বর্তমান পত্রিকা : Bartaman Patrika | West Bengal's frontliner Newspaper | Latest Bengali News, এই মুহূর্তে বাংলা খবর
সাপ্তাহিক বর্তমান

মৃত্যুর পরবর্তী ১৩ দিন 
আত্মার কী অবস্থা হয়?

শাস্ত্র বলছে, মৃত্যু যখন আসবে তখন ভাববে, আমাদের বিনাশ সম্ভব নয়। কিছুই আমাদের নাড়া দিতে পারবে না। জীবনটা যায় না, শরীরের বিনাশ হয়। অন্য শরীরে আমাদের আত্মা প্রবেশ করে। তবে কি পুনর্জন্ম নিশ্চিত? মৃত্যু এতই বাস্তব, এত স্বাভাবিক তবু তাকে মেনে নেওয়া ভীষণ কঠিন। মরণ আসে। মানুষ চলে যায়। মৃত্যুর পর কিছু নিয়ম-সংস্কার সব সম্প্রদায়ের মানুষকেই মানতে হয়। মৃতাশৌচের অবস্থাকালে বিদেহী আত্মা কোথায় অবস্থান করে? তার গতি কোন পথে ধাবিত হয়? শোকসন্তপ্ত পরিজনের জন্য মৃতের আত্মার করণীয় কী থাকে? বহু আকাঙ্খিত এই জিজ্ঞাসার অনুসন্ধান করলেন সোমব্রত সরকার।

শরীরের যখন বিনাশ হচ্ছে:
জীবন হচ্ছে যাত্রী। মৃত্যু একটা পথ মাত্র। আত্মা পথ দেখিয়ে মৃত্যুর কাছে জীবকে নিয়ে চলে যায়। মানুষের শরীরী জীবনটা যখন খুব পরিশ্রান্ত ও ক্লান্ত হয়, প্রবল হয়ে ওঠে দৈহিক যন্ত্রণা। রোগের নিরাময় না হলে শেষের দিনের যন্ত্রণা অসহনীয় হয়ে পড়ে, মৃত্যু আসে তার বিধ্বংসী রূপ নিয়ে।
প্রলয়ঙ্কর মৃত্যু নানা রূপে নানাভাবে নানা জনের কাছে এসে উপস্থিত হয়। সে যখন আসে মানুষকে তখন সামান্য বা লম্বা সময়ের জন্য বিশ্রাম নিতে হয়, তারপর তো আবার পথের যাত্রা শুরু হয়।
মানুষের মনটা সদা সর্বদার জন্য ভেবে ভেবে চলে মৃত্যুর কথা, হৃদয়টা কেবল ভাবে জীবনটার কথা আর আত্মা ভেবে যায় চুপিসারে অমৃতের কথা। অথচ সিংহভাগ মানুষ এই তিনটি অনুভূতির কোনওটাই টের পায় না। বহির্জীবনের দাপট মানুষের অন্তর্জীবনকে উপলব্ধি করতে দেয় না। কেবল বাধা দান করে।
নানান কাজের চাপে, জীবনের জটিল সব সমস্যার ভাঁজে মানুষের নার্ভগুলি উত্তেজিত হয়, তাই সকলেই আমরা অস্থির ও মারমুখী হয়ে পড়ি। প্রতিকূল কিছু পরিস্থিতি তৈরি হলেই রেগে যাই, খারাপ ব্যবহার করে ফেলি, আমাদের ঈর্ষা-দ্বেষ সমস্তটাই বেরিয়ে পড়ে। সুন্দর পোশাক পরা চেহারা-ছবি নিয়েও আমরা ঢেকে রাখতে পারি না আমাদের কদর্য রিপুদোষ।
যাঁদের অন্তর্জীবন আছে তাঁরাই একমাত্র মন, প্রাণ ও আত্মা— এই তিনটির আলাদা অস্তিত্ব টের পেয়ে যান। নানান বিপর্যয় ও দুর্বিপাকের মধ্যেও তাঁদেরই বহির্জীবনেও আমরা তখন মিষ্টতা, নম্রতা, পবিত্রতা, সরলতার স্পর্শ পাই। সংসারে বাস করা কিছু মানুষ এভাবেই আত্মসচেতনতার একটি স্রোত নিয়ে নদীর মতন সাগরের দিকে প্রবাহিত হতে থাকেন। এঁরাই একমাত্র ধরতে পারেন কখন তাঁকে দেহত্যাগ করতে হবে।
মানুষের অন্তর্জীবন যদি গভীর থাকে তাহলে সে মৃত্যুকে মুছে দিতে পারে। বুঝতে শেখে জীবন মহামূল্যবান, সময়ের মূল্যটাও অনেক। মন ও মৃত্যুর যখন উত্তরণ ঘটে তখনই মানুষ নতুন আবাস খুঁজে পায়, সেখানে কাছের আলোর সঙ্গে সুদূরের আলোরও সন্ধান মেলে। যখন আত্মা ও অমরত্ব এক হয়ে ওঠে তখনই মানুষ নতুন লক্ষ্যের খবরগুলো পেতে থাকে, আনন্দ ও উত্তরণের মহানন্দে ভেসে চলে যায়।
সাধারণ মানুষেরা মনে করে মৃত্যু মানেই জীবনের লয়। এটা তারা কেউই বুঝতে পারে না মৃত্যু একটা অবস্থা। মহাভারতের যুদ্ধে শ্রীকৃষ্ণ মানুষের এই অবস্থাটার কথাটাই বারে বারে স্মরণ করাচ্ছেন।
শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বোঝাচ্ছেন, ‘দেখ, যারা জন্মাচ্ছে মৃত্যু তাদের অবশ্যম্ভাবী, তেমনই মৃতদের পুনর্জন্মও নিশ্চিত। তাই যা এড়ানো কোনওভাবেই সম্ভবপর নয় তার জন্য দুঃখ করে কোনও লাভ নেই।’ 
ছান্দোগ্য উপনিষদে রয়েছে, আচার্য গুরুকে শিষ্যরা প্রশ্ন করছে, ‘মৃত্যু যখন আসবে তখন আমরা কী করব?’
