ছুরিকাহত হওয়ার পর সলমন রুশদি তাঁর সাম্প্রতিক বই ‘নাইফ’-এ লিখেছিলেন, ‘ভাষাও একটি ছুরি। তা দিয়ে জগৎকে উন্মোচন করা যায়, বার করে আনা যায় তার অর্থ, তার গভীরতম ক্রিয়া, তার সত্য, তার গোপন কথা। ভাষা আমার ছুরি... এটাই সেই ছুরি যা নিয়ে আমি পাল্টা লড়াই শুরু করলাম।’
রুশদির মতোই এই দুনিয়ার প্রতিটি সংবাদপত্র কিংবা সাংবাদিকের কাছে ‘ভাষা’ হল অস্ত্র। এই ভাষার স্বাধীনতাকে ঘিরেই রাজনীতিকদের হাতে সাংবাদিকদের ‘আক্রান্ত’ হওয়ার ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে উত্তরে প্রচ্ছন্ন বা প্রকাশ্য হুমকির ট্র্যাডিশন, নেতাকে নিয়ে অপ্রিয় খবর করার ‘অপরাধ’-এ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার ট্র্যাডিশন। ভারতীয় সাংবাদিকরা এ-হেন পরিস্থিতিতে এখন আর অনভ্যস্ত নন।
যথার্থ সংবাদপত্রের পথ সুগম নয়, কস্মিন্কালেও সুগম ছিল না। হিকি সাহেবের বেঙ্গল গেজেট-এর উপর ব্রিটিশের অত্যাচারের কথা আমরা জানি। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি মাথা নোয়াননি। শুধুমাত্র ভারত-দর্শনের জন্য সাগর পাড়ি দিয়ে কলকাতায় পৌঁছেছিলেন সেই আইরিশ ভদ্রলোক। ১৭৭২ সালে ডিসেম্বরে জাহাজ নোঙর করেছিল চাঁদপাল ঘাটে। উনিশ শতকের গোড়ায় ভগ্নমনোরথে সর্বস্ব হারিয়ে যখন ফের বিলেতের উদ্দেশে পাড়ি দিলেন, তত দিনে কেটে গিয়েছে প্রায় ত্রিশ বছর। জেমস অগাস্টাস হিকি— ‘দ্য ফাদার অব ইন্ডিয়ান প্রেস’।
মৌলিক প্রশ্ন তুলেছিলেন হিকি সাহেব। ব্রিটিশ রাজত্বে সব নাগরিক কেন সমান বিচার পাবে না? চিঠি জাল করেছিলেন দু’জনেই, রবার্ট ক্লাইভ আর মহারাজা নন্দকুমার। একজনের কিছুই হল না, আর একজন ঝুললেন ফাঁসিতে। আইনের শাসন এই? প্রশ্ন তুলেছিল ‘বেঙ্গল গেজেট’। গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস সিদ্ধান্ত নিলেন ঠিক তা-ই, যা আজকের শাসকরা করেন। প্রথমে তাঁর বশংবদ দুই সাহেবের কাগজ ‘ইন্ডিয়া গেজেট’-এর পোস্টেজ দিলেন ফ্রি করে। তারপর পোস্ট অফিস থেকে হিকির কাগজ বিলি বন্ধ করার নির্দেশ। ডাকঘরে বেঙ্গল গেজেট নিষিদ্ধ হওয়ার পর দু্র্নীতি নিয়ে বাইশটা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিয়ে একুশটা, আর কোম্পানির স্বৈরতন্ত্র নিয়ে চুয়াল্লিশটা নিবন্ধ বার করেন হিকি। আক্রমণের প্রধান লক্ষ্য হেস্টিংস। বিদ্রুপ, শ্লেষ, কৌতুক, এই ছিল হিকির অস্ত্র।
এর জন্য জেলবন্দি হতে হয়েছিল হিকি সাহেবকে। মানহানির মোকদ্দমা করেছিলেন খোদ গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। সেই সঙ্গে প্রভাবশালী মিশনারি জোহান কিয়েরনান্ডর, রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় কোটিপতি। তাঁর দুর্নীতি নিয়েও খবর ছেপেছিলেন হিকি। বিচারের দায়িত্বে হেস্টিংসের পেটোয়া ইম্পি। দোষী সাব্যস্ত হলেন হিকি। হেস্টিংসকে ‘ক্ষতিপূরণ’ দিতে ছাপাখানা নিলাম হয় ১০ এপ্রিল, ১৭৮৩। বন্ধ হয়ে গেল হিকিজ বেঙ্গল গেজেট। যে মানুষটি মাত্র কয়েকশো পাউন্ড সঙ্গে নিয়ে কলকাতায় এসে নিজের যোগ্যতায় আলাদা পরিচয় গড়ে তুলেছিলেন, ফিরতি জাহাজে খরচ চালানোর জন্যে সার্জনমেট হতে হয়েছিল সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধকে। পরিবারের সবাই আগে দেশে ফিরে গেলেও তিনি পারেননি। সমুদ্রপথেই তাঁর মৃত্যু হয়। হিকি সাহেব বুঝেছিলেন, এ দেশ বড় নিষ্ঠুর!
পরাধীন ভারতে এমন বহু সংবাদপত্র ইংরেজ শাসকের রোষে পড়েছে। প্রতিবাদের কণ্ঠরোধ করার জন্য তাঁরা এক গুচ্ছ দানবীয় আইন প্রণয়ন করেছিলেন। যুগান্তর, সাধনা, সন্ধ্যা, বলশেভিক, সংগ্রাম, শনিবারের চিঠি, ধূমকেতু— অজস্র পত্রপত্রিকা বাজেয়াপ্ত করা হয়, নয়তো লেখক, সম্পাদক বা প্রকাশকদের জেল-জরিমানা হয়। রাজতন্ত্রের কালে রাজা ছিলেন ঈশ্বরের প্রতিভূ। তাঁর পারিষদেরা প্রজাদের মনে শাসকের সম্পর্কে এই ধারণা গেঁথে দিতে চেষ্টার কসুর করত না। শাসক যতই অত্যাচারী, নৃশংস ও ক্ষমতান্ধ হন, তাঁকে মহান ও তাঁর আচরণকে ন্যায়সঙ্গত হিসেবে দেখাতে লেখানো হতো ফরমায়েশি জীবনচরিত। যে কোনও শাসনব্যবস্থায় শাসক ও ক্ষমতাতন্ত্রকে যারাই প্রশ্ন করেছে, তাদের পরিণতি হয়েছে দুর্বিষহ।
১৯১৭ সালে ‘কর্তার ইচ্ছায় কর্ম’ প্রবন্ধে ব্রিটিশ শাসনকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা আজ বড় প্রাসঙ্গিক: ‘আমাদের রাজপুরুষদের মধ্যেও দেখি, রাজ্য শাসনের কোনও একটা ছিদ্র দিয়া ভয় ঢুকিলেই তারা পাশ্চাত্ত্য স্বধর্মকেই ভুলিয়া যায়, যে ধ্রুব আইন তাঁদের শক্তির ধ্রুব নির্ভর তারই উপর চোখ বুজিয়া কুড়াল চালাইতে থাকে। তখন ন্যায় রক্ষার উপর ভরসা চলিয়া যায়, প্রেস্টিজ রক্ষাকে তার চেয়ে বড় মনে করে, এবং বিধাতার উপর টেক্কা দিয়া ভাবে প্রজার চোখের জলটাকে গায়ের জোরে আন্দামানে পাঠাইতে পারিলেই তাদের পক্ষে লঙ্কার ধোঁয়াটাকে মনোরম করা যায়।’ এখন পাশ্চাত্য স্বধর্ম নয়, ভারতীয় সংবিধান যেন ভুলে যাচ্ছে শাসকদল। আইনের শাসন নয়, রাষ্ট্রযন্ত্র নিজের স্বার্থে আইনের অপব্যবহার করছে, তা নিয়েই প্রশ্ন জাগছে সাধারণ মানুষের।
‘দলদাস না হলেই রাষ্ট্রদ্রোহী’— এই অসামাজিক রোগের শুরু ‘রাষ্ট্র’-এর উদ্ভব থেকে। সমাজবিজ্ঞানের মতে, পৃথিবীর রাজা, সামন্ত, গোষ্ঠী ইত্যাদি শক্তি ‘রাষ্ট্র’কাঠামোয় ক্রমে নিজেদের অভিযোজিত করে নিয়েছে। ‘রাষ্ট্র’-শক্তি ব্যক্তি নাগরিককে নানাবিধ সুরক্ষা, সুবিধা, শান্তি দিয়েছে। আবার ‘রাষ্ট্র’কাঠামোর সুযোগ নিয়ে শাসক রাজনৈতিক দলের প্রভু হয়ে গিয়েছে। তখন রাষ্ট্রের নিয়ন্তা প্রভুকে হয় ভক্তি বা ভয় করতে হয়। জরুরি অবস্থাকালীন ইন্দিরা গান্ধী সরকারের হাতে সংবাদ-স্বাধীনতার কণ্ঠরোধ যেমন ভারতীয় গণতন্ত্রের মুখে কালিমা লেপন করেছিল, তেমনই আজকের ভারতেও সংবাদমাধ্যম স্বাধীন, সেই দাবি করার উপায় নেই। বিজেপি জমানায় সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে ভারতের স্থান ক্রমে নিম্নমুখী, আন্তর্জাতিক স্তরেও তা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে, অথচ রাজনীতিকদের তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। মনে করিয়ে দেওয়া দরকার, আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স’-এর তরফে প্রকাশিত ২০২৩ সালের রিপোর্ট ও সূচক অনুযায়ী, ১৮০টি দেশের মধ্যে ১৬১তম স্থানে রয়েছে ভারত। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে যা সর্বনিম্ন। ২০২২ সালে এই তালিকায় ১৫০তম স্থানে ছিল ভারত। ২০২১ সালের সূচকে স্থান হয়েছিল ১৪২তম স্থানে।
সাংবাদিককুলের প্রতি গেরুয়া শিবিরের অপ্রীতি কোনও নতুন কথা নয়, বিশেষত যাঁরা ‘কানু বিনা গীত নাই’ গাইতে অভ্যস্ত নয় তাঁদের প্রতি। এ দেশের সাংবাদিকরা জেনে গিয়েছে, সরকারের সমালোচনা করলেই ধেয়ে আসবে দেশদ্রোহী, ভারতবিদ্বেষী তকমা, তারই পথ ধরে আসবে সাংবাদিক-হেনস্তা, নিপীড়ন, দমন— হুমকি দিয়ে, প্রাণের ভয় দেখিয়ে, কাজে বাধা দিয়ে বা উত্ত্যক্ত করে, সর্বোপরি জাতীয় নিরাপত্তা আইন ও কুখ্যাত ইউএপিএ আইনে জেলে ভরে।
আজ সাংবাদিক এবং সংবাদপত্রকে হেনস্তা শাসকের ভাবমূর্তিকে বড়সড় প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। এ কথা ঠিক, আইনের ঊর্ধ্বে কোনও দেশবাসী নয়। গণতন্ত্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদমাধ্যমের কর্মীদেরও আইন মেনেই কাজ করতে হয়। কারও বিরুদ্ধে কোনও আইন লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগ থাকলে তা অবশ্যই আইন অনুযায়ী তদন্তসাপেক্ষ। যাঁরা সাংবাদিকতা করেন, শুধুমাত্র সংবিধানের ১৯(ক) ধারার উপর ভরসা রেখেই পেশাদারিত্বের তাগিদে ঝুঁকি নিয়ে তুলে ধরেন মানুষের কথা। পেশাগত ও ব্যক্তিগত আক্রমণের মুখে সংবাদ ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাই প্রথম ও শেষ রক্ষাকবচ। সত্যের সন্ধানই সংবাদপত্রের স্বধর্ম, সত্যের প্রকাশই তার ব্রত। সেই সন্ধান কখনও সমাপ্ত হতে পারে না, ‘সম্পূর্ণ সত্য’ অনিবার্যভাবে অধরা থেকে যায়। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, নির্ভীক ও তথ্যসমৃদ্ধ সংবাদ পরিবেশন ছাড়া নাগরিকদের পক্ষে কীভাবে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত সম্ভব? কী আশ্চর্য, রাষ্ট্রশক্তি গণতন্ত্রের এই স্তম্ভকেই ক্রমশ কোণঠাসা করে ফেলছে।
তবে কি সাংবাদিকরা নির্ভয়ে আর জনগণের কথা লিখবেন না? শাসকের মুখের সামনে তুলে ধরবেন না আয়না? আলাদা কোনও রক্ষাকবচ নেই বলে কি শাসকের রক্তচক্ষুর সামনে মাথা নত করে থাকতে হবে? ২০২৩-এর ৫ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, সরকারের সমালোচনা করা দেশবিরোধিতা নয়। জাতীয় নিরাপত্তার পরিপন্থী, এই অভিযোগ তুলে মালয়ালম ভাষার একটি টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছিল কেন্দ্রের তথ্য এবং সম্প্রচার মন্ত্রক। এই নির্দেশ বহাল রেখেছিল কেরল হাইকোর্টও। ওই মামলার রায় দিতে গিয়ে শীর্ষ আদালতের তরফে বলা হয়েছিল, ‘সরকারের নীতির সমালোচনা করলেই কাউকে প্রতিষ্ঠান বিরোধী কিংবা সরকার বিরোধী বলা যায় না।’ শক্তিশালী গণতন্ত্রের জন্য যে স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের প্রয়োজন, তা-ও স্পষ্ট করে দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের তরফে। মামলার শুনানিতে দেশের প্রধান বিচারপতি ডিওয়াই চন্দ্রচূড় বলেছিলেন, ‘জনগণের অধিকারকে অস্বীকার করে জাতীয় নিরাপত্তার প্রসঙ্গ তোলা ঠিক নয়।’
হিকি সাহেব লিখেছিলেন, ‘যদি সংবিধান খারিজ হয়, মানুষ দাসত্বে পতিত হয়, একজন সাহসী মানুষ আর একটা স্বাধীন সংবাদপত্র একমাত্র তাদের উদ্ধার করতে পারে। কিন্তু সংবাদের স্বাধীনতা না থাকলে মস্ত বীরপুরুষও স্বাধিকার, স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারবে না।’ দুশো তেইশ বছর আগে বেঙ্গল গেজেট-এ ছাপা হয়েছিল কথাগুলি। এই কলকাতাতেই।
যত বাধাই আসুক, সংবাদপত্র আর তার সাংবাদিকরা জানেন, আজ, কাল, পরশু, মাস, বছর, শতাব্দী অতিক্রম করে তার বিরামহীন, অন্তহীন, ক্লান্তিহীন সত্যান্বেষণ জারি থাকবে। মহাকাল যে তার ললাটে লিখে দিয়েছেন সেই অমোঘ মন্ত্র: চরৈবেতি।