পূজনীয় স্বামী অখণ্ডানন্দ মহারাজের সারগাছি অঞ্চলে ‘দণ্ডীবাবা’ বা ‘দণ্ডীঠাকুর’ নামকে কেন্দ্র করে ১৩০৫ বঙ্গাব্দের (১৮৯৮ খ্রি.) অগ্রহায়ণ-পৌষ মাসে একটি বড় মজার ঘটনা ঘটেছিল। মহারাজ তখন পুরানো আশ্রমে থাকেন। আশ্রমের নিত্য ব্যবহারের জন্য কয়লা দরকার। একসঙ্গে সৈয়দাবাদ অঞ্চল থেকে শ-তিনেক মন কয়লা আনতে হবে। অনেক গোরুর গাড়ির দরকার, এতগুলি গোরুর গাড়ি পাড়াগাঁইয়ে একসঙ্গে পাওয়া বেশ কঠিন। মহারাজ তখন বর্তমান আশ্রমভূমির জমিদার হাজি শেখ আব্দুল আজিজের পিতা ভূতপূর্ব জমিদার হাজি শেখ আলির সাহায্য চাইলেন। তিনি খান-পঁচিশ গাড়ি জোগাড় করে দিলেন বটে, কিন্তু গাড়োয়ানরা শহরে যেতে একেবারে নারাজ। শেষে রফা হলো, দণ্ডীবাবাকে তাদের সঙ্গে যেতে হবে আর শেষরাতে রওনা হয়ে সকালেই সৈয়দাবাদ পৌঁছাতে হবে। সেইমতো গাড়োয়ানরা বলল, “আমরা কিন্তু রাত ২টার সময় এসে ডাকব।” রাত ২.০০-২.৩০মি. নাগাদ গাড়োয়ানরা গাড়ি যুতে এসে ডাকাডাকি করছে, “দণ্ডীবাবা”, “দণ্ডিঠাকুর”। মহারাজ তখন জেগেই ছিলেন।
সেসময় প্রায়ই মহারাজ সারা রাত জেগে থাকতেন। রাত্রিতেই পড়াশুনা, লেখালেখি প্রভৃতি কাজ চলত। দিনেরবেলাতেই আশ্রমের কাজকর্ম, অনাথ বালকদের দেখাশুনা, অন্যান্য বিষয় সামলানো—এসবেই দিন কেটে যেত। স্থির হয়ে বসে লেখাপড়া করার সময় কোথায়? কাজেই রাত্রিতে ছেলেরা ঘুমালে, দিনের ও সন্ধ্যার সব কাজকর্মের জের সারা হয়ে গেলে, তবে মহারাজের ফুরসত মিলত। মহারাজ লিখছেনঃ
লিখতে লিখতে, পড়তে পড়তে কত দিন সকাল হয়ে গেছে। এইরকম কত রাত্রি উপরি উপরি জেগে কেটে গেছে। লেখবার সময় অন্তর থেকে কেবলই ভাব ও ভাষা জুগিয়ে আসত, অথচ এদিকে ফরসা হয়ে গেছে, বাতি ঢিমে হয়ে গেছে, ছেলেদের তুলতে হবে, এক-একবার ঘুমন্ত ছেলেদের দিকে চাইতাম, মন ব্যস্ত হয়ে উঠত—কাজে সব দেরি হয়ে যাবে। অথচ ভাব সব এসে পড়ছে, সঙ্গে সঙ্গে না লিখে ফেললে, কাজকর্মে সমস্ত দিন ও সন্ধ্যার পর—১৬/১৭ ঘণ্টা পরে আবার কি সব মনে থাকবে? এমনটি কি তখন বেরুবে?—এই ভাবনা—আর তাড়াতাড়ি কলম চলছে। দিন গেছে, সন্ধ্যা গেছে, রাতও গেল, ২৪ ঘণ্টাতেও কুলোয় না—ঘুমাবার ফুরসত কই? কাজেই ঘুম যেন নিজেই ঘুমিয়ে পড়ত।’
গাড়োয়ানরা ডাকতেই মহারাজ সাড়া দিলেন এবং কাপড়চোপড় পরে ঘরে বাইরে বেরোলেন। মহারাজের পরিধানে গেরুয়া লম্বা আলখাল্লা, মাথায় বড় গেরুয়া পাগড়ি, পায়ে কাশ্মীরি স্যাণ্ডেল—তখন এইরকমই বেশভূষা ছিল মহারাজের।সকালবেলা সকলে মিলে সৈয়দাবাদ পৌঁছালেন। রাস্তার ওপর বিশ-বাইশখানা গাড়ি, গোরু একসঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা অসম্ভব; তাই মহারাজ গাড়োয়ানদের বললেন, “গঙ্গার ধারে গিয়ে গাড়ি খুলে দাও আর গোরুদের খাওয়াও।” এদিকে তিনি নিজে কুমুদবাবু, ওভারসিয়ার প্রমুখদের সঙ্গে নিয়ে কাশিমবাজার মহারাজের কর্মচারীদের কাছে কয়লার মাপ-জোকাদির ব্যবস্থা করতে গেলেন।
সরসীলাল সরকারের ‘অখণ্ডানন্দজীর স্মৃতি’ থেকে