ঋষি বললেন, ‘মৃত্যুর সময় তিনটি উচ্চ ধারণার পোষণ করো তোমরা। এক, আমাদের টলানো যাবে না। দুই, আমরা অবিনাশী। তিন, আমরা জীবনেরই সারাৎসার।
মৃত্যু যখন আসবে তখন ভাববে, আমাদের বিনাশ সম্ভব নয়, কিছুই আমাদের নাড়া দিতে পারবে না। জীবনটা যাচ্ছে না, শরীরটার বিনাশ হচ্ছে— আরেকটা শরীরের মধ্যে গিয়ে ঠিক আমাদের আত্মা প্রবেশ করে যাবে।’
মানুষের দুটো জীবন— বহির্জীবন সে চোখে দেখতে পায়, ষাট, সত্তর, আশি বছরের জীবন। অন্তর্জীবন চোখে দেখা যায় না, আধ্যাত্মিক জগতের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে উঠলেই এটা ধরা পড়ে। বোঝা যায় যে আমাদের মনটার মধ্যে রয়েছে ইন্দ্রিয়ের নানান ওঠা-পড়া, যা আমাদেরকে স্থির হতে দিচ্ছে না। ইন্দ্রিয়গুলো যখন একটু স্থির হয় জপ-ধ্যান-প্রাণায়ামে তখনই মনটা মিইয়ে আসে যেন। ইন্দ্রিয় ও জগতের কোলাহল থেকে একটু বেরিয়ে দু’দণ্ড যে অন্য জগতে প্রবেশ করেছি, এটুকু ধরতে পেরে যাই আমরা। এই হল গিয়ে প্রাণের দরজা। ওর আরও ভেতর যখন আমরা ঢুকে পড়তে পারব তখনই ধ্যান থেকে পাওয়া, অনুভূতি দিয়ে ধরা এবং যে অতীন্দ্রিয়লোকে চট করে যাওয়া চলে না— সেখানকারই একটা শক্তির অস্তিত্ব ধরতে শিখব। ওটাই আত্মা। ধ্যান করতে করতেই একে দেখা যাবে। এভাবেই অন্তর্জীবনের মধ্যে না এলে তাকে পাওয়া যাবে না।
মৃত্যুর সময় যে চিন্তা রাখবার কথা ভারতের প্রাচীন ঋষিরা, সাধকেরা বলে গেছেন, তা তো আর বহির্জগতের সাফল্য নিয়ে মেতে থাকতে থাকতে জীবনের আশ্চর্য পরিণতি–রোগ-ব্যাধি-শোকের ছায়া নেমে আসা শরীর নিয়ে উপলব্ধি করাটা কখনও সম্ভবপর নয়।
মৃত্যু বলে কিছু নেই এ সম্বন্ধে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন, ‘আত্মা মাঝে মাঝে শরীরকে ছেঁড়া, রংচটা কাপড়চোপড়ের মতনই ফেলে দিয়ে তরতাজা নতুন মাংস-চামড়ার একটা পোশাক পরে নেয়।’
যোগীদের কাছে মৃত্যু কোনও বড় ব্যাপারও নয়, হীন ব্যাপারও নয়। আমাদের কাছে মৃত্যু একটা বড় ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। মৃত্যুর পর দেহ সমাহিত করা, দাহ করা। আত্মা দেহ ত্যাগ করে চলে যাওয়ার পর তার কোনও আগ্রহ থাকে না শরীরটার কী হল? পাখি চলে গিয়েছে, খাঁচাটা পড়ে রয়েছে। পরিত্যক্ত খাঁচা নিয়ে মৃতের স্বজনেরা খালি ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।
দেহের বন্ধন
দামাস্কাসের সুলতান সভার মধ্যেই বসে আছেন। এক বিশ্বস্ত ভৃত্য সুলতানের কাছে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে বলল, ‘হুজুরে আলম, আপনার সবচেয়ে দ্রুতগামী ঘোড়াটা কিছুক্ষণের জন্য আমাকে একটু দেবেন?’ সুলতান খুবই ব্যগ্র হয়ে বললেন, ‘কেন হে, আমার বেগবান ঘোড়াটা নিয়ে তুমি এখন কোথায় যাবে শুনি?’ অনুগত যুবকটি বলল, ‘সুলতান, আপনার সাজানো উদ্যানটি পেরিয়ে যখন আসছিলাম তখন আমি মৃত্যুকে দেখলাম। সে দু’হাত বাড়িয়ে আমায় ধরতে এল আর খুব ভয় দেখাল। আমি তাই তড়িঘড়ি বাগদাদে পালাতে চাইছি। এজন্যই হুজুর, আপনার জোরসে ছোটা ঘোড়াটা আমার চাই।’ দামাস্কাসের সুলতান ভৃত্য যুবকটির প্রার্থনা তক্ষুনি মঞ্জুর করলেন। এরপর সুলতান নিজেই সভা ছেড়ে মৃত্যুর সন্ধানে উদ্যানে চলে এলেন। এসে দেখলেন স্থলপদ্ম গাছের তলায় মৃত্যু গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। দেখেই তো সুলতান হাঁক দিয়ে উঠলেন, ‘অ্যাই, তুমি এখানে করছটা কী শুনি? আমার অনুগতজনকে অত ভয় দেখাচ্ছ কেন বল তো?’ দামাস্কাসের সুলতানের কাছে ক্ষমা চেয়ে মৃত্যু বলল এবারে, ‘প্রভু, আমি ওই ছেলেটিকে একটুও কিন্তু ভয় দেখাতে চাইনি। ওকে এখানে দেখে গভীর বিস্ময়ে আমি তার দিকে খালি হাতটি বাড়িয়েছিলাম। এতেই ও ভয় পেয়ে গেল।’ সুলতান বললেন, ‘কেন তুমি ওকে আলিঙ্গন করতে চাইছিলে, আমাকে একটু বল।’ মৃত্যু বলল, ‘হুজুর, ওর এখন যে আপনার প্রমোদ উদ্যানে এই মুহূর্তে একদমই থাকার কথা নয়। আজ রাতেই ছেলেটির সঙ্গে আমার বাগদাদে দেখা হওয়ারই তো কথা!’
সেই যুবকটি শেষে দামাস্কাসের সুলতানের দ্রুতগামী ঘোড়াটি নিয়ে বাগদাদে পৌঁছে গেল। ওখানেই সে মারা গেল।
সুলতানের কাছে যুবক ভৃত্যটির মৃত্যুর সংবাদ এসে পৌঁছনো মাত্রই তিনিও অনুধাবন করলেন এবার, এভাবেই সকলের মৃত্যু ঘটবে। ভবিষ্যতের গহনে কী লুকিয়ে আছে আমরা কেউ তা জানি না, কিন্তু প্রত্যেকেই এটা খালি জানি— ভবিষ্যতে আমাদের মৃত্যু হবেই। তার হাত থেকে কারও রেহাই নেই।
মায়ের মন্ত্রশিষ্য, রামকৃষ্ণ মিশনের তদানীন্তন অধ্যক্ষ স্বামী বিশুদ্ধানন্দ মহারাজের জন্মতিথি উপলক্ষ্যে সকলেই জড় হয়েছেন বেলুড় মঠে, ১৯৬২ সালের ১০ জুন। দক্ষিণেশ্বরের সারদা মঠ থেকে সেদিন মহারাজকে প্রণাম জানাতে গিয়েছিলেন প্রব্রাজিকা সারদাপ্রাণা। মাতাজি ডাক্তার। তিনি গিয়ে সেদিন মহারাজের পায়ের কাছেই বসেছিলেন। স্বামী বিশুদ্ধানন্দ সারদাপ্রাণা মাতাজিকে দেখেই তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, ‘তুমি কি জানো, দূরপাল্লার ট্রেনে যেতে হলে আগে থেকে সিট রিজার্ভ করতে হয়?’ মাতাজি চটপট উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ মহারাজ, কিছুদিন আগে আমাদের রিজার্ভেশন করতে হয়।’ পূজ্যপাদ মহারাজ বললেন, ‘হ্যাঁ, ঠিক সেভাবেই শ্রীশ্রীমায়ের কোলে আমার রিজার্ভেশন হয়ে গেছে।’
পরদিন ১১ জুন পূর্বব্যবস্থা অনুযায়ী মহারাজকে একটি মেজর অপারেশনের জন্য হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। অপারেশন ভালোভাবেই হয়ে গেল— চিকিৎসকদের আশামতো তাঁর অবস্থার উন্নতিও হচ্ছিল। কিন্তু আকস্মিকভাবে ১৬ তারিখ সকালে দুঃসংবাদ এল অধ্যক্ষ মহারাজ লোকান্তরিত হয়েছেন। এ সংবাদে সকলেই মর্মাহত। বিশেষত, তিনি ক্রমে আরোগ্যলাভ করছেন— ডাক্তারদের মুখ থেকে এই কথা শোনার পর এমন শোকসংবাদের জন্য কারও মানসিক প্রস্তুতি একেবারেই ছিল না। সারদাপ্রাণা মাতাজি এই ঘটনার কথা জানিয়ে অস্থির মনে চিঠি লিখলেন তাঁর গুরুদেব যতীশ্বরানন্দ মহারাজের কাছে। বেঙ্গালুরু আশ্রম থেকে উত্তর এল প্রব্রাজিকা সারদাপ্রাণার কাছেই: ‘স্বামী বিশুদ্ধানন্দের শেষ জন্মতিথিতে তাঁকে দর্শন করার যে বিস্তারিত বিবরণ লিখেছ, তা পড়ে আমি অভিভূত। বিশেষত তাঁর ওই মন্তব্য ‘শ্রীশ্রীমায়ের কোলে তাঁর জায়গা রিজার্ভ করা হয়ে গেছে। আমরাও যেন এমন জীবন যাপন করি যাতে তাঁর কোলে আমাদেরও ঠাঁই হয়। মৃত্যু তাহলে আমাদের অমরত্বে উত্তীর্ণ করে দেবে।’ আর আমাদের প্রিয় গুরুজনদের সম্পর্কেও যদি এভাবে ভাবি যে, তাঁরা শ্রীশ্রীমার অভয় অঙ্কে স্থান পেয়েছেন, তাহলে শোক বা বিষাদের অবকাশ থাকে না। বরং এই ভেবে আনন্দ হয় যে, দেহের বন্ধন থেকে তাঁদের চিরমুক্তি লাভ হয়েছে।
পৃথিবীলোক
প্রাচীন ভারতের ঋষিরা জানিয়েছেন, মানুষের শরীর সত্তাটার মধ্যেই স্বর্গলোক রয়েছে। অর্থাৎ সৃষ্টিতে যে সূক্ষ্মলোক রয়েছে একই জিনিস আছে আমাদের শরীরের মধ্যেও। 
‘সর্গেষু লোকেষু শরীরত্বায় কল্পতে।’
দেহ থাকতে থাকতেই মানুষের মনে যদি এ ভাবনাগুলো চলে আসে, আর আচার্য গুরুর কাছ থেকে অধ্যাত্ম শিক্ষাক্রমের পাঠগুলো নেওয়া থাকে তাহলে সৃষ্টির মধ্যে যে সমস্ত সূক্ষ্ম লোকপরম্পরা রয়েছে তার ভেতর দিয়েই শরীরটাকে চালনা করা যায়।
আমি বেশ কয়েকবার গোরক্ষনাথ সম্প্রদায়ের সাধু ডক্টর ত্যাগীনাথজির সংস্পর্শে এসেছিলাম। তিনি নেপালের পশুপতিনাথে অঘোর কুঠিয়ায় বাস করতেন। একশো ছাব্বিশ বছর বয়সে দেহ রেখেছেন বাবা ত্যাগীনাথ। এই তো বছর কয়েক হল।
ত্যাগীনাথজি প্রত্যেক বছর তারাপীঠ মহাশ্মশানে আসতেন অঘোর চতুর্দশীর রাতে, মহানিশায়। তাঁর গুরুদেব ডক্টর রামনাথ বাবা এখানেই পিণ্ড-ব্রহ্মাণ্ড সাধনাতে সিদ্ধিলাভ করেছিলেন।
ত্যাগীনাথ বাবা আমাকে বলেছিলেন, ‘ভাণ্ড ও ব্রহ্মাণ্ডটা এক করবার সাধনপন্থা হল পিণ্ড-ব্রহ্মাণ্ড সাধনা। সমস্ত জগৎটাকে আত্মসত্তার মধ্যে আনতে হবে সপ্তলোকের মাধ্যমে।’
আমি বললাম, ‘ভূঃ, ভূবঃ, স্বঃ, মহঃ, জনঃ, তপঃ, সত্য।’
ত্যাগীনাথ বাবা মৃদু হেসে বললেন, ‘বইতে পড়া বিদ্যার কথা বললে তো চলবে না, প্রিয় বেটাজি। সাধন করনা চাহিয়ে— সাধনা করতে করতেই টের পেয়ে যাবে তুমি লোকগুলিকে চেতনার দিক থেকে বোঝানো হয়েছে। যেমন তুমি রোজ খাওয়াদাওয়া করছ, কাজকর্ম করছ। নিত্য জীবনপ্রবাহ থেকে তোমার মধ্যে যে যে চেতনা আসছে— কখনও মন উদার করছ, কখনও হিংসা আর লঘুস্বার্থের কথা ভাবতে গিয়ে তোমার মনকে নীচে নামিয়ে আনছ। যা কিছু করছ, সমস্তটাই করছ, তোমার ওই অন্নময় চেতনা থেকে। প্রাণময় চেতনাতে যখন মানুষ যায় তখন এই সূক্ষ্ম লোকগুলি সম্পর্কে সচেতন হতে শেখে। সাতটি লোকের সাযুজ্য গড়া মানুষের স্থূলশরীরের ভেতর যে সূক্ষ্মলোক, ওর মধ্যে সাতটি চক্র রয়েছে— মূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ, আজ্ঞা, সহস্রার। মোহ চাঞ্চল্য নিয়ে এসব যে ধরা যাবে না। অঘোর কুঠিয়াতে এস। তোমাকে আমি প্রাণভূমির রসাস্বাদনের শিক্ষা দেব। মনুষ্য ভূমির স্তরে এখনও আছ। এর পর গন্ধর্ব ভূমি। মনুষ্য গন্ধর্ব, দেব গন্ধর্ব— দুটি ভাগ আছে সেখানে। ওইখানে রয়েছে পিতৃচেতনা। তারপর দেবচৈতন্য। এই চারটি লোক সাধনার মধ্যে দিয়ে যাঁরা পার হতে পেরেছে তাঁরাই ব্রহ্মলোকে পৌঁছে গেছে। এখন তোমার কাজ হল, নিজের মাঝে আত্মার সুস্পষ্ট অনুভব। এটুকু কর। মাস ছয় পর এস, পিণ্ড-ব্রহ্মাণ্ড বুঝিয়ে দেব। এ অতি প্রাচীন সাধনা। পুরনো নাথযোগীরা শরীর থেকে বের হতে পারতেন, বেটাজি।’
বললাম, ‘গুরুজি, নচিকেতা তো স্বর্গলোকের ঊর্ধ্বে পৌঁছনোর ইচ্ছাপ্রকাশ করেছিলেন।’
ত্যাগীনাথজি বললেন আমায়, ‘কঠোপনিষদটি যদি ভালো করে পড়তে পার ভালো হয়, বেটাজি। সূক্ষ্ম অস্তিত্বের সাধনক্রমটা ওইখানেই দেওয়া আছে। যদিও পড়ে সবটা বোঝা যাবে না। তবু তো পড়। মন লাগাও। কিশোর নচিকেতা যমের মুখোমুখি হয়ে বলেছিল, তুমি আমাকে বল, মানুষ এখান থেকে ওপারে গেলে, থাকে না ফুরিয়ে যায়।’ 
যম মৃত্যুর পর মানুষের চার ধরনের গতি হওয়ার কথা সেখানে বলেও দিলেন। প্রথমেই বললেন, মাটির মানুষ মাটিতেই মিশে চলে যায়। তারপর বললেন, যাঁদের বেঁচে থাকাকালীন অতিরিক্ত বাসনা-কামনা থাকে সে সব পূরণ না হতেই মরে যায়, তাঁরাই বাসনার টানে পৃথিবীতে বার বার যাওয়া আসা করতে থাকে। আর শোক-দুঃখ, অপ্রাপ্তিতে মরলোকে কষ্ট ভোগ করতেই থাকে। বেঁচে থাকতে মানুষ যে বোঝে না, যত বাড়াবে বাসনা, বেড়েই যাবে। বাঙ্গাল কা মাঈ, সারদা মাঈজি বোল রাহি, নির্বাসনা হও খালি। হতে শিখছ না বলেই খামোখা কষ্ট পাচ্ছ আর বারে বার যাওয়া-আসা করছ। যমরাজ বললেন, মানুষের এই দুই গতি ছাড়া আরেকটা যেটা হয় সেটা হল— মহর্লোকে চলে যায়। নিজের আত্মার মহিমাকে যাঁরা বেঁচে থাকতেই অনুভব করতে শেখেন তাঁরাই উজিয়ে চলে যায়। যোগীদের, অধ্যাত্মজ্ঞানীদের মরণ এভাবেই হয়। চতুর্থ গতি যা হয় মানুষের— ব্রহ্মে সমাপন হতে পারে। মৃত্যুর প্রাক্কালে যাঁর চিত্ত এই সংসারের মায়িক বন্ধন ছিঁড়ে ফেলে, যিনি সূক্ষ্মলোকের— ওপারের আলোর সন্ধান পান, তিনিই একমাত্র সংসারে ফেরেন না। নিত্য জ্যোতিতে মিশে থাকেন। উচ্চকোটির মহাত্মারা এভাবেই যে আছেন। সাধনা করলেই তাঁদের অস্তিত্ব তুমি টের পাবে। মানুষের মৃত্যুর পর শ্রাদ্ধ সভায় কঠোপনিষদ পড়বার বিধান দিচ্ছে শাস্ত্র। সেটি পড়লেই জেনে যাবে, অন্তরে যদি মৃত্যুকে জানার শিক্ষা লাভ করতে পারো — জীবন থাকতে তাহলেই একমাত্র জীবনকে পাবে। না হলে পর এটি পেলাম না, এই অভাব পূরণ হল না, ও কষ্ট দিল এইসব করতে করতেই পৃথিবীলোক ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। ফের ফিরে এসে ওই একই কাজ করে যাবে। শান্ত আত্মারূপ উপলব্ধি করতে শেখ। পশুপতিনাথ এসো। সাধন করনা চাহিয়ে, ভজন করনা চাহিয়ে— বিনা সাধনে নাহি মিলে।
জীবন-মৃত্যুর রহস্য
মানুষের শরীরটা একটা কাপড়ের মতো। ছিঁড়ে গেলে সেটা ফেলে সব্বাই যেমন নতুন একটা পোশাক পরি, আত্মাও ঠিক তেমনই— নির্দিষ্ট কর্ম ও বাসনা পূর্ণ হলেই সে কাপড়ের মতনই শরীরটাকে ফেলে দিয়ে আবার নতুন শরীর গ্রহণ করে নেয়। ‘বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়’— গীতার মধ্যে শ্রীকৃষ্ণ এভাবেই আত্মার সত্তা সম্বন্ধে আমাদের পরিষ্কার করে অবগত করেছেন। মৃত্যুর পরেও আত্মার ক্রিয়া থাকে বলেই মানুষের শরীর চলে গেলে পারলৌকিক কাজকর্ম করতে হয়। অধ্যাত্ম সাধকেরা ধ্যানের অবস্থায় বিদেহীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হন। ধ্যানের অর্থ হল নিজেকেই নিরবচ্ছিন্ন স্মৃতিপথে জাগিয়ে তোলা। নিষ্কলুষ দিব্যসত্তার ধ্যানে যদি কেউ মগ্ন হতে জানেন তবে এই পদ্ধতি অবলম্বন করে যেমন জীবনপথের অনেক দিক খুলে দেওয়া যায় ঠিক তেমনই আত্মা সম্পর্কিত জ্ঞানেও সিদ্ধ হওয়া চলে। এঁদেরকেই বলেন প্রেতসিদ্ধ। এমন সাধু, যোগিনীরা এখনও বর্তমান। গভীর উচ্চাবস্থায় আরোহণ করে এঁরা বসে রয়েছেন কেউ পাহাড়ের গুহায়, কেউ দুর্গম জঙ্গলে কিংবা খুব নির্জন কোনও প্রান্তরে। এঁদের কাছে চট করে পৌঁছনোও চলে না। কেউ কেউ অবশ্য হদিশ পেয়ে জাগতিক সমস্যা মেটানোর কায়দাবাজি নিয়ে প্রেতসিদ্ধদের কাছে গেছেন। এসব ক্ষেত্রে হিতে বিপরীত ফল হয়েছে। মানুষ মরে গেলেও তার সংস্কার থেকে যায়, সংস্কারের বীজটাই তাকে নতুন জন্ম দেয় কিন্তু মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে তো আর আত্মা নতুন শরীর নেয় না, যতদিন তা না নিচ্ছে ততদিন পরিবারকে, পরিজনকে সাবধানে থাকতে হয়। মানুষ যখন মরে, মনের গভীরে ভোগবাসনার ইচ্ছা লুকিয়ে মরে। ঠিকমতো পারলৌকিক কাজ না হলে ভোগ করার তাড়না নিয়েই বিদেহীরা ফিরে এসে শুদ্ধ সত্তাদের কাছে সহায়তা চান। অনেকের এ সম্বন্ধে ধারণা না থাকার দরুন ভয় পেয়ে যান।
ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মেদিনীপুর জেলার অন্তর্গত নাগোরা মহকুমাতে কার্যে লিপ্ত আছেন। ১৮৬০ সাল। একদিন বঙ্কিমবাবু কার্য অনুরোধে মফস্‌সলে গেলেন। সেখানকার জমিদার বাড়ির উদ্যানবাটির একটি ঘরে তাঁর রাত্তিরে থাকবার বন্দোবস্ত হল। সন্ধ্যার পর তাঁর খাবারদাবারের ব্যবস্থা চলছিল আর বঙ্কিমবাবু ঘরে বসে লেখালেখি করছিলেন। রাত দশটার সময় হঠাৎ করেই একজন ধবধবে সাদা কাপড় পরা মহিলা তাঁর ঘরে ঢুকে পড়ল। বঙ্কিমচন্দ্র অত্যন্ত বিস্মিত হয়ে বললেন, ‘তুমি কে?’ মহিলা কোনও উত্তর দিলেন না। তিনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি কী জন্য এখানে এসছ?’ আগের মতোই নীরব রইলেন মহিলা। বঙ্কিমচন্দ্র লেখার টেবিল-চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে এবার রুক্ষস্বরে বললেন, ‘তুমি আমার কথার উত্তর করছ না কেন?’ মহিলা এবারও উত্তর করলেন না। দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর পেছন পেছন চলতে লাগলেন। মহিলা মূর্তি বাগানে এসে ফের দাঁড়িয়ে গেলেন। বঙ্কিমবাবু তাঁকে এক নিমেষে দেখা মাত্রই ওই মূর্তিময় মহিলা হাওয়ার ভেতর মিলিয়ে গেলেন। এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে কিছুক্ষণ বাগানে দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে আসা মাত্র এতই হতভম্ব হয়ে গেলেন যে বঙ্কিমচন্দ্র ওই জায়গা তৎক্ষণাৎ ছেড়ে আসতে চাইলেন। সেই রাতে তাঁর অন্যত্র থাকবার ব্যবস্থা করা হল। ১৮৬০ সালে ঘটা এই ঘটনার কথা বঙ্কিমচন্দ্রের ভ্রাতুষ্পুত্র লেখক শচীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন তাঁর লেখা বঙ্কিম জীবনীর মধ্যে।
এইসব কেন ঘটে— আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম রাজরাপ্পার প্রেতসিদ্ধা যোগিনীকে। তিনি বলেছিলেন, ‘মানুষের মধ্যে সাধারণত যা থাকে তা হল চর্মচক্ষুর দৃষ্টি। এই দৃষ্টি দিয়ে মানুষ সংসার দেখে, নিজের ভালো-মন্দ, লাভ-ক্ষতি বিচার করতে থাকে। আর উন্নততর দৃষ্টির অধিকারী যাঁরা, তাঁরা চর্মচক্ষু বা ইন্দ্রিয়ের সাহায্য না নিয়েও অনেককিছু দেখতে পান। ভারতবর্ষের প্রাচীন ঋষিরা ছিলেন দিব্যদৃষ্টির অধিকারী। আমাদের উপনিষদের ঋষিরা ধ্যানের ভেতর দিয়ে যে সত্য লাভ করেছিলেন সেগুলো সমস্তটাই বলে গিয়েছেন। শ্রুত সেই সত্য অনুভূতির অনেক পরে লেখ্যরূপ এসেছে বলেই কিছু কিছু আমরা জানতে পেরেছি। পৃথিবীর ঊর্ধ্বে যে বহু বহু স্তর বিদ্যমান, যেখানে মৃত্যুর পর মানুষের আত্মার গতি হয় সেসবের অস্তিত্বের কথা ঋষিরা জেনেছিলেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদ আর ঈশোপনিষদ দুটি ভালো করে পড়ে দেখ, বাবা। পড়লেই ধরতে পারবে, পৃথিবীর জীবনের বাইরে কেমন সব জীবন রয়েছে। সেই জীবনে যখন ত্রুটি হয় তখনই বিদেহীরা সাহায্য চাইতে এ লোকে এসে তাঁদেরই সাহায্য চান, যাঁদের দিব্যদৃষ্টি লাভ করবার সাধনা রয়েছে। কিন্তু বিদেহীদের পূর্বগত ইন্দ্রিয় সংস্কার যদি প্রবল থাকে তাঁরা এমন সমস্ত মানুষ নির্বাচন করে তাঁদের কাছে আসেন, যাঁদের এইসব বিদেহীদের মুক্ত করবার ক্ষমতা কিছুই তো থাকে না। উল্টে এঁরা ভয়টয় পেয়ে যান। জীবনভর মানুষেরা আহার-বিহার আর সুখসম্ভোগ নিয়ে ডুবে আছে, তবু মানুষের ভোগের নিবৃত্তি হচ্ছে না। লোভ- লালসায় যতই ইন্ধন দেবে ততই বেড়ে যাবে। এজন্যই তো মৃত্যু এসে যখন ভোগের পথ আটকে ধরে তখনও মানুষের ভোগ-বাসনা সরে না। বিছানাতে চিরতরে শুয়ে পড়েও মানুষ বাঁচতে চায়। কেন বাবা? ওই ভোগ লালসায়। মরণ এসে তো দেহটাকে শেষ করে চলে গেল কিন্তু, ভোগ-বাসনাটা তো পঞ্চভূতের সত্তায় রয়ে যে গেলই। এর যদি সদগতি না করে নিকটজনেরা তাহলে যে দুরবস্থার শেষ নেই গো। কার্যকারণের নিয়ম ধরেই কর্মফল ভোগ করে চলেছি যে আমরা। অপর কারও ঘাড়ে কর্মফল বর্তাবেও না। অনেকে বলেন, বংশধরদের মধ্যে পিতৃপুরুষদের পাপের ছায়া ফুটে ওঠে, সন্তানদের মধ্যে পিতৃপুরুষদের দোষ লেগে যায়— এই সমস্ত সবটাই ভুল ধারণা গো। আমি বলছি তোমায়— শোনো, আত্মা যদি আগের আগের জন্মে দোষে দুষ্ট থাকে তবেই সে একই ধরনের পিতৃপুরুষদের বংশে এসে আগের কাজের ফল ভোগ করতে জন্মগ্রহণ করে। শুদ্ধাত্মা যদি হতো তাহলে এই বংশে সে আসতই তো না। সমধর্মীদের একটা আকর্ষণ থাকে, এজন্যই তারা এক জায়গায় জড়ো হয়, প্রাপ্য দুঃখের ভাগীদার হয়। যখন আমরা দুঃখ-কষ্টে জড়িয়ে যাচ্ছি, বুঝতে হবে অতীতে, আগের আগের জন্মে আমরাও কাউকে একই ধরনের দুঃখ- কষ্ট দিয়েছি। প্রত্যেক মানুষের বর্তমান দুর্ভোগ তারই অতীত দুষ্কর্মের ফল। কর্মবাদের নিয়ম ধরে মানুষের বংশগতি নির্ধারিত থাকে। প্রত্যেক আত্মা তার যোগ্যতা অনুসারে বংশগতি লাভ করে। মানুষের বর্তমান স্বভাব, কাজকর্মের ওপর এই যোগ্যতা নির্ভর করে। কর্মফল মারাত্মক। গীতাতে এর জন্যে ওখানেই জোড় দিয়েছেন মহাত্মা বেদব্যাস।’
উপনিষদের ঋষিরা বারে বার বলছেন, ‘আত্মানং বিদ্ধি— নিজেকে জানো। আত্মসত্তাতে জোড় দেও খালি।’ যতই আমরা ভাবি না কেন— আগে আমাদের কোনও অস্তিত্ব ছিল না, আমরা পৃথিবীতে নতুন এসেছি, আর আসবই না— এই ধরনের অনস্তিত্বের চিন্তা করতে পারব না। অব্যক্ত চৈতন্য আর তার বর্হিপ্রকাশ আমদের এক করে জড়িয়ে রেখেছে। এর বাইরে মানুষের বেরনোর ক্ষমতা নেই। এর থেকে মুক্তির একমাত্র পথ যোগাভ্যাস। ইন্দ্রিয়গত দর্শন নিয়ে এ অবশ্য বোঝা যাবে না। নচিকেতা বোঝার জন্যই যমরাজের কাছে গেলে তিনি বললেন, ‘দেখ দেখি, বাক্য, মন ও চক্ষু দিয়ে এ সমস্ত তুমি কেমন করে বুঝবে! সর্বোচ্চ উপলব্ধির জন্য মানুষের এই শরীরটা অতি সামান্য একটা মাধ্যম। সূক্ষ্মতর ইন্দ্রিয় দিয়েও রূপ-রস-গন্ধ-শব্দ-স্পর্শ এই পঞ্চগুণের বাইরের কিছু উপলব্ধি করা চলে না। রক্তমাংসের যা দেখ তা ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নিয়ে দেখ। স্থূল পৃথিবীকে ইন্দ্রিয় দিয়েই ভোগ কর। এর বাইরের কিছু জানতে গেলে যে সাধনা চাই।’
বিশ্বের যে সমস্ত খ্যাতিমান লেখকেরা supermundane world— এর কথা লিখে গেছেন, তাঁদের মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় অন্যতম। উপনিষদের মধ্যে যে ব্রহ্মচক্রের কথাবার্তা রয়েছে, গীতার ভেতর যে আত্মার অস্তিত্বের বার্তা ধরা আছে, সেগুলোকে কাহিনি বৃত্তের মধ্যে সাজিয়ে বিভূতিভূষণ রচনা করেছেন তাঁর বিস্ময়কর অমর সৃষ্টি দেবযান, সেখানে তিনি লিখছেন, ‘প্রেতলোকের অস্তিত্ব সম্পর্কে সন্দেহ করবার কিছু নেই পৃথিবীর ঊর্ধ্বে বহু স্তর বর্তমান। বিশ্বে বহু লোক, বহু স্তর, বহু গ্রহ, মৃত্যুর পর সেখানে জীবের গতি হয়। জীবনের পরে যখন এইসব লোকে গতি হয়, তখন পৃথিবীর আনন্দ এদের কাছে তুচ্ছ বলে মনে হয় বটে, কিন্তু সেই আসক্তি বা কামনাই পুনর্জন্মের বীজ বপন করে।’
দেহান্তরবাদ যে শুধুমাত্র ভারতবর্ষে চর্চিত তাও তো নয়, সুপ্রাচীনকাল থেকে সকল দেশের সকল জাতির সত্যদ্রষ্টা ও দার্শনিকরা জন্ম-মৃত্যুর রহস্য নিয়ে ভেবেছেন। সমস্ত বিজ্ঞানী একযোগে বলেছেন যে, কোনও বস্তুর কারণ তার মধ্যেই নিহিত থাকে, বাইরে কিছুই থাকে না। গাছের কারণ গাছের মধ্যেই আছে। যতই উন্নতি আসুক না কেন বটগাছের বীজ থেকে অন্য গাছ হতে পারে না। আধুনিক বিজ্ঞান বলছে, প্রাণপঙ্কের কথা। এর মানেটা হল জীবনকণিকা। একটি জীবনকণিকা বিবর্তিত হয়েই মানুষের রূপ নিচ্ছে। জীবনকণিকার মধ্যেই রয়েছে অতিসূক্ষ্ম শক্তিকেন্দ্র। এর কিন্তু কোনও রূপ নেই। প্রাণপঙ্ক মানুষ, পশু যে কোনও রূপই নিতে পারে। জীবনকণিকাগুলোর জীবনশক্তি নিয়ে কেউই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন না। স্থূল জগৎকে নিয়ন্ত্রিত করছে এই প্রাণপঙ্ক। ভারতীয় অধ্যাত্মবাদে এরই নাম দেওয়া হয়েছে সূক্ষ্মশরীর। কার্য-কারণ ক্রিয়া নিয়ে তা আবির্ভূত হয়।
শ্রদ্ধার সঙ্গে দান
ছান্দোগ্য উপনিষদের ঋষি বলছেন যে, শরীরটার মৃত্যু ঘটছে মানে, ওর থেকে সূক্ষ্ম ও কারণ দশাগুলো সব সরে যাচ্ছে। স্থূলদেহে স্থিত যাবতীয় চেতনা যখন অবলুপ্ত হয় তখনই দেহটা জড় হয়ে পড়ে। জীবের মৃত্যু ঘটে ঠিকই কিন্তু জীবাত্মার মৃত্যু হয় না— ‘জীবাপেতং বাব কিলেদং ম্রিয়তে ন জীবো ম্রিয়তে।’
আমাদের স্থূলশরীরের মধ্যেই যে সূক্ষ্ম অনুভূতির শক্তিরাজি আছে এটা ধরা পড়বে একমাত্র ধ্যানে। এর একটি অত্যন্ত সহজ পদ্ধতি রয়েছে। একটি আসনে স্থির হয়ে কিছু সময় বসতে হবে। দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যখন একটু ঠান্ডা ও শিথিল হয়ে আসবে মেরুদণ্ড সোজা করে আসনস্থ অবস্থায় তখনই দেখা যাবে শরীরের মধ্যে মৃদু মৃদু ভাবে শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ উঠছে। ওই আওয়াজকে, ওঠাপড়াকে খেয়াল করতে থাকলেই কিছু সময় পর দেখা যাবে যে শরীরের বাহ্য অবস্থাটা সরে যাচ্ছে। এই অভ্যাস করতে করতেই সূক্ষ্ম অস্তিত্বের যাবতীয় অনুভূতিগুলো আপনা থেকে প্রকট হবে। এরপর আরও এগতে চাইলে গুরু বা আচার্যের সহায়তা দরকার। স্থিরতা, শান্তি ও নীরব সামর্থ্য গ্রহণ করবার নানান প্রক্রিয়া আছে, এগুলো শিখলেই স্থূলশরীরের মধ্যে যে সূক্ষ্মশরীর আছে, আর ওটি ধ্যান চেতনায় যে একেবারে কারণ বা তুরীয় স্তরে চলে যায়, এগুলো ধরা পড়বে। এর জন্য অবশ্য দীর্ঘদিনের একটা আধ্যাত্মিক জীবন চাই। আত্মা বা শান্ত ব্রহ্মের উপলব্ধি ও তাতে বাস করাটাই যোগপন্থার লক্ষ্য। যোগীদের প্রয়াণ ঘটলে বলা হয় যে তিনি দেহ রেখেছেন। দেহ রাখার অর্থ, স্থূল চেতনালোক থেকে বেরিয়ে পড়া। শুদ্ধ আত্মার সূক্ষ্ম ও কারণ চেতনা থেকে যায় বলেই যোগপন্থার মধ্যে মহাত্মাদের বায়বীয় সত্তার অনুভূতি পেয়ে থাকেন উচ্চস্তরের যোগীরা। মৃত্যুর পর সাধারণত আত্মীয়দের মৃতের গুণকীর্তন করা উচিত। গরুড়পুরাণ এই পদ্ধতিকে বলছে, যমগাথা। মৃত ব্যক্তির পূর্বের সঞ্চিত শুভাশুভ কর্মের ধ্যান করবারই নিয়ম এই সময়টাতে প্রিয়জনদের। তা না করে সকলেই এই সময়টাতেই হিসাব ও ভাগাভাগিতে বসে যান। মৃত ব্যক্তির রেখে যাওয়া সম্পত্তির বাটোয়ারা নিয়ে ভাগিদারদের মধ্যে বচসা বাধে। মানুষ মৃত্যুর পর অন্য শরীর ধারণ না করেই পূর্ণ অস্তিত্ব নিয়ে তখনও বর্তমান থাকেন। গরুড়পুরাণ বলছে, মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তির সূক্ষ্মশরীর বাড়ির মধ্যেই বাতাস হয়ে ঘোরে। একে বলা হয়, বায়ুকুটী। তেরো দিন পর্যন্ত এই ঘোরাফেরা চলে। এ সময়টায় বাড়িতে রোজ গরুড়পুরাণ পাঠ করবার রীতি রয়েছে। মৃত্যুর পর আত্মা যখন শরীরটা ছেড়ে চলে যায় তখন সে অল্পক্ষণ নিরালম্ব থাকে। এই সময় সে বায়ুভূত হয় আর নিরাশ্রয় হয়ে পড়ে। যখন মৃত্যুসময় উপস্থিত হয় মানুষের, কথা বলবার শক্তিটাই আগে চলে যায়। অন্যান্য ইন্দ্রিয় সমস্ত মনের মধ্যে গিয়ে ঢোকে। মন প্রাণে লয় হয়ে পড়ে আর প্রাণ জীবাত্মার সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে নেয়। বাগিন্দ্রিয় বা কথা বলবার শক্তিটা না থাকলে কী হবে, মনের কাজকর্ম করবার ইচ্ছাটা যে মরে না। কথা বলবার ইচ্ছে ষোলোআনা আছে অথচ শক্তিটা নেই বাগিন্দ্রিয়ের। মনের ভেতর ইন্দ্রিয়গুলো গুটিয়ে চলে যায় বলেই মনটা তখন দেখতে চায়, শুনতে চায়। কিন্তু এসবের কিছুই সে করতে পারে না। নিশ্চেষ্ট অবস্থায় মনটাই প্রাণে লয় পায়। অর্থাৎ মনের কাজগুলো প্রাণে এসে হাজির হয়। মনের কোনও স্বতন্ত্র শক্তি তখন আর থাকে না। যা থাকে তা ওই সূক্ষ্মশরীরের চৈতন্যশক্তি। সে শুধু ধরতে পারে যে সে মরল, তার শরীরের খেলাটা শেষ হল। তখন সে তার জীবনে অনুষ্ঠিত কুকর্মের জন্য অনুতপ্ত হতে থাকে আর ভালো কাজগুলো সে যে শরীর থাকতে করছে তারও জন্য প্রফুল্ল হয়ে ওঠে। গরুড়পুরাণ বলছে, এই হল গিয়ে স্বর্গ ও নরক ভোগের সূচনা। তখন প্রাণ আত্মার সঙ্গে এক হয়ে প্রেতলোকে চলে যায়। পরলোকগত আত্মার তৃপ্তি কামনার জন্য এই কারণে শ্রাদ্ধ করা হয়। শ্রদ্ধার সঙ্গে দান করাকেই শ্রাদ্ধ বলে— ‘শ্রদ্ধয়া অন্নদের্দ্দানং শ্রাদ্ধং।’ এই কারণেই লোক খাওয়ানোর প্রথা। শ্রাদ্ধে পূতাত্মা, শুদ্ধস্বভাব ও সাত্ত্বিক প্রকৃতির মানুষ যাঁরা, তাঁদেরই ভোজন করানোর কথাটা গরুড়পুরাণ বলছে। তবেই প্রেতাত্মার তৃপ্তি সাধন হয়।
সত্য যুগের ঋষি নিমি ছিলেন অতি সাত্ত্বিক প্রকৃতির তপস্বী। তাঁর ছেলে আত্রেয়ও একজন উচ্চকোটির মহাপুরুষ। আত্রেয় ঋষির কঠোর তপশ্চরণ করার ফলে শরীর চলে যায়। ঋষি নিমি ছেলের শোকে অত্যন্ত কাতর হয়ে পড়েন। ছেলের পারলৌকিক মঙ্গল কামনার জন্য কী এখন করা চলে, এই নিয়ে তাঁর অহোরাত্র অতিবাহিত হতে থাকল। তিন দিন দিবারাত্র চিন্তার পর তাঁর মনে এক সংকল্পের উদয় হল। তিনি মৃত ছেলের প্রীতি কামনায় তেরো দিনের মাথায়, দ্বাদশী তিথিতে শ্রদ্ধার সঙ্গে দান ধ্যান করবেন বলে মনস্থ করলেন। আত্রেয় যা যা খেতে ভালোবাসত সমস্ত খাদ্যবস্তুর আয়োজন করে নিমি ঋষি তাঁর পরিচিত ঋষিবৃত্তের সব্বাইকে নিমন্ত্রণ করলেন। সাতজন ঋষিকে দিয়ে ছেলের নাম ও গোত্র উচ্চারণ করিয়ে পিণ্ডদান পর্যন্ত করালেন। এত করেও নিমি ঋষির মন প্রবোধ মানল না। ওই কাজের মাধ্যমে তাঁর ছেলের তৃপ্তিসাধন কিছু হল কি না, এটা জানবার জন্য ঋষি নিমি ব্যাকুল হয়ে পড়লেন। তিনি একান্তমনে এই সমস্তই চিন্তা করতে থাকলেন। তাঁর ধ্যান নিবিষ্টতার মধ্যেই দেবর্ষি নারদ এসে উপস্থিত হলেন। তাঁকে তিনি সমাদর করে আপ্যায়ন করবার পর বললেন, ‘দেবর্ষি, আমি যে ছেলের আত্মার উদ্দেশে অর্ঘ্য নিবেদন করলাম, শ্রদ্ধাপূর্বক সাধ্যমতো দান ধ্যানের মাধ্যমে কিছু অন্নদাদি সেবার ব্যবস্থা করলাম, এই কাজ ঠিক হল কি না?’ দেবর্ষি নারদ বললেন, ‘তোমার কাজ ঠিক হয়েছে। তুমি এক কাজ কর— ধ্যানশক্তিতে পিতৃদেবকে একবার আকর্ষণ করতে থাক।’ ধ্যানযোগে ঋষি নিমি পিতৃদেবের চিন্তা করতে থাকলেন। তাঁর স্বর্গীয় পিতা সূক্ষ্মশরীরে এসে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘পুত্র, একান্তমনে সমাহিতচিত্তে ঐকান্তিক ইচ্ছা ও শ্রদ্ধা সহকারে পরলোকগত আত্মার প্রীতিকামনায় ওই রকম দান করলে মৃত ব্যক্তির তৃপ্তি ও কল্যাণ সাধিত হয়। একেই পিতৃযজ্ঞ বলে, পুত্র। শ্রদ্ধা সহকারে এ কাজটি করা হয় বলেই এর আরেক নাম হল শ্রাদ্ধ। ব্রহ্মা একে বিশিষ্ট ধর্মকাজ বলে নির্দিষ্ট করে রেখেছেন।’ সত্যযুগে ঋষি নিমির মাধ্যমেই শ্রাদ্ধবিধি প্রবর্তিত হল।
আত্মার ছোঁয়া
ভারতের ঋষিরা জরা-মৃত্যুর বাইরে বেরনোর সাধনা করে গিয়েছেন। উপনিষদের মধ্যে যে সমস্ত কথিকা তাঁরা ব্যাপ্ত করেছেন সেগুলোর সমস্তটাই আসলে শিষ্যদে?
29d ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

বাক্য ও ব্যবহারের রুক্ষতায় শত্রু বৃদ্ধির যোগ। হাতের গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি তাড়াতাড়ি করে  ফেলতে চেষ্টা করুন।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৫.৯৮ টাকা৮৭.৭২ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৭ টাকা১১০.২১ টাকা
ইউরো৮৮.৭৮ টাকা৯২.১৫ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা