প্রচ্ছদ নিবন্ধ

তিনে   চন্দ্র
রাহুল দত্ত 

তিন দশকের অক্লান্ত পরিশ্রম। তিন-তিনটি চন্দ্রযান। অবশেষে এল সাফল্য। ১৪০ কোটি মানুষের স্বপ্নপূরণের সেই নেপথ্য কাহিনি।
 
১৯৫৯ সাল। মহাকাশ দখলের লড়াই শুরু। প্রতিযোগিতায় নেমে মাত্র তিন বছরের মধ্যে, ১৯৬১ সালে মহাশূন্যে নভশ্চর পাঠিয়ে গোটা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাদের দেখে, কিছুটা প্রতিযোগিতার বশেই ১৯৬৯-৭২ পরপর ১২ জন নভোশ্চরকে চাঁদের মাটিতে নামিয়ে সকলের চোখ টেনে নেয় আমেরিকা৷ দু’পক্ষের রেষারেষিতে তখন টগবগ করে ফুঁটছে চাঁদের মাটি থেকে পৃথিবীতে শত্রু পক্ষের মন৷ ভারত তখন কোথায়? ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র তখনও হামাগুড়ি দিচ্ছে বলা চলে। চারিদিকে খাদ্য আন্দোলনের রেশ তখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি৷ তার মাঝেই অর্থের খোঁজে ইসরোর প্রথম অধিকর্তা হিসেবে, সবদিকে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন বিক্রম সারাভাই৷ অবশ্য ১৯৭২ সালে তাঁর আকস্মিক প্রয়াণে শোকের ছায়া নেমে আসে৷ তবে ১৯৬৯ সালে ইসরো তৈরি হওয়া থেকে তাঁর প্রয়াণের মাঝের ক’দিনে ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীদের তিনি এক সুতোয়া বেঁধে দিয়ে গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিল বিজ্ঞানের অজস্র স্বপ্ন। তাঁর দেখানো যাত্রাপথে দ্রুতই শৈশব কাটিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখতে শুরু করে দেয় ইসরো। তাই ৭০’র দশকের মাঝামঝি ছোট বাচ্চাটি প্রথম নিজে থেকে পা ফেলা শুরু করে৷ যাত্রাপথ বিশেষ মসৃণ ছিল না৷ এতো বড় স্বপ্নকে সফল করতে হলে নিজের পায়ে শক্তিশালী হয়ে দাঁড়াতে হবে, এটা ভালো করেই জানতেন সারাভাই। তাই উনি কিছু লক্ষমাত্রা দিয়ে যান। তা পাথেয় করেই শেষ পর্যন্ত ১৯৯৭ সালের সেপ্টম্বরে প্রথম সম্পূর্ণ নিজস্ব প্রযুক্তিতে পিএসএলভি রকেট বানিয়ে ফেলেন ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীরা। স্বপ্ন তো দেখলে হয় না, তা পূরণ করতে হয়। কিভাবে পূরণ হবে৷ কারণ ততদিনে আমেরিকা মঙ্গলে পৌঁছে গিয়েছে। তাই নিজেদের সামর্থ্য মতো কাজ করা শুরু করে দেন সকল বিজ্ঞানীরা৷ চাঁদকেই বানানো হয় টার্গেট। তবে প্রথম পদক্ষেপে রকেটকে আরও শক্তিশালী বানানোর কাজে মন দেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরা। ৬ বছর অতিক্রান্ত করে ২০০৩ সালে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ঘোষণা করেন ভারত এবার চাঁদে যাবে। ৬ বছর আগে শুরু হওয়া স্বপ্ন ততদিনে একটা রূপ পেতে চলেছে৷ কিন্তু, চাঁদ তো দূরের কথা দিল্লিই তখনও অনেক দূর ছিল। বিজ্ঞানীরা অবশ্য ক্লান্ত হননি ততদিনে৷ বুঝতে শিখে গিয়েছেন, স্বপ্ন পূরণ হওয়ার যাত্রা এখনও অনেক দূর। তবে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিল, সেই দিন যেদিন প্রথম চাঁদকে একেবারে কাছ থেকে দেখতে যাবে ভারত। এই সময় ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীদের স্বপ্ন সফল করার দিশা দেখান যিনি, তিনি হলেন এ পি জে আব্দুল কালাম। ভারতের প্রাক্তণ রাষ্ট্রপতি, সাধারণ মানুষের অনেকেই তাঁকে শুধু এই পরিচয়ে চিনে থাকেন। কিন্তু, তিনি ছিলেন ভারতের বিজ্ঞান সাধনার অন্যতম বড় সাধক। তাঁর হাত ধরেই ৯০’র দশকে বিশ্বের বড় বড় দেশের চোখ রাঙানি এড়িয়ে ভারত প্রথম পরমাণু গবেষণার সফল কাজ করেন পোখরানে। যা গোটা বিশ্বের কাছে ভারতকে এক লহমায় অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেয়। তবে মহাকাশের দরজা তখনও খোলেনি ভারতের জন্য। এই সময় চাঁদে যাওয়ার শুধু পরিকল্পনাই করছিল ভারত। তখন ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে কালামের একটাই প্রশ্ন ছিল, দেশ যে চাঁদে যাচ্ছে তার প্রমাণ কোথায়? এই একটা প্রশ্নই ভারতের মহাকাশ গবেষণার নয়া দিগন্ত খোলে। তখন উত্তর ছিল না ভারতীয় মহাকাশ গবেষকদের কাছেও। তাঁরা বলেছিলেন, চাঁদের ছবি তুলবে ভারতীয় মহাকাশযান। এটা যথেষ্ট নয়। তখন কালাম ভারতের মহাকাশ বিজ্ঞানীদের বুঝিয়েছিলেন, স্বপ্ন যা সবাই দেখে সেটাকে শুধুমাত্র ছুঁয়ে দেখা কোনওভাবেই যথেষ্ট নয়৷ ১৯৯৭ সাল বা ২০০৩ সালে শুরু হওয়া ভারতের চাঁদে পদার্পণের স্বপ্নকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরতে হবে, তবেই সকলে তোমায় দেখবে। তখন কালামের পরামর্শেই ভারতের প্রথম চন্দ্রযানে ‘মুন ইমপ্যাক্ট প্রোব’ (এমআইপি) নামে একটা প্রকল্প নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, চাঁদের সুমেরু অঞ্চলে তো সব দেশই নেমেছে। চাঁদের কুমেরু অঞ্চলে কী আছে ? তা জানতে হবে। সেই থেকেই ভারতের নজর চাঁদের দক্ষিনাংশের এই অন্ধকারময় অঞ্চলের দিকে। তবে সেখানে যাওয়া এতো সহজ নয়। কারণ কেউই এই অংশ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানে না৷ তাহলে কী করা হবে! চন্দ্রযান-১’এ চাপানো হয় এমআইপি’কে৷ ইসরোর বিজ্ঞানীদের পরিকল্পনা ছিল চন্দ্রযান-১ যখন চাঁদের দক্ষিণাংশের উপর দিয়ে যাবে তখন এমআইপি’কে চাঁদের বুকে আছড়ে ফেলা হবে। চাঁদের মাটিতে যখন সেটি ধাক্কা খাবে সেই বিশেষ মুহূর্তের কিছু বৈজ্ঞানিক ছবি তুলবে কক্ষপথের যানে থাকা ক্যামেরা। সেই ছবিই পরবর্তীতে বিশ্ববাসীকে প্রথম জানাতে সফল হয়, চাঁদে একসময় জল ছিল। পরবর্তীতে তার আরও বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীদের দাবি চাঁদের এই কুমেরুতে এখনও বরফ আকারে জল রয়েছে। প্রসঙ্গত, এর আগে ৭০’র দশকে আমেরিকার অ্যাপেলো মিশন চাঁদের মাটির যে নমুনা এনেছিল তা একাধিকবার বিশ্লেষণ করেও জলের কোনও অস্বিস্তের প্রমাণ দিতে পারেননি বিজ্ঞানীরা। কিন্তু, চন্দ্রযান-১ আমেরিকার মতো উন্নত দেশকেও দাম্ভিকতা ভুল ফের চাঁদ নিয়ে ভাবতে বাধ্য করেছিল। ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক নতুন শতাব্দীতে নয়া প্রযুক্তির সহযোগিতায় একধিকবার অ্যাপেলোর আনা চাঁদের মাটির নমুনা বিশ্লেষণ করেন। তাঁরা বলেছিল, চাঁদের মাটিতে হাইড্রোজেন আছে। এমনকী ৯০’র দশকের শেষের দিকে নাসার মহাকাশযান লুনার প্রসপেক্টারের দেওয়া তথ্যও বলছে, চাঁদের দক্ষিণাংশে বরফ থাকতে পারে আশা ব্যক্ত করেছিল এই যান। কিন্তু, আমেরিকা ততদিনে মঙ্গলে পৌঁছে গিয়েছে। তাই নতুন করে চাঁদে ফিরে আসতে তারা ইচ্ছুক ছিল না। কিন্তু, চন্দ্রযান-১’র তথ্য আমেরিকার মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সব হিসেব উল্টে দিয়েছিল। এখানেই ১৯৯৭ সালে যে স্বপ্ন দেখা ভারত শুরু করেছিল, তা পূরণ হওয়ার আশা দেখা দিতে থাকে৷ তবে স্বপ্ন পূরণ এখনও হয়নি৷ তাই আরও যাত্রাপথ বাকি৷ 
এই অবস্থায় মহাকাশ দৌড়ে ঢুকে পড়ে বর্তমান বিশ্বের আরেক সুপার পাওয়ার চীনেও। কিছুটা পরে শুরু করেও, যারা এখন আমেরিকার সঙ্গে রীতিমতো একই সারিতে দৌঁড়াচ্ছে মহাকাশ গবেষণার বিষয়ে৷ তাই চন্দ্রযান-১’র নয়া তথ্য একের পর এক দেশকে চাঁদের প্রতি ফের আগ্রহী করে তুলেছে৷ তাই ভারতের দেখানো পথেই চাঁদের কুমেরু অংশের কাছাকাছি দু’বার অভিযান চালায় চীন৷ যদিও একেবার দক্ষিণাংশ এখনও অধরা৷
 মাঝে প্রায় ১০ বছর অতিক্রান্ত। বৈজ্ঞানিক স্বপ্ন কখনও একটা সীমারেখায় বেঁধে রাখা যায় না। তাই মাঝের ১০ বছরে চাঁদকে একটু দূরে সরিয়ে রেখে অ্যাস্ট্রোস্যাট বা মঙ্গলযানের মতো বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ঝু্কেছিল ইসরো। কিন্তু, ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা ভুলে যাননি নিজেদের আসল স্বপ্নের কথা৷ তাই ২০১৯’এ ফের চাঁদের দক্ষিণ অংশকে ছোঁয়ার লক্ষ্যে দৌড় শুরু হয় ভারতের৷ মাঝে ২০১৯ সালে আচমকা উদয় হয় ইজরায়েলের। সেবারে ব্যর্থতার মুখ দেখতে হয় দুই দেশকেই। তারপরে ফের ৪ বছরের প্রতীক্ষা। স্বপ্নের জন্য সব করা যায়, ২০১৯ সালে কান্নায় ভেজা চোখগুলো ফের জাগতে শুরু করে। চলে আসে ২০২৩ সাল। গতবারের মতো এবারও আচমকাই উদয় রাশিয়ার। বিজ্ঞানীদের কথায়, প্রথম মহাকাশে মানুষ পাঠানোকে টেক্কা দিতে চাঁদে মানুষ পাঠিয়েছিল আমেরিকা। তাই শুধুমাত্র ছুঁয়ে দেখা নয়, ইতিহাস গড়ার কৃতিত্ব নিতেই ১৯৯৭ সালে ভারতের দেখা স্বপ্নকেই একের পর এক টার্গেট করে চীন, ইজরায়েল, রাশিয়া। কিন্তু, শেষ হাসি হাসলেন ভারতীয় বিজ্ঞানীরাই। স্বপ্ন পূরণ হল ইসরোর। বিক্রম সারাভাই, কালামের দেখানো পথে এবার আরও আগে তাকাতে চান ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীরা৷
 ৯৭’তে যে স্বপ্ন দেখার সূচনা হয়েছিল, ২৩’এ এসে পূর্ণ হল তার বৃত্ত। তবে কি এখানেই শেষ। ইসরোর বিজ্ঞানীরা বলছেন, না। এখান থেকে নতুন স্বপ্নের জন্ম হবে। প্রথম স্বপ্ন ছিল বিশ্বের কোনও দেশ যা পারেনি, তা করে দেখানো। তা পূরণ হল ২০২৩ সালে। এবার নয়া স্বপ্নর যাত্রা শুরু। চাঁদের বুকে বানাতে হবে কলোনি। পৌঁছবে মানুষ। কারণ সেখান থেকেই তো সম্ভব এই মহাজাগতিক বিশ্বের পরবর্তী দরজা খুলে দেওয়া। ইসরোর বিজ্ঞানীদের কথায়, চন্দ্রযান-৩’র মূল কাজ চাঁদের কুমেরু অংশের পরিবেশের খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ। যাতে পরবর্তী ধাপে পৌঁছনো যায়। ইতিমধ্যে সেই কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। জাপানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ভারত চালাবে চন্দ্রযান-৪ অভিযান। এবারের পাওয়া তথ্যে ভিত্তি করে সেই অভিযানে পরবর্তী ধাপে পা রাখবে ভারত। একইভাবে চাঁদে কলোনি বানাতে হলে, মানুষের থাকার উপযুক্ত ঘর-বাড়ি বানাতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন ইঁট-বালি-সিমেন্ট। কিন্তু, চাঁদে এসব কিভাবে পাওয়া যাবে। ভারতীয় বিজ্ঞানীরা বলছেন, বিকল্পের অনুসন্ধান অনেক আগেই শুরু হয়ে গিয়েছে। খুব দ্রুত তা তৈরি হয়ে যাবে। তারপরেই শুরু হবে ভারতীয় মহাকাশ বিজ্ঞানীদের নয়া স্বপ্নের যাত্রা। তবে বাকিরাও প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। আমেরিকা, চীন, রাশিয়া, জাপান, ইজরায়েল, দক্ষিণ কোরিয়া সহ বহু দেশই এখন ভারতকে লক্ষ্য করে নয়া স্বপ্ন দেখা শুরু করেছে। সকলেরই ভরকেন্দ্র চাঁদ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, ২০৩০-৩৫ সালের মধ্যে চাঁদকে কেন্দ্র করে মহাকাশবিজ্ঞানের নয়া দিগন্ত খুলবে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে, ভারতের পরবর্তী স্বপ্ন কী ? বিজ্ঞানীদের কথায়, স্বপ্ন তো সবে পূরণ হল। এখন তাকে আরও সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার সময়। সেই সঙ্গে ভারতের পরের স্বপ্নের অপেক্ষায় থাকবে ১৪০ কোটির দেশবাসী। প্রযুক্তিতে অন্যান্য দেশ এগিয়ে থাকলেও, বৈজ্ঞানিক স্বপ্নে এখনও ভারতীরা যে বিশ্বের কাছে বারবার নজির সৃষ্টি করতে পারে তা প্রমাণিত হয়েছে। এখন অন্যদের মতোই ব্যবসায়িক-বানিজ্যিক ক্ষেত্রকে ভারতের মহাকাশ গবেষণার সঙ্গে যুক্ত করাই মূল টার্গেট ইসরোর। হয়তো সেখান থেকেই জন্ম হবে ভারতের নয়া স্বপ্নের। অপেক্ষা...
11Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

পারিবারিক অশান্তির অবসানে গৃহ সুখ ও শান্তি বাড়বে। প্রেমের ক্ষেত্রে শুভ। কর্মে উন্নতি। উপার্জন বৃদ্ধি।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.২৬ টাকা৮৪.৩৫ টাকা
পাউন্ড১০৬.৪৬ টাকা১০৯.১২ টাকা
ইউরো৮৯.৭৬ টাকা৯২.২০ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা