।
প্রতি অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণাষ্টমীতে কালভৈরব মন্দিরে উৎসব হয়। সেইদিনই পুরাণমতে তাঁর আবির্ভাব হয়েছিল। সাধকেরা বলেন, ‘কাশীতে সাধনা করা সহজ কথা নয়। এখানে সাধনা করতে এসে অনেক বিপত্তি ঘটে। ছ’মাস ধরে যে কোনও সাধক ও তপস্বীদের বিঘ্ন-বিপর্যয় ঘটতে থাকে। এ সময়টায় আসলে কালভৈরব পরীক্ষা করেন। সাধকের আস্তানা জোটে না, নানান অত্যাচার ও অপমান সহ্য করতে হয়। এই সময়টাতে সাধককে প্রসন্ন চিত্তে সমস্ত সহ্য করতে হয়।’
কাশীর চলন্ত শিব ত্রৈলঙ্গ স্বামীকে পর্যন্ত এখানে এসে কত অত্যাচার-অবিচার সহ্য করতে হয়েছিল। মানুষের হেনস্তা, রাজ-হেনস্তা কাটিয়ে ত্রৈলঙ্গস্বামী এখানে এসেই শেষমেশ হয়ে উঠলেন মুক্তপুরুষ। এরকম দৃষ্টান্ত কাশীর বুকে অজস্র রয়েছে।
সাধকেরা বলেন, ‘কালভৈরবের মন্দির এসে কিছুটা সময় শিবনাম জপ করতে হয়।’ অনেকে এখানে এসে কালো রঙের সুতোর মালা— কালভৈরবের ডোর পরেন পূজারিদের সাহায্যে। কালভৈরব মন্দির পেরিয়ে গেলেই রয়েছেন দণ্ডপাণিভৈরব — কাশীর কোতোয়াল কালভৈরবের সহচর তিনি।
পূর্ণভদ্র যক্ষের ছেলে হরিকেশ এখানে এসে তপস্যাতে বসেন। বিশ্বনাথ প্রসন্ন হয়ে তাঁকে কাশীর দণ্ডধারী বরকন্দাজ উপাধি প্রদান করেন এবং কালভৈরবের সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। তাঁর নাম হয় দণ্ডপাণিভৈরব।
দণ্ডপাণিভৈরব এখানে দণ্ডপাণিশ্বর শিব প্রতিষ্ঠা করেন। কাশীর বিশ্বনাথ মন্দিরের পশ্চিমদিকের গলিতে রয়েছেন দণ্ডপাণিশ্বর শিব। তিনিই সকলের দণ্ডবিধান করে কালভৈরবের কাছে নিয়ে আসেন। শিবের ছেলে কার্ত্তিকেয় একবার দণ্ডপাণিকে যথাবিধি সম্মান জানাননি বলে তাঁকে পর্যন্ত কাশী ছেড়ে চলে যেতে হয়!
দেবসেনাপতি কাশী ত্যাগ করে বাবার কাছে অভিযোগ  করলেন। শিব বললেন, ‘দেখ, আমি কিন্তু তোমাকে কাশীতে ফিরিয়ে আনতে পারব না। কারণ আমিই তাকে এখানকার দণ্ডপাণি করেছি অন্যায়ের শাস্তি বিধান করবার জন্য। তুমি তাঁকে অপমান করে ঠিক করনি। যাও, তুমি দক্ষিণ ভারতে গিয়ে বাস কর।’
বিশ্বনাথের আদেশে কার্তিক দাক্ষিণাত্যে শৈলমল্লিকার্জুন পর্বতে বাস করতে লাগলেন। ঋষি অগস্ত্য যখন কার্তিকের কাছে গেলেন তখনই তিনি বাবা বিশ্বনাথের কাছে কাশী মাহাত্ম্য সম্পর্কে যা শুনেছিলেন তা ঋষিকে শোনান। স্কন্দপুরাণের কাশীখণ্ডে এই বৃত্তান্ত রয়েছে।

কালভৈরবের ব্রত ও পুজো
প্রতি মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে কালাষ্টমীব্রত পালন করেন কালভৈরবের উপাসকেরা। বছরে বারোটি মাসে বারোটি কালাষ্টমী পালন করেন তাঁরা। কালভৈরব যে সব সাধুদের ইষ্ট তাঁরা এই দিনটি অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে করেন। উপবাসী হয়ে কালভৈরবের পুজো করেন।
সাধকেরা বলেন, ‘বছরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কালাষ্টমীটি মাঘ মাসের। মাঘের কৃষ্ণ মার্গশীর্ষ অষ্টমী ভৈরবজয়ন্তী। এদিন মহাদেব কালভৈরবের রূপ ধারণ করেছিলেন। সাধারণ মানুষও যদি প্রতিটি কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীতে উপোস করতে না পারেন তাহলে ভৈরব-অষ্টমীর দিন নির্জলা থেকে ভৈরবের পুজো করলে সংসারের যাবতীয় বিপত্তি থেকে নিষ্কৃতি পেতে পারেন। ভৈরব সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধির দেবতা। তাঁর আরাধনা করলে সমস্ত ফলাফলে সাফল্য আসে এবং আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। কালাষ্টমীর দিন কুকুরকে মিষ্টি রুটি, কাঁচা দুধ দিলে ভৈরবের আশীর্বাদ পাওয়া যায়।’
কাশীতে ভগবান কালভৈরবকে চাল, গোলাপ ফুল, নারকেল, চন্দন, দুধ এবং শুকনো ফল ভোগ হিসেবে নিবেদন করা হয়। সমস্ত দেবতার পুজোতে ঘিয়ের প্রদীপ জ্বালানো হয়, তবে কালভৈরবের পুজোয় সর্ষের তেলের প্রদীপ ও ধূপকাঠি জ্বালানোর নিয়ম। ধুনো দিতে নেই।
কালাষ্টমীর উপবাস ভঙ্গের আগে চাঁদ দেখে কালভৈরব-শিলায় জল ঢেলে মনের ইচ্ছা জানিয়ে ভক্তেরা সব প্রার্থনা করেন।
কালভৈরবের বাহন কুকুর বলে অনেকেই রোজ রাস্তার কুকুরদের কেক-বিস্কুট-রুটি খাওয়ান। জ্যোতিষশাস্ত্র মতে কালভৈরবের আরাধনা করলে রাহু ও কেতুর অশুভ প্রভাব থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। কুকুরকে খাওয়ালে এ দোষ কেটে যায়। কাশীতে এসে কালভৈরবকে দর্শন ও পুজো না দিলে, কাশীদর্শন অপূর্ণ থাকে বলেই প্রচলিত রয়েছে। শিব হলেন কাশীর রাজা আর কালভৈরব তাঁর কোতোয়াল। তাই তিনি আশীর্বাদও করেন, আবার অভিশাপও দেন। স্বয়ং যমরাজেরও কাশীর অধিবাসীদের শাস্তি দেওয়ার অধিকার নেই। কাশীতে সাজা ঘোষণার অধিকার একমাত্র কালভৈরবের।
কালভৈরব মন্দিরের ঠিক পিছনেই অবস্থিত বিশ্বেশ্বরগঞ্জ থানা। থানার প্রধান অফিসারের চেয়ারে বিরাজমান বাবা কালভৈরব। সেই চেয়ারে কালভৈরবের ছবি রাখা থাকে সর্বক্ষণ। তাঁকে সাক্ষী রেখে থানার অফিসারেরা কাজ করেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় যুগের পর যুগ এই চেয়ারে অন্য কেউ কখনও বসার সাহস দেখাননি। থানার সামনে প্রতিষ্ঠিত কালভৈরবের মূর্তি। রোজ তাঁকে প্রণাম জানিয়ে শুরু হয় বারাণসীর কোতোয়ালির কাজ।

উজ্জয়িনীর কালভৈরব
উজ্জয়িনীর কালভৈরব মূর্তিটি কুমকুম, সিঁদুর দিয়ে  পাথরের আকারে একটি মুখ। কালভৈরবের রৌপ্য মস্তকটি মারাঠা শৈলীর পাগড়ি দ্বারা সজ্জিত, যা মারাঠা সেনাপতি মহাদাজি শিণ্ডের সময়কালের একটি ঐতিহ্য। অষ্টভৈরবের উপাসনা শৈব-ঐতিহ্যের অংশ এবং কালভৈরবকে তাঁদের প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কালভৈরবের উপাসনা ঐতিহ্যগতভাবে কাপালিক এবং অঘোরা সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা সময় পর্যন্ত সীমিত ছিল। সে সময়টায় উজ্জয়িনী কাপালিক ও অঘোরা সাধুদের একটি বিশিষ্ট কেন্দ্র ছিল।
কালভৈরব হলেন উজ্জয়িনীর অভিভাবক দেবতা। তাঁকে শহরের সেনাপতি মনে করা হয়। শিপ্রা নদীর তীরে বিশাল সিদ্ধবটের পাশেই বর্তমান মন্দিরের কাঠামোটি একটি পুরনো মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের উপর নির্মিত। মূল মন্দিরটি পারমার রাজা ভদ্রসেনের তৈরি। মন্দিরের আশপাশে নয় শতকের কিছু মূর্তি আছে। স্কন্দপুরাণের অবন্তী খণ্ডে উজ্জয়িনীর কালভৈরবের উল্লেখ রয়েছে। এখানকার কালভৈরবের নৈবেদ্য হল মদ্য।
শত শত ভক্ত নৈবেদ্য হিসেবে মদ দান করেন, যা পুরোহিত কালভৈরবের মুখের মধ্যে ঢেলে দেন। মদ অলৌকিকভাবে মূর্তির মধ্যে অদৃশ্য হয়ে যায়। ভক্তের বিশ্বাস, মূর্তির মধ্যে কোনও গহ্বর বা ফাটল নেই!
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ও বিজ্ঞানীরাও এই রহস্য উদঘাটনে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই এই রহস্য এখনও অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এমনও বিশ্বাস, রবিবার কালভৈরবের মন্দিরে মদ নিবেদন করলে গ্রহপীড়িত ব্যক্তি সমস্ত ধরনের গ্রহদোষ থেকে মুক্তি পান। মদভোগ দিলে বাবা কালসর্পদোষ, অকাল মৃত্যু এবং পিতৃদোষের মতো বিপজ্জনক ত্রুটি থেকেও মানুষকে মুক্তি দেয়।
আগে ভৈরব বাবাকে মদের সঙ্গে মাংসও নিবেদন করা হতো, কিন্তু পরে শুধু মদ নিবেদনের প্রবণতা চলতে থাকে। কালভৈরবের মন্দিরে মদ নিবেদন করাকে সংকল্প ও শক্তির প্রতীক বলে মনে করা হয়। মানুষ তাই এখানে দেবতাকে মদ নিবেদন করলেও প্রসাদ হিসেবে নিজেরা তা গ্রহণ করেন না।

কালভৈরব মন্ত্র
তান্ত্রিকগুরুরা বলেন, ‘প্রত্যহ কালভৈরব মন্ত্রটি পাঠ করতে। এতেই তাঁর অসীম অনুগ্রহ লাভ করা সম্ভব। কালভৈরব মন্ত্রটির সঠিক জপে সব ধরনের প্রতিপক্ষকে পরাজিত করা যায়। তবে প্রতিপক্ষ মানে ঈর্ষা ও ক্লেশকর সম্পর্কের বিষয়াদি কিন্তু কখনওই নয়। প্রতিপক্ষ নিজের  রিপু ও ইন্দ্রিয়রা। যেগুলো সদর্থক অর্থেই মানুষকে সঠিক রাস্তাতে এগিয়ে চলতে বাধা দেয়।’
ভৈরব মূর্তিগুলো সাধারণত প্রাচীন শিব মন্দিরের উত্তর-পশ্চিমদিকেই থাকে। চারহাত। তাঁর শারীরিক চেহারা ভীতিজনক। শিব মন্দিরে নিয়মিত পুজো শুরু হয় সূর্য দেবতার আরাধনা দিয়ে, শেষ হয় ভৈরব দেবতার উদ্দেশে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেই। জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী রবিবারের রাহুকাল কালভৈরবের উপাসনা করার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত এবং শুভ সময়। পঞ্জিকায় রাহুকালের সময় দেওয়া থাকে। সাধারণত ভোর চারটে থেকে সকাল সাড়ে ছটা অবধি এই সময় থাকে। এই ক্ষণে নারকেল ভেঙে ভৈরবমূর্তিতে সিঁদুর দান করে, জুঁই ফুল বা যে কোনও সুগন্ধি ফুলে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়া যায়। তারপর আটার তৈরি প্রদীপে কাপাস তুলোর পলতেয় সর্ষের তেল ঢেলে জ্বালিয়ে কালভৈরবের আরতি করতে হয়।
যে কোনও শক্তিপীঠই ভৈরব দ্বারা সুরক্ষিত। ভৈরব দেবতার অনুমতি নিয়ে সাধকেরা শক্তিপীঠের দেবীকে দর্শন করতে যান। সাধকেরা বলেন, ‘পঞ্চভূতের অধিপতি হলেন কালভৈরব। দেহের পাঁচটি চক্রে আছে পাঁচটি ভূত। কালভৈরবের মন্ত্র জপের সময় দেহের পাঁচটি চক্রকে বাতাস দিয়ে চালনা করতে জানলে সেটি নিমেষে জেগে যায়। মন্ত্র জাগলে পৃথিবী, আগুন, জল, বায়ু, ইথারের সঙ্গে দেহের একটা সম্বন্ধ তৈরি হয়। দেহটা প্রাকৃতিক উপাদান পেয়ে শক্তিশালী হয়ে যায়।’
কালভৈরব বীজমন্ত্র পাঠ করার সেরা সময় সকাল। রুদ্রাক্ষ ও মহাশঙ্খের মালায় কালভৈরব বীজ জপ করা হয়। গৃহী সাধকেরা রুদ্রাক্ষ ব্যবহার করেন। তন্ত্রসাধকদের মধ্যে অধিকারী ব্যক্তিরাই একমাত্র মহাশঙ্খের মালায় কালভৈরবের বীজমন্ত্র জপ করতে পারেন গুরুর নির্দেশ মতো। তবে গৃহস্থেরা কালভৈরব বীজমন্ত্র জপ না করে ভৈরববীজ জপ করতে পারেন। সেটাই বরং শ্রেয়। উত্তরদিকে মুখ করে বীজ জপের নিয়ম। গুরুর দেওয়া মন্ত্রও উত্তর বা পূর্ব মুখে বসেই জপ প্রশস্ত। কালভৈরব বীজ জপের পর কালভৈরব গায়ত্রী মন্ত্র পাঠ করেন অনেক সাধক। এই মন্ত্র সকলেই জপ করতে পারেন। এতে চঞ্চল মন স্থির হয়।
কালভৈরবের পুজো অত্যন্ত কঠিন। সঠিক বিধি মেনে পুজো না করতে জানলে যে কোনও সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। ঘরে কখনও কালভৈরবের পুজো করা উচিত নয়। মূর্তি রাখাও ঠিক নয়। অনেকে কালভৈরবের চিত্রপট ঘরে রাখেন, যা একেবারেই অনুচিত। তবে কালভৈরবের বিভূতি-ছাই ঘরে রাখা শুভকর। এই বিভূতি-ছাইকে রোজই পুজো করা যেতে পারে, ধূপ-দীপ দেখিয়ে মন্ত্র জপের মাধ্যমে। কালভৈরবের মন্ত্র না বলে গৃহস্থের শিবের মন্ত্র উচ্চারণই ভালো।
কালভৈরব হলেন শিবের রুদ্ররূপ। তন্ত্রমন্ত্রেরও দেবতা। কালভৈরবতন্ত্র বলে আলাদা একটি মার্গই রয়েছে। শিবের পুজোর মতোই কালভৈরবকে প্রদোষকালে পুজো করার নিয়ম। সূর্যাস্তের দেড় ঘণ্টা আগে থেকে অস্ত যাওয়ার দেড় ঘণ্টা অবধি প্রদোষকাল থাকে। প্রদোষের সময়কালে পুজোর আগে স্নান করে পরিষ্কার পোশাক পরতে হয়। এরপর ভৈরব মন্দিরে ‘ওম কালভৈরবায় নমঃ’ মন্ত্র উচ্চারণ করার সময় বেলপাতাতে রক্তচন্দন লাগিয়ে অর্পণ করতে হয়। এই মন্ত্রটি গৃহস্থেরা অনায়াসে জপ করতে পারেন।
ভৈরবের পুজোয় যে পাত্র দিয়ে অর্ঘ্য নিবেদন করা হয়, তা উত্তরদিকে মুখ করে রাখারই নিয়ম। বেলপাতাও উত্তরমুখী করেই অর্পণ করতে হয়। রক্তচন্দন, ফুল, সুপারি, নারকেল, ফুলের মালা ও দক্ষিণা অর্পণ করতে হয়। তারপর গুড়, ছোলা, বাতাসা দিয়ে নৈবেদ্য সাজাতে হয়। মাটির প্রদীপ সর্ষের তেল দিয়ে জ্বালিয়ে কালভৈরবকে শেষে আরতি করতে হয়।
কালভৈরবের পুজো করার পর শিবপুজো আবশ্যক। সঙ্গে পার্বতী, গণেশ ও কার্তিকের পুজোও করতে হয়। তিন দেবতাকে অভিষেক করার পর পার্বতীকে বেলপাতা, ফুল ও লাল ওড়না অর্পণ করতে হয়। পুজো শেষে ধূপ-দীপ জ্বালিয়ে চরণ, নাভি ও আজ্ঞাচক্রে আরতি করাটাই বিধি। কালভৈরবের পুজো করলে সব রকমের ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কালভৈরবের ভোগে খিচুড়ি, গুড়, তেল ও চাল দেওয়ার নিয়ম। কালভৈরবের মন্দিরে লেবু, কালো তিল, ধূপ, সরষের তেল, অড়হড় ডাল দান করা শুভ। এইগুলো দান করলে জীবনের সমস্ত ঝামেলা, বিদ্বেষ, সমস্যা দূর হয়ে সাফল্য ও উন্নতি হয়।
কালভৈরব অষ্টকম যে কেউ প্রতিদিনই পাঠ করতে পারেন। এই মন্ত্র মানুষকে দুঃখ, কষ্ট-যন্ত্রণা, হতাশা, ক্রোধ, বেদনা থেকে মুক্তি দিতে পারে। আটটি শ্লোকে এই মন্ত্রে শঙ্করাচার্য ভগবান কালভৈরবের কাছে প্রার্থনা করেছেন।
আচার্য শঙ্কর লিখছেন, ‘কাশীর শ্রেষ্ঠ শাসক কালভৈরবকে নমস্কার, যাঁর পদপদ্ম দেবতাদের অধিপতি ইন্দ্রদেব পুজো করেন; যিনি আকাশকে তাঁর পোশাক হিসেবে পরিধান করেন, যাঁর যজ্ঞের সুতো হিসেবে একটি সাপ রয়েছে, মাথায় চন্দ্রকলা, তিনি অতি সহানুভূতিশীল; যিনি নারদ, দেবতাদের, পণ্ডিত এবং অন্যান্য যোগীদের দ্বারা অহরহ প্রশংসিত হচ্ছেন।’

অষ্টাঙ্গভৈরব
কাল কথার অর্থ হল সর্বশক্তিমান সময়। আর ভৈরব হল ভয়ঙ্কর। শিবের একটি বিশেষ রূপ বা ভয়ঙ্কর রূপকে বলা হয় কালভৈরব। শিবপুরাণ অনুযায়ী, আটজন —অষ্টাঙ্গভৈরব মহাবিশ্বের আটটি দিকের অধিপতি।
অষ্টাঙ্গভৈরব হলেন — অসিতাঙ্গভৈরব, রুরুভৈরব, চণ্ডভৈরব, ক্রোধভৈরব, উন্মত্তভৈরব, কপালিভৈরব, ভীষণভৈরব এবং সংহারভৈরব। এঁদের আবার একজন করে প্রধান ভৈরব রয়েছেন। আটজন ভৈরব নিয়ন্ত্রিত হন একজন মহাস্বর্ণ কালভৈরবের দ্বারা। যিনি সাধারণভাবে কালভৈরব নামেই পরিচিত। প্রত্যেক ভৈরবের একজন করে ভৈরবী থাকেন।  প্রাচীন শক্তিপীঠ ও শৈবপীঠে থাকে ভৈরব ও কালভৈরবের মূর্তি। পীঠগুলোর দ্বাররক্ষক হিসেবে পূজিত হন তাঁরা। শৈবপন্থী সাধুরা বলেন, ‘মহাজগতের বিশেষ দেবস্থানগুলির রক্ষাকর্তা হলেন ভৈরব। দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গগুলির রক্ষাকর্তা তিনিই।’
কেদারনাথের কালভৈরব মন্দির ডানদিকের পাহাড়ের উপরে অবস্থিত। হিন্দু পুরাণের পাশাপাশি বৌদ্ধশাস্ত্র এবং জৈনধর্মগ্রন্থেও কালভৈরবের কথা আছে। নেপালে কালভৈরব এবং তাঁর বাহন কুকুরের বিশেষ পুজো হয়।
ওড়িশার কটকে একটি প্রাচীন কালভৈরব মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরটি একটা সময় ছিল নাথপন্থী সাধুদের আখড়া। মন্দিরের মধ্যে সিদ্ধযোগী মৎস্যেন্দ্রনাথের প্রস্তরমূর্তি রয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, মৎস্যেন্দ্রনাথের মূর্তিটি নয় শতকের। কটকের কালভৈরব মন্দিরে নিত্য পুজো-অর্চনা করেন নাথ সম্প্রদায়ের সন্ন্যাসীরা। হিমাচলপ্রদেশে কপালিভৈরব এক বিখ্যাত তীর্থক্ষেত্র। এই তীর্থের মহাদেব কপালিভৈরব নামে পূজিত হন। ইনি অষ্টাঙ্গভৈরবেরই একজন। কাশীতে একটা সময় গোরক্ষনাথ সম্প্রদায়ের সাধকদের খুব আসা যাওয়া ছিল। কালভৈরব মন্দিরের কাছে রয়েছে নাথ সম্প্রদায়ের যোগীদের একটি পুরনো মঠ। কালভৈরব মন্দিরের অল্পদূরে আছেন বাবা মঙ্গলনাথের আশ্রম। এখানে গোরক্ষনাথের বৃহৎ মূর্তি বিরাজমান। গোরক্ষ ধুনি প্রজ্বলিত থাকে সবসময়। কাশীর নাথ-মোহান্তরা কালভৈরব দর্শন করেন রোজ। কাশীর চেৎগঞ্জে বাবা গুলাবচন্দ্রের মঠ রয়েছে। নাথযোগীদের এই আখড়া-আশ্রমে ভগবান দত্তাত্রেয় ও অঘোরা যোগী কিনারাম বাবার মূর্তির সঙ্গে কালভৈরব বাবাও বিরাজমান।
শৈবপন্থী সাধকেরা অষ্টভৈরবের পুজো করেন একত্রে ধ্যানমন্ত্র উচ্চারণ করে গন্ধপুষ্প দিয়ে। অনেক সাধক  পৃথক ধ্যান করেও একে একে জটাজুটধারী চতুর্ভুজ অসিতাঙ্গভৈরব, ত্রিশূলধারী পানপাত্র হাতের রুরুভৈরব, চতুর্ভুজ ত্রিনয়নধারী চণ্ডভৈরব, খড়্গ ও নাগপাশে শোভিত করালবদন ক্রোধভৈরব, চার হাতে ঘণ্টা-ত্রিশূল-ডমরুধারী-মদিরা পানরত উন্মত্তভৈরব, শূলে টঙ্কার দেওয়া নীল শরীরের কপালিভৈরব, রক্তচক্ষুর ভীষণভৈরব এবং নারসিংহী শক্তিসংযুক্ত সংহারভৈরবের উপাসনা করেন — পূজয়ামি নমঃ, তর্পয়ামি নমঃ।
কাশীর হনুমান ঘাটের কাছে রুরুভৈরবের মন্দির রয়েছে। স্থানীয়রা তাঁকে আনন্দভৈরবও বলেন। অষ্টভৈরবের দ্বিতীয়স্থানে রয়েছেন রুরু। তাঁর গায়ের বর্ণ ধবধবে সাদা, নানা অলংকার পরিহিত, অধিকাংশ লাল চুনি পাথরের। চার হাতে রুদ্রাক্ষ মালা, বই, বীণা আর অঙ্কুশ ধরা। আবার কোথাও কোথাও উল্লেখ পাওয়া যায়&m
29d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বাক্য ও ব্যবহারের রুক্ষতায় শত্রু বৃদ্ধির যোগ। হাতের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি তাড়াতাড়ি করে  ফেলতে চেষ্টা করুন।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৯৮ টাকা৮৭.৭২ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৭ টাকা১১০.২১ টাকা
ইউরো৮৮.৭৮ টাকা৯২.১৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা