মৃত্যুর পরে মানুষের কী হয়? প্রেতাত্মারা পূর্বজন্মের নাম, আবেগ অতিক্রম করতে অক্ষম কেন? শ্রীঅরবিন্দের কাছে ধরা দিয়েছেন মৃত মহাত্মারা! দেশবন্ধু প্রশ্ন করলেন— ‘আপনি কে?’ অশরীরী কণ্ঠস্বর বলে— ‘উপাধ্যায়। ইউ মাস্ট ডিফেন্ড-অরবিন্দ।’ প্রেতের নির্দেশে দেশবন্ধু মামলা লড়ে জিতিয়ে আনলেন অরবিন্দকে। দেশব্রতী ভূপেন্দ্রনাথ বসুর হাতে ফুলের তোড়া তুলে দিল তাঁর পুত্রের প্রেতাত্মা! বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, বিবেকানন্দ, কানাইলাল দত্ত, মতিলাল রায়, মনোরঞ্জন গুহঠাকুরতা প্রমুখের রোমাঞ্চকর প্রেত দর্শনের কথা লিখেছেন সৈকত নিয়োগী।
অগ্নিগর্ভ সময়! স্বরাজের রঙিন স্বপ্নে বিভোর ঘুমন্ত বাঙালির প্রাণ, সে এক দৈবস্পর্শে সজাগ হয়ে উঠেছিল। আধ্যাত্মিক প্রেরণাই স্বাধীনতার মন্ত্র। মৃত্যুতেও স্তব্ধ হয় না গতিধারা। আলিপুর বোমা মামলা চলাকালীন চন্দননগর হাটখোলার জাতীয় মেলায় প্রদর্শিত চিত্রে শহিদ কানাইলালের স্বর্গারোহণ ব্রিটিশ পুলিসকে শঙ্কিত করে। ঈশ্বরের অবতার অরবিন্দকে মর্তের ব্রিটিশ আইন রুখতে পারে না জনমানসে আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের এমন প্রতিফলন ব্রিটিশ গোয়েন্দা নথিতে রয়েছে। বিপ্লবমন্ত্রে দীক্ষিত বাংলার আগুনপাখিদের মনে মৃত্যুঞ্জয়ের শংসাপত্র হয়ে উঠেছিল ‘আনন্দমঠ’, গীতা এবং স্বামী বিবেকানন্দ!
তখন রাত। তমসাচ্ছন্ন ঘরে খড়্গধারিণী মা কালীর সামনে জ্বলছে অনির্বাণ প্রদীপশিখা। ধ্বংসের দেবীর হাতেই নব সৃষ্টির বিধান। নরকরোটির মালা, বিক্ষিপ্ত কেশরাশি, শোণিত পিপাসু প্রসারিত জিহ্বা ও হাতে ধরা পাপিষ্ঠের দেহ ছেদিত নরমুণ্ড! বিপ্লবদুর্গ মুরারিপুকুর তখন প্রেতপুরী! বিপ্লবী পরিষদের নেতৃবৃন্দের বিধান, অত্যাচারী কিংসফোর্ডকে হত্যা করতে হবে। বইবোমা দিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। এবার সরাসরি প্রতিশোধ! বীরদর্পী নরেন গোঁসাইয়ের ঔৎসুক্য অগ্রাহ্য করে নেতা বারীন্দ্র দায়িত্ব দিলেন ‘দুর্গাদাস সেন’ ও ‘দীনেশ’-এর উপর। সমিতিতে এই দুই ছদ্মনামেই পরিচিত যথাক্রমে ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী। ‘ভবানী মন্দির’ গ্রন্থ শৃঙ্খলিত দেশমাতৃকার মুক্তিতে প্রাণ দিতে ও নিতে শিখিয়েছে তাঁদের। মা কালীর চরণ স্পর্শ করে এক ছুরি তুলে নিয়ে বারীন নিজের হাতে বসিয়ে দিলেন। বিপ্লবগুরু বারীন সেই রক্তে দুই যোদ্ধার কপালে এঁকে দিলেন বিজয় তিলক!
‘এতদিন তোমাদের আলাপ হয়নি, আজ মৃত্যুর পথে তোমাদের বন্ধুত্ব নিবিড় হয়ে উঠুক।’
বন্দেমাতরম্! ত্রিমূর্তি একত্রে উচ্চকণ্ঠস্বরে এই ধ্বনি তুললেন। বাংলার অগ্নিযুগের স্থপতিদের আধ্যাত্মিক চিন্তাই বিপ্লববাদকে উত্তরণের পথে নিয়ে যায়! মৃত্যুঞ্জয়ী বীরদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস দেশের কাজেই মোক্ষলাভ অবশ্যম্ভাবী। জন্ম হতেই তাঁরা দেশমাতৃকার জন্য বলিপ্রদত্ত।
মৃত্যুর পরে মনুষ্যজীবন কোথায় অন্তর্হিত হয়? চিরাচরিত বিজ্ঞানের সাম্রাজ্য এ প্রশ্নে মেধা খুঁজে পায় না। তবে সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের নাম জড়িয়ে রয়েছে পরলোক চর্চায়। এক্ষেত্রে ইউরোপীয় শিক্ষালোকে উদ্ভাসিতদের অভিমত অনেকাংশেই যুক্তির অন্তর্জালে সুসজ্জিত। প্রশ্ন উঠতেই পারে, মৃত্যুর পরে প্রেতাত্মা যদি সত্যিই থাকে, তবে তা পূর্বজন্মের নাম, আবেগ, প্রবৃত্তির বেড়াজাল অতিক্রম করতে অক্ষম কেন? বৌদ্ধধর্মে আত্মা জ্বলন্ত প্রদীপশিখার মতো। একটি প্রদীপ নিভে যেতে যেতে অবিশ্রান্ত ধারার অগ্রগতি নিশ্চিত করতে অপর প্রদীপ প্রজ্বলিত করে। ক্ষয়িষ্ণু আত্মা হবে নবরূপ আত্মার জন্ম। সেক্ষেত্রে, আত্মা অবিনশ্বর নয়। বরং, ধ্বংসেই তার চলমান ধারার বিকাশ। পরস্পর বিরোধী তর্ক-বিতর্কের অবকাশ অক্ষত রেখে স্মরণীয় বিপ্লবমনস্ক মনীষীদের জীবনালেখ্য। সেখানে প্রেতচর্চা ও প্রেতদর্শনের রোমাঞ্চকর কাহিনি বিজ্ঞানের জন্য পরীক্ষামূলক গবেষণার মঞ্চ গড়ে দিয়েছে। অগ্নিযুগের অগ্নীশ্বরের জীবনদর্শন দিয়েই আমরা সেই পরলোকচর্চায় আবিষ্ট হয়ে পড়লাম। শ্রীঅরবিন্দের দিব্য জীবন এমন অনেক রহস্যের অমীমাংসিত মায়াজাল। শ্রীঅরবিন্দের প্রেতচর্চায় ধরা দিয়েছেন প্রেতপুরীতে বিচরণশীল মৃত মহাত্মারা!
শ্রীঅরবিন্দ ও সংস্পর্শীদের প্রেতচর্চা
পাতার পর পাতা লিখে চলেছেন নলিনীকান্ত। আপাতদৃষ্টিতে পরিবেশ অতিপ্রাকৃত মনে হলেও সবকিছু অত্যন্ত স্বাভাবিক। পণ্ডিচেরির আশ্রম প্রাচীন ভারতের এক বিস্মৃতপ্রায় শক্তিতীর্থ, যেখানে সাধনার এক মহাজাগতিক স্তর পেরিয়ে মহাত্মার সন্ধান মেলে। ফরাসি দার্শনিক রেনে দেকার্তের সুচিন্তিত দর্শন মতে, আত্মাকে দেহের অস্তিত্ব ছাড়া কল্পনা করা যায়। আত্মার অস্তিত্ব শরীর থেকে পৃথক এবং অশরীরী!
১৯২৫ সাল। বাংলা তখন বিদ্রোহের তপ্তভূমি। দেশবন্ধুর নয়নমণি সুভাষচন্দ্র ও অন্যান্য বিপ্লবমনস্ক কংগ্রেস নেতৃবর্গ কারারুদ্ধ। কলকাতার পুলিস কমিশনার চার্লস টেগার্ট শশব্যস্ত। শ্রীঅরবিন্দের প্রিয় শিষ্য নলিনী তখন তন্ত্রসাধনার ন্যায় প্রাচীন ভারতের মুনি ঋষিদের অধিগত এক বিশেষ বিদ্যাবলে লিখে ফেলেছেন এবং অবিশ্বাস্য গ্রন্থ— ‘মৃতের কথোপকথন’। অবিশ্বাস্য সত্য সেই গ্রন্থে বিদ্যমান মাৎসিনি, কাভুর, গ্যারিবল্ডি, রোবস্পিয়ার, নেপোলিয়ন প্রমুখ ঐতিহাসিক চরিত্রের আত্মকথন। বলা যেতে পারে আত্মার কথন। ‘অকাল্টিজম’! বিজ্ঞান যে পদ্ধতিকে স্বীকৃতি দেয় না, সাধক নলিনীকান্ত বলেন— ‘ইহা বিজ্ঞান! সম্পূর্ণ বিজ্ঞান! রসায়ন, পদার্থবিদ্যার মতোই সাধন নিয়ম সূত্রে বাঁধা! অদৃশ্য শক্তি ও সত্তার বিষয়ে চর্চা।’ (তথ্যসূত্র: ‘Mysticism and Occultism’, Collected Works of Nolini Kanta Gupta-Volume 3)
সাধক নলিনীকান্তের আদিনিবাস পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর। রংপুরে ছাত্রজীবন। তারপর প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ঋষি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ তখন বাংলার তরুণ শক্তির প্রেরণা। ১৯০৫ সালের ৭ নভেম্বর পূর্ববঙ্গ ও অসম সমন্বিত পৃথক প্রদেশের লেফ্টেনেন্ট গভর্নর ব্যামফিল্ড ফুলার সাহেব ‘বন্দেমাতরম’ গান নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। রংপুরে বিপ্লবমনস্ক তরুণদের সঙ্গে প্রতিবাদে নলিনীকান্ত ‘বন্দেমাতরম’ গাইতে গাইতে প্রকাশ্য রাস্তায় শোভাযাত্রায় যোগ দিয়ে গ্রেপ্তার হলেন। সেই আমলে জুটল পঁচিশ টাকা জরিমানা। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময়েই হেঁদুয়া, কলেজ স্কোয়ার প্রভৃতি স্থানে সান্ধ্য সভায় নলিনীকান্ত দেখলেন চাদর গায়ে বক্তৃতারত অগ্নীশ্বর অরবিন্দকে। আকৃষ্ট হয়ে তিনি মুরারিপুকুর গুপ্ত সমিতির এক গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে উঠলেন। মুজফ্ফরপুরে বিস্ফোরণ থেকে আলিপুর বোমা মামলা, এক বছর আলিপুর জেলে কারাবাস, সর্বত্র নলিনীকান্তের জীবনপ্রবাহ অরবিন্দের অনুসারী। তারপর বোমার রাজনীতি ছেড়ে সাধনপথে পণ্ডিচেরী আশ্রমেও তিনি শ্রীঅরবিন্দের ছায়াসঙ্গী। ‘মৃতের কথোপকথন’ গ্রন্থে মহাত্মাদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপনে নলিনীকান্ত সে বিশেষ পদ্ধতিতে পরলোকচর্চার দিশারি, সন্ন্যাসী অরবিন্দের মতে তার নাম ‘অটোমেটিক রাইটিং’।
১৯১০ সালের ২৭ জানুয়ারি। আলিপুর বোমা মামলায় প্রধান সহায়ক ইন্সপেক্টর সামসুল আলমের হত্যায় যুক্ত থাকার অভিযোগে পুলিস অরবিন্দ ঘোষের ডানহাত নেতা বাঘাযতীনকে গ্রেপ্তার করে। বেশকিছু দিন পরে, ফেব্রুয়ারি মাসের কথা। রাত প্রায় আটটা বাজে। কলকাতার শ্যামবাজারে চার নম্বর শ্যামপুকুর লেনের দু’তলার বাড়ির সেই নির্দিষ্ট ঘরে তখন প্রেতচর্চায় মগ্ন অরবিন্দ ঘোষ। ‘কর্মযোগীন’ পত্রিকার অফিস। দিনের আলো নিভে এলেই সেখানে অনুগামীদের সঙ্গে মিলে আত্মাদের ব্যস্ত করে তোলেন অগ্নিপুরুষ অরবিন্দ। একটি ছোট তক্তপোষে বসেছেন তিনি, আশপাশে নক্ষত্রের চারধারে গ্রহ-গ্রহাণুপুঞ্জের মতো বসেছেন বারীন্দ্রনাথ ঘোষ, সৌরীন্দ্রনাথ বসু, বিজয়কুমার নাগ, হেম সেন, সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী ও নলিনীকান্ত। স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিমায় চলছে কথোপকথন। কথা প্রসঙ্গে উঠছে রঙ্গকৌতুকের তরঙ্গ। আত্মারা বাস্তবে নেমে এসেছেন, বলে চলেছেন জীবনকথা। সামনে রাখা কাগজে নিঃস্পৃহভাবে লিখে চলেছেন অরবিন্দ। আবিষ্ট রয়েছেন প্রেতাত্মার আবেশে। এমন সময় হঠাৎই ঘটল ছন্দপতন!
সেই মায়াবী ঘরে হঠাৎই প্রবেশ করলেন বাঘাযতীনের পরম স্নেহের বন্ধু রামচন্দ্র মজুমদার। অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত! অরবিন্দের দিকে ফিরে জানালেন ওয়ারেন্ট বেরিয়েছে। ব্রিটিশ সরকার আলিপুর বোমা মামলায় আইনি পরাজয় স্বীকার করেছে বটে, তবে অরবিন্দকে তারা মুক্তি দিতে রাজি নয়। প্রেতচর্চার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। গভীর চিন্তাময় হয়ে পড়লেন অরবিন্দ। অন্তরাত্মার নির্দেশ পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন, চন্দননগর যাবেন। চন্দননগর ফরাসি উপনিবেশ। সেখানে অস্ত্র আইন শিথিল। ব্রিটিশ অনুচরদের অবাধে প্রবেশ নিষিদ্ধ। ফলে বেশকিছুদিন নিরাপদ আশ্রয়ে অবস্থান করা যাবে। আলিপুর জেলে থাকাকালীনই ঈশ্বরের প্রত্যাদেশ পেয়েছেন তিনি। বিপ্লবগুরু অরবিন্দ তখন সন্ন্যাস লাভের পথে। ধর্মই বিপ্লব, অন্তর থেকে উপলব্ধি করেছেন তিনি।
অরবিন্দের প্রেতচর্চা রাজনৈতিক জীবনের পূর্বেই অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। সেই অনির্বচনীয় সত্যের প্রকাশ ঘটে বরোদায় মহারাজ সয়াজিরাও গায়কোয়াড়ের এস্টেটে অবস্থানকালেই। দেবতা অন্তরে জাগ্রত না হলে জীবের উত্তরণ অসম্ভব। দেবতাই ত্রাণকর্তা। আত্মজ্ঞান লাভের যজ্ঞে দেবতাই একমাত্র সিদ্ধিদাতা পুরোহিত। জীবাত্মার মধ্যেই দেবাত্মার অধিষ্ঠান। ঈশ্বরের অবস্থান। ঈশ্বরের উপস্থিতি যদি অনস্বীকার্য হয়, সে আত্মার অন্তরে তাঁর জাগরণ, মৃত্যুর পরে সেই আত্মার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা কীভাবে সম্ভব? অরবিন্দের মননজগৎ জুড়ে ছিল মনীষীদের সান্নিধ্য লাভের অভীপ্সা। পদ্ধতিগতভাবে প্ল্যানচেট। জাতীয়তাবাদের উৎস সন্ধান থেকে অবসর বিনোদন, সেজদা অরবিন্দ এবং বারীনের বরোদায় প্ল্যানচেট ছিল নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনামাত্র। বিংশ শতকের প্রাকলগ্নে বারীন অরবিন্দের হাতে অগ্নিযুগের স্ফুরণ ঘটে কোনও সামাজিক মতবাদ থেকে নয়; ঈশ্বর ভাবনা আধ্যাত্মবাদ ও মনীষীদের প্ল্যানচেটের মধ্যে দিয়ে। অন্ধকার ঘরে দুটো বোতামের মতো পায়ার উপর ত্রিকোণাকৃতি পানের মতো কাঠ। তার একদিকে ছিদ্রে একটি পেন্সিল আটকানো রয়েছে। ওই কাঠের উপর দু’জন বিপ্লবপ্রত্যাশী নেতার হাত এবং উদ্দীষ্ট আত্মার স্মরণে একসময় আপনা থেকে লিখতে থাকে পেন্সিল। অ-জাগতিক এক শক্তির আগমনে লেখা ফুটে ওঠে! ‘আমি রামমোহন রায়।’ পরবর্তীকালে বারীন সেই পূর্ব অভিজ্ঞতা স্মরণে নিশ্চিতভাবে বলতে পারেননি প্রেতাত্মার আগমন ঘটনা কতটা বাস্তব। তবে নির্দ্বিধায় তিনি স্বীকার করেছেন পারলৌকিক কোনও শক্তির স্বয়ংক্রিয় হয়ে উঠে পেন্সিলে আত্মকথা লিখন। বারীন ‘আমার আত্মকথা’ গ্রন্থে লিখেছেন— ‘আমাদের অবচেতনা বা ঊর্ধ্বচেতনায় এমন সব অলৌকিক শক্তি ও বৃত্তি আছে যার প্রকাশে অসম্ভব সম্ভব হতে পারে... শ্রীঅরবিন্দের ‘Yoga and its objects’ বইখানা তাঁর নিজের লেখা নয়, তিনি পেন্সিল ধরতেন আর এক অদৃশ্য শক্তি এসে লিখে যেত; রামমোহন রায়ের নামে এইভাবে আগাগোড়া বইটা পাওয়া গিয়েছিল, যখন এই ঘটনা ঘটে তখন অবশ্য আমি আন্দামানে।’
বারীন জানিয়েছিলেন বারোদায় তাঁরা একদল তরুণ এই অ-মানবী খেলায় মেতে উঠতেন— ‘একদিন স্বয়ং তিলক (বালগঙ্গাধর তিলক) এসে নানা প্রশ্ন করে যান, তখন আমার হাতে পেন্সিল ছিল। তার আগের দিন একজন দূরদেশবাসী মারাঠার মৃতা আত্মীয়া এসে সেই মারাঠা ভদ্রলোককে বলে গিয়েছিলেন তাঁদের পৈতৃক বাসভবন কোথায় কীভাবে ভাঙা ও বাড়ানো কমানো হয়েছে, প্রকৃত ঘটনার সঙ্গে সেগুলি হুবহু মিলে গেছিল।’ তবে সবক্ষেত্রেই যে এমনটা হতো তা নয়।
বারীনের জন্ম ইংল্যান্ডে। বাবা ডাঃ কৃষ্ণধন ঘোষের সুবাদে ছোট্ট শৈশব ক্রয়ডনে। পাশ্চাত্যের এনলাইটমেন্টে শিক্ষিত বারীন আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক হয়েও নিজের চোখকে অবিশ্বাস করতে পারেননি। বিজ্ঞানের ক্রমবর্ধমানশীল বৃত্তে আজ যা ব্যাখ্যার অতীত, অদূর ভবিষ্যতে তা কার্যকারণ সম্পর্কের অধীন। বিপ্লবমনস্ক, ধর্মপ্রাণ বারীন তা বিলক্ষণ উপলব্ধি করেন। মনীষীদের প্ল্যানচেট পর্বে মহাপ্রয়াণের এক দশক পরে একদিন এলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ। অরবিন্দের নিজের লেখা ‘অটোবায়োগ্রাফিক্যাল নোটস্’-এ সে ঘটনার উল্লেখ স্তম্ভিত করে। ঠাকুর বললেন— তোমরা মন্দির গড়ো! এই নির্দেশেই দুই বিপ্লবপথযাত্রী ‘আনন্দমঠ’ কল্পমন্দিরকে গড়ে তুলতে সচেষ্ট হলেন বাস্তবের মাটিতে। লিখলেন বিপ্লবীদের আকরগ্রন্থ পুস্তিকা ‘ভবানী মন্দির’। অগ্নিযুগের শুভসূচনায় ঘটল বোমার পরিচয়।
আলিপুর বোমা মামলায় অভিযুক্ত বারীন এবং অরবিন্দ সহ মুরারিপুকুর গুপ্ত সমিতির তাবড় বিপ্লবীরা। মাতৃ সাধনার পথ যেন রুদ্ধ, স্তব্ধ প্রায়। ব্রিটিশ সরকারের জিজ্ঞাসা গিয়ে পড়ল ‘নাটের গুরু’ অরবিন্দের উপর। কিন্তু সরকারের বিরুদ্ধে এহেন মামলা লড়ার সামর্থ্য নেই। অরবিন্দের বোন সরোজিনী দেবীর আবেদন প্রকাশ্যে— বিপ্লবী নেতা অরবিন্দের মামলা লড়তে অর্থ প্রয়োজন! জনগণের আবেগ সীমাহীন। তবে অর্থ অপ্রতুল। ইতিমধ্যে ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকায় ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের পক্ষে লড়ে প্রসিদ্ধ হয়েছেন উদীয়মান ব্যারিস্টার ‘দাশ মশাই’। কিন্তু বিলাসবহুল জীবনে অভ্যস্ত চিত্তরঞ্জনের নিয়োগে টাকা জোগানো দায়। ব্রহ্মবান্ধবও মামলা চলাকালীন ইহলোক ত্যাগ করেন। ফলে অ্যারিস্টোক্রেট দাশবাবুর নাগাল পাওয়া সম্ভবপর নয়। তখনও তিনি ত্যাগী দেশব্রতী ‘দেশবন্ধু’ হয়ে ওঠেননি। তখনও তিনি কেরিয়ার সর্বস্ব ব্যারিস্টার।
চিত্তরঞ্জনের শখ-অভ্যেস ছিল প্ল্যানচেটে পরলোক চর্চার। মামলার স্ট্রেস কাটাতে একপ্রকার আমোদ উপভোগ তাঁর প্ল্যানচেট। টেবিলে মোমবাতি জ্বেলে স্পিরিটের সন্ধান করছেন। মনের মায়াজালে অস্পষ্ট অবয়বে ফিরে ফিরে আসছেন স্বামী বিবেকানন্দের সহপাঠী ভবানীচরণ। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁকে দিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনে ব্রহ্ম বিদ্যালয় গড়ার ভার। ব্রহ্মবান্ধব গত হয়েছেন, তবু জাতীয়তাবাদী মানুষটি নেই যেন ভাবতেও পারেন না চিত্তরঞ্জন। হঠাৎই অমৃতলোকের অদৃশ্য হতে ভেসে এল কণ্ঠস্বর! ‘ইউ মাস্ট ডিফেন্ড অরবিন্দ’ শিহরিত হলেন চিত্তরঞ্জন। পরিচিত সেই কণ্ঠস্বরে ঝরে পড়ছে জাতীয়তাবাদের আবেগ! চিত্তরঞ্জন প্রশ্ন করলেন— ‘আপনি কে?’
উত্তরে সেই অশরীরী কণ্ঠস্বর বলে ওঠে— ‘উপাধ্যায়’। ভবানীচরণকে সকলে এ নামেই ডাকতেন। দেশের টানে সংসার ত্যাগী ভাবানীচরণ সন্ন্যাস নিয়েছিলেন। ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকার মামলায় অভিযুক্ত হিসাবে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে নোটিস পাঠালে তিনি বলেছিলেন— ফিরিঙ্গদের প্রহসন বিচারশালায় পবিত্র ধর্মীয় পোশাকে তিনি যাবেন না! তাই দেশেরই টানে তিনি আবার সন্ন্যাস ত্যাগী হলেন। ভগ্ন স্বাস্থ্যে বিছানায় শুয়ে প্রশ্ন করেন ব্রহ্মবান্ধব— মামলার পরের শুনানি আর কতদিন? অনুরাগীর জবাব, সময় হয়ে এসেছে। স্মিতহাস্যে ব্রহ্মবান্ধব বলেন— ওরা তাঁকে ধরতে পারবে না। স্মিতহাস্যে প্রাণত্যাগ করেন ব্রহ্মবান্ধব। অন্যান্য সবাই মামলা থেকে অব্যাহতি পেলেন। যজ্ঞের প্রধান পুরোহিতের তিরোধানে সে যজ্ঞ অর্থহীন। সজল নয়নে সদ্য অতীত দিনগুলি স্মরণ করলেন চিত্তরঞ্জন। প্ল্যানচেটের টেবিলে কম্পমান মোমবাতির আলোকশিখায় স্পিরিটের উপস্থিতি। আবার ভেসে এল সেই কণ্ঠস্বর—
‘ইউ মাস্ট ডিফেন্ড অরবিন্দ।’
সেই মুহূর্তেই চিত্তরঞ্জন সিদ্ধান্ত নিলেন যে কোনওভাবে অরবিন্দকে রক্ষা করতেই হবে। এক বন্ধুকে চিত্তরঞ্জন বলেছিলেন ‘আমি এখানে বসে আছি, এ যেমন সত্য, এ মোকদ্দমা আমার হাতে আসবে, তাও তদ্রুপ সুনিশ্চিত।’ নিয়তির নিয়ন্ত্রণে ঠিক তেমনই ঘটল। প্রবল উৎকণ্ঠা নিয়ে চিত্তরঞ্জনের সাক্ষাৎপ্রার্থী অরবিন্দের মেসোমশাই কৃষ্ণকুমার মিত্র জানালেন আর্থিক অক্ষমতার কথা। ব্রহ্মবান্ধবের আদেশ শিরোধার্য, চিত্তরঞ্জন জানালেন এই মামলায় জীবনপণ করবেন তিনি। তাই-ই করলেন। অসম্ভবকে সম্ভব করে তুললেন। চিত্তরঞ্জনের বুদ্ধিমত্তা, প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কাছে পরাজিত ব্রিটিশ সরকারের শৌর্য ভূলুণ্ঠিত হয়। পরাবাস্তবতা, অলৌকিক সেই ইতিহাসের ব্যাখ্যা সেদিন বিজ্ঞান দিতে পারেনি। ক্রমে বিজ্ঞান পরিণত হয়। ইউরোপ, ব্রিটেন, আমেরিকায় অলৌকিক ঘটনা প্রসঙ্গে গবেষণায় মন্ত্রাদির ব্যবহার জনসমক্ষে এসেছে। ১৯২৬ সালে লন্ডনের ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি অব সাইকিক্যাল রিসার্চে গবেষক হ্যারি প্রাইসের নেতৃত্বে উন্মোচিত বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এক নব দিগন্ত আজ বহুদূর বিস্তৃত। গবেষণা চলছে পরলোকের উৎসারিত আলোর সন্ধানে। স্বামী অভেদানন্দ থেকে থিওজফিক্যাল সোসাইটির ব্ল্যাভাৎস্কি, অ্যানি বেসান্ত। সত্যাসন্ধান অব্যাহত।
চন্দননগরে অরবিন্দ আত্মগোপন করেছিলেন গুপ্ত সমিতির নেতা মতিলাল রায়ের বোড়াইচণ্ডীতলার নিবাসে। আধ্যাত্মিক জগতের সন্ধানী মতিলাল মুগ্ধ হলেন যোগী পুরুষের সান্নিধ্যে। আইসিএস অরবিন্দ অ্যাক্রয়েড ঘোষ কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির কিৎস কলেজের অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। ক্লাসিক ট্রাইপসে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ব্রিটিশ কবিদের মধ্যে অগ্রগণ্য তাঁর শব্দচয়ন, চিন্তাসূত্রে মহত্ব। ইংরেজি, ফরাসি, গ্রিক, লাতিন, হিব্রু, ইতালীয়, জার্মান, স্প্যানিশ প্রভৃতি বিদেশি ভাষায় অত্যন্ত সুপণ্ডিত। অথচ, তিনিই সর্বত্যাগী হলেন ঈশ্বরের সন্ধানে। বোড়াইচণ্ডীতলার ছোট্ট স্টোররুমে বসে অরবিন্দ বলেন, দেখ ঈশ্বর আমার সঞ্চালন শক্তি! মুগ্ধ মতিলাল অনুসারী হলেন। পেলেন যোগ সাধনার অমৃতলোকের তত্ত্ব। ‘এম’ সম্বোধনে ‘কালি’ অর্থাৎ যোগী শ্রীঅরবিন্দ মতিলালকে সাধনা বিষয়ক অনেক পত্র লিখেছেন। স্বাভাবিকভাবেই এসেছে তন্ত্র সাধনার প্রসঙ্গ। সঙ্ঘগুরু মতিলাল রায় প্রতিষ্ঠিত ‘প্রবর্ত্তক সঙ্ঘ’-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত অরুণচন্দ্র দত্ত সেই সমস্ত অমূল্য পত্রাদির এক সংকলন প্রকাশ করেছিলেন। ‘লাইট টু সুপার লাইট’। সেখানে শ্রীঅরবিন্দ শিষ্য মতিলালকে বলছেন, আত্মসমর্পণ যোগের কথা। বলছেন কলিযুগে এমন অনেক তন্ত্রসাধক রয়েছেন যাঁরা সিদ্ধিলাভের আশায় সংযমী, ধ্যানী। কিন্তু অঙ্গরক্ষণ বা আত্মরক্ষার অভাবে প্রেতাত্মার অধীনে জীবন ধ্বংস করেন। সাধনার একমাত্র লক্ষ্য সিদ্ধিলাভ ও মুক্তি। লোভ, লালসা, জাগতিক চাহিদার ঊর্ধ্বে উঠে সাধনা না করলে সেই সিদ্ধিলাভ সম্ভব না। অরবিন্দের অনুসারী সাধক নলিনীকান্ত, নীরদবরণ, অনিলবরণ রায় সকলেই সেই সত্য উপলব্ধি করেছেন। তাঁদের স্মৃতিচারণায় অক্ষয় হয়ে রয়েছে অগ্নিযুগের অভিযাত্রী বিপ্লবীদের আধ্যাত্মিক প্রেরণা ও প্রেতচর্চার নিদর্শন।
বিপ্লবী অনিলবরণের রাজনৈতিক উত্তরণের কাহিনিও বেশ রোমাঞ্চকর। বর্ধমানের গুইর গ্রামের নবকুমার রায় ও চণ্ডীবালা দেবীর পুত্র মেধাবী ছাত্র অনিলবরণ কলকাতায় স্কটিশচার্চ ও সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের ছাত্র ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ও দর্শনে স্নাতকোত্তর ও আইনে স্নাতক হলেন। সংস্কৃত, ফরাসি ও জার্মান ভাষায় পণ্ডিত অনিলবরণ বীরভূমের হেতমপুর কলেজ এবং বাঁকুড়ার খ্রিস্টান কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯২১ সালে চাকরি ছেড়ে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশবন্ধুর স্নেহধন্য হয়ে ওঠেন। ১৯২৪ সালে বাংলার প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। স্বরাজ্য দলের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে ওঠেন। লন্ডনে চার্লস টেগার্টের ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে গোপীনাথ সাহার সমর্থনে লেখা প্রস্তাবে অনিলবরণের হাতে লেখা নোট। রাজনীতির সেই শিখরদেশে অবস্থানকালেই মেধাবী অনিল উপলব্ধি করলেন জাগতিক চিন্তার ঊর্ধ্বে পরলোকচর্চা, সত্য ও জ্ঞানের সন্ধান আবশ্যক। নেপথ্যে ঋষি অরবিন্দের রচনা। সবকিছু ত্যাগ করে এলেন পণ্ডিচেরী আশ্রমে শ্রীঅরবিন্দের সান্নিধ্যলাভ করতে। শ্রীঅরবিন্দের সঙ্গে অনিলবরণের কথোপকথনে উঠে এসেছে প্রেতচর্চা প্রসঙ্গ। শ্রীঅরবিন্দ বলছেন, পাশ্চাত্যের পরলোকচর্চাকারীগণ আত্মা, প্রেততত্ত্ব, শরীরতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে অস্তিত্ব স্বীকার করেন। প্রেততত্ত্বে আত্মা, মননজগতের অধিষ্ঠান স্বীকৃত। হৃদয়ে গুহায় প্রবেশের গোপন চাবিকাঠি আত্মা। প্রত্যেক জীবাত্মার অন্তরেই পরমাত্মার অধিষ্ঠান।
নেতা অরবিন্দের আধ্যাত্মিক শক্তির দিব্যপ্রভা সঞ্চারিত হয় বিপ্লবাচার্য জ্যোতিষচন্দ্র ঘোষের অন্তরে। অলৌকিক জগতের বেলাতটে তাঁর বিচরণ লক্ষণীয়। আলিপুর বোমা মামলার ক্ষত তখনও দগদগে ব্রিটিশ ইন্টালিজেন্সের নথিতে। হুগলির মাস্টারমশাই জ্যোতিষচন্দ্র এবং বিপ্লবী শ্রীশচন্দ্র ঘোষ মিলে অফিসার ডেনহ্যাম সাহেবকে হত্যার দুর্ধর্ষ প্লট রচনা করলেন। সবুজ রঙের গাড়িটা বেরিয়ে আসছে রাইটার্স বিল্ডিংয়ের ভিতর থেকে। সাজানো রাংতায় মোড়া ফুলের তোড়া নিয়ে ছুটে রাস্তা পেরিয়ে এল এক তরুণ। খোলা কাচের ভিতর দিয়ে সাহেবের গায়ে ছুড়ে জানাল সংবর্ধনা। ফুল নয়, ছিল পিকরিক অ্যাসিডের বোমা। ব্যাকসিটে বসা সাহেবের দুই পায়ের ফাঁকে আটকে বোমাটি আর ফাটল না। তরুণ ননীগোপাল মাস্টারমশাইয়ের স্নেহাবিষ্ট ছাত্র। নির্দেশমতোই ছুটল আমর্হাস্ট স্ট্রিটে মেসবাড়িটার দিকে। ডেনহ্যাম নয়, গাড়িতে ছিলেন ইঞ্জিনিয়ার কাওবে। ব্যর্থ, তবে সেটাই ছিল রাইটার্স বিল্ডিং-এর সিকিউরিটি ব্রিচ করে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের প্রথম অ্যাকশন। ডালহৌসি স্কোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা। মাস্টার জ্যোতিষচন্দ্র চন্দননগর গুপ্তসমিতির প্রধান হয়ে উঠলেন। পুলিসি অত্যাচার, থার্ড ডিগ্রি কোনও কিছুতেই তাঁকে টলানো যায়নি। স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শে অনুপ্রাণিত সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী জ্যোতিষচন্দ্রের বামপন্থার উৎস মার্কসবাদ নয়, বেদান্তচর্চা। ছোটবেলা থেকেই তিনি পেতেন, ‘অতীন্দ্রিয় জগতের সাড়া।’ এই শিরোনামে ১৯২৩ সালের জানুয়ারি-ফ্রেব্রুয়ারি মাসের ‘প্রবর্ত্তক’ পত্রিকার সংখ্যায় জ্যোতিষচন্দ্র জীবনের অলৌকিক অভিজ্ঞতাগুলি লিপিবদ্ধ করেছেন। সেখানে আধ্যাত্মবাদের সঙ্গে মিশে রয়েছে প্রেত দর্শনের অনুভূতি। মাস্টার মশাইয়ের বয়স সাত, ভোরে সবান্ধব ফুল তুলতে গিয়ে দেখলেন গাছের আড়ালে দুটি মূর্তি, একদৃষ্টে তাঁদের দিকে চেয়ে। বাতাস জমে গিয়ে দুটি স্বচ্ছ শরীরের অবয়ব নিয়েছে। সকলে ভূত বলে চম্পট দিলেও তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন। অনেকক্ষণ পরে বাতাসেই শরীর দুটি মিলিয়ে যায়।
আলিপুর বোমা মামলা চলাকালীন বিপ্লবী কানাইলাল জেল হাসপাতালে বিশ্বাসঘাতক নরেন গোঁসাইকে হত্যার পূর্বেই যে ঘটনার জ্যোতিষচন্দ্র দৈবাদেশ পেয়েছিলেন বলে পরিচিত কয়েকজন জানালেন। ঘটনার পর সে কারণে অনেকেই সন্দেহ করত তিনি সেই ষড়যন্ত্রে অংশীদার ছিলেন।
নেতা জ্যোতিষচন্দ্রের উপর তখন ব্রিটিশ পুলিসের সার্ভিলেন্স প্রচ্ছায়াসম। চন্দননগরে ছেয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ পুলিসের গোয়েন্দা। রাত প্রায় এগারোটা। চন্দননগরে গুপ্তসমিতির বৈঠক সেরে চুঁচুড়া ফিরছেন। চন্দননগরের ব্রিটিশ অধিকৃত অঞ্চল পার হতে যাবেন, এমন সময় পুলিসের প্রহরার মুখোমুখি। পরিচয় জানতে চাইলে পাল্টা ধমক দিলেন মাস্টারমশাই। নাম ঠিকানা লিখতে হবে। অসম্মত হওয়ায় লাগল বিবাদ। থানায় যেতেই হবে। গ্রেপ্তারি নিশ্চিত। চন্দননগরে জ্যোতিষচন্দ্রের নেতৃত্বেই তখন চলছে বোমার কারবার। এমন সময় চাদরের ঢাকা এক ছায়ামূর্তি ঘুটঘুটে অন্ধকার থেকে এগিয়ে এল। দু’চোখে অগ্নিফুলিঙ্গ! দৃষ্টির কোপানলে ভস্ম হওয়ার উপক্রম পুলিসের। কাঁপা কাঁপা গলায় শুধু জ্যোতিষচন্দ্রকে বলল, ‘বাবু, আপ যাইয়ে’। চলে যেতে যেতে জ্যোতিষচন্দ্র ফিরে দেখলেন যে আঁধার হতে এসেছিল, ছায়ামূর্তিটি সেপথেই অন্তর্হিত হয়।
অগ্নিপুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের প্রেতচর্চা
অগ্নিযুগের বাণীপ্রচারক স্বামী বিবেকানন্দের বিপ্লবীসত্তা সম্পর্কে চর্চা বিশেষ পরিলক্ষিত হয় না। সিস্টার ক্রিস্টিনের কাছে স্বামী বিবেকানন্দ বলেছিলেন, তিনি ভারতের রাজাদের নিয়ে একটি শক্তিজোট গঠন করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন, যারা বিদেশি শাসনযন্ত্রকে বিকল করে দেবে। যুদ্ধের মধ্যে দিয়ে, বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে আসবে ভারতের স্বাধীনতা— এমনই বিশ্বাস করতেন স্বামী বিবেকানন্দ। ‘এই জন্য আমি (স্বামীজি) বন্দুক-নির্মাতা স্যর হিরাম ম্যাকসিমের সঙ্গে বন্ধুত্ব করেছিলাম। কিন্তু দেশের ভিতর থেকে আমি কোনও সাড়া পাইনি! দেশটা মৃত।’
এমন আরও অনেক ঘটনার কথা ক্রিস্টিনকে জানালেও তিনি স্বামীজির বিপ্লব প্রচেষ্টার সেই সকল ব্যর্থতার কাহিনি স্বামীজির ভাই ভূপেন্দ্রনাথকে বলতে সম্মত হননি, ভগিনী নিবেদিতার জীবনীকার লিজেল রেমঁর থেকে গবেষক শঙ্করীপ্রসাদ বসু জেনেছিলেন স্বামীজির শিষ্যা জোসেফিন ম্যাকলাউড কেবলমাত্র বেদান্ত প্রচারেই অর্থদান করেননি। স্বামীজির নির্দেশে তিনি বিদেশ থেকে অস্ত্র আমদানি করে ভারতে বিপ্লব সংগঠিত করতে প্রচুর অর্থ দিয়েছিলেন। চন্দননগর শহরে অস্ত্র আইন বলবৎ না থাকায়, সেই শহরের মধ্যে দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ অস্ত্র ব্রিটিশ ভারতে পাচারের চেষ্টা করেছিলেন। অন্য অনেক প্রচেষ্টার মতো সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়। অস্ত্রসহ নৌকা ধরা পড়ে। অবশ্য পুলিস প্রধান চক্রী স্বয়ং বিবেকানন্দের হদিশ পাননি।
স্বামীজি বেলুড় মঠের সঙ্গে যুক্ত বিপ্লবী পণ্ডিত সখারাম গণেশ দেউস্করকে বলেছিলেন— ‘সমস্ত দেশটা একটা বারুদখানায় পরিণত হয়েছে। একটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গই একে প্রজ্বলিত করে দিতে পারে। আমার জীবদ্দশাতেই আমি বিপ্লব প্রত্যক্ষ করে যাব।’ ১৯০১ সালে ডিসেম্বর মাস। সময় দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। বেলুড় মঠে স্বামীজির সাক্ষাৎ প্রত্যাশী হয়ে এলেন লোকমান্য তিলক। স্বামীজি বললেন— ‘বাহুবল ছাড়া ব্রিটিশকে ভারত থেকে উৎখাত করা যাবে না।’ বিপ্লবী কামাখ্যা রায়কে বললেন— ‘ভারতের আজ বোমার প্রয়োজন।’ স্বামী শুদ্ধানন্দকে বিবেকানন্দ জানিয়েছিলেন, তিনি বিদেশ থেকে বোমা বানানো শিখে এসেছেন। প্রয়োজনমতো তার সদ্ব্যবহার হবে। ইংল্যান্ডের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিবেকানন্দ বলেন— ‘বেপরোয়া হয়ে কাজ করতে হবে। তাতে যদি গুলি বুকে পড়ে, প্রথমে আমার বুকে পড়ুক... পড়ুক গুলি আমার বুকে।’
ব্রিটিশ ইন্টালিজেন্স অফিসার চার্লস টেগার্টের রিপোর্টে জানা যায়, স্বামীজি রাজনৈতিক শ্রীকৃষ্ণের উপাসক হতে যুবসমাজকে আহ্বান জানিয়েছিলেন— ‘দেশে শ্রীরামচন্দ্র ও মহাবীরের পূজা চালিয়ে দে দিকি! বৃন্দাবন লীলা-ফিলা এখন রেখে দে। গীতাসিংহনাদকারী শ্রীকৃষ্ণের পূজা চালা; শক্তিপূজা চালা।... এখন চাই তোপ্ তোপ্ গোলাগুলি ঢাল তরোয়াল নিয়ে খেলা।’
অগ্নিযুগের অগ্ন্যুৎসারী রাজনৈতিক সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দের তন্ত্র ও প্রেতচর্চা সম্পর্কে অভিমত চাঞ্চল্যকর। শিলংয়ে চিফ কমিশনার হেনরি কটন সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সে দেশের ধর্মভাব দেখে স্বামীজি বলেছিলেন— ‘তন্ত্র প্রধান দেশ। এক ‘হঙ্কার’ দেবের নাম শুনলাম, যিনি ও অঞ্চলে অবতার বলে পূজিত হন। শুনলুম, তাঁর সম্প্রদায় খুব বিস্তৃত। ওই ‘হঙ্কার’ দেব শঙ্করাচার্যেরই নামান্তর কি না বুঝতে পারলাম না। ওরা ত্যাগী— বোধ হয়, তান্ত্রিক সন্ন্যাসী কিংবা শঙ্করাচার্যেরই সম্প্রদায় ‘বিশেষ।’
শিষ্য সেই সূত্রে স্বামীজিকে প্রশ্ন করেন, প্রথমবার বিলেত থেকে ফিরে কলকাতার স্টার থিয়েটারে জনসভায় তিনি তন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন, তবে অভিমত পরিবর্তন কী কারণে? স্বামীজির ব্যাখ্যা— ‘তন্ত্রের বামাচার মতটা পরিবর্তিত হয়ে এখন যা হয়ে দাঁড়িয়েছে, আমি তারই নিন্দা করেছিলুম। তন্ত্রোক্ত মাতৃভাবের অথবা ঠিক ঠিক বামাচারেরও নিন্দা করিনি। ভগবতীজ্ঞানে মেয়েদের পূজা করাই তন্ত্রের অভিপ্রায়।’
প্রেত প্রসঙ্গে স্বামীজি বলেন, ‘ভূতুড়ে কাণ্ডে মন দিসনে, ভাববি ভূতপ্রেত আছে তো আছে। শরীর মধ্যে যে আত্মা আছেন, তাঁকে প্রত্যক্ষ করলে ভূতপ্রেত তোর দাসের দাস হয়ে যাবে।’ স্বামীজি কি কখনও প্রেতদর্শন করেছিলেন? শিষ্যের প্রশ্নে স্বামী বিবেকানন্দ জানালেন, তাঁর এক আত্মীয়ের প্রেতাত্মা মাঝে মধ্যেই তাঁকে দেখা দিত। দূর-দূরান্তের অনেক সংবাদ এনে দিত। তবে সবক্ষেত্রে সেই সংবাদ সঠিক হতো না। একবার তীর্থে গিয়ে তাঁর মুক্তি প্রার্থনা করার পর থেকে, সে আর আসেনি।
আত্মা কি অমর? ‘দ্য নিউ ইয়র্ক মর্নিং অ্যাডভাটাইজার’ পত্রিকার আলোচনায় স্বামীজি যোগ দিলেন। সেই প্রবন্ধে যুক্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত ব্যাখ্যা করে লেখেন, ‘মুক্ত অধিকারী ও বন্ধনহীন— এই যে জীবাত্মা, এই যে মানবাত্মা, ইহাই মানুষের প্রকৃত স্বরূপ; ইহার জন্মও নাই, মৃত্যুও নাই। এই মানবাত্মা অজর, অমর, শাশ্বত ও সনাতন।’ তবে কি আত্মার পুনর্জন্ম লাভ সত্য? ১৮৯৫ সালে নিউইয়র্কের প্রসিদ্ধ দার্শনিক পত্রিকায় স্বামীজি স্বপক্ষে নিজ উপলব্ধি ব্যক্ত করেন।
‘প্রত্যেক আত্মার একটি নিজস্ব সত্তা আছে এবং আত্মা তাহার বর্তমান জীবনে অতীতের অভিজ্ঞতা বহন করিয়া আনে।’
জাতিস্মরের স্মৃতিশক্তি প্রখর তাই সে পূর্বজন্ম স্মরণ করতে পারে। সকলের ক্ষেত্রে এমন ঘটে না কেন?...
‘সেই মস্তিষ্ক নাই, তাহা একেবারে ধ্বংস হইয়া গিয়াছে, এবং নূতন একটি মস্তিষ্ক হইয়াছে। অতীতে অর্জিত সংস্কারগুলির সমষ্টি আমাদের মস্তিষ্কে আসিয়াছে— উহা লইয়া মন এই শরীরে বাস করিতেছে।’
সেই সমস্ত সংস্কারের সদর্থক প্রকাশে আধ্যাত্মবাদের পূর্ণতা। স্বামীজির পরলোকচর্চায় ঘটে আধ্যাত্মিক শক্তির বিচ্ছুরণ। ক্ষয়িষ্ণু, পতিত সমাজের কাছে সেই শক্তিই আলোকবর্তিকা! তাই, ফাঁসির আগে সন্ন্যাসীর ন্যায় প্রশান্ত কানাইলাল অমরত্বের বাসনায় আবৃত্তি করতেন স্বামী বিবেকানন্দের জ্ঞানযোগ! ‘মৃত্যুতেই জীবনের শেষ নয়, মৃত্যুতে শুধু দেহেরই নাশ হয়, মৃত্যু আত্মাকে স্পর্শ করতে পারে না।’ স্বামীজির বাণী মুক্তি সংগ্রামের বীজমন্ত্র! আলিপুর জেলের কনিষ্ঠতম বিপ্লবী শচীন দেওয়াল খসিয়ে লিখে দিল স্বামীজির সংশপ্তক অনুসারীর অক্ষয় নাম! ‘Long Live Kanailal!’
‘বন্দেমাতরম্’ প্রবক্তা বঙ্কিমচন্দ্রের প্রেতদর্শন
রাত তখন একটা। ১৮৬০ সাল। কাঁথির এক স্থানীয় জমিদার বাড়িতে আশ্রিত জাতীয়তাবাদী বঙ্কিমচন্দ্র। ‘আনন্দমঠ’ তখনও তাঁর কল্প জগতে তরঙ্গলহরী বিতরণ করেনি। সাহিত্য জগতে আত্মমগ্ন ঋষি। হঠাৎই এক শুভ্র বস্ত্র পরিহিতা নারীর আগমন। গ্রন্থপাঠে নিমগ্ন বঙ্কিমচন্দ্র সবিস্ময়ে মুখ তুলে চাইলেন। ‘কে?’ উত্তর প্রত্যাশী না হয়েই প্রশ্ন করলেন বঙ্কিম। ‘কে আপনি?’ জবাব নেই। বারংবার প্রশ্ন করতে করতে এগিয়ে গেলেন নারী মূর্তির দিকে। খোলা দরজা দিয়ে প্রচ্ছায়াহীন নারী ভেসে চলে বাইরের উঠোনের। বাইরে বেরিয়ে এলেন বঙ্কিমচন্দ্র। সবিস্ময়ে দেখলেন, সেই নারী বাতাসে মিলিয়ে গেল। কিছুক্ষণ অপলক দৃষ্টিতে সেই দিকে চেয়ে রইলেন তিনি। সময়ের হিসাব নেই। তারপর ঘরে ফিরে এসে ভাবতে লাগলেন, তিনি যা দেখলেন তা কি সত্যি? যুক্তি ও কার্যকারণে এ ঘটনার কী ব্যাখা হতে পারে? শঙ্কিত নন, তবে এক অস্থিরচিত্ততা ক্রমশ গ্রাস করতে লাগল তাঁর মন। ভৃত্যকে ডেকে বঙ্কিমচন্দ্র নির্দেশ দিলেন, সেই মুহূর্তেই তিনি সেই ভৌতিক নিবাস ত্যাগ করতে চান। পরবর্তীকা??