বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
সাপ্তাহিক বর্তমান

কালভৈরব জয়ন্তী কী?

কাশীর শাসক কালভৈরবকে নিয়ে লিখেছেন গৌতম বিশ্বাস।

শিবের দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে অন্যতম প্রধান জ্যোতির্লিঙ্গ বিশ্বেশ্বর। যাঁর অবস্থান হল কাশীতে। এই স্থানই হল সৃষ্টির আদিস্থান। এই কারণে কারও কারও মতে শিবের এই জ্যোতির্লিঙ্গকেই আদিলিঙ্গ বলা হয়। বিভিন্ন শাস্ত্রে এই কথাই বলা হয়েছে। ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, খ্রিস্টপূর্ব এগারোশো শতাব্দীতে রাজা হরিশ্চন্দ্র বিশ্বনাথ মন্দিরের জীর্ণোদ্ধার করিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সম্রাট বিক্রমাদিত্য পুনরায় এই মন্দিরের জীর্ণোদ্ধার করেন। তবে কবে এই মন্দির স্থাপিত হয় তার সঠিক কোনও সন-তারিখ পাওয়া যায় না।
এবার জানাই কালভৈরবের কথা। দেবতাদের মধ্যে ভৈরবের গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁরাই দেবস্থানগুলিকে রক্ষা করেন। কাশীতেও আছেন এমনই এক ভৈরব, তিনি কালভৈরব নামেই পরিচিত। এই কালভৈরবকে কাশীর কোতোয়াল বলা হয়। বিশ্বাস করা হয় যে, বাবা বিশ্বনাথ হলেন কাশীর রাজা এবং কালভৈরব হলেন তাঁর কোতোয়াল, যিনি জনগণকে আশীর্বাদ করার সঙ্গে সঙ্গে শাস্তিও প্রদান করেন। কাশী বিশ্বনাথ দর্শনের পূর্বে কালভৈরবের দর্শনে গেলে তাহলেই দেব দর্শনের ফল পাওয়া যায়। আবার কাশীবাসী হতে গেলেও কালভৈরবের অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। সেজন্য যাঁরা কাশীতে থাকতে আসেন কিংবা বাবা বিশ্বনাথের দর্শনে আসেন তাঁদের কালভৈরবের দর্শনে যেতে হয়। কাশী গিয়ে কালভৈরবকে দর্শন করে তীর্থ পরিক্রমা সম্পূর্ণ করতে হয়। এটাই শাস্ত্রীয় নিয়ম।
কালভৈরবের ধর্মই হল, শিবনগরী কাশীক্ষেত্রকে সুরক্ষিত রাখা এবং পাপীদের দণ্ড দেওয়া। ঠিক যেমন একজন পদাধিকারী পুলিস প্রশাসক করে থাকেন। এই দেবতার সঙ্গে সর্বদা একটি কুকুর বিরাজ করে। গোয়েন্দা কুকুর যেমন পুলিসকে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ খুঁজে বার করতে সাহায্য করে তেমনই কালভৈরবের কুকুর সবসময় তাঁর সঙ্গে থেকে তাঁকে সহায়তা করে। লোক বিশ্বাস, কালভৈরবের দর্শনে শনিদেবের সাড়ে সাতি এবং শনির দণ্ড থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কথিত আছে, স্বয়ং যমরাজও কালভৈরবের অনুমতি ব্যতীত কাশীনগরীর কারও প্রাণ নিতে পারেন না। কাশীতে অপরাধকারীকে শাস্তি দেওয়ার অধিকার কালভৈরব ছাড়া আর কারও নেই। সেই অধিকার স্বয়ং শিবই তাঁকে দিয়েছেন।
পৌরাণিক কাহিনি অনুসারে, একবার ব্রহ্মাদেব, ভগবান বিষ্ণু ও ভগবান শিব— এই তিন দেবতা একে অপরের সঙ্গে তুমূল তর্ক-বিতর্কে লিপ্ত হয়ে পড়েন। তাঁদের মধ্যে কে সর্বশ্রেষ্ঠ? এই নিয়েই তিন দেবতার মধ্যে ভীষণ বিতর্ক শুরু হয়। এই তর্কাতর্কির সময় ব্রহ্মাদেব ভগবান শিবকে উদ্দেশ্য করে কিছু অসম্মানজনক উক্তি করে ফেলেন, যার দরুন শিব অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন। মুহূর্তের মধ্যে দেবাদিদেব শিব রুদ্র রূপ ধারণ করেন। সেই সময়ই রুদ্রের তেজ থেকে এক ভৈরবের সৃষ্টি হয়, তাঁরই নাম কালভৈরব। যে মুখ দিয়ে ব্রহ্মাদেব শিবকে অসম্মানজনক কথা উচ্চারণ করেছিলেন, সেই মাথাটাই কালভৈরব ত্রিশূল দিয়ে ছেদন করে দেন। এই হত্যার দরুন কালভৈরব ব্রহ্মহত্যার পাপের ভাগী হয়ে পড়লেন। তাঁর হাতে ব্রহ্মার করোটি আটকে গেল। শত চেষ্টাতেও ব্রহ্মার মাথাটিকে তাঁর হাত থেকে আলাদা করতে পারলেন না। তখন শিবই তাঁর প্রিয় সন্তানসম কালভৈরবকে ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে আসেন। কালভৈরবকে তিনি পরামর্শ দিয়ে বললেন, তুমি পৃথ্বীলোকে ব্রহ্মাদেবের এই মাথাকে নিয়ে ভ্রমণ করতে থাক, যেখানে এই মাথা নিজে থেকেই তোমার হাত থেকে খসে পড়বে, সেই স্থানেই তুমি ব্রহ্মহত্যার পাপ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে। জন্মদাতা পিতা শিবের কথামতো কালভৈরব ব্রহ্মকপাল নিয়ে পৃথিবী ভ্রমণ করতে লাগলেন, কিন্তু পৃথিবীর বহু স্থান ঘুরেও ব্রহ্মকপাল তাঁর ত্রিশূল থেকে কোথাও খসে পড়ল না। শেষ পর্যন্ত ঘুরতে ঘুরতে কালভৈরব যখন কাশী এসে পৌঁছন তখন তাঁর হাত থেকে ব্রহ্মকপাল আপনি খসে পড়ে যায়। কালভৈরব সেই থেকে কাশীতে থেকে যান এবং শিবের ইচ্ছায় কোতোয়াল রূপে বাস করতে থাকেন।
কাশীতে যখনই কোনও প্রশাসনের পদাধিকারী পদস্থ হন, তখনই সেই পদাধিকারীকে কালভৈরবের কাছে হাজিরা দিতে হয় এবং তাঁর অনুমতি নিয়েই কাজকর্ম শুরু করতে হয়। শুধু এই নয়, কাশীর জনগণ মনে করেন যে, কাশীতে একজন কোতোয়ালিও রয়েছেন। যিনি কালভৈরব নামে পরিচিত। তিনি সজাগ দৃষ্টিতে সর্বদা নিরীক্ষণ করে থাকেন কাশীক্ষেত্রের সর্বত্র।
কাশীতে কালভৈরব মন্দিরের ঠিক পিছনেই বিশ্বেশ্বরগঞ্জ থানা। আশপাশের দুষ্কৃতীরা তো বটেই, পুলিস অফিসারেরাও কাঁপেন থানেদার কালভৈরবের নামে। বিশ্বেশ্বরগঞ্জ থানায় তাঁর নামে একটা চেয়ার আলাদা করে সাজিয়ে রাখা থাকে।  বেনারসের কোনও পুলিস অফিসারই আজ পর্যন্ত ওই চেয়ারে বসার সাহস দেখাননি। শুধু একটা থানা নয়, বলতে গেলে সমগ্র কাশীর ল-অ্যান্ড অর্ডারই সামলান এই কড়া অফিসার। তাঁর রাজত্বে (কাশীতে) এলে তাঁর সামনে মাথা ঝোঁকাননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও হাজিরা দেন এই দুর্দান্ত থানেদারের সামনে। কাশীর এই থানেদারকে সত্যিই সমঝে চলে শহরের পুলিস থেকে সাধারণ মানুষ সবাই। থানার সামনে রয়েছে বাবা কালভৈরবের একটি মূর্তি। রোজ কালভৈরবকে প্রণাম করেই শুরু হয় কোতোয়ালির কাজ। 
কথায় বলে কাশীর রাজা হলেন স্বয়ং বিশ্বনাথ, আর কালভৈরব হলেন কাশীর নগরপাল বা কোতোয়াল। তাঁর অনুমতি ছাড়া কাশীতে বসবাস করা যায় না। এমনকী বাবা বিশ্বনাথের দর্শনও করা উচিত নয়। 

কিন্তু কে এই কালভৈরব? 
ভগবান শিবের যে ক’টি অবতার আছেন, তাঁর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হলেন কালভৈরব। মহাদেবের রক্তচক্ষুর উন্মত্ত রূপকেই হিন্দু ধর্ম অনুসারে কালভৈরব নামে পুজো করা হয়। সময়ের অধিপতি, মৃত্যুর দেবতা। পাপীদের দণ্ড দেন তিনি। চতুর্ভুজ কালভৈরবের উপরের দুই হাতে থাকে শূল ও বরাভয় আর নীচের দুটো হাতে থাকে দণ্ড আর মুণ্ড। পোশাকবিহীন অঙ্গ, গায়ের রং ঘোর কালো। বাহন কালো রঙের একটি কুকুর। সমস্ত শিবমন্দিরেই কালভৈরবের মূর্তি থাকার কথা। এই নির্দেশ স্বয়ং রুদ্রদেব  দিয়েছিলেন।
তন্ত্রশাস্ত্রগুলোতে কালভৈরবের যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তাতে তিনি এক মহাশক্তিশালী দিব্যপুরুষ। তাঁরই অধীনে থাকে বরাহরূপী ষড়রিপু। বামাচারী তান্ত্রিক আর অঘোরীদের উপাস্য দেবতা তিনি। শুধু হিন্দু নয়, বৌদ্ধ আর জৈনধর্মেও কালভৈরবের নাম পাওয়া যায়।

কীভাবে জন্ম হল কালভৈরবের?
এর উত্তর পাওয়া যায় ব্রহ্মপুরাণ থেকে। জানা যায়, জগৎ সৃষ্টির সময় প্রথম মানব মনুর সঙ্গে প্রথম মানবী হিসেবে শতরূপার জন্ম দিয়েছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। জগতে প্রথম নারী শতরূপা ছিলেন অনন্তযৌবনা আর অসামান্য রূপসী। সেই রূপযৌবনই হল তাঁর কাল। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা তাঁর এই মানস-কন্যাটির রূপে মোহিত হয়ে পড়েন। কামনার জ্বালায় তাঁর বোধ শক্তি এতটাই লোপ পেয়ে যায় যে, ইন্দ্রিয়তাড়িত হয়ে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা ছুটে যান মেয়ের দিকে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই আগে থেকেই সতর্ক হয়ে যান শতরূপা। তিনি তখন পিতা ব্রহ্মার এই অনাচারের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে ব্রহ্মলোক থেকে পৃথিবীতে পালিয়ে আসেন। কিন্তু ব্রহ্মার চোখ এড়িয়ে ত্রিভুবনে কোথাও লুকোনো সম্ভব নয়। মেয়ের উপর নজরদারি করার জন্য তখন ব্রহ্মার ঘাড়ের উপর অতিরিক্ত একটি মাথা গজিয়ে ওঠে। সেটাই হল ব্রহ্মার পঞ্চম মস্তক। সেই পাঁচটি মাথার, পাঁচজোড়া অর্থাৎ দশটি চোখ দিয়ে স্বর্গ, মর্ত, পাতাল তিন ভুবনের সর্বত্র সবকিছুর উপরেই তিনি নজর রাখতে পারতেন। বাবার হাত থেকে নিজেকে লুকোনোর জন্য শতরূপা তখন বিভিন্ন প্রাণীর রূপ নিতে থাকেন। শতরূপা যখনই যে প্রাণীর রূপ ধারণ করেন, ব্রহ্মাও তখন সেই প্রাণীর পুরুষ রূপ নিয়ে তাঁর পিছু নিতে থাকেন। শেষপর্যন্ত শতরূপা একটি গুহার ভিতর আশ্রয় নেন। কন্যার প্রতি ব্রহ্মার এরূপ ব্যবহার দেখে রাগে কাঁপতে থাকেন দেবাদিদেব শিব। অসহায় শতরূপাকে রক্ষা করার জন্য মহাদেবের ক্রোধ থেকে জন্ম নিলেন ঘোর কালো, বড় বড় রক্তজবার মতো চোখ নিয়ে কালভৈরব। তাঁর গর্জনে কেঁপে ওঠে সমগ্র জগৎ। একমুহূর্তও সময় নষ্ট না করে ব্রহ্মাকে তাড়া করেন কালভৈরব। কালভৈরবের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ব্রহ্মা ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করলেন কালভৈরবের উপর কিন্তু তাঁর সমস্ত শক্তি যেন নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। কোনও প্রভাবই পড়ল না কালভৈরবের উপর। কালভৈরব ক্রমশ এগিয়ে যেতে লাগলেন ব্রহ্মার দিকে। সেই অবস্থায় ব্রহ্মা পালাতে শুরু করলেন। এতে কালভৈরব আরও রেগে গেলেন। সেই রাগের বশে তিনি ব্রহ্মার পাঁচ নম্বর মুণ্ডটা ত্রিশূল দিয়ে কেটে ফেলেন। সেই থেকেই ব্রহ্মা হয়ে গেলেন চতুরানন। তাঁর চার মাথা থেকেই চার বেদের উৎপত্তি। কিন্তু ওই পাঁচ নম্বর মাথাটিই ছিল সর্বনাশের মূল। ব্রহ্মার ওই মাথাই কামনার জন্ম দিয়েছিল। তাই ব্রহ্মার পঞ্চম মাথাটা কেটে নেওয়ায় যাবতীয় কামনা দূর হয়ে তাঁর জ্ঞানের প্রকাশ ঘটল। এই ভাবেই কালভৈরবের সৃষ্টি হয়েছিল।
তারপর মহাদেবের আশীর্বাদে এই কাশীতেই প্রতিষ্ঠা পেলেন তিনি। আজও কাশীতে বাস করতে হলে, শুধু বাবা বিশ্বনাথ আর মা অন্নপূর্ণা দর্শনে এলে সবার আগে কালভৈরবের অনুমতি নিতে হয়। কাশীর শাসনভার সেই অনাদি অনন্তকাল কাল থেকে আজও একইরকমভাবে সামলে যাচ্ছেন বাবা কালভৈরব। 

কালভৈরব জয়ন্তীর মাহাত্ম্য 
কালভৈরবের নামে অনেকেই ভয় পান। শিবের অন্যতম রুদ্ররূপ হল কালভৈরব রূপ। শাস্ত্র মতে কালভৈরবের পুজো করলে সমস্ত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া এবং সুখ-সমৃদ্ধি লাভ হয়। এর পাশাপাশি কালের ভয় সমাপ্ত হয়। অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথিতে কালভৈরব জয়ন্তী পালিত হয়। একে কালাষ্টমীও বলা হয়। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী ওই দিন কালভৈরবের জন্ম। মঙ্গলবার বা রবিবার কালভৈরব জয়ন্তী পালিত হয়। এই দিনে নিয়ম মেনে কালভৈরবের পুজো করলে ভক্তের জীবন আনন্দময় হয়ে ওঠে। সমস্ত পাপ থেকে ভক্ত মুক্তি পায়। মনে করা হয়, কোনও ব্যক্তির ওপর কালভৈরবের আশীর্বাদ থাকলে তাঁর জীবনে নেতিবাচক শক্তি প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। উপরন্তু ভক্ত ভূত-প্রেত এবং অশরীরীদের কুপ্রভাব সহ সমস্ত রকম বাধা সহজেই কাটিয়ে উঠা যায়। 
কুকুর হল কালভৈরবের বাহন। তাই তাঁর আশীর্বাদ লাভের জন্য কালভৈরব জয়ন্তীর দিন কালো কুকুরকে মিষ্টি রুটি বা গুড়ের মালপোয়া খাওয়ালে ভালো ফল পাওয়া যায়। এর ফলে সেই দাতা জীবনের সমস্ত কষ্ট থেকে মুক্তি পান।
কালভৈরব জয়ন্তীতে পুজো পদ্ধতি— কালভৈরব জয়ন্তীর দিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে তাড়াতাড়ি স্নান করে নিতে হয়। তারপর শুদ্ধ পরিষ্কার পোশাক পরিধান করে ঠাকুরের আসনের সামনে ধূপকাঠি ও প্রদীপ জ্বালিয়ে ভক্তিভাবে পুজোর কাজ করতে হয়। পুজোর সময় কালভৈরবের উদ্দেশে বেলপাতা ও ধুতরো ফুল নিবেদন করে তাঁর আরাধনায় নিমগ্ন হতে হবে। পুজোর সময় মধু, দুধ, দই, ঘি ও চিনি দিয়ে পঞ্চামৃত তৈরি করে কালভৈরবের সামনে রাখতে হয়। সর্ষের তেলে তৈরি বোঁদে প্রসাদ হিসেবে নিবেদন করলে কালভৈরব ভক্তের প্রতি সদয় থাকেন। পুজো হয়ে গেলে বোঁদে প্রসাদ কালো কুকুরকে খাওয়াতে পারলে তাড়াতাড়ি ফল পাওয়া যায়। এছাড়া পুজোর পরে গরিব-দুঃখীদের ফল বিতরণ করলে কালভৈরব ভক্তের প্রতি খুশি হন। কালভৈরব খুশি হলে ভক্তও তাড়াতাড়ি সুফল লাভ করে। 

কাশীর কালভৈরব মন্দির
কাশীর কালভৈরব মন্দিরের অবস্থান বড় পোস্ট অফিস পেরিয়ে বাঁদিকের গলিপথে কিছুটা গেলেই। সেখানেই রয়েছে কাশীর বিখ্যাত কালভৈরবের মন্দির। মন্দির থেকে পোস্ট অফিস পর্যন্ত গলিটি কালভৈরবের গলি নামে পরিচিত। মন্দিরের চারদিকে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব ও পশ্চিম মিলিয়ে চারটি দ্বার রয়েছে। তবে যাত্রীরা সাধারণত সামনের (উত্তর) ও পিছনের (দক্ষিণ) দিক দিয়েই যাতায়াত করেন। কাশীর বিশ্বনাথ মন্দির থেকে হাঁটা পথে দেড় কিলোমিটারের মতো হবে। 
প্রবেশদ্বারের একপাশে কালভৈরবের বাহন কালো পাথরের সারমেয় মূর্তি। মূর্তিটি সদাই সতর্কদৃষ্টিতে প্রহরারত। এছাড়াও আরও দু’জন দণ্ডহাতে দ্বারপাল আছে। দ্বারপাল দু’জনও বেশ শক্তপোক্ত। দেখলেই তাঁদের প্রতি সমীহ জাগে। মাথা নিচু করতে হয়। দর্শনার্থীরাও তাঁদের প্রতি সম্মান জানাতে মাথা ঝুঁকিয়ে সামনে এগিয়ে যান কালভৈরবের দর্শনে। প্রথমে নাটমন্দির তারপরেই গর্ভমন্দির। চারদিক বারান্দায় ঘেরা। কালভৈরবের দণ্ডে মাথা ঠেকিয়ে দর্শনার্থীরা কয়েকটি সিঁড়ি ভেঙে তিনদিক খোলা নাটমন্দিরের মতো একটি ঘরে উপস্থিত হন। সেখান থেকেও কালভৈরবের মূর্তি দেখা যায়, তবে স্পষ্ট নয়, দূরত্বের জন্য অস্পষ্ট লাগে। সেজন্য ভালো করে দর্শনের জন্য আরও কাছে এগিয়ে গেলে ভালো হয়। গর্ভগৃহের সামনে একটি টুলের উপর বিভূতির পাত্র নিয়ে বসে থাকেন পূজারি। তিনি ভক্তদের কপালে বিভূতির টিকা পরিয়ে দেন। কালভৈরবের পুজো দিতে চাইলে তিনি ভক্তদের দেওয়া পুজোর উপকরণ নিয়ে গর্ভগৃহে চলে যান। এই ফাঁকে ভক্তরাও কালভৈরবের বিগ্রহ ভালো করে দেখার সুযোগ পান। একটি উঁচু পাথরের উপর দেবতা আসীন। কালভৈরবের সর্বাঙ্গ লাল রঙের পট্টবস্ত্র দিয়ে আবৃত থাকে সর্বদা। বিগ্রহের উচ্চতা আনুমানিক তিন ফুট মতো। কালভৈরবের সর্বাঙ্গ নানা রঙের ফুল দিয়ে সাজানো। কালভৈরবের মুখে বিশাল রুপোর মুখোশ পরানো থাকে। ফলে আসল মুখটি কেমন তা রহস্যই থেকে যায়। তবে মুখোশ পরানো চোখ দু’টি বেশ বড় বড়। মাথায় মুকুট। পূজারি ভক্তদের দেওয়া পুজোর ডালা নিয়ে বিগ্রহের পায়ে ছুঁয়ে কিছু মন্ত্র উচ্চারণ করে নৈবেদ্যতে কয়েকটি ফুল দিয়ে ফিরে এসে ভক্তের হাতে ফিরিয়ে দেন। কালভৈরবের কথা পূজারির কাছে জানতে চাইলে তিনি একই কথা সবাইকেই জানা— ইনি হলেন কাশী বিশ্বনাথের বিশ্বস্ত প্রধান সেনাপতি এবং কাশীপুরীর রক্ষক।
অনেক ভক্ত পুজো দেওয়ার পর নাটমন্দিরের এক পাশে দাঁড়িয়ে ধূপ ও ধূপবাতি জ্বালিয়ে আচার্য শংকরকৃত কালভৈরবাষ্টক স্তোত্র আবৃত্তি করে করেন।
‘ভূতসংঘনায়কং বিশালকীর্তিদায়কং।
কাশীবাসি-লোকপুণ্য-পাপ-শোষকং বিভূম্।।...
কালভৈরবের সমস্ত দেহ বস্ত্রাবৃত থাকলেও তাঁর ধ্যান থেকে জানা যায়, তাঁর দেহ নীলবর্ণ। গলায় রয়েছে সর্পযজ্ঞোপবীত। কপালে চন্দ্রকলা। তিনি চার হাতে যথাক্রমে ত্রিশূল, টঙ্ক, পাশ ও দণ্ড ধারণ করে আছেন। মাথার জটা পিঠ পর্যন্ত নেমেছে। ইনি মৃত্যুদর্পনাশক হলেও ভক্তের মুক্তিদাতা। তাঁর সুদৃষ্টিতে জীবের সকল পাপ নাশ হয়।
পূজারির কাছে এই মন্দিরের উৎসবের কথা জানতে চাইলে তিনি শোনালেন, প্রতি অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণাষ্টমী তিথিতে এখানে বড় উৎসব হয়। সেই দিনটিতেই কালভৈরব পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন। এছাড়া প্রতি রবিবার কালভৈরবের দর্শনে বহু ভক্ত সমাগম হয়। ভক্তরা রাত জেগে কালভৈরবের কীর্তন করেন। যাঁরা কাশীবাসী হন তাঁদের প্রথম ছ’মাস নানা বিঘ্নের মধ্যে কাটাতে হয়। কালভৈরব তাঁদের নানাভাবে পরীক্ষা করেন। সেই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারলে তবেই তাঁরা কালভৈরবের দয়ায় তাঁদের জন্মগত সংস্কার ও কর্মফল বশত যে সমস্ত বিঘ্ন জন্মায় সেগুলি দূর হয়ে নির্ভয়ে নিশ্চিন্তে কাশীবাসী হতে পারেন। তাই কাশীবাসীদের প্রথমে বিশ্বনাথ দর্শন তারপরেই কালভৈরবের পুজো ও দর্শন করতে হয়। শাস্ত্রে এমন নিয়মও আছে, মন্দিরে গিয়ে বসতে হয়, তাহলে মন্দিরের অধিষ্ঠাতা দেবতা ভক্তের উপর সন্তুষ্ট হন। 
বারান্দার একপাশে বিক্রি হচ্ছে কালো তাগা। যিনি বিক্রি করছেন তাঁকে ঘিরে রয়েছেন দশ বারোজন ভক্ত। সকলেই চাইছেন সেই তাগার মালা। অনেকেই শুধু নিজেই পরছেন না, নিজের পরিবারের প্রত্যেক সদস্যদের জন্যও কিনছেন। একে বলে কালভৈরবের ডোর। কাশীবাসীদের বিশ্বাস, এই ডোর ভক্তিভরে পরলে কালভৈরব সর্বদা তাঁর ভক্তকে সমস্ত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করেন। এই ডোর কোথায় পরতে হয়? জানা গেল ডান হাতে ও গলায় শরীরের এই দুই জায়গাতেই কালভৈরবের ডোর পরা যায়। কালভৈরবের মন্দিরের পিছনে একটি পাথরের বেদি আছে। 
সেই বেদির গায়ে নবগ্রহ মূর্তি খোদিত। মন্দির পরিক্রমা করে পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলে দেখা যাবে মন্দিরের গায়ে দশাবতার, সপ্তমাতৃকার ও বিভিন্ন দেব-দেবীর চিত্র আঁকা। কালভৈরবের মন্দিরের পিছনের রাস্তা দিয়ে একটু এগতেই আরেকটি বিখ্যাত মন্দির দেখা যায়। সেটি দণ্ডপাণির মন্দির। দণ্ডপাণির কালোপাথরের মূর্তিটি সর্বদা কাপড়ে জড়ানো থাকে। একে দণ্ডপাণি ভৈরবও বলা হয়। ইনি হলেন কালভৈরবের সহচর। ইনিই গণেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তাই তাঁর আরেক নাম দণ্ডপাণি বিনায়ক। প্রতি রবি ও মঙ্গলবার এখানেও পুজো দেওয়ার জন্য খুব ভিড় হয়। 
দণ্ডপাণি সম্বন্ধে কাশীখণ্ডে একটি কাহিনি আছে। পূর্ণভদ্র নামে এক যক্ষের ছেলে কঠোর তপস্যা করতেন। বিশ্বনাথ তাঁর তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে তাঁকে দণ্ডধারী বরকন্দাজ উপাধি দেন এবং কালভৈরবের সহকারী হিসেবে নিযুক্ত করেন। সেই থেকে তাঁর নাম দণ্ডপাণি ভৈরব। কাশী বিশ্বনাথের গলিতে যে দণ্ডপাণিশ্বর শিব আছেন তিনিও এই দণ্ডপাণি ভৈরব দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত। বলা হয়, ইনি সকল পাপীদের এখানে নিয়ে এসে তাদের পাপের দণ্ড দেন।

কী কী দান করলে ভক্তের মঙ্গল হয়?
কালভৈরবের উপাসনা করা ও উপবাস করে পুজো দেওয়া, সব শিবভক্তেরই কাম্য। এতে সবরকমের ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। কালভৈরবের ভোগে অবশ্যই খিচুড়ি, গুড়, তেল ও চাল রাখতে হবে। নৈবেদ্য হিসেবে এইদিন সম্ভব হলে লেবু, কালো তিল, ধূপ, সর্ষের তেল, অড়হড় ডাল, মালপোয়া ইত্যাদি দান করা যেতে পারে। এই জিনিসগুলি দান করলে জীবনের সমস্ত ঝামেলা, বিদ্বেষ, সমস্যা দূর হয়ে সাফল্য ও উন্নতি আসে।
কালভৈরবের বাহন হল কালো কুকুর। তাই এদিন কুকুরকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। কালভৈরবাষ্টমীর দিন তাঁর আশীর্বাদ পেতে কুকুরকে মিষ্টি রুটি বা গুড় রুটি খাওয়ালে কালভৈরব ভক্তের উপর প্রসন্ন হন। ভক্তদের মনষ্কামনা পূরণ করেন। কালভৈরব হলেন ভগবান শিবের অন্যতম উগ্র ও ভয়ঙ্কর অবতার। কালভৈরব অতীত বা নিয়তিও নন। তিনি সর্বদাই ভক্তের সঙ্গে সূক্ষ্মভাবে বিরাজ করেন। ভক্তের বিপদে আপদে তিনি রক্ষা করেন।
ইনি পঞ্চভূতের অধিপতি, যার মধ্যে রয়েছে পৃথিবী, আগুন, জল, বায়ু এবং আকাশ। তিনি ভক্তের জীবনে সমস্ত ধরনের কাঙ্ক্ষিত পরিপূর্ণতা প্রদান করেন, ভক্তকে সমস্ত কামনা উদার হস্তে প্রদান করেন। কালভৈরবকে স্মরণ করার মাধ্যমে, একজন ব্যক্তি গভীর ধ্যানের আনন্দ অর্জন করে, সমস্ত দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয় এবং কোনও কিছুর জন্য চিন্তা থাকে না।
যে সমস্ত পবিত্র স্থানে মাতৃরূপের ঐশ্বরিক শক্তি থাকে সেই স্থানগুলি শক্তিপীঠ নামে পরিচিত। এই স্থানগুলি কালভৈরব দ্বারা সুরক্ষিত থাকে। এ থেকে বোঝা যায় কালভৈরব শুধু শৈবতীর্থেই বিরাজ করেন না তিনি শক্তিপীঠগুলিতেও সদাজাগ্রত অবস্থায় থাকেন। তিনি পাহারায় রত থাকেন যাতে কারও দ্বারা শিবস্থান ও শক্তিপীঠগুলি অপবিত্র না হয়।
প্রতিদিন কালভৈরব বীজ মন্ত্র পাঠ করলে পাঠকারী ব্যক্তি তাড়াতাড়ি মুক্তির দিকে এগিয়ে যায়। পার্থিব জগতের সমস্ত দুঃখ, কষ্ট এবং মায়া থেকে মুক্ত হওয়া যায়। ভক্তের সমস্ত ধরনের নেতিবাচক কার্যকলাপের পরিণতি হ্রাস করে। বীজ মন্ত্র জপে ভক্তের সিদ্ধির পথে সমস্ত বাধা দূর হয়। সমস্ত রকম অসুস্থতা এবং ব্যাধি থেকে মুক্তি হয়। বীজ মন্ত্র জপ করলে দীর্ঘদিন ধরে চলা আইনি বিবাদে জয়ী হতে সাহায্য করতে পারে। 
এছাড়া এই মন্ত্র জপে দারিদ্র্য দূর হয়ে ভক্তের জীবনে আসে অর্থ ও সাফল্য। পাশাপাশি কালভৈরব গায়ত্রী মন্ত্র নিয়মিত অনুশীলন করলে সীমাহীন সুবিধা লাভ হয় ভক্তের। মন্ত্রটি পাঠ করলে ভক্তের সমৃদ্ধি লাভ এবং মনে শান্তি আনে। প্রতিপক্ষ শত্রুর বিরুদ্ধে জয়, জাগতিক বিলাসিতা এবং সাফল্য পাওয়া যায়। মানুষের দ্বারা সৃষ্ট সমস্যার সমাধানও সম্ভব হয়। কালভৈরবাষ্টকম স্তোত্র পাঠেও অনেক উপকার মেলে।
কালভৈরবের পুজোর পরে শিবপুজো 
করা উচিত
কালভৈরবের পুজো করার পর শিবপুজো করা আবশ্যক। সঙ্গে পার্বতী, গণেশ ও কার্তিকের পুজোও করা ভালো। এই তিন দেবতাকে অভিষেক করার পর পার্বতীকে বেলপাতা, ফুল ও লাল ওড়না অর্পণ করতে হয়। করতে হয় ভোগ নিবেদন ও আরতি।
কালভৈরবের উপাসনা করা ও উপবাস করে পুজো দেওয়া, সব শিবভক্তেরই কাম্য। এই পুজো করলে সব রকমের ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। 
কালভৈরবের ভোগে অবশ্যই খিচুড়ি, গুড়, তেল ও চাল রাখবেন। 
এই দিনে কোন কোন কাজ করবেন না
১) কালভৈরবাষ্টমীর দিন কোনও প্রকার অনৈতিক কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত থাকা উচিত নয়। 
২) এদিন মাংস, আঁশযুক্ত খাবার, মদ্য ও ধূমপান থেকে অবশ্যই দূরে থাকা উচিত। 
৩) এদিন কারও উপর অযথা রাগ দেখানো কাম্য নয়। রাগ করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়াও উচিত নয়। পরিবারের শান্তি বজায় রাখতে এদিন কালভৈরবের মন্ত্র জপ করলে খুবই ভালো ফল দেয়।
কাশী ছাড়াও উজ্জয়িনী, মাইহার, হরিহরেশ্বর, অমরকণ্টক, কেদারনাথ, গোকর্ণ, রতনপুর, জয়পুরে যশোরেশ্বরীর মন্দিরে, পুণের পাতালেশ্বর শিবমন্দিরে, উত্তরকাশীতে, ত্রিপুরার ঊনকোটি, কনখলের দক্ষরাজার যজ্ঞস্থল প্রভৃতি জায়গায় কালভৈরব মূর্তিতে পুজো করা হয়।
29d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বাক্য ও ব্যবহারের রুক্ষতায় শত্রু বৃদ্ধির যোগ। হাতের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি তাড়াতাড়ি করে  ফেলতে চেষ্টা করুন।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৯৮ টাকা৮৭.৭২ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৭ টাকা১১০.২১ টাকা
ইউরো৮৮.৭৮ টাকা৯২.১৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা